ফানুস - পর্ব ৪২ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          মানুষের জীবনে এমন অনেক জটিল পরিচ্ছেদ থাকে, যা কিনা এতই বিভ্রান্তিকর যে বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও আমরা বুঝতে পারি না। অথচ প্রথমে আমরা ভাবি বুঝে গিয়েছি। তারপর আসলেই যখন বুঝতে পারি, তখন মনে হয়, হায়, এত দিন তাহলে কী বুঝেছিলাম? প্রিয়র জীবনে এমনই একটা পরিচ্ছেদ নিকিতা। বিয়ের পর প্রথম দুই বছর নিকিতা যেভাবে জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছিল, প্রিয় সেভাবেই নিকিতাকে ঘৃণা করত। কিন্তু তারপর ভুল বুঝতে পেরে মেয়েটা যেভাবে নিজেকে শুধরে নিয়েছিল, তাতে করে ওকে আর ঘৃণা করা যায় না। তাই বলে প্রিয় কখনো তাকে ভালোবাসতেও পারে নি। নিকিতার অমন অকৃত্রিম পাগলপারা ভালোবাসা দেখেও পারে নি। সেই নিকিতার জন্যই আজ তার এত কষ্ট কেন হচ্ছে? কেন বুক ফেটে যাচ্ছে? নিকিতার ভেতরে এখন তার সন্তানের বসবাস বলেই কি এমন লাগছে?

প্রিয় যখন জুতা খুলছিল, ঠিক তখন সম্ভবত নিকিতা গলায় দড়ি দিয়ে পায়ের নিচের টুলটা ফেলে দিয়েছিল। সেই শব্দ শুনেই প্রিয় দৌড়ে গিয়েছিল। কীভাবে কী হলো, সেসব চিন্তা প্রিয়র মাথায় আসে নি। যেটা এসেছিল তা হলো নিকিতা এবং বাচ্চাকে বাঁচাতে হবে। দৌড়ে গিয়ে তাকে নামিয়ে সোজা হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে ঢুকিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছে প্রিয়। এসির মধ্যে দাঁড়িয়েও দরদর করে ঘামছে। খুব বেশি দেরি কি হয়ে গিয়েছিল? নাকি সময়মতো হাসপাতালে আনা গেছে? ডাক্তাররা এখনো কিছু জানায় নি। নিকিতা বাঁচবে তো? বাচ্চাটা কি পৃথিবীতে আসার আগেই…নাহ, আর ভাবতে পারছে না প্রিয়।

শারীরিক সম্পর্ক দুটি মানুষকে কাছে আনে, ওদেরও এনেছে, কিন্তু তাতে কোনো ভালোবাসা ছিল না। নিকিতার দিক থেকে অবশ্য প্রবল ভালোবাসা ছিল। যা-ই হোক না কেন, দুদিক থেকে ভালোবাসা না থাকলে সেটাকে ভালোবাসাহীন সম্পর্ক বলাই ভালো। তবে এই ভালোবাসাহীন সম্পর্কটায় অনেক বোঝাপড়া ছিল, বন্ধুত্ব ছিল, নিয়মিত শারীরিক মিলন ছিল, পরস্পরের প্রতি পরস্পরের দায়িত্ব, কর্তব্য ও যত্নও ছিল। তবে প্রিয় নিকিতাকে এখনো স্ত্রী বলে মেনে নেয় নি। এমনকি সপ্তাহখানেক আগেও নিকিতা বলছিল, ‘আচ্ছা, তুমি তো আমাকে স্ত্রী বলে মানো না, নাকি মেনে নিয়েছ?

‘প্রশ্নই ওঠে না। আইন ও ধর্মীয় নিয়মকানুন অনুযায়ী আমাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু হৃদয়ের নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে হয় নি। তাই আমি তোমাকে স্ত্রী বলে মানি না। বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত মহলে কখনো তোমাকে স্ত্রী বলে পরিচয় করিয়েছি?

‘না।

‘বন্ধ দরজার ভেতরেও কি কখনো তোমাকে স্ত্রী বলে স্বীকার করেছি?

না।

‘তাহলে?

‘তাহলে তুমি আমার এত যত্ন নাও কেন?

‘কী যত্ন নিলাম?

‘এই যে না খেয়ে থাকলে খাইয়ে দাও। যখন যেটা খেতে চাই, সিজন না হলেও কোত্থেকে যেন এনে দাও! সকালে আমাকে নিয়ম করে হাঁটাও। ইদানীং এত বড় পেট নিয়ে গোসল করতে অসুবিধা হয় বলে তাও করিয়ে দাও। কেন করো এসব?

‘সেটা তো তুমি আমার বাচ্চার মা হচ্ছ বলে।

‘বাব্বা, বাচ্চাই তো চাচ্ছিলে না। এমনকি বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছিলে। এখন আবার বাচ্চার মা হচ্ছি বলে এত আদর?

