ফানুস - পর্ব ০১ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          অ্যালার্ম বাজছে। লেপের ভেতর থেকে হাত বের করে অ্যালার্ম বন্ধ করেই যত দ্রুত সম্ভব হাতটা আবার ভেতরে ঢুকিয়ে নিল প্রিয়। যদিও অ্যালার্মের ক্যারক্যারে শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে, তবু এমন শীতের সকালে আয়েশি বিছানা রেখে উঠতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু অফিস নামক বিভীষিকার জন্য উঠতেই হয়।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছিল প্রিয়। শুদ্ধ পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাবা, আই নিড সাম প্যাস্টেল কালার।’

প্রিয় বলল, ‘সেদিন না নিকিতাকে বলেছিলাম কিনে দিতে? দেয় নি?

‘না। কাল আমার আর্ট এক্সাম। পুরো বক্সটাই তো হারিয়ে ফেলেছি আজ যদি না কেনা হয়, এক্সাম কীভাবে দেব?

‘ঠিক আছে, আজ আমি তোকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছি। যা যা লাগে, কিনে দিচ্ছি।

‘আর কিছু লাগবে না, বাবা। কিন্তু আমাকে স্কুলে দিতে গেলে তোমার অফিসে দেরি হয়ে যাবে তো!

‘একদিন দেরি হলে কিছু হবে না বাবু। ম্যানেজ করে নেব।’

‘ওকে বাবা।

এমন সময় নিকিতা ঘরে ঢুকে বলল, ‘এই, তোমরা খেতে এসো। ব্রেকফাস্ট রেডি।

প্রিয় বলল, ‘শুদ্ধ, তুই গিয়ে দাদার সাথে খেতে বস, আমরা আসছি।’

শুদ্ধ বেরিয়ে গেল। নিকিতা বলল, কিছু বলবে?

প্রিয় ঘড়ি পরতে পরতে বলল, তুমি শুদ্ধকে কালার কিনে দাও নি কেন? টাকাটা কি তোমার বাপের বাড়ি থেকে আসে? টাকাটা তো আসে আমার পকেট থেকে।

‘কেন দিই নি, সেটা আগে শুনে তারপর না হয় বাপের বাড়ির খোটাটা দিতে!

‘কেন, বাপের বাড়ির কথা বলায় গায়ে ফোঁসকা পড়ল?

‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘ভুলে গিয়েছিলাম মানে? ছেলের ব্যাপারে এত বেখেয়ালি কেন তুমি? যে কাজটা ঠিকভাবে করতে পারবে না, তার দায়িত্ব কেন নেবে? তোমার আর শুদ্ধকে স্কুলে দিতে যেতে হবে না। আমি অফিসে যাওয়ার সময় দিয়ে যাব। স্কুলবাসের জন্য কথা বলছি। ওরা বাসায় দিয়ে যাবে।

নিকিতা একটু ধমকের সুরেই বলল, এমন কথা কেন বলছ? একদিন একটা ভুল হয়েছে মানে যে প্রতিদিন হবে, তা তো না।’

‘একটা ভুল? একটা? ছেলের ব্যাপারে তোমার গাফিলতির শেষ নেই। ধমক তোমার বাপেরে গিয়ে দাও।’

এ কথা বলে প্রিয় ডাইনিংয়ে গিয়ে খেতে বসল। নিকিতার চোখে জল এসে গেল। কিন্তু সে কাঁদল না।

—————

পেট্রা অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। শিখা তখন ঘরে ঢুকে বললেন, ‘পেট্রা, তোর কি আজ অফিসে না গেলে হয় না?

পেট্রা চোখে কাজল দিতে দিতে বলল, না মা। তুমি যদি আমাকে আগে বলে রাখতে, তাহলে আমি ছুটি নিয়ে রাখতাম।’

‘আগে কীভাবে বলব? ওরা তো গতকাল জানাল যে আজ আসবে।

‘ঠিকাছে, তুমি আটটায় আসতে বলে। আমি এর মধ্যে চলে আসব।’

‘সারা দিন খেটেখুটে আসবি, ফকিন্নির মতো লাগবে তখন।

‘লাগলে লাগবে, কিছু করার নেই আমার।

এ কথা বলতে বলতে পেট্রা কুর্তির ওপর জ্যাকেটটা গায়ে দিয়ে ব্যাগটা তুলে বেরিয়ে পড়ল। শিখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তার চেহারায় চিন্তার ছাপ।

—————

বাবর খান এই নিয়ে পরপর দুবার মন্ত্রিত্ব পেলেন। দুই পুরুষ ধরে এ বাড়িতে বংশীয় রাজনীতি চলছে। বাবর খানের পিতাও প্রথমে এমপি ও পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। বাবর খানের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। কিন্তু এই বংশীয় রাজনীতির সমাপ্তি এখানেই। তার বড় পুত্র সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। একই দুর্ঘটনায় তিনি স্ত্রীকেও হারিয়েছেন। ছোটপুত্র প্রিয় হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার। রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ নেই। অল্প বয়স থেকে পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক থাকায় তিনিও ছেলেকে রাজনীতিতে আসতে জোর করেন নি।

প্রিয়র জন্য নাশতার টেবিলে অপেক্ষা করছিলেন বাবর খান। কিন্তু প্রিয় এসে তার সঙ্গে কথা না বলেই নাশতা খাওয়া শুরু করে দিল। অবশ্য তিনি কথা না বললে প্রিয় কখনোই আগ বাড়িয়ে কথা বলে না। ব্যাপারটা সূক্ষ্ম একটা ব্যথা তোলে তার হৃদয়ে। তাই প্রিয়কে দেখামাত্র তিনি আগে কথা বলে নিজেকে এই ভেবে সান্তনা দেন যে, তিনি আগে কথা বলেন, তাই প্রিয় বলার সুযোগ পায় না।

বাবর খান বললেন, ‘গুড মর্নিং প্রিয়।

প্রিয় বাবার দিকে না তাকিয়ে বলল, গুড মর্নিং।

বাবর খান উৎসুক হয়ে বললেন, ‘আমাকে কংগ্রাচুলেট করবে না?

প্রিয় হেসে বলল, ওহ, তুমি তো আবার মন্ত্রী হয়েছে? কগ্রাচুলেশনস।

‘ধন্যবাদ প্রিয়। এবার আমার অনুরোধটা রাখো, এলজিইডির নিয়োগ পরীক্ষায় বসো শুধু। বাকি সব ব্যবস্থা আমি করে দেব।’

শুদ্ধর খাওয়া শেষ। সে বাবার জন্য বসে রয়েছে। কিন্তু শুদ্ধকে আর এখানে থাকতে দেওয়া যাবে না। প্রিয় বলল, ‘শুদ্ধ, ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি আসছি। শুদ্ধ চলে গেলে বাবর খান বললেন, ‘আমি কিছু বলছি প্রিয়।

প্রিয় না তাকিয়ে বলল, ‘তোমার সাহায্যের আমার কোনো দরকার নেই। বেসরকারি হলেও আমি নিজের যোগ্যতায় অনেক ভালো চাকরি করি।’

‘তা করো, কিন্তু সরকারিতে যে সুবিধা পাবে তা বেসরকারিতে পাবে না। নিজের কথা না ভাবলেও এখন স্ত্রী-সন্তান আছে, তাদের কথা ভাবো। তাদের একটা ভবিষ্যৎ আছে না?

‘আমি আমার স্ত্রী-সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে যথেষ্ট সক্ষম, এটা তুমি নিজেও জানো।

প্রিয়র নাশতা পুরোপুরি শেষ হয় নি। কিন্তু সে বাবর খানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

পেট্রা অফিসের ক্যানটিনে বসে লাঞ্চ করছিল। স্মরণ পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বসতে পারি?

—————

পেট্রা তাকাল। কালো রঙের স্যুট পরা সুদর্শন স্মরণ আহমেদ হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। পেট্রা হেসে বলল, ‘শিওর স্যার।

স্মরণ বসতে বসতে বলল, আপনাকে অসংখ্যবার বলেছি আমাকে স্যার বলবেন না।

‘সিনিয়রদের তো স্যারই বলতে হয়। এটাই নিয়ম।

‘আমাকে বলবেন না। আমি তো আপনার ডিপার্টমেন্টের না।

পেট্রা হাসল। স্মরণ বসে বেয়ারাকে বলল খাবার দিতে। তারপর পেট্রাকে বলল, ‘একী! শুধু গাজর আর শসা? এ যুগের মেয়েদের ডায়েট নামক জিনিসটা একেবারে শেষ করে দিল।

পেট্রা হাসল। স্মরণ বলল, ‘হাসির কী বললাম?

‘এটা আমার প্রি-লাঞ্চ, এরপর ভাত খাব।

স্মরণ হেসে বলল, ‘ও আচ্ছা, তা-ই বলো।’

সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলল, এই সরি সরি, তুমি করে বলে ফেললাম।

প্রতিবারই স্মরণ এমন বলে। পেট্রার ধারণা, স্মরণ এটা ইচ্ছা করেই বলে। যাতে সমস্যা নেই, আমাকে তুমি করে বলতে পারেন’—ধরনের কিছু পেট্রা বলে। কিন্তু সে ইচ্ছা করেই এ কথা বলে না। পেট্রা বলল, ‘আসলে ভাত আমার খুব প্রিয় একটা জিনিস। অনেক ভাত খাই আমি। কিন্তু এত ভাত খেলে তো মোটা হয়ে যাব। আবার ভাত না খেলেও দুর্বল হয়ে যাই। খাওয়ার আগে সালাদ খেলে স্টমাকে বেশি ভাত খাওয়ার মতো জায়গা থাকে না। তাই এই ব্যবস্থা।

‘তুমি মোটা! কোন হিসেবে?

‘না, আমি মোটা নই। তবে মোটা যাতে না হই, তাই এই ব্যবস্থা। মোটা হয়ে গেলে বেশি কাজ করতে পারি না।

‘ওহ!

খাবার চলে এল। স্মরণ খেতে খেতে বলল, ‘অফিসের খাবার এভাবে রেগুলার খেলে আমি মারা যাব সম্ভবত। এত ঝাল মসলা দেয়!

‘প্রবাসীদের এই একটা সমস্যা।

‘এই যে ম্যাম, আমি প্রবাসী ছিলাম, কিন্তু এখন আর নেই।

‘কয় বছর ছিলেন অস্ট্রেলিয়াতে?

‘সাত বছর।

‘চলে এলেন কেন? লোকজন তো একবার বিদেশি জীবনের স্বাদ পেলে আর দেশে ফেরার নাম নেয় না।

‘ধুর। বিদেশি জীবন ওরকমই। দূর থেকে খুব সুখের মনে হয়। আসলে খুবই কষ্টের। হ্যাঁ, বিলাসিতার অভাব নেই কিন্তু সুখের বড় অভাব। আমি তো হায়ার সেকেন্ডারির পরই চলে গিয়েছিলাম। স্টুডেন্ট লাইফ ভালোই কেটেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির সুবিধাটাই সবচেয়ে বড় সুবিধা। কিন্তু গত এক বছর প্রফেশনাল লাইফটা আমার ভালো লাগে নি। গাধার খাটুনি খেটে একটু সময়ের জন্য বাসায় ফেরা। আত্মীয়স্বজন নেই, আপনজন নেই, প্রাণ খুলে বাংলায় কথা বলার মতো মানুষ নেই। কিছু নেই আসলে!

পেট্রা চুপচাপ খাচ্ছে। স্মরণ বলল, আপনি কত দিন আছেন এখানে?

‘দুই বছর।

‘আমার তো দুই মাস প্রায়। এই অফিসের পরিবেশ ভালো, কাজ করে শান্তি পাচ্ছি।’

পেট্রা হাসল। স্মরণ তাকিয়ে রইল। মেয়েটাকে আহামরি সুন্দরী বলা যায় না। আবার অসুন্দরীও নয়। গায়ের রং স্বাভাবিক ফর্সা, গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা, শরীরের গড়ন শক্তপোক্ত আকর্ষণীয়, চেহারা মোটামুটি। সাজগোজ তেমন নেই। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল। কিন্তু তার ভেতর কোথায় যেন একটা আভিজাত্য আছে, একটা ভিন্নতা, একটা আকর্ষণ! কিন্তু কোথায়? ধরতে পারছে না কেন স্মরণ?

লাঞ্চ শেষে যার যার ডেস্কে যেতে যেতে স্মরণ বলল, ‘অফিস শেষে সময় হবে? একটু কফি খেতে যেতাম।

পেট্রা বলল, ‘সরি, আজ তো হবে না। আজ আমাকে দেখতে আসবে, তাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।’

‘ও, ইটস ওকে।

পেট্রা চলে গেল। স্মরণের খারাপ লাগল। পেট্রাকে আজ দেখতে আসবে!

—————

ছেলেপক্ষ চলে যাওয়ার পর পেট্রা শাড়ি পাল্টে চুলে তেল দিতে বসল। প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘লোকটাকে তোর কেমন লাগল?

পেট্রা বলল, ‘কোন লোক?

‘তোর ক্যান্ডিডেট। ছেলেটাকে কেমন লাগল বলা উচিত ছিল। কিন্তু ছেলে তো নয়, লোকই তো।’

‘আমার ভালো লাগালাগির কিছু নেই। মা যাকে ঠিক করবে, তাকেই বিয়ে করব।

‘তাই বলে এই ভুঁড়িওয়ালা লোকটাকে? কোনো ম্যানার জানে না। গাবরের মতো শব্দ করে খাচ্ছিল। এমন একটা লোক হবে আমার বড় বোনের হাজব্যান্ড? তুই এত শিক্ষিত, স্মার্ট। তুই কেন ও রকম কাউকে বিয়ে করবি?

পেট্রা চুপচাপ চুলে তেল দিচ্ছে। কিছু যায়-আসে না তার। এখন বিয়ে হলেই সে বাঁচে। তা যার সঙ্গেই হোক। প্রিয়াঙ্কা বলল, কিছু বল?

‘মায়ের যখন এই ছেলেকে পছন্দ হয়েছে, আমার আর কিছু বলার নেই।

‘সে তো ছেলের অনেক টাকা আছে বলে। জানি মানুষের জীবনে টাকা অনেক জরুরি জিনিস, কিন্তু…’

প্রিয়াঙ্কা কথাটা শেষ করার আগেই শিখা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন। হতাশ গলায় বললেন, ‘পেট্রা, ছেলের বাবা ফোন করেছিল।

প্রিয়াঙ্কা বা পেট্রা কেউ কিছু বলল না। শিখাই আবার বললেন, ‘তারা তোকে পছন্দ করে নি।

পেট্রা ভাবলেশহীন মুখে মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিল মায়ের পরের কথাগুলো শোনার জন্য। প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘ভালো হয়েছে। ওই ভোেটকুকেও আমার পছন্দ হয় নি। কিন্তু ওরা আমার বোনকে পছন্দ করে নি কোন সাহসে? ওদের ছেলে কি আমার বোনের যোগ্য?

শিখা রেগেমেগে বললেন, তাহলে কোন রাজপুত্র আসবে তোমার বোনকে বিয়ে করতে, শুনি? ওরা তোমার বোনকে পছন্দ করে নি, কারণ তোমার বোনের বয়স বেশি। ত্রিশ বছর বয়সী কোন মেয়েকে কেউ ঘরের বউ করতে চায় না। তার ওপর চেহারার এই তো ছিরি। ইশ, কত ফুটফুটে ছিলি পেট্রা তুই, রাস্তা দিয়ে হাঁটলে ছেলেরা চেয়ে থাকত। সকাল-বিকাল প্রপোজাল আসত। কত ভালো ভালো প্রপোজাল! তুই রাজি হতি না। আর আজ! ঘটক লাগিয়েও ছেলে পাই না। যা-ও পাই, তা-ও তোকে পছন্দ করে না। সবকিছুরই একটা বয়স থাকে পেট্রা। চাহিদা থাকতে মেয়েদের বিয়ে দিতে হয়। ঘরে বসে বুড়ি হলে সেই মেয়ের আর বিয়ে হয় না।’

প্রিয়াঙ্কা চিৎকার করে উঠল, এহ্, ওদের ছেলে কী? বুড়ো ভুড়িওয়ালা আনস্মার্ট ব্যাটা একটা।

শিখা বললেন, ‘তুই চুপ থাক। ওই ছেলে ঠিকই একটা কচি মেয়ে পেয়ে যাবে।

হ্যাঁ, টাকা হলে বাঘের চোখও কিনতে পাওয়া যায়। সেখানে কচি মেয়ে তো খুবই সহজলভ্য।

‘এই, তুই এখানে কেন? তুই জামাইর সাথে চলে গেলি না কেন?

প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘শোনো মা, আমি আমার বাপের বাড়িতে যত দিন ইচ্ছা থাকব। তুমি না চাইলেও থাকব।’

পেট্রা বলল, ‘প্রিয়াঙ্কা, তুই থামবি? মায়ের সাথে এভাবে কথা বলিস না। যত দিন ইচ্ছা থাক, কেউ তো না করে নি।

বোনের ধমক খেয়ে প্রিয়াঙ্কা চুপ হয়ে গেল। শিখা বিছানায় বসে পড়লেন। উসখুস করতে করতে বললেন, ‘সবারই এক প্রশ্ন। বড় বোনের আগে কেন ছোট বোনের বিয়ে হলো?

প্রিয়াঙ্কা কিছু বলতে যাচ্ছিল, পেট্রা চোখ বড় করে তাকাতেই থেমে গেল। শিখা বলে যেতে লাগলেন, চেহারাটা তো একদম নষ্ট করে ফেলেছিস। চোখের নিচে কালি পড়ে কী অবস্থা হয়েছে! সারা রাত ঘুমাস না নাকি?’

পেট্রা বলল, ‘ঘুমাই মা। কালি কেন পড়ে, আমি জানি না।’

‘আজকালকার মেয়েরা পারলারেই পড়ে থাকে। তুই তো ভুলেও যাস। স্কিনের কী অবস্থা?

‘পারলারের খরচটা কে দেবে, মা? আয় তো করি ওই কটা টাকা। তুমি তো জানো বাসাভাড়া, সংসার খরচ আর রায়ানের পড়াশোনাতেই সব শেষ হয়ে যায়। তারপর সামান্য কিছু হাতখরচ থাকে, সেটা আর পারলারে ঢালতে ইচ্ছা করে না।

‘ঠিকাছে, এই মাস থেকে দুধ-চা খাওয়া বন্ধ। এটা একটা ফালতু খরচ। দুধ-চায়ের জন্য মাসে চার প্যাকেট দুধ লাগে। মানে এক হাজার টাকা, এতে ফেশিয়াল হয়ে যাবে। আমিও কি নিজের ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে গেলে এমন মেয়ে পছন্দ করতাম? কখনো না।’

পেট্রা চুলে বেণি করতে করতে বলল, ‘অসম্ভব, চা না খেলে বাঁচব না।’

‘রং-চা খাবি।

‘তুমি জানো আমি রং-চা খাই না।

প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘আচ্ছা, তোমরা এভাবে এত কষ্ট করে থাকো, আমি কতবার টাকা দিতে চেয়েছি। নাও না কেন তোমরা?

শিখা বললেন, ‘জামাইয়ের টাকায় খাব নাকি? মরে গেলেও না।’

‘ও, তার মানে কি পেট্রার বিয়ে হয়ে গেলে ওর কাছ থেকেও টাকা নেবে না? তাহলে তোমার আর রায়ানের চলবে কীভাবে?

শিখা বললেন, ‘পেট্রা তো জামাইয়ের টাকা দেবে না। ও নিজে চাকরি করে আয় করা টাকা দেবে। তুই চাকরি করে টাকা দিলে তোর টাকাও নেব। তা তো পারবি না। সেরকম পড়াশোনা তো করিস নি। ফাঁকি কাকে দিয়েছিলি এখন বুঝতে পারছিস?

পেট্রা বলল, ‘আচ্ছা, ঠিকাছে ঠিকাছে, তোমরা থামো। মা, আমি এই মাস থেকেই প্রতি মাসে আমার হাতখরচের টাকা থেকে ফেশিয়াল করব।

প্রিয়াঙ্কা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এবার তোমার শান্তি হয়েছে?

‘আমার শান্তি সেদিন হবে, যেদিন পেট্রাকে বিয়ে দিতে পারব। কতবার বলেছি, পেট্রা, বাপ থাকতে বিয়েটা কর। বাপ মরা মেয়েদের বিয়ে দিতে কত কষ্ট, এবার বুঝতে পারছিস তো?’

কেউ আর কোনো কথা বলল না। শিখা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের এতক্ষণ বলা কোনো কথাই গায়ে লাগে নি পেট্রার। সে জানে মা কতটা মানসিক চাপে থাকেন তাকে নিয়ে। কিন্তু বাপ মরা মেয়ে, এই কথাটা পেট্রা কখনোই সহ্য করতে পারে না। বাবার মুখটা মনে পড়ল পেট্রার। বুকটা চিরে যাচ্ছে। চোখে আগুন জ্বলছে। প্রিয়াঙ্কা পেছন থেকে পেট্রার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সরি।

‘ফর হোয়াট?

‘আমি আগে বিয়ে করে ফেলেছি সেটা নিয়েও তোকে কথা শুনতে হচ্ছে।

প্রিয়াঙ্কা কান্না শুরু করে দিল। পেট্রা প্রিয়াঙ্কাকে ধরে সামনে এনে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘পাগলি, কাঁদে না। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস।’

পেট্রা কাঁদতে পারল না। তার চোখের জল কবেই ফুরিয়ে গেছে!

—————

শুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশে শুয়ে আছে নিকিতা। তাকিয়ে আছে প্রিয়র দিকে। প্রিয় সোফায় বসে ল্যাপটপে কিছু করছে। কী করছে, তা নিকিতা দেখতে পারছে না। কারণ, ল্যাপটপ প্রিয়র দিকে ফেরানো। প্রিয়র পরনে কালো রঙের ট্রাউজার আর কালো টি-শার্ট। চুলগুলো এলোমেলো, একটু পরপর দুহাতে চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে কিছু ভাবছে। কী সুন্দরই না লাগছে প্রিয়কে! নিকিতার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ প্রিয়। প্রিয়র শ্যামবর্ণ শরীর, কাটা কাটা চেহারা, হাসি, হাঁটার স্টাইল সবকিছুই ক্ষণে ক্ষণে পাগল করে দেয় নিকিতাকে। তবে মানুষটার হাসি খুব কমই দেখা যায়। সে বোধ হয় দুনিয়ার সবচেয়ে রাগী মানুষ। এত সুদর্শন একজন পুরুষের কেন এত রাগ থাকতে হবে?

প্রিয়র কাজ শেষ হতেই আলো নিভিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। দুজনের মাঝখানে শুদ্ধ। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরে। কম্বলের নিচে শীত করছে নিকিতার। শুদ্ধর জন্য আলাদা কম্বল। প্রিয়র কম্বল পছন্দ নয়, লেপ নিয়ে ঘুমায়। ঠিকাছে, নিকিতাও না হয় প্রিয়র লেপের মধ্যেই ঘুমাত। তা নয়, সব সময় ত্যাড়ামি। তোমার ত্যাড়ামি আমি একদিন তাড়াবই, মনে মনে এ কথা বলল নিকিতা।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। প্রিয় ঘুমিয়ে পড়েছে। নিকিতা শুদ্ধকে আলতো করে ধরে নিজের জায়গায় এনে নিজে গিয়ে মাঝখানে শুয়ে পড়ল। তারপর প্রিয়র লেপের নিচে ঢুকে প্রিয়কে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়ও জড়িয়ে ধরল। ভীষণ ভালো লাগছিল। কিছুক্ষণ পর নিকিতা খুব সন্তর্পণে প্রিয়র ঠোঁটে চুমু খেল। প্রিয়র ঘুম ভেঙে গেল এবং নিকিতাকে সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল। আলো জ্বালিয়ে বলল, তোমার সমস্যা কী?

নিকিতা কিছু বলল না, অদ্ভুত নেশাতুর চোখে তাকিয়ে ছিল। যদি এতে কাবু করা যায়। খুব কম পুরুষমানুষই আছে, যারা এই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করতে পারে। প্রিয় রেগে গিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বলল, ‘লিসেন, বাবর খানের জন্য তুমি এই ঘরে এখনো থাকতে পারো। গট ইট?

এ কথা বলে প্রিয় লেপ-বালিশ নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল। নিকিতা প্রিয়র কাছে গিয়ে বলল, ‘সরি প্রিয়, ভুল হয়েছে আমার। বিছানায় এসো, প্লিজ। এখানে ঘুমাতে তোমার কষ্ট হবে।

‘আস্তে কথা বলো, শুদ্ধ উঠে যাবে।

‘সরি, সরি। বিছানায় এসো।

‘আমি এখানেই ঠিক আছি। তুমি ঘুমাতে যাও।

‘না, তুমি এসো।

‘নিকিতা, আমার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। তুমি ঘুমাতে যাও। আমাকে বিরক্ত কোরো না।

নিকিতা প্রিয়র পা ধরে বলল, পায়ে ধরি তোমার, প্রিয়, এসো না। আমি আর এমন করব না।’

প্রিয় উঠে বসে হাতজোড় করে বলল, আল্লাহর দোয়াই লাগে, এই পায়ে ধরার অভ্যাসটা তুমি ছাড়ো, আমি এটা খুব অপছন্দ করি।’
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp