মা আর কিছুই বলল না। কেমন একটু মিইয়ে গেল। ভদ্রমহিলা গল্প বলতে শুরু করলেন,
“আমার নাম শ্যামা। হাতে সময় বেশি নেই তাই আমি গল্পটা খুব ছোট করে বলছি। আমি ইন্টারের পর গ্রাম থেকে ঢাকায় আসি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য। ইউনিভার্সিটির হলেই থাকতাম। বেশ কিছুদিন পর আমার একজনের সাথে সম্পর্ক হয়। ওর নাম সিফাত। আমাদের ইউনিভার্সিটিরই দুই বছরের সিনিয়র ছিল। ও ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। ওর বাবা অস্ট্রেলিয়াতে থাকত। উনি হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল সপরিবারে ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে। সিফাত আমাকে খুব ভালোবাসত, আমাকে ছেড়ে যাবে না আর তখনো গ্রাজুয়েশন শেষ হয়নি, আমার কথা তখন বলতেও পারবে না বাসায়। তাই পড়াশোনা ও নানান অজুহাত দিয়ে দেশে রয়ে গেল সিফাত। ওর বাবা-মা, ছোটবোন সবাই চলে গেল অস্ট্রেলিয়া। তারপর ও একা হয়ে গেল। যতক্ষণ ইউনিভার্সিটি থাকত, আমার সাথেই থাকত। বাসায় গেলে বড্ড খারাপ লাগত ওর, তখন তো এখনকার মতো ফোন অ্যাভেইলেভেল ছিল না। তাই আমরা একটা পাগলামি করলাম। হঠাৎই আমরা বিয়ে করে ফেললাম। ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া করে আমরা সংসার শুরু করলাম। খুব সুখে ছিলাম আমরা।
একদিন খবর এল সিফাতের মা খুব অসুস্থ। ওর বাবা কিছুদিনের জন্য ওকে যেতে বলল। ও আমাকে একা রেখেই চলে যেতে বাধ্য হলো। যাওয়ার আগে ওর খুব মন খারাপ হলো। যাওয়ার আগে আমাকে বারবার করে বলে গেল…মন খারাপ করো না, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসব। ও গিয়ে চিঠি পাঠাল। এরপর থেকে আমরা নিয়মিত দুজন দুজনকে চিঠি লিখতাম। ও যাওয়ার এক মাসের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম আমি আর একা নেই। বুঝতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি। সিফাতকে জানাতেই ও ভীষণ খুশি হলো। বলল যেভাবেই হোক ও বাবাকে রাজি করিয়ে আসছে। কিন্তু এক মাস দু মাস তিন মাস কেটে গেল। সিফাত আর এল না। আমার চিঠিগুলো ফেরত আসতে লাগল। কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। আমি আমার ফ্যামিলিতেও কিছু জানাতে সাহস পেলাম না। তখন সিফাতের ক্লাসের এক বান্ধবীকে সব বলতেই ও নিজের মতো করে সিফাতের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। এই অবস্থায় আমার একা থাকা ঠিক হবে না বলে আপুটা আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে গেল। ওদের ছোট্ট সংসার, ও আর ওর হাজবেন্ড। ওদের বাড়িতে থেকেই আমার বাচ্চাটা হলো। আমি পরীক্ষা আর নানান ছুতোয় গ্রামে গেলাম না ওই কয় মাস। আমার পড়াশোনার জন্য বাড়ি থেকে যে টাকা পাঠাতো তাতে একটা বাচ্চার কিছুই হতো না। তখন আপুর তিন বছর হয়েছে বিয়ের, কিন্তু ওদের কোনো বাচ্চা ছিল না। কারণ ও কখনো মা হতে পারবে না। সেজন্যই বোধহয় আমার বাচ্চাকে ওরা দুজনই খুব আদর করত। শুধু আদর কেন, বাবুর সব খরচও ওরাই চালাতো।”
আমরা কেউ কোনো কথা বলছিলাম না। সবাই মনোযোগ দিয়ে ওনার গল্প শুনছি। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এর মধ্যে হঠাৎ করে আমার বাবা এসে আমাকে নিয়ে গেল। ইউনিভার্সিটি থেকেই নিয়ে গেল। আমি যাওয়ার আগে বাবুকে একবার দেখতেও পারলাম না। আপুকেও কিছু জানাতে পারলাম না। বাড়িতে গিয়ে শুনি বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। যাওয়ার আগে কিছুই জানতে পারিনি। কিছুই আর করার থাকল না। আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল। কোনোভাবে আমি আপুকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম আমার অবস্থার কথা লিখে। আরো লিখলাম আমার এখন আর কিছুই করার নেই। ওর তো একটাই কষ্ট যে ও কখনো মা হতে পারবে না, ও যেন আমার বাবুকেই নিজের বাচ্চার মতো পালে। আমি আমার বাবুকে ওদেরকে দিয়ে দিয়ে দিলাম। সেই বিয়েটা টিকল না আমার। কারণ আমার বাবু হওয়ার সময় কিছু সমস্যা হয়েছিল তাই আমি মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এত ঝামেলার মধ্যে আমি আমার বাবুর কোনো খোঁজ নিতে পারিনি। তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থা বড্ড খারাপ ছিল। আমার ডিভোর্সের পর আমি ঢাকায় এসে আপুর বাসায় গেলাম। ততদিনে পাঁচটি বছর পার হয়ে গেছে। গিয়ে দেখি ওরা ওখানে আর নেই। শত খুঁজেও ওকে আর পাইনি। খুব কষ্টে একটা চাকরি জোগাড় করে থেকে গিয়েছিলাম ঢাকায় আপুকে খোঁজার জন্য। আপুকে আর বাবুকে না পেলেও হঠাৎ একদিন সিফাতকে পেলাম। জানতে পারলাম ওর বাবাকে আমাদের বিয়ের কথা বলার পর ওর বাবা ওকে আটকে ফেলে। বাড়ি বিক্রি করে অন্য বাড়িতে চলে যায় যাতে আমার চিঠি না পায়। তারপর একসময় ওর বাবাকে মানিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসে। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে আমাকে। এরপর থেকে আমরা দুজনে মিলে আপুকে খুঁজতে থাকি, আমার বাবুকে ফিরে পাওয়ার আশায়। তোমাদের মাই আমার সেই আপু, আমার হাজবেন্ডের ফ্রেন্ড। আর নীরব আমার ছেলে।”
আমার মুখ দিয়ে আচমকা বেরিয়ে গেল।
“মানে? আপনি কী বলছেন এসব?”
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি মা কাঁদছে। সৌরভ বলল,
“যত্তসব গাঁজাখুরি কাহিনী। আপনি তো বললেন আপনার আপু কখনো মা হতে পারবে না। কিন্তু আপনার কথা যদি সত্যি ধরেও নেই তাহলে আমি আর আমার বোন কোত্থেকে আসলাম?”
সৌরভের কথার জবাব দেয়ার সময় পেল না উনি। তার আগেই আমি আমার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
“মা কী বলছে উনি?”
মা চোখ মুছতে মুছতে বলল,
“সব সত্যি। তোকে আমি জন্ম দিইনি। ও তোকে জন্ম দিয়েছে।”
ওই মহিলা আমার মায়ের কাছে এসে বলল,
“তোর তো আরো দুটো ছেলেমেয়ে আছে আপু। আমার তো একটাই ছেলে। মানছি আমিই ওকে তোর কাছে ফেলে গিয়েছিলাম। সেজন্যই তো আজ সবার সামনে আমি আমার সব দোষ স্বীকার করে নিলাম।”
মা কোনো কথা বলল না। অনবরত কাঁদতেই থাকল। আমি ওনাকে বললাম, “আমি আমার মায়ের অবস্থা দেখেই বুঝতেই পারছি আপনার কথাগুলো সত্যি। তাই এখন মনে হয় আমার আপনাকে কিছু কথা জানানো দরকার। আমি ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের কোনো কথা শুনিনি। আমি সবসময়ই দস্যি ছিলাম, জেদী ছিলাম। এসব সবাই জানে কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি যে ছোটবেলায় মায়ের সাথে শপিং-এ গেলে মা যখন কালো শার্টটা দেখিয়ে বলত, এই কালো শার্টটা তোকে খুব মানাবে। তখন আমি আমার পছন্দের সাদা শার্টটার কথা মাকে বলিনি। কারণ, আমার মনে হয়েছে মা যখন বলছে তখন আমাকে কালোটাই ভালো লাগবে। ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট খেলা শিখেছি, খেলেছি কারণ মায়ের ক্রিকেট খেলা পছন্দ ছিল। মা চাইত আমি ক্রিকেট খেলি। তাই আমি কোনোদিন বলতে পারিনি যে আমার ফুটবল খেলা খুব পছন্দ। মায়ের স্বপ্ন ছিল আমরা দুই ভাই ডাক্তার হব। তাই আমি জার্নালিস্ট হবার প্রবল ইচ্ছেটাকে পাত্তা না দিয়ে ডাক্তারি পড়েছি। এরকম হাজারো ঘটনা ঘটেছে যা কেউ জানতে পারেনি। আমি কেন এরকম করেছি জানেন? বিকজ শি ডিজার্ভ ইট। এতটাই ভালোবাসা সে দিয়েছে আমাদেরকে। আর সে আমাদের জন্য যে যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তার কাছে এগুলো কিচ্ছু না।”
সবাই চুপ করে আছে। আমার দুই মা অনবরত কাঁদছে। আমার এক ফোঁটাও কান্না পাচ্ছে না। খারাপও লাগছে না। এমন একটা ফিলিং হচ্ছিল যে একদম সেই কাজটাই করছি যা আমার করা উচিত। খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি আমার মানসীর ডিভোর্স এবং দিতিয়ার সাথে বিয়ে এই দুটো ঘটনার সাথে এই ঘটনার কোনো যোগাযোগ রয়েছে। আমি আবার বলতে শুরু করলাম,
“একটা মেয়ে আছে, যার জন্মের পর আমি বলেছিলাম আমি ওকে বিয়ে করব। সাত বছরের বাচ্চা ছিলাম তখন আমি। সবাই হেসেছিল আমার কথা শুনে। কিন্তু বড় হয়ে আমি সত্যি তাকে বিয়ে করেছিলাম। বুঝুন কবে থেকে সম্পর্ক। আমার শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দুতে মিশে আছে ও। আমার প্রাণটা আছে ওর মধ্যে। সেই মেয়েটাকে ডিভোর্স দিয়ে আমি আরেকটা বিয়ে করেছি। কেন জানেন? আমার মায়ের জন্য।”
কথা শেষ করে দেখলাম সবাই কাঁদছে। অনন্যা, দিতিয়া, মোনা সবাই। কী অদ্ভুত! এমনকি সৌরভেরও চোখে জল। সেই মুহূর্তেও আমার চোখে এক ফোঁটা জল আসেনি। ওই মহিলা বলল,
“নীরব, আমি বুঝতে পারছি তোমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলাম বলে তুমি রাগ করছ। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি নিরুপায় ছিলাম। আমাকে মাফ করো বাবা।”
“আপনার কোনো দোষ ছিল না, সেটা আমি জানি। আপনি নিরুপায় ছিলেন সব ঠিক। কিন্তু আপনার দোষ ছিল সেই সময় সবাইকে না জানিয়ে বিয়ে করা এবং একটা জীবন পৃথিবীতে নিয়ে আসা, এই কথাটা বলব না ভেবেছিলাম, কিন্তু আপনি দোষগুণের বিচার করছিলেন তাই বলতে বাধ্য হলাম। আর কী যেন বলছিলেন…হ্যা আপনার ওপর রাগ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না কারণ প্রথমত, আপনার জন্যই আমি এমন মা পেয়েছি। আর দ্বিতীয়ত, আমি সবার সাথে রাগ করি না।”
একথা বলে আমি একটু থামলাম। তারপর বললাম,
“আর একটা কথা, আমি আমার মাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। বেটার হয় আপনি যদি আপনার সময়টা এখানে নষ্ট না করেন।”
এই বলে আমি বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। কদিন আগে মা যেভাবে আমাকে বিয়েতে রাজি করিয়েছে তাতে আমি মনে মনে মায়ের ওপর খুব অভিমান করে ছিলাম…খানিকটা রাগও। আজ সব রাগ, অভিমান দূর হয়ে গেল। আসলেই আমি খুব খারাপ। কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করলে খুব বেশিই খারাপ ব্যবহার করতে পারি। হোক সে মানসী, দিতিয়া কিংবা নিজের গর্ভধারিণী মা।
·
·
·
চলবে.........................................................................