প্রিয় নিকিতার পেটে হাত রেখে বলেছিল, ‘নিকিতা, তখন তো বাচ্চার শরীর তৈরি হয় নি, শরীরে প্রাণও আসে নি। কিন্তু এখন তো সে জলজ্যান্ত একটা মানুষ। হ্যাঁ, আমি চাই নি তাকে; কিন্তু বাচ্চা যেহেতু আমার একার না, তাই তাকে রাখা না-রাখার সিদ্ধান্তটা আমি একা নিতে পারি নি। এখন আমার বাচ্চা দুনিয়ায় আসার পথে। তার জন্য তোমার এত কষ্ট করতে হচ্ছে, নিজের চোখেই তো দেখছি। আমি তাই বাচ্চার বাবা হিসেবে দায়িত্বটুকু পালন করছি, এই তো। আর সেদিন কেন বাচ্চা অ্যাবরশনের জন্য অমন করছিলাম তা তুমি বুঝবে না নিকিতা। সেই দিনটা আমার জীবনের চরম ব্যর্থতা, হতাশা ও অসহায়ত্বের দিন ছিল।

‘কেন? কী হয়েছিল সেদিন?

‘বাদ দাও।’

‘খুব অদ্ভুত সম্পর্ক আমাদের! এমন অদ্ভুত সম্পর্ক কখনো দেখি নি, জানো?”

‘হ্যাঁ, খুব অদ্ভুত। অনেক রাত হয়েছে, তুমি এখন ঘুমাও।

‘তোমার বুকে ঘুমাব।’

‘এসো।’

নিকিতার এমন অনেক আবদারই প্রিয় মিটিয়েছে। অফিসের সময়টুকু ছাড়া পুরো সময়টা সে বাসায় থেকেছে। যখন যেটার দরকার, সেটার ব্যবস্থা করেছে। কারণ, প্রথম দিকেই ডাক্তার বলেছিল, নিকিতা হতাশায় ভুগছে। সব মেয়েই প্রেগন্যান্সির সময় শারীরিক পরিবর্তনের জন্য হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নিকিতার হতাশা ছিল অতিমাত্রায়। তাই তাকে সময় দিতে হবে, যত্ন নিতে হবে, নতুবা মা ও বাচ্চা দুজনেরই ক্ষতি হতে পারে। নিকিতার ডিপ্রেশনের কারণ শুধু শারীরিক পরিবর্তন নয়, তা জানে প্রিয়। বাচ্চা নষ্ট করতে বলায় প্রচণ্ড পরিমাণে ভয় ঢুকে গিয়েছিল তার মনে। প্রিয় চাইলেও বাচ্চাটা তারই, পৃথিবীর মুখ দেখার অধিকার তারও আছে।

প্রিয় ডাক্তারের পরামর্শ অনুয়ায়ী নিকিতাকে সময় দিয়েছে, খেয়াল রেখেছে, যত্ন নিয়েছে। তিন মাস যেতে না যেতেই সব হতাশা কেটে গিয়েছিল। মেয়েটা আবার হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। তারপর যখন জানতে পারল ছেলে হবে, তখন তো আনন্দে আত্মহারা সে। দুই ছেলেকে নিয়ে এই করবে, সেই করবে। কত পরিকল্পনা! গতকালও তো কত খুশিমনে বাচ্চার নাম ঠিক করল। আর আজ? আজ এমন কী হলো যে তার আত্মহত্যা করতে যেতে হলো?

বাবা শুদ্ধকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে। শুদ্ধ অনবরত কাঁদছে। নিকিতার বাড়ির লোকজনও এসে পড়েছে। প্রায় সবাই কাঁদছে। সবাইকে আলাদা আলাদাভাবে প্রিয় অনেক প্রশ্ন করল। সবাই জানাল, তাদের সঙ্গে শেষবার যখন কথা হয়েছে বা দেখা হয়েছে, সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। প্রিয়র সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল আনিসার ব্যাপারে কথা বলতে ওদের বাসায় যাওয়ার সময়। প্রিয় বলেছিল, তোমার বাবার সাথে কথা বলেই বাসায় ফিরছি। কিছু আনব? কিছু খেতে ইচ্ছা করছে?

‘হুম, খুব খেতে ইচ্ছা করছে।

‘কী?

‘এক শটা চুমু।’

‘এক শ কত দিন বসে খাবে? অল্প আনলে হয় না, চুমু! আমি গরিব মানুষ।

‘উঁহু, আমার এক শটাই চাই।’

‘আচ্ছা, এক হাজারটা আনব। এখন ফোন রেখে আমাকে উদ্ধার করুন। আমি আপনাদের বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।

‘আচ্ছা আচ্ছা, ওগুলো নিয়ে তাড়াতাড়ি আসুন জনাব। আপনার বউ, যে মেয়েটা কিন্তু আপনার দুই ছেলের মা, সেই মেয়েটা আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। খুব খিদে পেয়েছে তার।’

এই তো ছিল প্রিয়-নিকিতার শেষ কথোপকথন। এরপর ওইটুকু সময়ের মধ্যে কী এমন হলো? সবাই বলছে কিছু হয় নি, সব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কিছু তো একটা হয়েছেই এবং সিরিয়াস কিছু। না হলে নিকিতা এমনটা কখনোই করত না। এত সহজে আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে হলে সে বহু আগেই তা করত। নিকিতার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে তো কখনো জানতেও পারবে না কী হয়েছিল আসলে। এর বেশি কিছু ভাবতে পারছে না প্রিয়। দুশ্চিন্তায় তার মাথা কাজ করছে না। শুদ্ধ কাছে এসে আগের মতোই কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘বাবা, নিকিমা কি বাঁচবে না? ভাইকে কি পাব না?

প্রিয় শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল, এসব বলে না, বাবা। মা আর ভাইয়ের জন্য দোয়া করো।
·
·
·
চলবে..................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp