অভিমানিনী - পর্ব ২২ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          মানসীর জন্মদিনের বেশ কিছুদিন পর হসপিটালে অবসর সময় কাটাচ্ছিলাম। ইচ্ছে হলো মানসীকে ফোন করি, খুব মনে পড়ছিল ওকে। ফোন করতেই ওপাশ থেকে মানসীর গলা পাওয়া গেল,

“হ্যালো…”

“কেমন আছিস?”

“তুমি? ফোন করেছ কেন? যদি অন্য কেউ ধরত?”

“তাহলে কি হতো?”

“কী বলতে?”

“কিছুই বলতাম না। ফোন নামিয়ে রাখতাম। আগেও এমন করেছিলাম। কেমন আছিস বললি না তো!”

“ভালো, তুমি কেমন আছ?”

“আমি আছি বোধহয় ভালোই।”

“ওহ, জন্মদিনের উপহারগুলো ভালো ছিল। শাড়িটা তো অসাধারণ ছিল।”

“হুম, আচ্ছা সেদিন ওরকম করলি কেন?”

“কী রকম? তোমার হসপিটালে যেটা করেছি? সরি আসলে ওই দিন পুরোনো জন্মদিনের স্মৃতিগুলো এত মনে পড়ছিল নিজেকে সামলাতে পারিনি।”

“আমি যে সেই ব্যাপারটা বলিনি তা তো খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছিস। ঢঙ করছিস কেন?”

“তাহলে কি ঐ সারপ্রাইজটার কথা বলছ?”

“হ্যাঁ, তবে ওটা আসলে সারপ্রাইজ ছিল না।”

“কেন? সত্যি করে বলো তো দিতিয়াকে ওভাবে দেখে তোমার ভালো লাগেনি?”

“লেগেছে কিন্তু আমি খুব অস্বস্তিবোধ করেছি। আমি ওর মধ্যে তোকে দেখতে পাচ্ছিলাম। এটা অন্যায়। ওর প্রতি এবং তোর প্রতিও।”

“আমার প্রতি তোমার আর কোনো কিছুতে অন্যায় নেই নীরবদা। ওর প্রতি অন্যায় হতে পারে।”

“এভাবে কথা বলছিস কেন?”

“কীভাবে কথা বলছি? যা সত্যি তাই তো বলছি। আচ্ছ বাদ দাও তো, এই বলো না ওকে আদর করেছিলে?”

“এই প্রশ্নের মানে কী?”

“ওহ সরি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেলেছি। থাক বলতে হবে না। আমিও কিসব প্রশ্ন যে করি। ছিঃ কী নির্লজ্জ আমি!”

ওর এ কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। রাগে, দুঃখে, অভিমানে আমি ফেটে পড়ছিলাম। বললাম,

“আমি ২০ মিনিটে আসছি…রাখি।”

“এই শোনো শোনো…”

“কী?”

“আসছি মানে কোথায় আসছ?”

“তোদের বাসায়।”

“মাথা খারাপ?”

“তোর মাথা কতটা খারাপ হয়েছে সেটা দেখতেই যাচ্ছি।”

“আরে প্লিজ এসো না, যা আছে বাসায়।”

“তাতে আমার কিছু যায় আসে না। খালামণিকে আমি ভয় পাই না। তাকে সামনে রেখেও কথা বলতে পারব।”

“আমার ভুল হয়েছে। দুষ্টুমি করে বলেছি ওসব কথা, এত রেগে যেও না প্লিজ।”

“রাখছি, জাস্ট ২০ মিনিট।”

২০ মিনিটও লাগেনি পৌঁছতে। বেল দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ও দরজা খুলতেই আমি ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ওর একটা হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে আমার কাছে এনে বললাম,

“কী বলছিলি তখন?”

ও ভয় পেয়ে বলল,

“সরি।”

“আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে মনে?”

“না।”

“ওকে, আমার চরিত্র খারাপ। আমি সেদিন দিতিয়াকে খুব আদর করেছি। সারারাত ধরে আদর করেছি। ওর সারা শরীরে…”

আমি এটুকু বলতেই মানসী দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরল। আমি ওর কান থেকে জোর করে ওর হাত সরিয়ে বললাম,

“এখন শুনতে খারাপ লাগছে কেন? শুনতেই তো চেয়েছিলি! আরো শোন। কী কী করেছি সব শোন…একদম ডিটেইলে বলব।”

“মাফ করো। আমি ওভাবে বলতে চাইনি।”

আমি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম,

“তুই ওকে ওভাবে প্রেজেন্ট করলি কেন আমার সামনে?”

“আমি ভেবেছিলাম তোমার ভালো লাগবে।”

“ভালো লাগলে কী হবে?”

ও আর কোনো কথা বলল না। আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে সোফায় বসে বললাম, “আমি তো ওকে বিয়ে করতে চাইনি। মা আর তোর জন্যই তো রাজি হতে হয়েছে। আর তুই কী করেছিস? তোকে বলেছিলাম না চল পালিয়ে যাই অনেক দূরে। শুনেছিস তখন আমার কথা? এখন এত কষ্ট পাওয়া কেন?”

ও আমার সামনে বসে বলল,

“সরি। বিশ্বাস করো আমি কোনো কষ্ট পাইনি। তুমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করো, এটা তো ঠিক না। ওর তো কোনো দোষ নেই, তাই আমি চেয়েছিলাম যাতে তোমাদের সম্পর্কটা একটু স্বাভাবিক হয়। তুমি আর ওর সাথে খারাপ ব্যবহার না করো। সেজন্যই আমি ওভাবে সেজেগুজে তোমার কাছে গিয়েছি আর ওকেও ওভাবে প্রেজেন্ট করেছি।”

“আমি কি তোদের হাতের খেলনা? একবার মা খেলে, আরেকবার তুই। আমারও তো ধৈর্যের একটা লিমিটেশন আছে।”

“মাথা ঠাণ্ডা করো প্লিজ।”

“কীভাবে মাথা ঠাণ্ডা করব? তুই যা যা করতি সব শিখিয়ে দিয়ে এসেছিস। তোর মতো করে সাজিয়ে দিয়ে এসেছিস। তুই তো ওকে মানসী বানিয়ে দিয়ে খালাস। ওকে ওভাবে দেখে আমার ওপর দিয়ে কতটা মানসিক চাপ যাবে তা তো ভাবিসনি। আমি তো একটা মানুষ। আমি তো যন্ত্র না।”

মানসী মাথা নিচু করে রইল। কোনো কথা বলল না। হঠাৎ মনে পড়ায় আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,

“আচ্ছা, তুই তখন যে বললি আমি দিতিয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করি। তোকে কে বলেছে একথা?”

ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,

“কই কেউ না। আমি আন্দাজ করেছি।”

“মানসী প্লিজ ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভারস্মার্ট! কে বলেছে বল?”

“কেউ বলেনি।”

“মা, অনন্যা তা না হলে দিতিয়া নিজে।”

“দিতিয়া ওরকম মেয়েই না। ওকে তুমি এখনো চেনোনি।”

“মেয়েমানুষদের না চেনাই ভালো। অনেক বছর পর চেনা মানুষটা যখন অচেনা হয়ে যায় তখন বড্ড কষ্ট হয়।”

তারপর আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর ও একসময় বলল,

“কিছু খাবে? লাঞ্চ করেছ?”

“লাঞ্চ করিনি, আর এখন কিছু খাবও না।”

“একটু খাও। আমি রান্না করেছি।”

“ইচ্ছে করছে না। আর তোকে আমি ভালোবাসি বলেই মা, তুই, দিতিয়া সবাই মিলে তোর নাম করে ব্ল্যাকমেইল করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করবি, তাও তো ঠিক না।

মানসী বলল,

“আমার ওপর রাগ করে থেকো না। আমি শুধু চেয়েছিলাম তোমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে যাক। সারাজীবন যখন একসাথে কাটাতেই হবে তখন এসবের কোনো মানে হয় না।”

“কোন দুঃখে আমি দিতিয়ার সাথে সারাজীবন কাটাব?”

এসব বলো না, তুমি ওর স্বামী। তুমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই। অনেক ছোটবেলায় ওর বাবা-মা মারা গেছে। চাচা-চাচির সংসারে কী অবহেলায় ছিল ভাবতেও পারবে না। ও পড়াশোনায় অনেক ভালো ছিল। পড়তে তো টাকা লাগতই না উল্টো ও স্কলারশিপের টাকা পেত। সেই টাকার লোভে ওকে ওর চাচা পড়াত। কী লোভী ভাবতে পারছ? আর ওর চাচি ওকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করাতো। ঠিকমতো খেতে দিত না। এভাবে বড় হয়েছে দিতিয়া। এখন তুমি যদি ওকে ছেড়ে দাও ও কোথায় যাবে বলো? হ্যাঁ, পড়াশোনা যখন করেছে, চাকরি করে নিজে চলতে পারবে। কিন্তু সারাজীবন কি একা থাকবে? কেউ তো ওকে বিয়েও করবে না। এখনো আমাদের দেশে ডিভোর্সি মেয়েদের খারাপ চোখে দেখা হয়। ওর জীবনটা কি এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে?”

“সবার পরিস্থিতি বোঝার দায় কি তোর আর আমার? নিজের কথা ভাবতে পারিস না?”

“নিজের কথা ভাবার কী আছে? আমার কথা ভাবার জন্য আমার বাবা-মা সবাই আছে। তাছাড়া আমার আর তোমার বিয়ের কথা তো কেউই জানে না। চুপচাপ ডিভোর্সও হয়ে গেছে। আমার বিয়ে হতে কোনো সমস্যাই হবে না। আমার বাবা আমার জন্য তোমার চেয়েও ভালো ছেলে নিয়ে আসতে পারবে।”

কথাটা শুনে বুকটা ছিঁড়ে গেল আমার। বললাম,

“তুই পারবি আমি ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে?”

“কেন পারব না! আমি চাইলেও সারাজীবন তোমার স্মৃতি নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারব না। আমার ফ্যামিলি সেটা হতে দেবে না।”

“তুই এখন কী সহজে কথাগুলো বলছিস! অথচ আমার বিয়ের আগে ঠিক এইখানে দাঁড়িয়েই বলেছিলি, নীরবদা কিছু একটা করো। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।”

“তখন আবেগে বলেছিলাম, আসলে কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচবে না কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারবে না এগুলো প্রেমের সময় মনে হয় কিন্তু আসলে এগুলোর মতো ভিত্তিহীন কথা আর হয় না। কত মানুষ এসব কথা বলার পরও তাদের ভালোবাসার মানুষকে ছাড়াই থাকে, ছাড়াই বাঁচে আজীবন। আমরাও নাহয় তাদের মতোই রইলাম।”

“বাহ, খুব ভালো কথা। সত্যি মেয়েরা সবকিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।”

মানসী সত্যি মানিয়ে নিয়েছিল সব। এত ছিচকাঁদুনে একটা মেয়ে সেদিন এক ফোঁটাও কাঁদেনি। খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন। ওর সাথে আর কথা না বলে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। খুব ইচ্ছে করছিল যাওয়ার আগে একবার ওকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু ধরিনি কারণ, তার আর কোনো মানে হয় না। বাসা থেকে বের হতেই রাস্তায় খালামণির সাথে দেখা হলো। আমি রাগের চোটে ভুলেই গিয়েছিলাম আসার আগে মানসী বলেছিল খালামণি বাসায়। তার মানে মানসী মিথ্যে বলেছিল যাতে আমি না আসি! মানুষ কত বদলে যেতে পারে! খালামণি আমাকে দেখেই বলল,

“নীরব তুই এ সময়ে?”

“এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। খুব ক্ষিদে পেয়েছিল তাই।”

“ওহ, খেয়েছিস তো পেট ভরে?”

“হ্যাঁ, খালামণি খেয়েছি।”

“আচ্ছা আসিস আবার।”

সাথে সাথেই বাসায় এলাম। কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। এসেই শুয়ে পড়লাম। বিকেল বেলা দিতিয়া আমাকে বাসায় আসতে দেখে বলল,

“আজ এত তাড়াতাড়ি? শরীর খারাপ করেনি তো?”

“না।”

“তাহলে এত তাড়াতাড়ি তো তুমি কক্ষনো আসো না। কী হয়েছে?”

“কিছু না।”

“ওহ। খেয়েছ দুপুরে?”

আমি উঠে বসে চিৎকার করে বললাম,

“বিয়ের সময় কি আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব?”

দিতিয়া অবাক হয়ে চেয়ে রইল। কোনো কথা বলল না। আমি বললাম,

“অধিকার ফলাতে আসছ? টেক কেয়ার করা হচ্ছে? খবরদার বলে দিচ্ছি আমার কোনো ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না।”

ও কোনো কথা বলল না। দৃষ্টি নামিয়ে নিল : আমি বললাম,

“আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।”

—————

এই পর্যন্ত পড়তেই হঠাৎ শুনতে পেল,

“অদ্রি অর্পি, কী করছিস তোরা এখানে?”

ওরা ডায়েরিটাতে এতই ডুবে গিয়েছিল যে টেরই পায়নি দিতিয়া কখন এসে দাঁড়িয়েছে লাইব্রেরির দরজায়!
·
·
·
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp