অপরাহ্নের নিষিদ্ধ অনুভূতি - পর্ব ২০ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


          সুনসান নীরবতায় মোড়ানো শেষ রাতের পরিবেশে। ভোর পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিট। তন্ময়ী দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরোনো বাগান বাড়ির পিছনে। ওর হসপিটালে যাওয়ার কথা থাকলেও রাস্তা পরিবর্তন করে এদিকে এসেছে। সুবিশাল লোহার গেট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছে। বাইকটা গেইটের ওপাশেই আছে। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্ট গুলো নিয়ন আলোয় মৃদু জ্বলছে। কিন্তু পিছন দিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘন অরণ্যে চারপাশ আচ্ছাদিত যার দরুন চন্দ্রের মিঠা আলো প্রবেশের সুযোগ ও নেই। তাছাড়া অদ্ভুতভাবে চন্দ্রিমা ঢাকা পড়ে আছে একগুচ্ছ কালো কাদম্বিনীর আড়ালে। এখানে আসার আগ অবধি সবটা ঠিকই ছিল। তন্ময়ীর হাতে জ্বলছে ফোনের টর্চটা। 

আসার সময় গাছ বেয়ে বেড়ে ওঠা কাঁটাযুক্ত লতাতে অসাবধানতাবশত ডান হাতটা অনেকখানি কে টে গেছে। র ক্ত ঝরছে, যন্ত্রণায় পিষ্ট হাতটা। হয়তো বিষাক্ত কোনো গাছ হবে। তবে সেটা দাঁতে দাঁত চেপে দিব্যি সয়ে নিচ্ছে মেয়েটা। সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ রাতেই এই দিকের সবটা ঘুরে ঘুরে দেখবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সামনে এগোতে নিলেই উপর থেকে শব্দ তুলে কিছু একটা পড়ল ওর সামনে। চমকে উঠল। তাকাল উপরের দিকে। বাগানবাড়ির ছাদের একাংশ দৃশ্যমান।‌ পরপরই দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। থমকাল হৃৎস্পন্দন। চক্ষু জোড়া কপালে উঠে গেছে ইতোমধ্যে। তা অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। আধ খাওয়া ক্ষতবিক্ষত একটা লা শ সম্মুখে পড়ে আছে। লাশটা উপর থেকে পড়ার সময় কয়েক ফোঁটা র ক্ত তন্ময়ীর অজান্তেই ক্ষত স্থানে পড়েছে। সেকেন্ডের ব্যবধানে তা যেন ক্ষতস্থানের যন্ত্রণা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলো। মস্তিষ্ক লা শ টা নিয়ে ভাবার ফুরসৎ পেল না। তীব্র যন্ত্রণায় দিশেহারা হয়ে হাতে থাকা ফোনটা ফেলে দিয়ে অপর হাতের সাহায্যে ডান হাতটা চেপে ধরল। এই যন্ত্রনা কমার নয়। তড়িৎ গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে প্রতিটা শিরা, উপশিরায়। আশ্চর্যজনকভাবে ক্ষতস্থানের চামড়া ফেটে রক্তের স্রোতের দ্বারা একটা 'স্কোরপিয়ান' এর প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হলো। তন্ময়ী বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ! হঠাৎ করেই যন্ত্রণাটা বুক সহ মস্তিষ্কে চাপ ধরতেই তন্ময়ী ডান হাতটা ছুঁড়ে বিকট শব্দে চিৎকার দিয়ে উঠল। মুহুর্তেই হাত থেকে একটা লালাভ রশ্মি নির্গত হয়ে সামনের সবটা লন্ডভন্ড করে দিলো। সুউচ্চ গাছগুলো উল্টে পড়ল অদৃশ্য এক বজ্রাঘাতে। 

কিছু মিনিটের ব্যবধানে ক্লান্ত হয়ে ওখানেই বসে পড়ল তন্ময়ী। বিস্ফোরক দৃষ্টি নিবিষ্ট সামনের জঙ্গলের দিকে। যেটা কিছুক্ষণ আগেও সবুজে মোড়ানো ছিল। কী সুন্দর গাছগুলো সারি সারি বিন্যস্ত ছিল! কিন্তু এখন সেগুলো সব শেষ। একবার নিজের হাতের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার জঙ্গলের দিকে। কী হলো এটা? কেন হলো? চারপাশ হাতড়ে উত্তর মিলল না। ওর মাঝে কি তবে আরও একটা সত্ত্বা আছে? কিন্তু কে সে? তবে কি ওর ধারণাই সঠিক? এই পর্যায়ে রাগে দুঃখে দুহাতে চুল খামচে চিৎকার দিয়ে উঠল। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে এইবার আগের মতো কিছুই হলো না। কিছুক্ষণ নীরবে ঠাঁয় বসে রইল। মৃত্তিকা হাতড়িয়ে ফোনটা খোঁজার চেষ্টা করল। পেয়েও গেল। পড়ে যাওয়াতে টর্চ অফ হয়ে গেছে। ওটা অন করতে নিবে তৎক্ষণাৎ পিছন থেকে ভেসে এলো পরিচিত একটা শীতল পুরুষালী কণ্ঠস্বর,

"কতটুকু রহস্য ভেদ করতে সক্ষম হলে মিস তন্ময়ী?"

তন্ময়ী ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। দেখল ফোনের টর্চ অন করে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা অস্পষ্ট। তবে তন্ময়ীর চিনতে সময় লাগেনি। এটা ডুবইস রৌহিশ রৌনক। বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কে উঠে দাঁড়াল তন্ময়ী। এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখল। কিন্তু এতগুলো সাক্ষাৎতেও অপরপক্ষের আঁখি দুটো দেখার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি মেয়েটার। ওই দুর্ভেদ্য সানগ্লাস অবধি দৃষ্টি আটকিয়ে থাকে। তার ওপারে যেতে সক্ষম হয় না। রৌহিশ আসাতেই যেন আশেপাশের দম বন্ধকর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে ঠিক আগের মতোই। তন্ময়ীর অসহনীয় শরীর বিষিয়ে তোলা পীড়া থেমেছে। মন, মস্তিষ্ক এখন শান্ত। চারপাশে বয়ে চলেছে ঝিরিঝিরি মারুত। প্রকৃতি জুড়ে রাজত্ব করছে সতেজ এক ছায়া। তন্ময়ী নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছে ততক্ষণে। জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

"আপনি এখানে কীভাবে আসলেন?"

"আমার এরিয়াতে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন করা বোকামি মিস তন্ময়ী।"

তন্ময়ী চুপ রইল কিয়ৎসময়। কিছু একটা ভাবল। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েও ফেলল। তাচ্ছিল্য হাসল, "আমি এখানে আপনি কীভাবে জানলেন?"

"রৌহিশ রৌনকের সাথে যুক্ত হওয়ার আগেই তার সবকিছুতে ধ্বংসলীলা চালানো শুরু? ইটস নট ফেয়ার মিস তন্ময়ী।"

তন্ময়ীর করা প্রশ্ন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল রৌহিশ। ওর এমন কথায় তন্ময়ী ঘাড়টা ঈষৎ বাঁকিয়ে অরণ্যের একাংশের সেই ধ্বংস দেখল। পরক্ষণেই আমতা আমতা করল, "আমি নিরুপায়।"

"তাহলে উপায় খুঁজে বের করো।"

এমন কথায় তন্ময়ী কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। প্রত্যুত্তর করল না। কিয়ৎসময় নীরব চাহনিতে রৌহিশকে পর্যবেক্ষণ করল। অতঃপর পায়ের পাতায় চাপ প্রয়োগ করে একটু উঁচু হয়ে রৌহিশের কান বরাবর অধর এগিয়ে আস্তে করে বলল, 

"হার্ট অব ডার্কনেস, মাইন্ড অব আ ভিলেন।"

মুখের কথা শেষ করে সরে আসতে চাইল কিন্তু সক্ষম হলো না। আটকে গেল হাতের বেষ্টনীতে। দুটো শরীরের মাঝে আধা ইঞ্চি ব্যবধান। এক খন্ড বরফের ন্যায় হীম শীতল স্পর্শ তন্ময়ীর প্রতিটা শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হলো। বিদ্যুতের ন্যায় একটা ঝাঁকুনি খেয়ে গেল শরীর জুড়ে। শিরশির করে উঠল সম্পূর্ণ কায়া। ভাবুক হলো তন্ময়ী। ভ্রু জোড়া গুটিয়ে এলো। কপালে ভাঁজ পড়ল। একজন মানুষের শরীরের তাপমাত্রা এতোটা নিচে কখনোই নামতে পারে না। অসম্ভব ব্যাপার এটা। কী যেন ভাবল মেয়েটা। ওষ্ঠপুট অল্পস্বল্প প্রসারিত হলো। পরক্ষণেই কোমর থেকে শক্ত হাতটা সরাতে চাইলে ব্যর্থ হলো ও। বুকে ধাক্কা দিতে নিয়েও থামল। মূলত বুকটা স্পর্শ করতে চাইল না তন্ময়ী। রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করল রৌহিশের দিকে। এইসবে নির্বিকার ছেলেটা। আস্তে ধীরে তন্ময়ীর অধর বরাবর অধর এগোলো। সেদিকে চেয়েই অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল মেয়েটার কায়া জুড়ে। চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে নিলো। অধর থেকে একটু দূরে মুখটা থামাল রৌহিশ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আনন জুড়ে ভাসমান হলো। শব্দ করে তাচ্ছিল্য হেসে কান বরাবর মুখটা নিলো। কানের লতি ছুঁই ছুঁই করে ঠোঁটটা অবস্থান করছে। নাসারন্ধ্র নিঃসৃত ঠান্ডা বাতাস তন্ময়ীর কাঁধ জুড়ে ধেউ খেলে যাচ্ছে। ভীষণ অস্বস্তি সাথে অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে মেয়েটার। সম্পূর্ণ নব্য অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো আজ। তৎক্ষণাৎ শুনতে পেল সায়রের ন্যায় গম্ভীর শীতল পুরুষালী কণ্ঠস্বর,

"ইন আ ওয়ার্ল্ড অব হিরোস আই রিলাইস বিইং দ্য ভিলেন। অ্যান্ড নট ইউর টিপিক্যাল ফেইরিটেল ভিলেন। সো, ফেয়ার মি মিস তন্ময়ী। আ'ম দ্য ভিলেন অব মাই ওউন স্টোরি।"

তন্ময়ীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। কাপ ধরলো শরীরে। কণ্ঠের শীতলতায় শরীরের প্রতিটা লোমকূপ খাঁড়া হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। মেয়েটা ভয় পেল তবে প্রকাশ করল না। রৌহিশ ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে ওকে। দুজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। শাণিত দৃষ্টি একে অপরে নিবিষ্ট। দুই পক্ষেরই ওষ্ঠপুটে খেলা করছে কপট হাসি। এ যেন নতুন কিছুর পূর্বাভাস। আগামী সূর্যদ্বয় গুলো হয়তোবা নতুন কিছু বয়ে আনবে। যা সকলের জন্য হয়তো মঙ্গলজনক নয়তো ধ্বংসাত্মক খেলায় নিজেদের খোয়াতে হবে।

—————

ঘড়ির কাঁটার দখলদারিত্ব ছয়টার ঘরে। নব দিনের সূচনা। ঘন অরণ্যের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটা কাঠের তৈরি কুঠির। মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে অবস্থান। এমনকি ওঠার জন্য কোনো সিঁড়িও নেই। কেবল আছে একটা দরজা, নেই কোনো খিড়কি। কুঠিরের সামনে দিয়ে বয়ে গেছে একটা নদী। শোনা যাচ্ছে পানির কলকল ধ্বনি। বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে একটা মৃদু আর্তনাদ ভেসে আসছে। কেউ অস্ফুট স্বরে বারবার পানি চাইছে। কিন্তু মুখটা বাঁধা থাকায় তা গোঙানির আওয়াজে রুপান্তরিত হয়েছে। আফসোস আশেপাশে অর্ধমৃত প্রাণটা ব্যতীত আর কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। আছে শুধু বহু প্রজাতির বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব। কাঠের ফাঁকফোকর দিয়ে প্রবেশ করা হিম শীতল হাওয়ায় ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে শীর্ণ আঘাতপ্রাপ্ত দেহ খানা। শক্ত কিছুর আঘাতে শরীরের বেশিরভাগ জায়গা ক্ষতবিক্ষত। র ক্ত জমে নীল হয়ে ফুলে আছে। নেত্র যুগল ও বাঁধা। যার কারণে নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবগত নয়।

অর্ধচেতন মস্তিষ্ক যখন এগুলো উপলব্ধি করতে ব্যস্ত তৎক্ষণাৎ শ্রবণেন্দ্রিয়ে ঝংকার তুলল কিছু বন্য পশুর হুংকার। এই আওয়াজ টিভিতে শুনেছে। বড্ড পরিচিত। ওর ফেভারিট বিভিন্ন ভ্যাম্পায়ার মুভি সহ অনেক জায়গায় শুনেছে আরকি। এটা নেকড়ের হুংকার। কিন্তু তার সাথে আরও একটা শব্দ কর্ণে ভাসমান হচ্ছে। এটাও পরিচিত। এই গর্জন ভ্যাম্পায়ারের। শব্দগুলো ক্রমশ প্রকট হয়ে চলেছে। যেন যুদ্ধ চলছে দুই পক্ষের। কিছু সময়ের ব্যবধানে শব্দগুলো থেমে গেল। পরপরই ক্লান্ত মস্তিষ্ক জানান দিলো দরজাটা কেউ একজন ভাঙার চেষ্টা করছে। হলোও তাই। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ধুপধাপ শব্দ তুলে দরজার প্রতিটা কাঠ ভেঙে পড়ল ফ্লোরে। কিন্তু তারপর? তারপর আর কিছু শোনার অবস্থায় রইল না। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। ধরিত্রী অন্ধকারের অতলে হারিয়ে গেল। ধ্যান জ্ঞান শূন্য হয়ে ওখানেই পড়ে রইল জীর্ণ শীর্ণ শরীর খানা।

ভেতরে প্রবেশ করল একটা ছায়ামূর্তি। সাথে হুড়মুড়িয়ে ঢুকল সকালের নির্মল বাতাস এবং দিনের আবছা আলো। অদূরে নিস্তেজ শরীরে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পড়ে থাকতে দেখে আঁখি জোড়া ছলছল করে উঠল ছায়ামূর্তির। ছুটে গেল সেদিকে। শরীরের প্রতিটা ক্ষততে আলতো করে আঙ্গুল ছুঁয়ে দিলো। কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে। বক্ষপিঞ্জিরার বাম পাশে ভীষণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বুকের মাঝে ছোট্ট দেখখানা জড়িয়ে ধরে অস্ফুট স্বরে আওড়াল,

"আমার প্রাণ, আমার শ্যামস্নিগ্ধা। ছাড়ব না ওদের আমি। খুব কষ্ট দিয়েছে তোমায় তাই না? প্রতিটা সেকেন্ড মৃ ত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করবে বাস্টার্ড গুলো। আমায় ক্ষমা করো। আমি তোমায় রক্ষা করতে পারিনি। আ'ম সরি পিচ্চি। নেক্সট টাইম নিজের সবটুকু দিয়ে তোমার খেয়াল রাখব।"
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp