তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো - পর্ব ২৭ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


“এই, ওঠো।”

কোনো সাড়াশব্দ নেই। নিহিন কলরবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার ডাকল,

“কী উঠবে না?”

কোনো সাড়া নেই, মানুষ এত ঘুমায় কীভাবে যে গায়ে হাত দিয়ে ডাকলেও ওঠে না! এবার কলরবের বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিলো নিহিন। কলরব চোখ মেলল,

“আরেকটু ঘুমাই প্লিজ।”

তারপর নিহিনের হাতটা টেনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে আবার ঘুমাতে লাগল। নিহিন বলল,

আরে, এ তো দেখছি আবার ঘুমাচ্ছে। এই তুমি আর কত ঘুমাবে? কলরব আবার চোখ মেলে তাকিয়ে হাত ছেড়ে নিহিনের কোমরে ধরে এক টান দিয়ে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল,

“তুমি কেন উঠেছো? আসো তো, আরও ঘুমাবো।”

নিহিন বুঝল কলরবের ঘুমই ভাঙেনি। ও হয়তো ভাবছে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু এত শক্ত করে ধরেছে, যে নিহিনের দম বন্ধ হবার জোগাড়। নিহিন কলরবকে ধাক্কা দিয়ে বলল,

“এই ছাড়ো আমাকে, ব্যথা পাচ্ছি তো, উফ।”

কলরব চোখ খুলল, কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে নিহিনকে ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে ওঠে বলল,

“তুমি?”

নিহিন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

“আরেকটু হলে তো মেরেই ফেলছিলে।”

কলরব সে কথার উত্তর না দিয়ে ঘরির দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি এত সকালে! আমার ঘরে? কীভাবে?”

নিহিন একটা হাত পিছনে নিয়ে হাতড়ে হাতড়ে সুইচটা ধরল। তারপর ফ্যান ছাড়তেই সব ফুলগুলো পড়লো ওদের মাথার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে নিহিন সুর করে গাইলো,

“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ…”

ততক্ষণে বিস্মিত কলরব চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল, তারপর ফ্যান বন্ধ করে দিল যাতে মোমগুলো নিভে না যায়, তবু বেশিরভাগ মোম নিভে গেল। হিনিনের উইশ করা শেষ হতেই বলল,

“হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!”

হাসলো নিহিন। কলরব আবার বলল,

“পুরো বাসর ঘর বানিয়ে দিলে! ক্যান্ডেল লাইট বাসর ঘর!”

“ইশ, যাও।”

লজ্জা পেয়ে চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল নিহিন। ও ভাবতেই পারেনি কলরব এইটাইপ কিছু বলবে, তাহলে জীবনেও ফুল নিয়ে এসব করত না। কলরব বলল,

“কিন্তু সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ তুমি নিজে। যাক তোমাকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখার সৌভাগ্য অবশেষে হলো। শাড়ি পরতে শিখেছ তাহলে এতদিনে। তার ওপর পরেছ সাদা শাড়ি, সাদা রঙে তো তোমাকে আগে থেকেই ভালো লাগে আমার, আর সঙ্গে লাল মিলিয়ে কী সাজটাই না দিয়েছ। ইউ আর লুকিং গরজিয়াস! অনেকটা রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য, চারুলতা, আশালতা, বিনোদিনী কিংবা কুমুদিনীর মতো।”

“খুব যে বলছো, পড়েছ ক্যারেকটারগুলো?”

“অবশ্যই।”

“তাহলে বলছো কেন? সমাপ্তি আর আশালতার তো আমার অর্ধেক বয়স ছিল।”

“আর লাবণ্যর…”

কথা শেষ করতে দিল না কলরব। হেসে বলল,

“ম্যাডাম, আমি জাস্ট বলতে চেয়েছি সাজটা ওদের মত হয়েছে!”

“কিন্তু বিনোদিনী তো ছিল বিধবা। ও সাজতো না।”

“ম্যাডাম আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন? শেষের দিকে বিনোদিনী যখন বিহারীবাবুর কাছে গিয়েছিল, গয়নাগাটি পরে বউ সেজেই গিয়েছিল।”

“আচ্ছা আচ্ছা বুঝলাম।”

তর্কযুদ্ধে জিতে হাসতে লাগল কলরব। নিহিন গিটারটা হাতে নিয়ে ওর সামনে ধরল,

“এটা তোমার জন্য।”

কলরব বলল,

“ওহ ওয়াও! সো সেক্সি গিটার! কিন্তু আমি তো এখন বোধহয় সব ভুলে গিয়েছি। ১০ বছর ধরে গিটার ধরি না।”

“মানুষ এসব ভোলে না, আমার জন্য তোমাকে গাইতেই হবে। কোনো কথা শুনবো না। তবে হ্যাঁ, কল্পর সামনে গাইবে। আজ ও খুব আফসোস করছিল তোমার গান কখনো শোনেনি বলে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে, ট্রাই করব।”

“ট্রাই ফ্রাই বুঝি না, গাইতে হবে।”

“আচ্ছা বাবা গাইবো তো।”

তারপর নিহিন বিছানা থেকে নেমে গেল, কলরব নামতে গিয়েই কেকটা দেখতে পেল।

“আরেব্বাস, আরো সারপ্রাইজ আছে নাকি? কেকটা নিশ্চই তুমি বানিয়েছ?” কেকের ওপর কিছু ফুলের পাপড়ি পড়েছিল, নিহিন ওগুলো সরাতে সরাতে বলল,

“হ্যাঁ, কিন্তু বুঝলে কী করে? দোকানের মতই তো ডেকোরেট করেছি।”

“নিহিন নিহিন গন্ধ পাচ্ছি তো।”

বলেই হেসে ফলল কলরব। নিহিন বলল,

“ঘোড়ার ডিম, সত্যিটা বলো।”

“আরে বাবা, আমার বার্থডেতে তুমি দোকান থেকে কেক আনবে? এটা হতে পারে? আমি চিনি না তোমাকে?”

“ও।”

কলরব কেকের এক পাশ থেকে একটু উঠাতে গেল আর নিহিন বলে উঠল, “কি করছো?”

“খাবো।”

“আগে দাঁত ব্রাশ করে আসো। মুখ না ধুয়েই খেতে আসছে!”

“আরে আমি একটু খাবো।”

“না বেশিটুকুই খাও বাট আগে মুখ ধুয়ে এসো, যাও।”

কলরবকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলো নিহিন। কলরব নিহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“এত ফোর্স করছো কেন? বাথরুমেও কোন সারপ্রাইজ আছে নাকি?”

“উফ তুমি যাও তো।”

হাসতে হাসতে গেল কলরব। যাওয়ার সময় বলল,

“মোমগুলো আবার জ্বালিয়ে দাও।”

“কেন?”

“তাহলে অন্ধকারে থাকবে? ছি ছি কী দুষ্টু চিন্তা!”

“কী বললে তুমি?”

অভিমানী সুরে বলল নিহিন। কলরব বলল,

“আচ্ছা সরি, তুমি মোমগুলো জ্বালিয়ে দাও, কাজ আছে। আমি আসছি।”

“ঠিক আছে।”

“সাবধানে, শাড়ি সামলে!”

মোম জ্বালানো শেষ করে খাটের একপাশে পা ঝুলিয়ে বসে দেওয়ালে টাঙানো নিজের ছবিটা দেখছিল নিহিন। কলরব দাঁত ব্রাশ করে এসে বলল,

“এবার কি আমি একটু কেক খেতে পারি?”

“হ্যাঁ খাও, তবে পাশ থেকে। কল্প আর বাবা আসলে কেক কাটবে কলরব একটু কেক হাতে উঠাতে উঠাতে বলল,

“তারা কোথায় গিয়েছে? ফুপির বাসায় নাকি অন্য কোথাও?”

“ফুপির বাসায়ই। বলল তো পাশের বাসার পরের বাসা।”

কলরব বলল,

“কেকটা অসাধারণ হয়েছে।”

নিহিন বলল,

“তুমি এভাবে খালি গায়ে ঘুমাচ্ছিলে কেন? আর এখনও সেভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?”

“কেন? সমস্যা কী?”

“ছি ছি লজ্জা করে না?”

“না ওটা তোমার করলেই হবে। সবাই মিলে লজ্জা পেয়ে লজ্জার গোডাউন খুলবো নাকি?”

“প্লিজ একটা কিছু পরো। আমার অস্বস্তি লাগছে।”

“উফ মেয়েরা যে কী জ্বালাতে পারে!”

নিহিন এবার নিজের ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কলরব ওয়ারড্রবের

কাছে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর টি শার্ট পড়ে নিহিনের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,

“নিজেকে কেউ এত দেখে?”

“ছোটবেলা দেখতে ভালো লাগে।”

কলরব নিহিনের একটা হাত ধরে নিজের দিকে ফেরালো। নিহিন ফিরতেই হাঁটু মুড়ে বসল নিহিনের সামনে। তারপর পকেট থেকে স্বর্ণের নূপুরটা বের করে নিহিনের সামনে ধরল। বলল,

“উইল ইউ ম্যারি মি?”

নিহিনের বুকের ভেতর হাজারখানেক প্রজাপতির ওড়াউড়ি শুরু হয়ে গেল। কিছু বলতে পারল না, শুধু মাথা নিচু করে মিষ্টি করে হাসল। কলরব বলল,

“তাহলে পা দাও।”

“নিহিন একটা পা এগিয়ে দিলো। কলরব পা টা ধরে নিজের কোলে উঠাতে গেলেই নিহিন বলে উঠল, “

“একি করছো? পা ধরছো কেন? এমনি পরিয়ে দিলেই তো হয়।” কলরব একটা ধমক দিলো। বলল,

“উফ, কী হবে পা ধরলে? মহাভারত অশুদ্ধ হবে?”

“পাপ হবে আমার।”

“কখনো না, তোমার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি আমার। একটা কথাও আর বলবে না।”

কলরব নিহিনের পা টা নিজের কোলের ওপরে উঠিয়ে নূপুরটা পরিয়ে দিলো। আর তারপর নিহিনের পায়ের পাতাতে একটা চুমু খেল। সর্বাঙ্গে শিউরে উঠল নিহিন। কলরব তাকিয়ে দেখল নিহিন কাঁপছে, চোখ বন্ধ। পা টা যেভাবে যত্ন করে তুলেছিল সেভাবে যত্ন করে নামিয়ে রাখল। তারপর ওঠে দাঁড়াল। নিহিন তখনও মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। কলরব ওর মুখটা দুহাতে তুলল। তাকাল না নিহিন। কলরব নিহিনের বন্ধ দুটি চোখের পাতায় চুমু খেল। তারপর জড়িয়ে ধরল, নিহিনও ধরল। কিছুক্ষণ পর কলরব জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই ডাকল সেই পুরোনো নামে,

“পরি?”

“হু।”

কণ্ঠটা ভারী শোনালো নিহিনের। কলরব বলল,

“এতদিন এই নামটাতে ডাকতে পারছিলাম না, আজকের দিনটার অপেক্ষায়।”

“এখন শান্তি হয়েছে?”

“খুব।”

“আচ্ছা তুমি যে নূপুরটা আমাকে দিয়েছিলে সেটা আর এটা তো একই রকম। ইচ্ছে করে একরকম বানিয়েছ না?”

“হ্যাঁ।”

“এতদিন পরও ডিজাইনটা তোমার মনে আছে?”

“না। তিথিকে বলেছিলাম যে করেই হোক ডিজাইনটা এনে দিতে হবে।”

“আচ্ছা এজন্যই ও ছবি তুলে নিয়োছিল।”

“হুম তাও আবার তোমার পাসহ, দেখেই মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।”

“ইশ।”

আরেকটু শক্ত করে ধরল কলরব। যেন কেউ নিয়ে যাচ্ছে। নিহিন বলল, “তিথি আমাকে কিছু বলল না?”

“বললে সারপ্রাইজ নষ্ট হতো যে!” তারপর বলল,

“শোনো, তোমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল।”

“বলো।”

“প্রথমত, বাবা আর আমি তোমাদের বাসায় বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাব। কবে যাব, সেটা বাসায় কথা বলে জানাবে আমাকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”

“ঠিক আছে।”

“তোমার বাবা এবার রাজি হবে তো পরি?”

“হবে, কারণ অনেক দিন ধরেই আমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি রাজি হইনি। আর তাদের পছন্দে একবার বিয়ে করে তো…”

“স্টপ! এতকিছু জানতে চাইনি।”

হঠাৎ মনে পড়ায় নিহিন জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ওই দিন তুমি হাসছিলে কেন?”

“কোনদিন?”

“ওই যে, এসব বলতে চাচ্ছিলাম তুমি শুনতে চাচ্ছিলে না বললে অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি তোমার পছন্দ না। তারপর আমি বললাম ‘আমিও তো তোমার অতীত’ তারপর হাসছিলে।

“কারণ তুমি আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব। ওইদিন বলিনি কারণ তখনো তোমাকে প্রপোজ করিনি

“ইচ্ছে করে আমাকে কনফিউশনে রেখেছিলে।”

“না, কিছু সমস্যা ছিল। সেগুলো সমাধান না করে বলব কী করে?”

“কী প্রবলেম?”

“ওই তোমার আমার বিয়েতে কী কী বাধা আসতে পারে সেগুলো।”

নিহিন কলরবের বুক থেকে মাথা তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কী সেগুলো?”

“পরে বলব। এখন এসব বলার সময় না কারণ ওগুলো প্রায় সমাধান করে ফেলেছি।”

আবার কলরবের বুকে মাথা রাখল নিহিন।

“আচ্ছা তুমি কি ঠিক করে রেখেছিলে আজ আমাকে প্রপোজ করবে?”

“হ্যাঁ, প্রথমবার প্রপোজ করেছিলাম তোমার জন্মদিনে আর এবার আমার জন্মদিনে করতে চেয়েছিলাম।”

“আমি যদি না আসতাম।”

“তাহলে আমি নিজেই গিয়ে নিয়ে আসতাম।”

“যদি মনে না থাকত? আর উইশ না করতাম?”

“মনে করিয়ে দিতাম।”

“রাগ করতে না?”

“এত বছর পর তাই রাগ করতাম না। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি জানতাম আমার বার্থডেতে তোমার কোনো প্ল্যান থাকবেই। তার ওপর তিথিও মুখ ফসকে বলে ফেলছিল, পরে কথাটা গিলে ফেলেছে। ততক্ষণে আমি যা বোঝার বুঝে গিয়েছি।”

নিহিন সরে দাঁড়িয়ে বলল,

“পাজিটা আমার কাছে মুখ ফসকে তোমার প্ল্যানের কথা বলতে পারল না, অথচ তোমার কাছে ঠিকই বলে দিলো!”

“আহা শোনো না, কাছে এসো..”

এই বলে নিহিনকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরল।

“কী প্ল্যান তা বলেনি তো। বিশ্বাস করো আমি শুধু জানতাম যে তোমার কোনো প্ল্যান থাকবে। সেটা যে এরকম ক্যান্ডেল লাইট বাসর ঘরের প্ল্যান তা আমি স্বপ্নের মধ্যেও দেখিনি।”

“উফ পেয়েছে এক কথা, এটা মোটেও ক্যান্ডেল লাইট বাসর ঘর নয়। পরিবেশটা একটু রোমান্টিক করার জন্য এভাবে সাজিয়েছি।”

“ভালোই হয়েছে, আমার প্ল্যান ছিল শুধু প্রপোজ করা। সেটা এত সুন্দরভাবে তোমার জন্যই সম্ভব হলো।”

নিহিন আবার একটু সরে গিয়ে কলরবের দিকে তাকিয়ে বলল,

“হুম, অনেক হয়েছে আর কী কী গুরুত্বপূর্ণ কথা যেন বলবে? শুধু তো একটা বললে।”

“সেটা নাহয় বলব, কিন্তু বারবার সরে যাচ্ছ কেন?”

“আই কন্ট্যাক্ট করার জন্য।”

“সারাজীবন বহু আই কন্ট্যাক্ট করতে পারবে, পাল্লাও দেবো। কিন্তু এখন একটু আমার বুকে থাকো। খুব শান্তি লাগে। বুকের ভেতর আগুন জ্বলছিল এতদিন, একটু ঠাণ্ডা হতে দাও।”

একথায় নিহিনের চোখে ভিজে উঠল। সেটা দেখতে পেয়ে কলরব বলল,

“খবরদার, এখন কাঁদলে একটা থাপ্পড় মেরে গালে দাগ বসিয়ে দেবো।”

এরপর নিহিন নিজেই কলরবের বুকে মাথা রাখল। তারপর কলরব বলল,

“অবশ্য গাল লাল করার আরো উপায় আছে।”

“ইশ, আর কোনো কথা নেই?”

“আছে তো। ওই যে গুরুত্বপূর্ণ কথা। তার মধ্যে আরেকটা হলো আজ তোমাকে ১৫/১৬ জনের মত রান্না করতে হবে।”

“আচ্ছা। কিন্তু এতজন কারা?”

“আমরা ৪ জন, সাব্বির, তিথি আর কিছু ফ্রেন্ড, বড় চাচা আর ফুপিদের বাসা থেকে কেউ আসতে পারে, ও হ্যাঁ খালামনিও আসবে।”

“মানে কি আজ আমার ইন্টারভিউ?”

ভয়ে ভয়ে বলল নিহিন। কলরব বলল,

“আরে নাহ, এমনি সবার তোমাকে দেখার আগ্রহ তাই। আর তজনের রান্না বাইরে ব্যবস্থা করা যেত, কিংবা বুয়া করতে পারত, কিন্তু তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি কারণ আমি সবাইকে জানাতে চাই যে আমি কতটা ভাগ্যবান। তারাও দেখুক ১০ বছরের কষ্টের পুরস্কারসরূপ আমি কি পেতে চলেছি। তারাও বুঝুক গত ১০ বছর কষ্ট করলেও বাকি ৭০ বছর বেহেশতি খাবার খেতে পারব। বলোতো পরি ১০০ বছর বাঁচব না?”

নিহিনের প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে, এত ভালোবাসা কোথায় রাখবে ও? ও কি যোগ্য এত ভালোবাসার? অনেক কষ্টে কান্না চেপে ধরা গলায় বলল,

“হুম।”

শেষ পর্যন্ত এক ফোঁটা জল চোখ গড়িয়ে পড়েই গেল। কলরব বুঝলো এ কান্না আটকে রাখা এত সহজ নয়।

“আমি জানি আমি আর ৩০ বছর বাঁচলেও তুমি আমাকে হাজার বছরের সুখ দেবে।”

নিহিন কোনো কথা বলতে পারল না। কলরব ওর চোখ মুছে দিয়ে বলল, “কেঁদো না প্লিজ। তুমি কাঁদলে আমার বড় কষ্ট হয়। তোমার থেকে দূরে থাকার চেয়েও অনেক বেশি কষ্ট।”

নিহিন বলল,

“এটা সুখের কান্না।”

“না তুমি সুখেও কাঁদতে পারবে না। হাসবে শুধু।”

নিহিন ভেজা চোখেই হেসে বলল,

“আচ্ছা। আর কী গুরুত্বপূর্ণ কথা যেন আছে?”

“হুম, আর একটা কথা। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করব ভেবেছিলাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোমাকে জাস্ট জানিয়ে দিলেই হবে।”

“কী?”

“না মানে, কল্প আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না। বিয়ের পরও কিন্তু ও আমাদের সাথেই ঘুমাবে।”

“না, তা হবে না। তাছাড়া বিয়ের পর কল্প তোমার কাছে ঘুমাতেই চাইবে না।” চিন্তায় পড়ে গেল কলরব।

“পরি শোনো…”

ওকে থামিয়ে নিহিন বলল,

“তখন ও শুধু আমার সাথেই ঘুমাতে চাইবে।”

হাসল কলরব।

“তোমার মতো লক্ষ্মী বউয়ের কাছে এটাই আশা করা যায়।”

“কিন্তু তুমি ঘাবড়ে গিয়েছিলে।”

“ঠিক তা নয়।”

“দেখো কল্প আমারও ছেলে, আমার ছেলেকে নিয়ে তুমি অনেক ভেবেছো এই পাঁচ বছর। এবার আমাকে ভাবতে দাও তো।”

হাসল কলরব। নিহিন কলরবের বুকে মুখ ঘষছিল। কলরব বলল, “শুড়শুড়ি দিচ্ছ কেন?”

নিহিন এতক্ষণে ছাড়ল কলরবকে।

“তোমার শুড়শুড়ি আছে?”

কলরব খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল,

“হ্যাঁ আছে। তো, এমনভাবে বলার কী হলো?”

এবার কলরবকে শুড়শুড়ি দেওয়া শুরু করল নিহিন। কলরব তো রীতিমতো লাফাচ্ছিল আর হাসছিল,

“এই থামো, থামো বলছি। আমি ধরলে কিন্তু বাঁচবে না, খবর আছে।”

তবু নিহিন শুড়শুড়ি দিয়েই গেল। হঠাৎ কলরব নিহিনকে ধরে সামনের দিকে ফিরিয়ে ওর হাত দুটো পিছনে নিয়ে আসলো। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে পিছন থেকেই জড়িয়ে ধরে বলল,

“আমার বউটা খানিকটা দুষ্টু হয়েছে, অথচ তা টের পাওয়ার সুযোগই হয়নি আমার এতদিন।”

নিহিন লজ্জায় কিছু বলতে পারল না। কলরব ওর ঘারের ওপর থেকে চুল সরিয়ে আলতো করে চুমু খেল। ভালোলাগায় মরে যাচ্ছিল নিহিন। কলরব নিহিনের কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল। তারপর বলল,

“জানো শাড়ি পরে তোমাকে একদম বউ বউ লাগছে!”

নিহিন হাসল। কলরব বলল,

“দাঁড়াও…”

বলেই নিহিনের শাড়ির আঁচল তুলে মাথায় ঘোমটা পরিয়ে দিলো কলরব। তারপর এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল যে নিহিন লজ্জায় কুঁকড়ে গেল।

তারপর কলরব বলল,

“এখন একদম নতুন বউ। ওয়েট…”

তারপর কলরব আচমকা নিহিনকে কোলে তুলে নিয়ে আয়নার দিকে হাঁটতে লাগল। নিহিন তাকাতেই পারছিল না, শুধু ভাবছিল এ সময়টাকে যদি আটকে দেয়া যেত। আয়নার সামনে গিয়ে ও দাঁড় করিয়ে দিলো নিহিনকে। তারপর বলল,

“দেখো, কী অসাধারণ লাগছে। নিহিন কিছু বলল না। কলরবই আবার বলতে শুরু করল,”

“শুধু একটা জিনিস মিসিং, নাকে যেন কী একটা দেয়, নাক থেকে কান পর্যন্ত..”

“নথ।”

“হ্যাঁ নথ। আরো একটা জিনিস যেটা কপালে দেয়।”

“টিকলি?”

“না, টিকলির পাশে যেটা দেয় এভাবে।”

নিহিনের মাথায় হাত দিয়ে এঁকে দেখালো। নিহিন বলল, “টায়রা।”

“হ্যাঁ, ওটাও মিসিং। এই দুটো জিনিস হলেই বিয়ের কনে মনে হতো। আর এখন সদ্যবিবাহিত নতুন বউ বলে মনে হচ্ছে। উফ পাগল হয়ে যাচ্ছি। শোনো আজ আমি চরিত্রহীন হতে চাই।”

“ইশ!”

নিহিন সরিয়ে দিতে চাইল কলরবকে। কিন্তু ও এমনভাবেই ধরেছে যে পারল না।

তারপর কিছুক্ষণ নিহিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

“আচ্ছা, মনে আছে ছোটবেলার একটা কথা। তোমাদের ছাদে একদিন দেখা করতে গিয়েছিলাম। একটা কাজ করব বলেছিলাম আর তুমি কেঁদে ফেলেছিলে। তোমার কান্না দেখে আমি বলেছিলাম, এসব করা দূরের কথা আর এসব বলবও না, তুমি বড় হলে করব। পরি এখন কিন্তু তুমি বড় হয়ে গেছ। সুতরাং…”

একথা শুনেই নিহিনের মনে পড়ে গেল। লজ্জায় মাথা নিচু করে হেসে ফেলল।

কলরব বলল,

“দেখেছ আগে যে কথা শুনে কাঁদতে, এখন সেকথা শুনে হাসছ।

একথা শুনে ধ্যাত বলে সরে যেতে চাইলো নিহিন। কিন্তু যথারীতি কলরবের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারল না নিহিন। কলরব বলল,

“এত সোজা না।”

তারপর কলরব দুহাতে নিহিনের মুখটা তুলে ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল।

কিছুক্ষণ পর বেল বাজতেই সরে গেল নিহিন,

“আংকেল আর কল্প এসেছে। আমি দরজা খুলতে যাচ্ছি।”

“দাঁড়াও।”

“কী?”

“বলো বাবা আর কল্প এসেছে।”

নিহিন হেসে বলল,

“বাবা আর কল্প এসেছে।”

“এই তো এখন কল্পর মায়ের মতো লাগছে!”

নিহিন আবার হাসল। কলরব কেকটা হাতে নিয়ে বলল,

“কেকটা রান্নাঘরে রেখে আমি দরজা খুলছি। তুমি মোমগুলো ঝটপট সরিয়ে ফেলো। এগুলো দেখলে কল্পর মন খারাপ হতে পারে, ওকে রেখে আমরা সেলিব্রেট করেছি ভেবে।”

“আচ্ছা।”

দরজার দিকে রওনা হয়েই ফিরে তাকাল কলরব। বলল,

“ঘোমটা টা ফেলো। নাহলে কল্প হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। আর ওর হাজারটা প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।”

নিহিন লজ্জা পেয়ে ঘোমটা ফেলে দিলো। কতদিকে খেয়াল কলরবের! ঘরের দরজার বাইরে গিয়ে আবার উঁকি দিলো কলরব,

“শোনো..”

নিহিন তাকাতেই বলল,

“শশুরআব্বা এবারও ফিরিয়ে দিলে তুলে নিয়ে আসব তোমাকে।”
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp