আমি টেবিলে বসে কিছু একটা লিখছিলাম। হঠাৎ মানসী এসে আমার পেছনে দাঁড়াল। আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“এই কিসব হাবিজাবি লিখছো বলো তো।”
“আরে বাবা, হাবিজাবি না। কাজ করছি।”
“ওটা বুঝি আমার থেকেও বেশি মূল্যবান?”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,
“নাহ তোর থেকে মূল্যবান আমার কাছে আর কিছু আছে?”
ও আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল,
“তাহলে এসব রাখো এখন। আমার খুব ঘুম পেয়েছে আর আমি তোমার কোলে ঘুমাব।”
আমি ওসব ওভাবেই রেখে উঠে গেলাম। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“নরম বিছানা রেখে আমার সোনাবউটা আমার শক্ত কোলে ঘুমাবে?”
“হ্যাঁ, ঘুমাবে। কারণ, এই শক্ত কোলটাই আমার স্বর্গ!”
আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। ও ভয় পেয়ে বলল,
“তুমি কি পাগল হলে? আমি কোলে চড়তে চাইনি। তোমার কোলে ঘুমাতে চেয়েছি।”
“আমি কোলে নিতে চেয়েছি, তাই নিলাম।”
“ইশ, আমি এখন কত্ত ভারী হয়ে গিয়েছি। কেন নিলে? প্লিজ আমাকে নামাও। বড্ড ভয় লাগছে।”
আমি ওকে কোল থেকে নামালাম না। ওভাবেই হেঁটে হেঁটে বিছানার কাছে নিয়ে গেলাম। তারপর বিছানায় শুইয়ে দিলাম। ও হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন। বলল,
“তুমি না বড্ড জেদি…ভাল্লাগে না।”
আমি ওর পাশে বসে ওর গালে চুমু খেয়ে বললাম,
“আমার খুব ভালো লাগে।
আমি শুয়ে পড়লাম। তারপর বাচ্চাদের মতো ও আমার কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। তারপর ও আমার হাতটা ওর পেটের ওপর রেখে বলল,
“দেখো আমাদের তুলতুল কত্ত বড় হয়ে গেছে।”
“হুম, এখন যে এত আহ্লাদ করছিস! সামনের মাসেই যখন ও চলে আসবে তখন তো আমার কাছেও আসবি না। ওকে নিয়েই পড়ে থাকবি।”
ও আমার গলা জড়িয়ে ধরে নাকে নাক ঘষে বলল,
“ইশ! কক্ষনো না। ও আমার কোলে থাকবে আর আমি তোমার কোলে থাকব।”
আমি সেই সুযোগে ওর ঠোঁটে চুমু দিলাম। ও বলল,
“এখন ও পেটের ভেতর আছে তাই তোমাকে কিছু বললাম না। যখন ও চলে আসবে তখনও কিছু বলব না। কিন্তু ও একটু বড় হলে এসব অসভ্যতামি চলবে না, বুঝেছ?”
আমি খুব অবাক হওয়ার ভান করলাম,
“অসভ্যতামি! এগুলো অসভ্যতামি নাকি? আরে এই অসভ্যতামিগুলো না করলে ও আসতে পারত নাকি?”
একথা বলতেই ও আমাকে মারতে লাগল,
“ছিঃ তুমি খুব খারাপ…খুব খারাপ।”
মার খেতে খেতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মরার চোখ দিয়ে তো এক ফোঁটা পানি বের হয় না। হঠাৎ করে এমন স্বপ্ন কেন দেখালাম! উফফ অসহ্য!
বিছানা থেকে না উঠেই হাত বাড়িয়ে ওয়ালেটটা নিলাম। ওয়ালেট খুলে তাকিয়ে রইলাম আমার আর মানসীর ছবিটার দিকে। দিতিয়া, আমার বিয়ে হয়েছে তিন মাস হয়ে গেছে। এতদিন ওকে না দেখে আছি। ছবিগুলোই ভরসা। কত ভালো লাগে ওকে আমার সাথে! পৃথিবীর আর কাউকে মানাবে না আমার সাথে, আর কাউকে না।
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকালাম। দিতিয়া ঘরে ঢুকল। আমি ওয়ালেট রেখে উঠে পড়লাম। বারান্দায় গিয়ে টাওয়াল নিয়ে ফ্রেশ হতে যাব এমন সময় দিতিয়া বিছানা গোছাতে গোছাতে বলল,
“জানো, মানসী এসেছে।”
আমি চমকে তাকালাম। বললাম,
“কখন?”
“অনেকক্ষণ।”
মন চাইল এক্ষুনি ছুটে বের হয়ে যাই ওর কাছে। কিন্তু পারলাম না। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে স্বাভাবিকভাবেই বের হলাম। আমার চোখদুটো চারপাশে খুঁজে ফিরছে ওকে। কিন্তু কোথাও দেখলাম না। ব্রেকফাস্ট করতে বসলাম। খাচ্ছি ঠিকই কিন্তু কেমন যেন! মনে হচ্ছে লোহা খাচ্ছি! হজম হবে না!
দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছি, এতক্ষণে সবার খাওয়া শেষ। একাই খাচ্ছিলাম। তবুও অনন্যা এসে পানি ঢেলে দেয়ার ছুতোয় ফিসফিসিয়ে বলল,
“মানসী বাগানে আছে। তোমাকে ডাকছে।”
আমার বুকের ধুকপুকানি আরো বেড়ে গেল। যেন এই প্রথম প্রেমে পড়েছি। কখনো দেখা হয়নি ওর সাথে। আমার সদ্য হওয়া প্রেমিকা আমায় ডাকছে। আমি উঠে পড়লাম,
“আমার খাওয়া হয়ে গেছে।”
—————
বাগানে যেতেই দেখতে পেলাম মানসীকে। চোখে চোখ পড়তেই ওর চোখের ভেতর দিয়ে ওর অস্থিরতাটা দেখে ফেললাম। ও আর মোনা গাছ লাগাচ্ছিল। আমি বললাম,
“মোনা একটু ভেতরে যা তো।”
মোনা চলে গেল। মানসী হাত ধুতে ধুতে বলল,
“অনেক শুকিয়ে গেছ দেখছি।”
“আমি মৃদু হাসলাম। তারপর বললাম,
“এতদিন একবার আসতে তো পারতি।”
“নাহ, পারলে আসতাম। আজ মা নিজেই নিয়ে এল।”
“ওহ। খালামণি কোথায়?”
“মা বোধহয় খালামণির ঘরে।”
“ওহ..”
আমি কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। হাঁ করে চেয়ে থাকলাম শুধু। জানি না কী কারণে ও আমার দিকে তাকাচ্ছেই না। তাকালেও জাস্ট এক সেকেন্ডের জন্য। তারপরই ওর দৃষ্টি এদিক-ওদিক ঘুরছে। অথচ এই আমরাই একসময় কতটা কাছে ছিলাম দুজন দুজনের। ঠিক কিছুক্ষণ আগের স্বপ্নটার মতোই। খুব ইচ্ছে করল ওই অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা ওকে বলতে। কিন্তু সেটাও বলতে পারলাম না। কারণ, আমি ওকে আর কাঁদাতে চাই না। হঠাৎ ও নীরবতা ভেঙে বলল,
“এখন নিশ্চয়ই খালামণির উপরে আর রাগ নেই?”
“না নেই। তুই কার কাছে জানলি?”
“প্রথমে অনন্যা বলেছিল ইউনিভার্সিটিতে। আর খালামণিও আজ সবটা বলে মাফ চাইল।”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। ওই বলল,
“রাগ যখন নেই আর ড্রিংক করো না প্লিজ।”
সব পাচারকারী যে অনন্যা তা বুঝতে সমস্যা হলো না। বললাম,
“যেদিন সব জেনেছি তারপর আর ড্রিংক করিনি তো।”
“ওহ!”
“তোর পাচারকারী এটা বলেনি তোকে?”
ও হেসে দিল। আমি বললাম,
“ভেরি ব্যাড! কিন্তু তোর তো তাও একজন পাচারকারী আছে। আমার তো তাও নেই।”
“কী হবে রেখে?”
আমি কথা বাড়ালাম না। এটা তো কোনো তর্ক করার বিষয় হতে পারে না। ও বলল,
“তুমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছ কেন? পুরুষ মানুষের ক্যারিয়ারটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
“আমার ক্যারিয়ার দিয়ে আর কী হবে?”
“এটা কী ধরনের কথা? জীবনে যা কিছুই ঘটে যাক পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারে তার প্রভাব পড়তে দেয়া যাবে না।
আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। ও কেন এসব বলছে! ও না বুঝলে কে বুঝবে আমাকে? আমি বললাম,
“অন্য কথা থাকলে বল।”
“ভাবির সাথে আজ অনেক কথা হলো। খুব ভালোমানুষ ও।”
বুঝলাম ও কি বলতে চাচ্ছে। তবু বলার জন্যই বললাম,
“ভাবিটা আবার কে?”
“দিতিয়া।”
“ওকে ভাবি বলার কী আছে? নাম ধরে ডাকলেই হয়।”
“কীভাবে হয়? ও আমার চেয়ে অনেক বড়। আমি নাম ধরে ডাকতেই মা বকা দিল। বলল ভাবি বলতে।
“গাটা জ্বলে যায় এদের ঢং দেখলে। বলার হয় ওদের সামনে বলবি। আমার সামনে না।”
“বাদ দাও তো। জানো, ওই আগ বাড়িয়ে কথা বলল। বারবার বলছিল, আমি নাকি অনেক ভাগ্যবতী তাই তোমার অমন ভালোবাসা পেয়েছি। আর আমি বলেছি ও অনেক ভাগ্যবতী তাই ও তোমাকে পেয়েছে!”
একথা শুনে আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। কিন্তু কিছু বললাম না। ও আবার বলল,
“ওকে আমার সব কথা ওভাবে না বললেও পারতে।”
এবার আমার রাগ চরমে উঠল। আমি আর রাগ ধরে রাখতে পারলাম না। বললাম,
“এত জ্ঞান দিচ্ছিস যে? এই গুরুদায়িত্বটা তোকে কে দিল?”
“রেগে যাচ্ছ কেন? চলেই তো যাব। আবার কবে দেখা হবে তাও তো জানি না।”
“দেখা করলেই দেখা হয়। তুই ইচ্ছে করেই দেখা করিস না।”
“কীভাবে যোগাযোগ করব? বাসার টিএনটি লক করা থাকে সবসময়। আর তোমাদের বাসায় আমার আসা নিষেধ ছিল এতদিন। আজ তো মা নিয়ে এল বলে আসতে পারলাম। তাছাড়া কী হবে এখন আর দেখা করে? এখন সম্পর্ক, মায়া এসব না বাড়ানোই ভালো।”
এসব শুনে রাগ সামলানোর জন্যই আমি চুপ করে রইলাম। ও বলল,
“দিতিয়া অনেক ভালো মেয়ে। আমি ওর হাজবেন্ডের এক্স গার্লফ্রেন্ড এক্স ওয়াইফ। তবু সব জেনেশুনে কী ভালো ব্যবহার করল আমার সাথে। কোনো জড়তা ছাড়াই আমার সাথে তোমাকে নিয়ে আলোচনা করল। কি অদ্ভুত লক্ষী মেয়ে!”
“তুই কি ওর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর?”
“ছিঃ কী বলো তুমি এসব?”
“এত গুণগান করছিস তাই বললাম।”
“যা সত্যি তাই বলেছি। অন্য কোনো মেয়ে হলে…”
“আবার সেই…”
আমিও কথা শেষ করলাম না। গটগট করে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে। কারণ, ওর সাথে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। যা হয়েছে তার জন্য ও দায়ী নয়।
·
·
·
চলবে........................................................................