শেষ পর্যন্ত মীরাকে বলেই ফেললাম এই সম্পর্কটা আমাদের আর আগানো উচিত না। মুহূর্তেই মীরা পাগল হয়ে গেল। কান্নাকাটি করে একাকার অবস্থা। যতকিছুই বোঝাই না কেন সে কিছু বুঝতে নারাজ। বারবার একই কথা,
রাফি তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব, যা বলবে তাই করব। আমাকে ছেড়ো না।
বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করো মীরা। আমি তোমাকে শখে ছাড়ছি না। এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
ভবিষ্যৎ আছে। আমার বাসায় না মানলে আমি পালিয়ে যাব।
অসম্ভব। আমার বোন যদি কারো সঙ্গে পালিয়ে যায় আমি মনে হয় মরেই যাব। তাই অন্যকারো বোনকেও আমি ভাগিয়ে আনব না।
আচ্ছা পালাব না। আমি যেভাবে হোক ম্যানেজ করব।
তুমি কেন আমার সঙ্গে থাকতে চাচ্ছ মীরা? আমার সঙ্গে তো তুমি ভালো নেই।
খুব ভালো আছি। কে বলেছে ভালো নেই? আচ্ছা আমি তোমার বিষয়ে নানা ধরনের অভিযোগ করেছি বলেই তো এসব বলছো? আর কখনো কোনো অভিযোগ করব না। সপ্তাহে একবার ফোন না করলেও কিছু বলব না। আমার ফোন না ধরলেও কিছু বলব না। দেখা না করলেও কিছু বলব না।
মীরার কণ্ঠে আকুতি। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
তুমি বুঝতে পারছ না মীরা!
আমি বুঝতে পারছি। তুমি বুঝতে পারছ না। তোমাকে আমি প্রোপোজ করিনি তুমি আমাকে করেছে। আমি প্রেম-ভালোবাসা বুঝতাম না। তুমি আমাকে বুঝিয়েছো। তুমি শিখিয়েছে। এখন কীভাবে আমাকে মাঝসমুদ্রে ফেলে চলে যাওয়ার কথা বলতে পারছো?
সব স্বীকার করছি। তোমার প্রত্যেকটা কথা সত্য। কিন্তু পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গেছে। আমি যদি তখন আজকের পরিস্থিতিতে থাকতাম তাহলে কখনোই তোমাকে প্রেম বোঝাতে যেতাম না।
আমি কিছু জানি না। কিছু জানি না। কিছু জানি না।
মীরা উভ্রান্তের মতো আচরণ করছে। এত কান্না আমি আর নিতে পারছি না। কোনো উপায় না দেখে বললাম,
আচ্ছা এসব বাদ। আপাতত শান্ত হও।
আমি শান্ত হব না। আমি মরে যাব তবু শান্ত হব না।
কেন শান্ত হবে না? ভালোবাসি না তোমাকে?
মীরা শান্ত হলো বটে। কিন্তু আমি হলাম দিশেহারা। কূল-কিনারা খুঁজে না পাওয়া এক ব্যর্থ নাবিক।
—————
আমার কথা শেষ হলে রাহি এসে বলল,
খুব ভুল করছিস কিন্তু ভাইয়া।
বুঝতে পারলাম ও আমার কথা শুনতে পেয়েছে। বললাম,
এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ভালোবাসা এত হিসাব করে চলে?
তুই এত বড় বড় কথা বলিস না। আসছে ভালোবাসাবিদ।
আমার কেউ থাকলে আমি কখনোই এমন করতাম না।
নেই তো বেঁচে গেছিস। থাকলে বুঝতি। রাহি যা তো এখান থেকে।
আমি যাব না। একটা মেয়েকে তুই এভাবে কষ্ট দিবি? ভবিষ্যতে কী হবে সেটা নাহয় তখন দেখা যাবে।
তখন কষ্ট আরো বেশি হবে। যে সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই সেটা বয়ে বেড়ানো কোনো মানে হয় না। শুধু শুধু মায়া বাড়ানো।
এভাবে তোরা সুখী হবি ভাবছিস?
হব। মীরাও হবে। হা প্রথমে কষ্ট পাবে এরপর একদিন সয়ে যাবে। প্রতিদিন তিলে তিলে কষ্ট পাওয়ার থেকে একবারে কষ্ট পাওয়া ভালো। ও আমার সঙ্গে ভালো নেই।
খুব ভুল করছিস ভাইয়া। এই খারাপ সময়টাতে তোর উচিত ওকে আঁকড়ে ধরে থাকা।
সেটা স্বার্থপরতা।
রাহি আর কথা বাড়াল, চলে গেল। অর্থাৎ এই যুক্তির পর ওর আর কিছু বলার নেই।
রাফসান শিকদার
০৫ আগস্ট, ২০১১
মা কোথায় তুমি? আমার বিশ্বাস তুমি বেঁচে আছো। বেঁচেই যদি থাকো তো ফিরে আসো মা। প্লিজ ফিরে আসো। আমি আর পারছি না।
রাফসান শিকদার
১২ আগস্ট, ২০১১
মীরাকে আরো কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দেব। এ ছাড়া উপায় নেই আসলে। তার আগে শেষবারের মতো মীরাকে দেখতে ঢাকা গেলাম। আজ সারাদিন ছিলাম ওর কাছে। সবকিছু ওর ইচ্ছেমতো করেছি। আমাকে এত দীর্ঘ সময় কাছে পেয়ে ও খুব খুশি ছিল। চলে আসার আগে খোলা রাস্তাতেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম, শেষবারের মতো! এই সুযোগ তো আর কোনোদিন আসবে না। কোথায় আছি কীভাবে আছি, লোকে দেখলে কী ভাববে সেসব ভাবনার বাইরের কোনো জগতে ছিলাম তখন। যে জগতে বাকি জীবনের জন্য তখনকার অনুভূতি আর স্পর্শগুলোকে জমা করছিলাম, শেষবারের মতো!
রাফসান শিকদার
১৯ আগস্ট, ২০১১
প্রতিদিন রাত হলে মীরাকে ফোন করতে ইচ্ছে করে। এতদিনের অভ্যাস, এত সহজেই ছাড়া যায় না। আমি সিম খুলে রেখেছিলাম। প্রতিদিন ফোনটা হাতে নিই। তীব্র ইচ্ছে হয় সিম ঢুকিয়ে ওকে একটা ফোন করি। পরক্ষণেই মনে হয় কত কষ্টে এই কঠিন কাজটা করেছি। একটা ফোনেই আবার সব এলোমেলো হয়ে যাবে। সিমটা ভয়ানক বিপজ্জনক। তাই ওটাকে দু-টুকরো করে জানলা দিয়ে নদীতে ছুঁড়ে ফেললাম। ফোনটা বিক্রি করতে দিতে হবে। এটা থাকলে এই ইচ্ছে হতেই থাকবে। ফোন আমার জন্য জরুরি কিছু না।
রাফসান শিকদার
২৪ আগস্ট, ২০১১
এই কয়মাসে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। তার সঙ্গে মোবাইল বিক্রির টাকা ভরে গ্যাস আনার ব্যবস্থা করলাম। রাহির লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে অনেক কষ্ট হতো। যাক মোবাইল বিক্রির টাকাটা একটা ভালো কাজে লাগল।
রাফসান শিকদার
৩০ আগস্ট, ২০১১
আচ্ছা কেমন আছে মীরা? খুব কি ছটফট করছে? নাকি এতদিনে কিছুটা শান্ত হয়েছে?
হে আল্লাহ! ওর ভেতরের সব অস্থিরতা তুমি আমাকে দাও। আমার যদি বিন্দুমাত্র শান্তি থাকে সেটুকু তুমি ওকে দিয়ে দাও। ওকে তুমি ভালো রেখো।
রাফসান শিকদার
০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১
আমাদের গলির এক বাড়িওয়ালা আমার ছাদের গাছগুলো কিনে নিলেন। অভাবে পড়ে কতকিছু বিক্রি করলাম কিন্তু এই প্রথম কিছু বিক্রি করার সময় হারানোর তীব্র কষ্ট অনুভব করলাম। গাছগুলো আমার সন্তানের মতো ছিল। বেশির ভাগ ফলের গাছ ছোট কলম থেকে এতবড় করা। ফুলগাছগুলো বেশির ভাগ বীজ বা নার্সারি থেকে আনা পাঁচ-ছয় ইঞ্চি ছোট চারা থেকে করা। ভালো হয়েছে বিক্রি করে দিয়েছি। গাছের মেডিসিন, খাবার এটা সেটা কত খরচের ব্যাপার। তার ওপর এখন গাছের যত্ন নেয়ার মতো সময় আমার হাতে থাকে না। যেগুলো উঠানের মাটিতে করা সেগুলো তো রইলই। এগুলো যেহেতু টবে বা ড্রামের সীমিত মাটিতে করা তাই যত্ন না পেলে ধীরে ধীরে মরে যাবে। মরে যাওয়ার চেয়ে অন্যের বাড়ি আলোকিত করুক যেমনি করে মীরাও একদিন অন্যের বাড়ি আলোকিত করবে!
রাফসান শিকদার
১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১১
·
·
·
চলবে...................................................................................