শিকদার সাহেবের দিনলিপি - পর্ব ১৪ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          আজ সকালে আমি বাগানে কাজ করছিলাম, তখন মীরা ফোন করল। কী করি জিজ্ঞেস করতেই বললাম,

গোলাপ গাছের সেবা করি।

মীরা বলল,

গত এক মাস ধরে তো তুমি গোলাপ গাছের সেবাই করে যাচ্ছে। কী হয়েছে তোমার বলো তো? গোলাপের এডিকশন হয়নি তো? সকাল থেকে একবারও ফোন করোনি! ভুলেই তো গেছে আমাকে।

আমি হেসে বললাম,

গোলাপ গাছগুলো এই সিজনে বাঁচিয়ে রাখা মুশকিল মীরা। গোলাপের ডাইব্যাক নামে এক রোগ আছে। এটা হলে গাছ বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে যায়। তবে একটু যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে পুরো শীত ভরে ফুল দেয়। একেকটা ফুল কলি থেকে শুরু করে পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হওয়া পর্যন্ত প্রায় দু মাস গাছে থাকে। তখন সকালবেলা বাগানে এলে মনে হয় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। সেজন্যই এই কষ্টগুলো করা। গোলাপ বড় অভিমানী গাছ। যত্ন না করলে অভিমানে শেষ হয়ে যায়। ঠিক যেমন তুমি যত্নে টান পড়লেই অভিমানের বৃষ্টি ঝরাও। রাতেও কয়েক ঘন্টা কথা হয়েছে। এখন বাজে সকাল ১০টা। এরমধ্যে ফোন দিইনি বলেই অভিমান তুঙ্গে।

ইশ!

মীরা একটু হাসল। বলল,

তুমি কথা কম বলো। কিন্তু কথা জানো। কথা দিয়ে একদম গলিয়ে ফেলতে পারো।

আমি হাসলাম। তবে আর কিছু বললাম না। কী আর করা যাবে। ফোন দিতে পারিনি এখন তো কথা দিয়েই গলাতে হবে। পকেটের অবস্থা খারাপ। এ মাসের পকেটমানি শেষ। বাজারের টাকা থেকে টাকা মেরে ফোনে ভরতে হবে। এরপর ফোন দিতে পারব। মাঝেমাঝে আমার এক লাফে বড় হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। এই সব পড়াশোনা, সীমিত পকেটমানি দিয়ে হাজারটা হিসেবনিকেশ করে চলা আর ভালো লাগে না।

রাফসান শিকদার,
২৯ জুলাই, ২০১০

কেমন আছিস বকুল? অনেকদিন কথা হয় না। কী করব! আমি যে আর আমার মাঝে নেই। যেদিন থেকে মায়ের খোঁজ পাই না সেদিন থেকে আমি স্বাভাবিক নেই। শুধু আমি কেন বাড়ির কেউই ঠিক নেই সেদিন থেকে। সবচেয়ে বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে বাবা। প্রথমদিকে কদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা সামলে উঠেছে। আবার অফিস করছে। হঠাৎ করেই মায়ের ফোন বন্ধ পাচ্ছি। শেষ যখন কথা হলো সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। হঠাৎ করে কী হলো বুঝে উঠতে পারছি না। বাবা অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগের কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারেনি। মায়ের বাড়িতে কেউই বাবা-মায়ের বিয়েটা মেনে নেয়নি তাই কারো সঙ্গেই বাবার বা আমাদের যোগাযোগ নেই। নানা, নানু ও মামাদের সঙ্গে দু-একবার কথা হয়েছে তবে সেটা মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলবার সময়। মা ডেকে কথা বলিয়ে দিয়েছিল, তা না হলে তাও হতো না। তারা আমাদের বিষয়ে তেমন একটা আগ্রহবোধ করেন না। মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার পর নানাবাড়িতে চিঠি পাঠিয়েছে বাবা। কোনো উত্তর আসেনি। আচ্ছা বকুল কী হতে পারে মায়ের? এত বছর বাদে তিন সন্তানের জননীকে নিশ্চয়ই আটকে রাখেননি তারা? সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাহলে কি মায়ের কোনো বিপদ হয়েছে? মায়ের বিপদ সম্পর্কিত কিছু ভাবতে পারছি না। চাইছিও না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও তিনি যেন ভালো থাকেন, মনেপ্রাণে এই প্রার্থনা করি।

রাফসান শিকদার
১১ সেপ্টেম্বর, ২০১০

আজ বিকেলে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে। ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। আমাকে দেখে রূপ ছুটে এসেছে। আমি বাড়ি ফিরলেই ওর গল্পের ঝুড়ি খুলে যায়। কিন্তু সেসব দিকে না গিয়ে আজ ও সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করল,

লাফি বাইয়া মা কি মরে গেছে?

আমি চমকে উঠে বসলাম। রূপকে ধমকে বললাম,

এসব কী বলছিস? কে বলেছে তোকে এই সব?

আচমকা আমার ধমক খেয়ে রূপ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। জীবনে এই প্রথম আমি রূপকে ধমক দিলাম এবং তুই করে বললাম। রূপ কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল রাহির কাছে। রাগে আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। কী করলাম আমি? আমার কলিজার টুকরাটাকে এভাবে কষ্ট দিলাম? দু চোখ ভেঙে কান্না এলো আমার। ছুটে গেলাম রাহির ঘরে। রূপ রাহিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। রাহি আমার দিকে চেয়ে বলল,

কী হয়েছে ভাইয়া?

পরে বলছি।

আমি রূপকে সরি বললাম, কোলে নিলাম। রূপ শুধু কাঁদছেই না, সঙ্গে ভয়ে কাঁপছে। আমি অনেকক্ষণ ওকে নিয়ে বাগানে হাঁটলাম। ওকে শান্ত করে সামনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

রাফি ভাইয়াকে ভয় লাগছে?

রূপ চুপ করে আছে। তবে কান্না থেমেছে। আমি রূপের ছোট ছোট হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বললাম,

ভাইয়া সরি। তুমি একটা পচা কথা বলেছ, তাই ভাইয়া রেগে গিয়েছিলাম। কিন্তু আর কখনো তোমাকে বকা দেব না প্রমিস। তুমি ভয় পেয়ো না।

রূপ বলল,

একন আল ভয় লাগছে না।

গুড গার্ল। এখন আমাকে বলো তো, তোমাকে কে বলেছে মা মরে গেছে?

কেউ বলেনি। আমি তিভিতে দেকেছি কেউ মরে গেলে আল আসে না। মাও তো আল আসে না। তাই আমি ভেবেছিলাম মা আবাল মরে গেল কি না।

আমি রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,

আমাদের মায়ের কিছু হয়নি রূপ। মা একদম ভালো আছে।

তা হলে মা ফোন কলে না কেন?

মা তো অন্য একটা দেশে গেছে ভাইয়া। ওই দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের নেটওয়ার্কটা হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই মা ফোন করতে পারছে না। নেটওয়ার্ক ঠিক হয়ে গেলেই আবার কথা বলতে পারব।

লাফি বাইয়া শুনো, আমি যখন বল হব তখন একতা নেতওয়াক বানাবো যেতা কোনোদিন নষ্ট হবে না। সব বাবুরা মার সাতে কতা বলতে পালবে।

অবশ্যই বানাবে।

নিশ্চয়ই খুব দ্রুত মা ফিরে আসবে আর রূপের কাছে আমার প্রতিনিয়ত মিথ্যে বলার দিন শেষ হবে।

রাফসান শিকদার
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১০

কিছুক্ষণ আগে বাবা আমার ঘরে এসেছিলেন। আমার পাশে বসে বললেন,

আমি যদি কিছুদিনের জন্য তুরস্ক যাই তুই কি এদিকটা সামলাতে পারবি রাফি?

আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। বাবা চলে গেলে আমরা তিন ভাইবোন কীভাবে থাকব? কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। কারণ বাবার কথায় কিছুটা আশার আলো দেখতে পেলাম। বাবার চিঠির উত্তর আসেনি ঠিকই কিন্তু বাবা গেলে তো নিশ্চয়ই একটা খবর আনতে পারবে। আমি বললাম,

কেন পারব না বাবা তুমি অফিসে গেলে এদিকের সব তো আমিই সামলাই। তোমার ছোট ছেলে তো লাটসাহেব। কোনো দিকে তার নজর নেই। সব আমাকেই করতে হয়।

বাবা আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে খানিক হেসে বললেন,

যার এমন দায়িত্ববান বড় ভাই আছে সে তো একটু লাটসাহেব হবেই বাবা।

আমি মাথা চুলকে হেসে ফেললাম। তারপর বললাম,

তুমি যদি যেতে পারো তো যাও। কিন্তু বাবা তোমার কাছে কি যাওয়া আসার মতো টাকা-পয়সা আছে?

বাবা চিন্তিত হয়ে বললেন,

টাকা-পয়সা যদি থাকতই, এই দু মাস কি বসে থাকতাম রে বাপ? কবেই চলে যেতাম তোর মাকে খুঁজতে। টাকা ধার করেছি। সপ্তাহখানেকর মধ্যে পেয়ে যাব। টাকাটা হাতে পেলেই যাব। কিন্তু তোদের এভাবে একা রেখে যেতে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

আমি বাবাকে অভয় দিয়ে বললাম,

তিনজন মানুষ কখনো একা হয় না বাবা। তুমি নিশ্চিন্তে যাও। তোমার ছেলেমেয়েদের আমি দেখে রাখব কথা দিচ্ছি।

রাফসান শিকদার
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০

মীরা এখন কলেজে পড়ে ভাবতেই কেমন অবাক লাগছে তাই না? মেয়েটা কিন্তু দিন দিন বড় হচ্ছে। ওর পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ার মতো। এইতো দু বছর পর ভার্সিটিতেও উঠে যাবে। তখন ছেলেদের নজর থেকে ওকে রক্ষা করব কি করে? ওকে ভালোবসে ওর চোখে যদি কেউ তাকায় সে মরবে নিশ্চিত!

রাফসান শিকদার
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১০

মীরা দেখা করতে চাচ্ছে। এই মাসে একবারও দেখা হয়নি। সেমিস্টার ব্রেক চলছে তাই ঢাকা যাওয়া হচ্ছে না। তা ছাড়া এই মুহূর্তে আমার কাছে একদম টাকা-পয়সা নেই তাই দেখা করতে পারছি না। খালি হাতে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে কোথায় যাব আমি? বাবা অন্য একটা দেশে যাচ্ছে কিছু বাড়তি টাকা বাবার কাছে থাকা ভালো-তাই এ মাসে হাত খরচের টাকা নিইনি। দেখা না করার জন্য একের পর এক অজুহাত দিয়ে যাচ্ছি মীরাকে। ও আজ আমাকে বলল, আমি নাকি বদলে গেছি। আমি নাকি ওকে আগের মত আর ভালোবাসি না।

ওকে বোঝাতে পারি না যে আমি বদলে যাইনি, আমার পরিস্থিতি বদলে গেছে। আর কটা দিন কষ্ট করো মীরা। বাবা যখন মাকে নিয়ে ফিরে আসবে, তখন সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে। তুমিও ফিরে পাবে তোমার আগের রাফি কে।

রাফসান শিকদার
৩১ সেপ্টেম্বর, ২০১০
·
·
·
চলবে.....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp