ফানুস - পর্ব ১৫ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          স্মরণ প্রায়ই অফিস ছুটির পর লিফট দিতে চায়, যেটা পেট্রার পছন্দ না। শুধু বন্ধু হিসেবে থাকলে একটা কথা ছিল, কিন্তু তা তো নয়। ওকে সরাসরি না করে দেওয়ার পরও ও বিয়ে করতে চায়। বাসায় প্রপোজাল নিয়ে যেতে চায়! এসব আবার কেমন আবদার? একে তো বয়সে ছোট, তার ওপর মুসলিম। বিয়ে হলে উভয় পরিবারের লোকের কাছেই কথা শুনতে হবে ওকে। সবাই বাঁকা চোখে ওর দিকেই তাকাবে, স্মরণের দিকে না। হ্যাঁ, এসব প্রিয়র সঙ্গে বিয়ের পরও হয়েছে। তখন গায়ে লাগে নি। কারণ, প্রিয়কে সে ভালোবাসে। স্মরণকে তো সে ভালোবাসে না, তাহলে কেন সে এসব সহ্য করবে?

অনেকটা স্মরণকে অ্যাভয়েড করার জন্যই ইদানীং পেট্রা চেষ্টা করে একটু আগে বের হতে। অন্তত স্মরণের আগে।

আজ অফিস থেকে বেরিয়ে পেট্রা দেখতে পেল স্মরণ নয়, প্রিয় গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে প্রিয়কে দেখে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠেছে পেট্রার ঠোঁটে। দেখেও না দেখার ভান করতে পারল না। পারল না এড়িয়ে যেতেও। ওই হাসি যে আজও বুকের ভেতর তোলপাড় করে ফেলতে পারে। পেট্রা এগিয়ে গিয়ে মুখটা স্বাভাবিক রেখেই বলল, না বলে এভাবে আসার মানে কী?

প্রিয় হেসে বলল, ‘বলে এলে তো দেখা করতি না।’

পেট্রা চুপ করে তাকিয়ে রইল প্রিয়র দিকে। ঠোঁটে হাসি। প্রিয় বলল, ‘কিন্তু পেট্রা, তুই গোয়েন্দাগিরি কবে থেকে শুরু করলি, বল তো?

পেট্রা অবাক হয়ে বলল, ‘কী করেছি?

‘এই যে গোয়েন্দাগিরি করে বের করেছিস আজ আমি আসব, তাই তো শাড়ি পরে এসেছিস, যাতে দেখেই আমি গরম হয়ে যাই।’

‘অসভ্য কোথাকার! যত্ত আজেবাজে কথা। ভালো কথা বলতে পারিস না?

প্রিয় হেসে বলল, আচ্ছা যা, বলছি। প্লিজ, আজ আমাকে কয়েকটা ঘণ্টা সময় দে।’

‘কেন? কী করবি?

‘তেমন কিছু নয়, শুধু একটা লংড্রাইভে যাব। সেই ক্রিসমাসে দেখা হয়েছিল। মিস করছিলাম খুব। প্লিজ, ফিরিয়ে দিস না। কন্টিনিউয়াসলি তো আর দেখা করছি না।’

পেট্রার ইচ্ছা করছিল যেতে, কিন্তু কাজটা কি ঠিক হবে? মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বলল, ‘দেখা তো হলোই। এখন চলে যা।

‘প্লিজ, পেট্রা। ক্রিসমাসে শুদ্ধর সাথে দেখা তো করিয়েছি। এখনো কেন রেগে আছিস আমার ওপর?

‘আমি রেগে নেই। কিন্তু এখন এভাবে আমাদের দেখা করা, ডেটে যাওয়া ঠিক না প্রিয়।

প্রিয় চুপ। পেট্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রিয় পেট্রার হাতটা ধরে বলল, ‘কী ভাবছিস?

পেট্রা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা চল।

প্রিয় বিশ্বজয়ের হাসি নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ধরল। পেট্রা উঠল।

—————

নিকিতা শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়ের বিয়েতে বসুন্ধরা কনভেনশন হলে এসেছিল। সঙ্গে শুদ্ধও আছে, শ্বশুর সাহেব ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেন নি। নিকিতা শ্বশুরের গাড়িতে করে এসেছিল। প্রোগ্রাম শেষ করে গাড়িতে উঠতেই শুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়ল। নিকিতা তাকে শুইয়ে দিয়ে জানালায় চোখ রেখে বাইরেটা দেখছিল। হঠাত্র চোখ আটকে গেল পাশ কেটে এগিয়ে যাওয়া গাড়িটায়। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, হাশেম ভাই, এটা প্রিয়র গাড়ি না?

ড্রাইভার হাশেম আলী আমতা আমতা করতেই নিকিতা গাড়ির নম্বরটা দেখে ফেলল এবং নিশ্চিত হলো, এটা প্রিয়র গাড়ি। বলল, এ সময় ওর জিমে থাকার কথা। এখানে কী করছে? ওকে ফলো করেন, হাশেম ভাই।’

হাশেম আলী গত দশ বছর ধরে প্রিয়র বাবার গাড়ির ড্রাইভারের চাকরি করছে। কোনো কিছুই তার অজানা নয়। প্রিয়র সঙ্গে যে পেট্রা আছে, তা সে আগেই দেখেছে। সে চাচ্ছিল না কোনো গ্যাঞ্জাম হোক। তাই বলল, ‘কিছু মনে কইরেন না ভাবি, ছোটভাই তো পোলাপান না। আসছে হয়তো কোনো কাজে। কাউরে পেছন থিকা ফলো করা ঠিক না।

‘আপনি আমাকে ঠিক-বেঠিক শেখাচ্ছেন? আপনার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি।’

‘মাফ করবেন ভাবি, ছোটভাই জানলে খুব রাগ করব।

‘আপনি যদি না যান, আমি শুদ্ধকে গাড়িতে ফেলে রেখে সিএনজি করে প্রিয়কে ফলো করব। আর আপনার এই চাকরিও থাকবে না। মনে রাখবেন, আপনার ছোটভাই কিন্তু আপনার চাকরি বাঁচাতে পারবে না। কারণ, আপনি ওর কর্মচারী না। আপনি আমার শ্বশুরের কর্মচারী।

‘ভাবি, চাকরি গেলে যাইব, আমি বেইমানি করতে পারুম না।’

নিকিতা এতটাই ডেসপারেট হয়ে গেল, সত্যি সত্যি শুদ্ধকে গাড়িতে রেখে নেমে গেল। ড্রাইভার কী করবে, বুঝতে পারছিল না। মোবাইল বের করে প্রিয়কে ফোন করল কিন্তু প্রিয় ফোন ধরছে না। কী কেলেঙ্কারি হবে কে জানে! ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল হাশেম আলীর।

নিকিতা নেমে একটাও সিএনজি পাচ্ছিল না। সব সিএনজিওয়ালা কি মরেছে আজ? নিকিতা দ্রুত পা ফেলে হাঁটছে। ততক্ষণে প্রিয়র গাড়ি অনেক দূর চলে গেছে। এরমধ্যে একটা সিএনজি পেয়ে গেল নিকিতা। রাস্তা ফাঁকা থাকায় দূর থেকে নজর রাখতে নিকিতার অসুবিধা হচ্ছে না। প্রিয়র গাড়ি বসুন্ধরা কনভেনশন হল পার হয়ে ৩০০ ফিট রাস্তার কোনো এক জায়গায় থামল, কিন্তু প্রিয় নামল না। জায়গাটা প্রচণ্ড নিরিবিলি ও অন্ধকার। নিকিতার কান্না পাচ্ছিল। প্রিয় এমন একটা জায়গায় কেন গাড়ি থামাল?

নিকিতা যখন কাছাকাছি গেল, ঠিক তখনই উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ি তার হেডলাইটগুলো জ্বালিয়ে আসতে লাগল। সেই লাইটের আলোয় নিকিতা দেখতে পেল, প্রিয় একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। মেয়েটা যে পেট্রা ছাড়া আর কেউ নয়, তা বুঝতে কষ্ট হলো না নিকিতার। তার সমস্ত শরীরে আগুন জ্বলে উঠল। প্রিয় এবং প্রিয়র বাবা দুজনেই ওকে বলছে প্রিয় আর পেট্রার এখন কোনো যোগাযোগ নেই। যোগাযোগ না থাকার এই নমুনা? সবাই মিলে এই রকম মিথ্যাচার করেছে তার সাথে? সে গরিবের মেয়ে বলে, নাকি অসহায় বলে? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে নিকিতা কাঁদতে শুরু করেছে সে নিজেও জানে না। একটু পেছনে থাকতেই সিএনজি ছেড়ে দিল, তারপর এগিয়ে গেল প্রিয়র গাড়ির দিকে। আজ হাতেনাতে ধরবে প্রিয়কে। সব মিথ্যাচারের শেষ দেখে ছাড়বে। আর ওই অসভ্য মেয়েটাকেও দেখে নেবে।
·
·
·
চলবে................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp