ফানুস - পর্ব ১২ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          ঘুম থেকে উঠে প্রিয় দেখল নটা বেজে গেছে। ইশ, অফিসে লেট হয়ে যাবে আজ। তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। মাথাটা চেপে ধরে আবার বসে পড়ল প্রিয়। নিকিতা বলল, ‘খারাপ লাগলে আজ অফিসে যেয়ো না।”

প্রিয় পেছনে তাকিয়ে দেখল নিকিতা বিছানার পাশে বসে আছে। প্রিয় বলল, ‘না, যেতে হবে।

তারপর নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাল মে বি আমি একটু সেন্টি হয়ে গিয়েছিলাম, না?

নিকিতা সামান্য হাসল। প্রিয় বলল, ‘ফরগেট ইট।’

এরপর প্রিয় গোসল করতে ঢুকল! গোসল করলে হয়তো ভালো লাগবে।

‘এই তাহলে তোমার কাহিনি! ফুল অব ট্র্যাজেডি!

স্মরণ বলল। এ কথা শুনে পেট্রা আনমনা হয়ে বলল, ‘ট্র্যাজেড়ি! হুম, হয়তোবা।

স্মরণ খেতে খেতে বলল, ‘এসব কাহিনি আসলে খেতে খেতে শুনতে হয় না। এসব বলতে গিয়ে কিছুই খেলে না তুমি। আমি কিন্তু ঠিকই খাচ্ছি।’

পেট্রা হেসে বলল, ‘হুম, কারণ, কাহিনিটা আমার। তোমার নয়।

‘আমার কাহিনি ভাই এমন ট্র্যাজিক না। কী হয়েছিল, আমি জানতেই পারি নি। যদিও আমি অনেস্ট ছিলাম এবং ভালোবাসতাম, তবু খুব তাড়াতাড়ি সামলে উঠতে পেরেছিলাম। কষ্ট থেকে বেশি ছিল আমার অপমানের অনুভূতি। তোমাদের মতো ভালোবাসা আমাদের ছিল না।

‘স্বাভাবিক, কারণ, আমাদের প্রেম-বিয়ে মিলিয়ে দশ বছর সম্পর্কের পর ডিভোর্স হয়, তারপরও আরও দুই বছর আমরা সম্পর্ক রেখেছিলাম। এরপর তো তার বিয়ে হয়ে গেল। তার বিয়ের পর থেকে আমরা কোনো সম্পর্ক রাখি নি। তারপর আরও দুই বছর হয়ে গেল। সম্পর্ক হওয়ার আগে আবার ছয় বছর ধরে ক্লাসমেট ছিলাম। সব মিলিয়ে বিশ বছর ধরে পরিচিত আমরা। আর তোমাদের তো মাত্র এক-দেড় বছরের সম্পর্ক। সময় আসলে একজন মানুষকে আরেকজন মানুষের ভেতরে নিয়ে যায়, এ রকমই মনে হয় আমার।’

স্মরণ অবাক হয়ে বলল, ‘বাপরে! এত বছর! যখন তোমাদের কাহিনি শুনছিলাম, তখন মনে হয় নি আমি বিশ বছরের কাহিনি শুনছি। অথচ দেখো হিসাবে বিশ বছর এসে গেল।

পেট্রা ম্লান মুখে একটু হাসল। স্মরণ বলল, ‘কিন্তু তোমাকে দেখে আমার ভালো লাগছে। সব মেয়ে যদি তোমার মতো হতো, তাহলে খুব ভালো হতো।

কেমন?

