মীরা আমার কাছে মরে গেছে। কিন্তু নামটা পিছু ছাড়ছে না। জীবনের প্রথম একটা টিউশনি জুটল, ছাত্রীর নাম মীরা, তাই টিউশনিটা আর করা হলো না। এমনিতেও আমার দ্বারা টিউশনি হবে বলে মনে হয় না। রাস্তায় মেয়েরা হেঁটে যায়, একজন আরেকজনকে ডাক দেয় মীরা বলে। সেদিন দেখি, ইউনিভার্সিটির পাশে একটা নতুন টি স্টল হয়েছে, নাম মীরা টি স্টল। আজ বিকেলে রং নাম্বারে একটা কল এলো। সেই মেয়ের নামও মীরা। বেচারি মিষ্টিকণ্ঠী মেয়েটা কি না নামের জন্য প্রথমেই ধমক খেল। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম কে সে বলল, আমি মীরা। আসলে দুটো শব্দ শুনে কণ্ঠটা ঠাওর করতে পারিনি। এক্স মীরা ভেবে বকে ফেলেছি। দুনিয়াতে এত মীরা কেন ভাই? নাকি সব মীরা এসে আমার কাছে মরে?
রাফসান শিকদার
১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
বকুল, তুই আসার পর একদিনও এমন হয়নি যে একইদিনে দুবার তোকে লিখতে বসেছি। আজই প্রথম। ঘটনা হয়েছে কী শোন, সন্ধ্যার রং নাম্বারের মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে ইচ্ছে করছে আবার কথা বলি। না মানে মেয়েটার কণ্ঠ অসম্ভব সুন্দর। আমার ধারণা পৃথিবীর সবচেয়ে সুকণ্ঠি বালিকা সে। অন্তত আমি এরচেয়ে সুন্দর কণ্ঠস্বর আগে কখনো শুনিনি। টিজ করছিস কেন তুই? অন্যকিছুই না ভাই। শুধু কণ্ঠ শোনার জন্যই। তুই তো জানিসই মেয়েদের প্রতি আমার সেরকম আগ্রহ নেই। যখন থেকে ছেলে মেয়ে ব্যাপারগুলো বুঝতে শুরু করেছি, তখন থেকেই আমার সবটা জুড়ে ছিল কেবল বেঈমান মীরা। আর কোনো মেয়ে সম্পর্কে কোনো আগ্রহ তৈরি হওয়ার সুযোগই হয়নি। আর ও বেইমানি করার পর থেকে মেয়েদের প্রতি একটা ঘৃণামিশ্রিত ভয় কাজ করে। না হয় আগে-পিছে কম মেয়ে কি ঘোরে? সেজন্যই বলছি, বিশ্বাস কর কেবল ওই কণ্ঠটা শুনতেই আবার ফোন করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু একটা অজুহাত তো দরকার। হুট করেই তো আর ফোন করা যায় না। কী অজুহাত তৈরি করা যায় বল তো?
আচ্ছা শোন, একটা আইডিয়া এসেছে। মেয়েটা বলেছিল ওর ফোন থেকে কে ফোন করেছে ও জানে না তবে খোঁজ নেবে। কী খোঁজ পেল সেই অজুহাতেই তো কল করা যায়। আমাকে কে ফোন করেছিল সেটা আমি জানতে চাইতেই পারি। কী বলিস বকুল?
রাফসান শিকদার
১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
মীরার সঙ্গে কথা হচ্ছে। আমি ওকে বলেছিলাম ওর সুকণ্ঠ শুনবার জন্য মাঝে মাঝে কল করব। কিন্তু এখন আমি প্রতিদিনই কল করি। মীরাও করে। আরে না বকুল, ওই মীরা না। ছোট মীরার কথা বলছি। যা বাবা এই এক নাম যে আমাকে আর কত বিপদে ফেলবে! আচ্ছা শোন, যাতে তোর আর আমার মাঝে কোনো কনফিউশন না হয় সেজন্য একটা কাজ করি। বেইমানটার নাম যে মীরা সে কথা তুই ভুলে যা। ওর ভালো নাম যেহেতু শান্তনা, ওকে আমরা এখন থেকে শান্তনা ডাকব। আর সুকণ্ঠীকে ডাকব মীরা বলে।
দেখ বকুল, তুই কিন্তু প্রচুর টিজ করছিস। আমার কথা বলার একমাত্র জায়গা তুই। তুই এমন করলে কিন্তু মীরার কথা তোকে আর বলবই না।
রাফসান শিকদার
১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
আমাদের প্রচুর কথা হচ্ছে। প্রচুর মানে প্রচুর। এখন তুই টিজ করলেও আমি আপত্তি করব না। না মানে… মনে হয় আমি একটু একটু গলে যাচ্ছি। আমি বোকা মানুষদেরকে পছন্দ করি না। কিন্তু ও বোকা হওয়া সত্ত্বেও ওকে আমার ভালো লাগে। ওর বোকামোগুলো আসলে বুদ্ধিহীনতা নয়। ও সরল তাই বোকা বোকা কথা বলে ফেলে। আর ওর এই সরলতাই আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করছে। কিন্তু একেবারেই অচেনা বলে একটু ভয় হচ্ছে। এই সবকিছু যদি ভান হয়? ভান হলে খুব কষ্ট পাব। আরেকটা খুঁতখুঁতানিও আছে মনে। ও আমার থেকে ৫-৬ বছরের ছোট। পার্থক্যটা কি একটু বেশি হয়ে গেল না? ধুর বকুল, তুই বাবা মায়ের উদাহরণ টানছিস কেন? ওদের হিসাব আলাদা। আমার ভয় হচ্ছে। প্রথমবার দারুণভাবে ঠকার পর আমি কখনো কোনো মেয়েকে আমার জীবনে আসার সুযোগ দিই না। অথচ ওকে বলতে গেলে নিজেই ডেকে এনেছি। রং নাম্বারে কল আসতেই পারে তাই বলে তার সঙ্গে খাতির জমাতে হবে? না দেখে না শুনে না চিনে কীভাবে আমি গলতে শুরু করলাম নিজেও বুঝতে পারছি না। সামনে কি কোনো ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে আমার জন্য?
রাফসান শিকদার
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
আজ সকালে মা জানতে চাইল বাগানে কোনো তরকারি আছে কি না। আমি বললাম আছে কিন্তু এখন থেকে আমার বাগানের তরকারি রান্না করলে কিনে নিতে হবে। মা তো অবাক! কিনতে হবে কেন? আমি বললাম, আমার ইদানীং একটু টাকা-পয়সার দরকার। কোনো বাড়তি আয় তো নেই। তুমি তরকারি কিনলে আমি ফলন বাড়াব। কৃষক হব। একটা আয়ের উৎস হবে। মা আমার কথায় হেসে কুটিকুটি হলেন। হাসতে হাসতে বললেন,
দিন-রাত এত ফোনে কথা বললে টাকা-পয়সার তো দরকার হবেই।
আমিও হেসে দিলাম। মা বললেন, কিন্তু আমার স্বামীর জায়গায় যে ফসল ফলাচ্ছিস। জায়গার ভাড়া দিবি? আমি বললাম,
এটা আমার বাপের জায়গা। ভাড়া কেন দেব?
মা আবার বললেন,
আচ্ছা বুঝলাম কিন্তু সেই তরকারি যখন রান্না হবে সেটাও তো তুই খাবি। তাহলে? আমি বললাম,
তুমি তোমার ছেলেমেয়েকে কী খাওয়াবে সেটা তোমার বিষয়। আমার বাগানেরটা না পেলে তো বাজার থেকে কিনতে তাই না? এত কষ্ট করে ফসল ফলাব তার কোনো দাম পাব না?
মা খুব হাসলেন। তারপর বললেন,
আচ্ছা এখন থেকে সব কিনে নেব। বাজার দরেই কিনব। এবার বল তো মেয়েটা কে?
আমি বললাম,
নিজেও জানি না। রং নাম্বারে পেয়েছি। এখন আর কিছুই বলতে চাই না। সব ঠিকঠাক থাকলে আমি নিজেই তোমাকে জানাব। মা-ও আর চাপাচাপি করলেন না।
বুঝলি বকুল, এখন থেকে আমি আর বেকার না। এখন থেকে আমি একজন গর্বিত কৃষক। আজ মা বাগান থেকে এক হালি টমেটো, এক আঁটি লাউশাক আর কিছু কাঁচামরিচ কিনেছেন। লক্ষ্মী মা আমার-বাজারদরের থেকে একটু বেশিই দিয়েছেন। এক হালি টমেটো শুনে হাসছিস কেন? আমার কাছে তো পাল্লা-বাটখারা নেই। তাই এভাবে মেপেছি। তোর আবার মেয়েদের মতো সবকিছুতেই হাসাহাসি। থাম তো এবার। শোন কাল আরো কিছু সবজি লাগাব। প্রচুর সবজি ফলাতে হবে। কৃষক রাফির বাগান ফলে-ফসলে ভরে যাবে দেখিস। সারারাত কথা বললেও ফোনের টাকা আর ফুরোবে না। কি দারুণ ব্যাপার।
রাফসান শিকদার
১০ অক্টোবর, ২০০৯
আজ ছুটির দিন। বাবা বাজারে গিয়েছিলেন। মা তাকে দিয়ে আমার জন্য একটা উপহার আনিয়েছেন। অনুমান কর তো জিনিসটা কী হতে পারে? আচ্ছা আমি বলছি, পাল্লা আর বাটখারা। যাতে আমি সবজি মাপতে পারি। ভাবা যায়? গতকালই সিদ্ধান্ত হলো যে সবজি বিক্রি করব। মাপার জিনিস নেই বলে হালিতে বিক্রি করলাম। আর আজই মাপার জিনিস রেডি! সাধেই কি আর বলি মা আমার বন্ধু। সত্যিই আমি কত ভাগ্যবান তাই না? আমি জিনিসটা পেয়ে হেসেছি, ধব্যবাদ দিয়েছি কিন্তু বোঝাতে পারিনি কতটা খুশি হয়েছি। বাবা মাকে কতটা ভালোবাসি তাও বোঝাতে পারি না কখনো। নিশ্চয়ই তারা বুঝে নেয়, তাই না? বিশেষ করে মা। মুখ দেখেই কীভাবে যেন সব বুঝে যায়!
রাফসান শিকদার
১১ অক্টোবর, ২০০৯
·
·
·
চলবে....................................................................................