‘এই যে, যত দিন সম্পর্ক ছিল, উড়াধুরা ভালোবেসেছ। এখন আবার বাস্তবতার চাপে পড়ে সব মেনে নিয়ে শক্ত, স্বাভাবিক হয়ে আছ। এটা খুব কঠিন কাজ পেট্রা, সবাই পারে না। আজ তোমার ওপর রেসপেক্টটা খুব বেড়ে গেল।’

পেট্রার ঠোঁটে আবার সেই ম্লান হাসি। স্মরণ বলল, ‘প্লিজ পেট্রা, এভাবে হেসো না। সব সময়কার মতো মন খুলে হাসো{

পেট্রা কিছু বলল না। স্মরণই সবকিছু নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বলল, একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরো না। শুদ্ধর বাবার কিন্তু অনেকগুলো ভুল ছিল। মুসলমান হয়ে তোমাকে ভালোবাসাটা আমি ভুল বলছি না, কিন্তু তারপরও কিছু সিদ্ধান্ত তার ভুল ছিল। যেমন, তোমাকে মেডিকেলে পড়তে না দেওয়া, বিয়ে করা, বাচ্চা নেওয়া। এসব ভুল সিদ্ধান্ত না নিলে আজ তোমার জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।

পেট্রা পানি খেয়ে বলল, ‘সিদ্ধান্ত তার ছিল, আমি তাতে নিষেধ করি নি। সে বয়সে আমার চেয়ে এক বছরের বড় কিন্তু ম্যাচিওরিটির দিক দিয়ে আমার থেকে মিনিমাম দশ বছরের ছোট। আগেও ইমম্যাচিওর ছিল, এখনো আছে। তাকে আমি শাসন করতাম, কিন্তু সব ব্যাপারে করতে পারি নি। বাধা দিতে পারি নি অনেক ক্ষেত্রেই। কেন তা ঠিক জানি না। সে পাগলের মতো ভালোবাসত আমাকে। একদিন আমাকে না দেখলে রাতে ঘুমাতে পারত না। আমি ছাড়া তার চারদিক অন্ধকার ছিল। প্রচণ্ড

নির্ভরশীল ছিল আমার ওপর। তুমি জানো সে জুতোর ফিতা বাঁধতে পারত না। বাসা থেকে মা বেঁধে দিত। কিন্তু স্কুলে এসে খেলতে গিয়ে জুতা খুললে বা কোনো কারণে খুলে গেলে সে মহাবিপদে পড়ত, আমি তখন তার জুতার ফিতা বেঁধে দিতাম। সবাই হাঁ করে চেয়ে দেখত, তাতে আমাদের কিছু যেত-আসত না। হাত-পায়ের নখ বড় হয়ে যেত, কাটতে পারত না। মায়ের কাছে গেলে মা দিত বকা, এত বড় হয়ে গেছিস, এখনো নখ কাটতে পারিস না? তখন আমার কাছে আসত। আমি কেটে দিতাম। তার নিত্যদিনের এমন হাজারো কাজ আমি করে দিয়েছি। এসব আমি খুব উৎসাহ নিয়ে করতাম। এমনকি একসাথে বসে আমি আমাদের ছেলের নখও কেটেছি, ছেলের বাবার নখও কেটেছি। শেষ যেদিন বাসা থেকে দুজন একসাথে বেরিয়েছি, সেদিনও তার জুতার ফিতাটা আমিই বেঁধে দিয়েছিলাম। কে জানে এখন কীভাবে চলে তারা হয়তো সব শিখে নিয়েছে এত দিনে।

স্মরণের বলতে ইচ্ছা করল, তার তত বউ আছে, সে-ই হয়তো করে দেয়। কিন্তু বলল না। এ কথা বললে হয়তো পেট্রা আবার কষ্ট পাবে। বলল, ‘হি ওয়াজ টু মাচ লাকি।’

‘মি অলসো। আমরা দুজন যতটা লাকি, ততটাই আনলাকি।’

স্মরণ প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, আচ্ছা, ওই মেয়েটা পরে ঝামেলা করে নি, স্কুলে যে মেয়েটার সাথে মিশে উনি তোমাকে জেলাস করেছিলেন?

না তো, সে ওই মেয়েটাকে সব জানিয়েই করেছিল, সবাই মিলেই প্ল্যান করেছিল।

স্মরণ হেসে বলল, ‘আচ্ছা, আর প্রপোজালের সময় উনি যে কিছু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ওগুলো কি রেখেছিলেন?

‘হ্যাঁ, সব। এমনকি, আমার সব প্র্যাকটিক্যাল সে এঁকে দিয়েছিল। লিখলে তো ধরা খাব, তাই লিখেছি আমিই। তবে আমি নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম, দরকার নেই। আমারটা আমিই করি। দুজনেরটা একা করতে তোর কষ্ট হবে। সে বলেছিল, আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি আমার প্রতিজ্ঞা ভাঙব না। কিন্তু আসল প্রতিজ্ঞা, আই মিন, সারা জীবন আমার সাথে থাকার প্রতিজ্ঞাটা রাখতে পারে নি শুধু। তবে আমি তাকে দোষ দিই না, দোষ আমাদের ভাগ্যের।

স্মরণ আর কিছু বলল না। পেট্রা বুঝতে পারছিল, সে আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে, তাই প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু তুমি এসব জানার জন্য এত উতলা কেন হয়ে ছিলে? এই ডিনারের নিমন্ত্রণ তো আমার কাহিনি শোনার জন্যই, তাই না?

স্মরণ লাজুক মুখে হাসল। তারপর আবার বেহায়ার মতো বলল, ‘হুম, তবে মূল কারণ ছিল তোমার সঙ্গ পাওয়া। তোমার সঙ্গ খুব ভালো লাগে।’

পেট্রা কঠিন চোখে স্মরণের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্মরণ, কন্ট্রোল ইওরসেলফ। আমার জীবনে অনেক সমস্যা, এর মধ্যে নিজেকে জড়িয়ো না। তুমি ছোট নও, আশা করি তুমি বুঝবে!

‘দেখো পেট্রা, বিয়ে তো করবে তুমি, তাই না?

‘হ্যাঁ, আমার মাকে শান্তি দেওয়ার জন্য বিয়ে করতে হবে। সারা জীবন আমি তাদের কোনো শান্তি দিতে পারি নি। তাঁদের সম্মানও রাখতে পারি নি। তাই এখন মা যেভাবে চায়, আমি সেভাবেই চলি।

‘হ্যাঁ, কিন্তু…’

‘কিন্তু?

স্মরণ ইতস্তত করে বলল, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, পেট্রা।

পেট্রা অবাক হলো না। সে জানত, আরেকটা পাগলের পাল্লায় পড়তে যাচ্ছে। বলল, ‘স্মরণ, সব জেনেশুনে তুমি পাগলের মতো কথা বলছ কেন? আমি তোমাকে বিয়ে করব কীভাবে? আর তুমিই-বা কীভাবে করবে?

‘তুমি অনুমতি দিলে আমি আমার বাসায় কথা বলব।

‘কোনো দরকার নেই। আমার মা অনেক কথা শোনাবে আমাকে। বলবে মুসলিম ছেলে ছাড়া আমি কিছু চোখে দেখি না।

‘মাকে মানাও না, পেট্রা। আমার কখনো কাউকে এতটা ভালো লাগে নি, যতটা তোমাকে লাগে।’

‘কেন মানাব? আর মানানোর কথা আসছে কোথা থেকে? তোমার সাথে আমার কী সম্পর্ক? তা ছাড়া, আমি কখনো তোমাকে ভালোবাসতে পারব না।

‘সে তো তুমি কাউকেই ভালোবাসতে পারবে না। তোমার ধর্মের কারও সাথে বিয়ে হলেও পারবে না। কারণ, শুদ্ধর বাবার জন্য যে অনুভূতি তোমার, সেটা আর কারও জন্য আসবে না। তোমরা দুজন দুজনের। শুধু ভাগ্যের ফেরে তোমরা আলাদা হয়ে গেছ।

‘এটা জেনেও তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছ কেন?

‘কারণ, আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। বললাম না তোমার সঙ্গ আমার ভালো লাগে। আমি তোমাকে ভালোবাসি, পেট্রা।

‘তুমি আমার ছেলের চেয়েও ইম্যাচিওর।

স্মরণ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। পেট্রা বলল, এখন তোমার কাছে সবকিছু যতটা সহজ আর সুন্দর মনে হচ্ছে, সত্যি এমন কিছু ঘটলে দেখবে–সবটাই ঘোলাটে। বুঝবে চরম ভুল করেছ তুমি। আমি আমার জীবনটাকে আর জটিল করতে চাইছি না।’

স্মরণ তাকিয়ে রইল পেট্রার দিকে। পেট্রা চোখ ফিরিয়ে নিল। স্মরণ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিল, ‘বিয়ে আমি তোমাকেই করব, পেট্রা। যে যে সুখ তোমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, সব ফিরিয়ে এনে দেব। তোমার ভালোবাসা আমার না হলেও চলবে!’

—————

স্মরণ পেট্রাকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফেরার সময় বুথে ঢুকল টাকা ওঠাতে। বুথ থেকে বের হতেই দেখা হয়ে গেল প্রিয়র সঙ্গে। প্রিয় একগাল হেসে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আরে স্মরণ! কী খবর?

স্মরণও হেসে হ্যান্ডশেক করে বলল, এই তো ভাইয়া, খবর সব ভালো। আপনি কেমন আছেন?

‘আছি ভালো। তুমি জিমে আসো না কেন? অনেক দিন দেখি না।

‘জবে জয়েন করেছি, ভাইয়া, অফিস করে পরে আর সময় পাই না।’

‘ধুর মিয়া, আমাদের অফিস দেখিয়ো না। আমরা অফিস করি না? অফিস করেই তো আসি।’

স্মরণ বলল, আপনাদের মতো এনার্জি আমার নাই, ভাইয়া। প্রিয় হেসে বলল, ‘বিয়েশাদি করেছ নাকি?

স্মরণ লজ্জা পেয়ে বলল, ‘আরে না, ভাইয়া, ও রকম কিছু না।

‘তাহলে জিমে আসা শুরু করে আবার। না হলে দেখবে এমন সুন্দর শরীর দুদিন পর ঢোল হয়ে যাবে।’

স্মরণ হাসতে লাগল। পরক্ষণেই খেয়াল করল, প্রিয়র হাতে চিকেন ফ্রাইয়ের পার্সেল। জিজ্ঞেস করল, আপনি এসব খান নাকি?

‘মাঝেমধ্যে খাই।’

‘জিম করে আবার তেলের জিনিস খান!

‘তাতে কী? এসবই তো জীবনের আনন্দ। যখন যা করতে ইচ্ছা হয় করি, যা খেতে ইচ্ছা হয় খাই। এতে মেন্টাল পিস পাওয়া যায়। আমি এখন আর কোনো কিছু বেছে খাই না, সব খাই। তবে এটা আমার বাচ্চার জন্য নিচ্ছি, খুব পছন্দ করে। বেড়াতে গিয়েছিল, আমাকে নাকি খুব মিস করছিল, তাই চলে এসেছে। এখন আমি ওর পছন্দের জিনিস না নিয়ে যাই কী করে, বলো?

স্মরণ অবাক হয়ে বলল, ‘ভাইয়া, আপনার বাচ্চাও আছে?

হ্যাঁ, অবশ্যই আছে।’

‘আমি ভেবেছিলাম আপনার বিয়েই হয় নি।

প্রিয় হেসে দিল। তারপর বলল, ‘জিমে আসো, ভাই। তাহলে তোমার বাচ্চাও বড় হয়ে যাবে অথচ তোমাকে অবিবাহিত লাগবে।’

এ কথা বলেই প্রিয় চোখ মারল। স্মরণ বলল, ‘আচ্ছা ভাইয়া, আমি সামনের মাস থেকে আবার আসব। মাত্র দুই মাস হলো জবে জয়েন করেছি, একটু গুছিয়ে নিই সব।

‘শিওর।’

‘আচ্ছা ভাইয়া, রাত অনেক হয়ে গেছে, আজ তাহলে আসি।

‘আচ্ছা।

‘আপনি এখন কটায় যান জিমে?

‘এখন একটু দেরি হয়ে যায়। অফিস থেকে কখন ফিরি, তার ওপর নির্ভর করে। তবে আট-নয়টার মধ্যেই যাই।’

‘আচ্ছা, তাহলে আমিও এই সময়ে আসব। আপনাকে দেখে আমি অনেক অনুপ্রেরণা পাই।

প্রিয় সম্মতিসূচক মাথা কাত করে বলল, তুমি শুধু আসো। বাকিটা আমরা দেখে নেব।’

—————

ছুটির দিন, আরামের দিন। দুপুর পর্যন্ত ঘুমানোর পরিকল্পনা ছিল কিন্তু সকাল আটটা বাজতেই ঘুম ভেঙে গেল প্রিয়র। সব সময় এমনটাই হয়। কিছু করার নেই, বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করার পর উঠে গেল।

নাশতা করেই প্রিয় শুদ্ধকে নিয়ে বাজার করতে গেল। বাজার করা ওর খুব পছন্দের কাজ। ইদানীং শুদ্ধও খুব উপভোগ করে। তাই তাকেও নিয়ে যায় মাঝেমধ্যে। বাজার থেকে ফিরে টিভির সামনে বসে ছিল। হঠাৎ প্রিয়র মনে হলো নিকিতাকে বলেছিল রান্না শেখাবে। আজ মন্ত্রীসাহেব বাসায় নেই। ওকে রান্নাটা শেখানোই যায়। তিনি থাকলে কখনোই এটা করা যাবে না, তাহলে তিনি ভাববেন তিনি জিতে গেছেন।

প্রিয় রান্নাঘরে ঢুকে দেখল নিকিতা টুকটাক গোছাচ্ছে। মানিকের মা মাছ কেটে ধুয়ে রান্না করতে যাচ্ছে। প্রিয় বলল, ‘খালা, আজ তোমার রান্না করতে হবে না। তুমি তোমার ঘরে যাও।’

মানিকের মা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে হাঁ করে চেয়ে রইল। প্রিয় বলল, ‘আজ আমার রান্না করতে ইচ্ছা করছে।’

মানিকের মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চলে গেল। নিকিতা বলল, ‘আজ তোমার ছুটির দিন, রেস্ট নিতে।

প্রিয় এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘না, আজ তোমাকে রান্না শেখাব।

নিকিতা উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এল। হেসে বলল, ‘সত্যি!

প্রিয় গম্ভীরভাবে বলল, ‘হুম। মনোযোগ দিয়ে দেখবে, পরেরবার যখন তুমি রান্না করবে, তখন যাতে উল্টোপাল্টা না হয়।’

নিকিতা হেসে বলল, ‘ঠিকাছে।’

প্রিয় রান্না করতে শুরু করল। নিকিতা বলল, ‘আচ্ছা, তুমি রান্না কোত্থেকে শিখলে? তুমি তো নখটাও কাটতে জানো না। তাহলে রান্নার মতো একটা কঠিন কাজ কী করে পারো?

প্রিয় অবাক হলো। এ কথা নিকিতা জানল কীভাবে! কড়া চোখে তাকাল নিকিতার দিকে। নিকিতা থতমত খেয়ে বলল, ‘না, মানে, বাবা বলেছে।’

প্রিয় বলল, ভাইজানের সাথে একা থাকতাম। বুয়া না এলে আমাদেরই রান্না করে খেতে হতো। তাই বেসিক রান্না পারতাম। ডাল, ভাত, ভর্তা, ডিমভাজি–এগুলো ভাইজানের কাছ থেকেই শিখেছি। বাকি সব রান্নার শো দেখে। পেট্রাও ভালো রান্না জানত না। ওকেও শিখিয়েছি।

কেমন যেন নিভে গেল নিকিতা। রান্না শেখার কথা জিজ্ঞেস করে একী বিপদে পড়া গেল? এখন কি প্রতিদিনই ওর কথা শুনতে হবে নাকি? প্রিয় আবার রান্নায় মনোযোগ দিল।

—————

স্মরণ অফিস থেকে ফেরার আগেই ওর বাবা ফেরে, তাই মাকে তেমন একা পাওয়া যায় না। আবার ছুটির দিনেও তো বাবা বাসায়ই থাকে, তাই শেষ পর্যন্ত স্মরণ মাকে ইশারা দিয়ে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে এল। মা বললেন, ‘কী হয়েছে? এত ফিসফাস কেন?

‘মাম্মা, খুব জরুরি কথা আছে তোমার সাথে।

‘তো বল, এত গুজুরগুজুর, ফুসুরকাসুর কিসের?

‘না…মানে…মাম্মা, আমি যদি কাউকে বিয়ে করতে চাই, তোমরা রাজি হবে?

মা হেসে বললেন, ‘পাগল ছেলে, কত দিন ধরেই তো তোর বাবা জিজ্ঞেস করছিল তোর পছন্দের কেউ আছে কি না। তুই-ই তো ধানাইপানাই করছিস। একবার একটা মেয়ের কথা বলেছিলি, তারপর তো আর কিছুই বললি না।

তার মানে, আমি যাকেই চাইব, তোমরা রাজি হবে।

‘অবশ্যই। তোর সুখই তো আমাদের সুখ।

‘যদি মেয়েটা খ্রিষ্টান হয়?

মায়ের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন, ‘কী বলছিস এসব? খ্রিষ্টানের সাথে মুসলমানের বিয়ে আবার কী করে হয়?

‘মাম্মা, দুনিয়াতে তো এমন অনেক নজির আছে।

মা স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘তোর বাবা রাজি হবে না।

‘ভালোবেসে ফেলেছি, মাম্মা।

মায়ের বুক কেঁপে উঠল। ছেলে একী ভয়ংকর কথা বলছে! বললেন, ‘আমি কিছু জানি না, বাবাকে গিয়ে বল।

স্মরণ মায়ের হাত দুটো ধরে বলল, ‘মাম্মা, ও মাম্মা, বাবাকে বলতে পারব না বলেই তো তোমাকে বলছি। আর ওর বাবা নেই, ওর মা সম্ভবত রাজি হবে না সহজে। তুমি রাজি করাবে। আমি ওকে চাই, ওকেই চাই।

মা পড়লেন আরেক বিপদে। বললেন, ‘আরে, এটা কি বাজারে কিনতে পাওয়া যায় নাকি যে বললেই এনে দেব? মেয়ের মায়ের কথা

আমি জানি না, কিন্তু তোর বাবাকে এই কথা বলার মতো সাহস আমার। নেই। এমন আবদার করার আগে…’

স্মরণ আঁতকে উঠল, ‘স্টপ স্টপ…আর কিছু বোলো না। আল্লার দোহাই লাগে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল কোরো না, মাম্মা। ওকে আমার লাগবেই, ওকে না পেলে আমি কোনোদিন বিয়ে করব না।’

‘কিচ্ছু বলার নেই আমার। এসব কথা তুই তোর বাবাকে গিয়ে বল।

এ কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মা। স্মরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়ল। এমন হলে কী করে হবে? কী করবে সে এখন?

—————

শুদ্ধ অনেকক্ষণ বাবাকে না দেখে নিকিতাকে জিজ্ঞেস করার জন্য রান্নাঘরের দিকে গেল। দূর থেকেই দেখতে পেল বাবা রান্না করছে আর কী যেন বলছে। ওদিকে নিকিতা আন্টি হাসি হাসি মুখ করে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শুদ্ধর খুব খারাপ লাগল। তার মনে হলো, নিকিতা আন্টির জায়গায় যদি মা থাকত, তাহলে মায়ের কোলে বসে বাবার রান্না দেখতে পারত! সবার মা-বাবা তো একসঙ্গে থাকতে পারে, তাহলে তার মা-বাবা কেন একসঙ্গে থাকতে পারে না? কে জানে কেন!
·
·
·
চলবে..................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp