প্রিয় ও নিকিতার একটু স্পেস দরকার। যা শুদ্ধর জন্য তারা পায় না। তাই বাবর খান অনেক ভেবে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উত্তরবঙ্গে একটি প্রজেক্ট পরিদর্শনে যাচ্ছেন। শুদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। শুদ্ধকেও পটিয়ে ফেলেছেন তিনি। প্রিয় প্রথমে শুদ্ধকে যেতে দিতে চাচ্ছিল না। কিন্তু শুদ্ধের আগ্রহে রাজি হতে হলো। স্কুলে শীতের ছুটি চলছে। ছেলেটারও কিছুদিনের জন্য হাওয়া বদল হওয়া দরকার।
ছুটির দিন পুরো বিকেল, সন্ধ্যা প্রিয় ড্রয়িংরুমে মুভি দেখে কাটিয়ে দিল। নিকিতা টিভি দেখেই একটু সময় কাটায়, আজ তা পারছে না। কিন্তু দূর থেকে প্রিয়কে দেখেই সময় কাটিয়ে দিচ্ছে সে ভালো লাগছে খুব। প্রিয় রাত নয়টা বাজতেই চিৎকার করে বলল, ‘নিকিতা, খেতে দাও। ছেলেটা নেই, বোর লাগছে। তাড়াতাড়ি ঘুমাব।’
খেতে খেতে প্রিয় বলল, ‘মাংসটা তুমি বেঁধেছ?’
‘ভালো হয় নি, না? বুয়া তাড়াতাড়ি চলে গেছে আজ, বেশি কিছু রান্না করতে পারে নি। সে জন্যই পরে মাংসটা আমি বেঁধেছিলাম।’
‘মোটামুটি হয়েছে। আসলে ছোটবেলা থেকে ভালো রান্না খেয়ে অভ্যাস তো, এ রকম খেতে পারি না। এক কাজ করি চলো।
‘কী কাজ?
‘সামনের শুক্রবার আমি তোমাকে মাংস আর বড় মাছ ভুনা করা শেখাব। শনিবার আবার ভাজাভুজি আর ছোট মাছের কারি শিখিয়ে দেব। তুমি শুধু ওই প্রসেস ফলো করে রান্না করবে, প্রথম প্রথম একটু উল্টোপাল্টা হবে। পরে প্র্যাকটিস করতে করতে দেখবে মানুষ তোমার হাত চেটে খেতে চাইবে।
‘ঠিকাছে, আমি শিখব।’
নিকিতার ভালো লাগছিল। প্রচণ্ড ভালো লাগছিল। নিকিতার মনে পড়ে গেল শ্বশুর তাকে বলেছিলেন পেট্রার সঙ্গে দেখা করলে মন ভালো থাকবে প্রিয়র। সত্যিই সেদিনের পর থেকে প্রিয়র কথা বলার ধরনটাই বদলে গেছে। আগে যতবার খারাপ বেঁধেছে, প্রিয় বকেছে। বলেছে, রান্না করতে হবে না আর। আর আজ নিজ হাতে রান্না শেখাতে চাচ্ছে!
প্রিয় শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরই নিকিতা ঘরে এল। ঘরে ঢুকতেই প্রিয়র চোখে চোখ পড়ল। প্রিয় চোখ ফিরিয়ে নিল। নিকিতা ঘুরঘুর করে কী কী যেন করল, তারপর বিছানায় আসতেই প্রিয় বলল, ‘আজ তো বাবা বাড়িতে নেই। আজ আমাদের এক বিছানায় ঘুমানোর কী দরকার?
‘বিছানা বদল হলে আমি ঘুমাতে পারি না।’
‘ঠিকাছে।
প্রিয় আর কথা বাড়াল। নিকিতা বিছানায় শুয়ে প্রিয়র লেপের ভেতর ঢুকতেই প্রিয় লেপটা টেনে ধরে বলল, ‘তোমার কম্বল কোথায়?
নিকিতা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আমি তোমার লেপের ভেতর শুলে কি তোমার গায়ে ফোঁসকা পড়বে?
প্রিয় হেসে লেপটা ছেড়ে দিল। নিকিতা লেপের ভেতর ঢুকল। প্রিয় হেসে বলল, ‘সুযোগ পেয়ে উল্টোপাল্টা কিছু কোরো না আবার, মাঝেমধ্যে যেই অ্যাটাক দাও, ভয় লাগে ভাই।’
নিকিতা প্রচণ্ড অবাক হলো। প্রিয়র এতটা পরিবর্তন? এত সুন্দর করে কথা বলছে ওর সঙ্গে? এটুকু সব সময় পেলেও সে সুখী হতো। প্রিয় নিকিতাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হলো, কী দেখছ?
নিকিতা কোত্থেকে যে সাহস পেল! পুরোপুরি প্রিয়র দিকে ফিরে হাতের ওপর মাথা ভর দিয়ে বলল, আমি কি পরনারী? আমি ছুঁলেই তোমার পাপ হবে?
নিকিতার মুখে এমন কথা শুনে প্রিয় যা বোঝার বুঝে গেল। মেয়েটা বহুত সেয়ানা। প্রিয় কিছু না বলে উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে রইল। নিকিতা বুঝতে পারল না প্রিয় রাগ করেছে, নাকি স্বাভাবিকই আছে। তাই আর কিছু বলার সাহস পেল না। আজ না হয় এটুকুই থাক, সপ্তাহখানেক তো বাসা খালিই।
—————
প্রিয়র সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কয়েকদিন কেটে গেছে। কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারছে না পেট্রা। গভীর রাতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে কাঁদছে। বুকটা ভার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে নিঃশ্বাসটা যে-কোনো সময় আটকে যাবে। প্রিয় এমন পাগলের মতো কেন করে? এভাবে পাওয়াকে কি পাওয়া বলে? সে কি বোঝে না তার প্রতিটা স্পর্শে পেট্রার কেমন। লাগে? সে তো চলে গেছে, অথচ তার স্মৃতিগুলো একটু একটু করে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে পেট্রাকে। কান্নার মাঝেই প্রিয়াঙ্কার ফোন এল। রাত বাজে দেড়টা, এত রাতে ওর ফোন কেন? চোখ মুছে ফোন ধরল পেট্রা। প্রিয়াঙ্কা বলল, এই পেট্রা, তুই কি ঘুমিয়ে পড়েছিলি?
‘না, বল।
প্রিয়াঙ্কা আঁতকে উঠে বলল, ‘তুই কাঁদছিলি?
‘বুঝতেই যখন পারছিস, তখন আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?
‘সরি, কী হয়েছে রে? কেন কাঁদছিস?
‘আমার মনে হয় প্রিয় কোনো মেন্টাল ডিজঅর্ডারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কী বলে, কী করে কোনো ঠিক নেই।
‘কেন, কী হয়েছে?
‘প্রিয় এখনো অনেক পাগলামি করে, যেন এখনো আমি তার বউ আছি।’
‘আহা, বেচারা কী করবে আর? তুই তো বুঝিস প্রিয়দাকে?
‘আমি আর পারছি না রে প্রিয়াঙ্কা, ক্রিসমাসের দিন ওকে আর শুদ্ধকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কত সুখে ছিলাম আমরা! আর এখন?
প্রিয়াঙ্কা অস্থির হয়ে বলল, ‘কলিজাটা আমার, এভাবে কাঁদিস না, আমার ইচ্ছা করছে দৌড়ে তোর কাছে চলে যাই। তোকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বসে থাকি।
পেট্রার কান্না থামল না, সে উতলা হয়ে বলল, ‘কী করব আমি, প্রিয়াঙ্কা? কী করব? ছোটবেলা থেকে তো সারা জীবন একজনকেই চিনেছি, জেনেছি, ভালোবেসেছি। নিজের সব বিসর্জন দিয়েছি এই একটি মানুষের জন্য। আমার রক্তে মিশে আছে যে মানুষটি, তাকে ছাড়া বাকিটা জীবন কী করে কাটাব?
ওদিকে প্রিয়াঙ্কাও কান্না শুরু করে দিল। বলল, ‘ফর গড সেক, তুই কাঁদিস না, পেট্রা।
পেট্রা গলাটা একটু স্বাভাবিক করে বলল, তুই কাদিস না, বাচ্চার ক্ষতি হবে। আমি রাখছি।’
পেট্রা ফোন রাখতেই দেখল একটা মেসেজ এসে রয়েছে। তার বুক কাঁপছে। কারণ মেসেজটা প্রিয় পাঠিয়েছে। সে মেসেজটা ওপেন করল। প্রিয় লিখেছে, ‘সেদিন চলে আসার সময় তোকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছিল। ঝগড়ার পর মিটমাট হলে যেমন খাবলে-খুবলে ধরতাম, তেমন করে।
পেট্রার যতটা কষ্ট হচ্ছিল, তা শত গুণ বেড়ে গেল মেসেজটা পড়ে। পেট্রা হঠাই শব্দ করে কেঁদে উঠল! কান্নাটা আটকাতেও পারছে না সে। ছোট ফ্ল্যাট, রুমগুলো কাছাকাছি। শেষমেশ কেউ আবার না শুনে ফেলে তাই বালিশ কামড়ে ধরে কাঁদতে লাগল। তার মতো মেয়েদের কাঁদতেও হয় লুকিয়ে লুকিয়ে।
—————
বালিশে হেলান দিয়ে বসে সিগারেট খেতে খেতে পেট্রাকে মেসেজটা দিয়েছে প্রিয়। কোনো রিপ্লাই এল না! পেট্রা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? কিন্তু সে হয়তো জানেও না তার কথা ভেবে প্রিয় এখনো দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি। এখনো পেট্রার চোখজোড়া যেন দেখতে পাচ্ছে। এখনো তার ঠোঁটের স্পর্শ অনুভবে রয়ে গেছে। নিজের হাতের দিকে তাকাল, এই হাত সেদিন অনেক অবাধ্যতা করেছে। যা করেছে, তা কি সত্যি পাপ? পরিবারকে রাজি করানোর জন্য বিয়ে করেছিল তারা। কিন্তু বিয়ের আগেও পেট্রা তার কাছে যা ছিল, বিয়ের পরও তা-ই। যখন থেকে তাকে ভালোবেসেছে, তখন থেকেই নিজের সারা জীবনের সঙ্গী মেনে এসেছে। তাকে। কলমের কালি খরচ করে স্বাক্ষর করে বিয়ে করা আর স্বাক্ষর করে ডিভোর্স করাটা কি এতই জরুরি? মনের এখানে কোনো জায়গা নেই? মন কাকে চাইছে, সেটার কোনো গুরুত্ব নেই? তাহলে যখন কলম ও কালি আবিষ্কৃত হয় নি, তখন কি বিয়েই হতো না? তখন কি পাপ-পুণ্যের কোনো বিষয় ছিল না? যদি তাই হয়, তাহলে তো তখন জন্ম নিলেই ।ভালো হতো। মগ্ন হয়ে এসব ভাবছিল প্রিয়। ব্যাঘাত ঘটাল নিকিতা। বলল, ‘সিগারেটটা ফেলো, তোমার তো হাত পুড়ে যাবে।
প্রিয় চমকে বলল, ‘হ্যাঁ? ও হ্যাঁ, ফেলছি।
প্রিয় সিগারেটের ফিল্টারে আরও একটা টান দিল। নিকিতার মনে হলো, প্রিয়র ঠোঁটটা বুঝি পুড়ে যাবে এবার। নিকিতা বলল, তুমি কি পাগল? সিগারেট শেষ, তাও টানছ? দরকার হলে আরেকটা ধরাও!
প্রিয় হেসে বলল, ‘আরে নাহ, সিগারেটের শেষ টানের অনুভূতি যে কী শান্তির, তুমি তা বুঝবে না। বলা হয় সিগারেটের শেষ টানের অনুভূতি ষোলো বছরের কোনো তরুণীর ঠোঁটে চুমু খাওয়ার অনুভূতির সমান।
‘তুমি আবার এসব বোঝো নাকি?
প্রিয় হাসল। নিকিতা সাহস করে বলল, চোখের সামনে দিয়ে আঠারো বছরের এক তরুণীর বিশ বছর হয়ে গেল। একবার চুমু খেলে না হয় বুঝতাম যে তুমি এসব বোঝে।
এবার প্রিয় হো হো করে হেসে ফেলল। নিকিতার ভয়টা কমে গেল। প্রিয় হাসি থামিয়ে হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে বলল, তুমি খুব চাও আমাকে, তাই না?
‘তুমি আমার স্বামী। তোমাকে চাওয়াটাই কি যৌক্তিক না?
‘অবশ্যই, তা ছাড়া তোমার বয়সটাই এমন।
নিকিতা কী বলবে, ভাবতে ভাবতেই প্রিয় জিজ্ঞেস করে বসল, ‘আচ্ছা, তুমি না বাসর রাতে বলেছিলে তোমার একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল। ওর কাছে চলে যাও না কেন?
‘আশ্চর্য তো, ওর কাছে যাব কেন? ওর সাথে তো কত আগেই ব্রেকআপ হয়ে গেছে।
‘তো কী! প্যাঁচআপ করে নাও।
‘সে রকম হলে তো বিয়ের আগেই করতাম। তোমাকে বিয়েই করতাম না।’
প্রিয় যেন সেকথা শুনলে না। হঠাৎ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা নিকিতা, তুমি কি কখনো চলে যাবে না? এভাবেই থাকবে। সারা জীবন?
‘হ্যাঁ থাকব।’
‘তোমার এমন সুন্দর যৌবন বিফলে যাবে?
এ কথায় লজ্জা পেল নিকিতা। প্রিয় বলল, ‘আরে, এতক্ষণ তো খুব নির্দ্বিধায় কথা বলছিলে, এখন আবার লজ্জা পাচ্ছ কেন?
নিকিতা একটু ভাব ধরে বলল, আমার এত লজ্জা নেই।’
প্রিয় হেসে বলল, ‘তাও ঠিক। অত লজ্জা থাকলে কি আর নিজ থেকে রাতবিরাতে আমাকে অ্যাটাক দিতে?
নিকিতা হাসল। বলল, ‘অ্যাটাক দিয়েই-বা লাভ কী! ধমক ছাড়া এই জীবনে আর তো কিছু পেলাম না।
প্রিয় আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ‘আসলে তোমার দুর্ভাগ্য কোথায় জানো? তুমি একটা যুদ্ধের মাঝে পড়ে গেছ। বাপ-ছেলের যুদ্ধ। তোমাকে আমি কখনো স্ত্রীর জায়গা দেব না, দিলে যুদ্ধে আমি হেরে যাব। আর আমি তো হার মানব না। অন্যদিকে ভালোও বাসতে পারব না তোমাকে। তোমাকে কেন, এই পৃথিবীর আর কোনো মেয়েকেই ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব না।
নিকিতার খারাপ লাগল। তবু কথাটা এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, তোমার কি শুদ্ধর মায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক আছে এখনো?
‘নাহ, নেই। তোমার আমার বিয়ের পর ও আমার সাথে সম্পর্ক রাখে নি। তবে কয়েকদিন আগে দেখা হয়েছিল আমাদের। প্রায় এক বছর পর।
‘তাহলে তুমি থাকো কীভাবে?
প্রিয় অবাক হয়ে বলল, ‘ঠিক বুঝলাম না।’
‘আই মিন, তুমি তো ডিভোর্সি। শুদ্ধর মায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, মানে তার সাথে কিছু হয় না, আমার সাথেও কিছু করো না। তোমার কষ্ট হয় না? আই মিন সবারই তো একটা ফিজিক্যাল নিড় থাকে।
প্রিয় হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘গুড কোশ্চেন। তার আগে বলল, তুমি তোমার ফিজিক্যাল নিড কীভাবে ফুলফিল করো?
নিকিতা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আরে, আমি এখনো ভার্জিন। আমি কি তোমার মতো বিবাহিত ছিলাম নাকি? আর তোমার মতো তাগড়া পুরুষমানুষও না আমি।’
প্রিয় হো হো করে হেসে দিল। নিকিতার ভালো লাগছিল। কী সুন্দর হাসি প্রিয়র! খুব কমই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তার। আজ সে নিজেই হাসাচ্ছে, ভাবতেই বুকের ভেতর ঝড় বইছে।
প্রিয় হাসতে হাসতে বলল, ‘তাগড়া পুরুষমানুষ! হোয়াট আ ডায়ালগ ইয়ার!
‘উত্তরটা এড়িয়ে যেয়ো না।’
‘কেন এড়িয়ে যাব? আমি কারও সাথেই কিছু করি না। তোমার মতো
সাথে করে ঘুমাই। কোনোদিন চোখ বুলিয়ে দেখিও নি তোমার শরীরে। আমার কন্ট্রোল পাওয়ার সম্পর্কে তোমার ধারণা সবচেয়ে বেশি থাকার কথা।
‘কিন্তু একটা ছেলে হয়ে কীভাবে পারো তুমি?
প্রিয় হেসে বলল, আমার তো লাগবে পেট্রাকে, অন্য কোনো নারী শরীর দিয়ে আমার হবে না। যে হাত তাকে ছুঁয়েছে, সে হাত অন্য কাউকে ছুঁতে দ্বিধাবোধ করে। আর ফিজিক্যাল নিডের কথা বলছ, আই থিংক ইটস অল অ্যাবাউট লাভ।’
কীভাবে? তাহলে কি দেশে প্রস্টিটিউশন থাকত?
‘প্রস্টিটিউশনে যারা যায় বেশির ভাগেরই ঘরে বউ আছে, তাও টেস্ট চেঞ্জের জন্য যায়।
‘কী বলে? বিবাহিতরাও যায়?
‘বিবাহিতরাই বেশি যায়।’
নিকিতা সন্দেহের গলায় বলল, তুমি জানো কীভাবে?
প্রিয় হাসতে হাসতে বলল, ‘কী মনে হয়, আমিও যাই?
নিকিতা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, ‘না না, তা নয়। কিন্তু তোমার জানার সোর্সটা কী, তাই জানতে চাচ্ছিলাম। আমি তো এসব জানি না, তাই।
‘আমি কলেজে পড়ার সময় একবার প্রস্টিটিউশনে গিয়েছিলাম।
নিকিতার চোখ বড় বড় হয়ে গেল! বলল, ‘হোয়াট? আমি ভাবতেও পারছি না।’
প্রিয় হেসে বলল, ‘পেট্রার অনুমতি নিয়েই গিয়েছিলাম। আমার আসলে ওই মেয়েগুলোর সম্পর্কে জানার খুব ইচ্ছা ছিল, তাই গিয়েছিলাম। কিছু করি নি। নট আ সিঙ্গেল কিস। গল্প করেছি সারা রাত।
‘পেট্রা তোমাকে অনুমতি দিল?
‘আপু বলল, তোমার চেয়ে দশ বছরের বড়।
‘সরি, আসলে ওনাকে তো কখনো দেখি নি, তাই খেয়াল ছিল না।’
‘ঠিকাছে ঠিকাছে। আর না বললেই হলো।
‘আচ্ছা, এবার বলো পেট্রা আপু তোমাকে অনুমতি দিল কীভাবে? আই মিন, দুনিয়ার কোনো মেয়ে এটা মানতে পারবে? আমি হলে জীবনেও পারমিশন দিতাম না।’
প্রিয় হেসে বলল, এখানেই পেট্রার সাথে বাকি সবার পার্থক্য। আমি যখন ইচ্ছাটার কথা জানিয়েছি, ও বলেছিল, ইচ্ছা হলে যাবি কিন্তু এটাকে রেগুলার অভ্যাস বানিয়ে ফেলিস না। তারপর যখন বলেছি, শুধু একবারই যাব, তখন ও আর কিছু বলে নি। আসলে ওর আমার ওপর বিশ্বাস ছিল। আমাকে পেট্রা যতটা চেনে, ততটা দুনিয়ার কেউ চেনে না। আর আমিও কখনো বিশ্বাস হারানোর মতো কিছু করি নি। উল্টোপাল্টা কিছু করলে ওর অনুমতি নিয়ে নিতাম, এটাতে লাভও ছিল। পরবর্তী সময়ে কোনো ঝামেলা হলে ওর সাহায্য পেতাম।
‘উল্টোপাল্টা কিছু বলতে?
‘একটা তো শুনলেই, এমন আরও অনেক উদ্ভট কাজ করতাম।
‘যেমন? একটা বলো।
‘যেমন ড্রিংক করা, কোনো মেয়ে শত্রুতা করলে বন্ধুদের নিয়ে তাকে আটকে ভয় দেখানো–এ রকম আরও অনেক ছিল। বাদ দাও তো। ছোটবেলায় কত আকাম করেছি!
‘তোমাদের সম্পর্কটা অদ্ভুত ছিল। এমন সম্পর্কের কথা আগে কখনো শুনি নি।
প্রিয় হাসল। হাসিটা মলিন। নিকিতা বলল, আচ্ছা, তোমরা দুজন দুজনকে তুই করে বলতে কেন?
‘বন্ধু ছিলাম যে।’
‘আমাকে বলবে তোমাদের লাভ স্টোরিটা?”
প্রিয় অবাক হয়ে বলল, তুমি শুনবে?
‘আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে।
প্রিয় নড়েচড়ে বসল। হেসে বলল, আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখনকার একদিনের ঘটনা। আমাদের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল এবং আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমি সেকেন্ড হয়েছি। আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। একদম নার্সারি ক্লাস থেকে কখনো কোনো পরীক্ষায় আমি সেকেন্ড হই নি। সব সময় ফাস্ট। এমনকি যে সেকেন্ড হতো, তার সাথে আমার অনেক নম্বরের ডিফারেন্স থাকত। আমি ঘামতে লাগলাম। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। আমার এত খারাপ লাগছিল, যা বলে বোঝানোর মতো না। তাও আবার ফার্স্ট হয়েছে একটা মেয়ে, যে কিনা ওই বছরই আমাদের স্কুলে নতুন এসেছে। বুঝলে, মানসম্মানের তেরোটা বেজে গিয়েছিল আমার। একটা মেয়ে আমাকে ডিঙিয়ে ফাস্ট হয়েছে। সবার মুখে একটাই কথা। প্রিয় এবার ফাস্ট হতে পারে নি, নতুন একটা মেয়ে ফাস্ট হয়েছে। রাগে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।
নিকিতা হেসে বলল, ‘মেয়েটা পেট্রা আপু ছিল?
প্রিয় হেসে বলল, ‘হুম।
‘তারপর?
‘তারপর আর কী, পেট্রা আমার শত্রু হয়ে গেল। এই একজনই ছিল ক্লাসে, যার সাথে আমি কথা বলতাম না। আমার জীবনের তখন একটাই লক্ষ্য, ফাস্ট হওয়া। তারপর ফাইনালে ঠিকই আমি ফার্স্ট হলাম। এবার আমি ওর শত্রু হয়ে গেলাম। উড়োকথা শুনলাম, ও নাকি কখনো সেকেন্ড হয় নি, তাই এটা মেনে নিতে পারছে না। এখন আরও বেশি পড়াশোনা করছে যাতে আবার ফাস্ট হতে পারে। কিন্তু পারল না। হাফ ইয়ার্লিতে আমিই ফার্স্ট হলাম। কিন্তু ফাইনালে গিয়ে ও ফার্স্ট হলো। আমি হলাম সেকেন্ড।
নিকিতা হেসে ফেলল। প্রিয় হাসতে হাসতে বলল, বোঝো অবস্থা, ক্লাস ফাইভে আমার রোল নম্বর হলো ২। কী লজ্জা, কী লজ্জা! ক্লাস ফাইভে ও একবারও ফার্স্ট হতে পারে নি, কিন্তু সিক্সে আবার আমি হাফ ইয়ার্লিতে ফার্স্ট হলেও ফাইনালে হতে পারি নি। এভাবেই আমরা ক্লাস এইটে উঠলাম। এই পাঁচ বছরে আমরা কেউ কারও সাথে হাই-হ্যালোও করি নি। দুজন দুজনকে শত্রু মনে করেছি।’
‘ক্লাস এইটে কী হলো?
‘ক্লাস এইট মানে তো বোঝেই, মোটামুটি ভালোই বড় হয়েছি আমরা, বয়ঃসন্ধিকাল চলছে। তো আমার একটা বন্ধু একদিন পেট্রাকে নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে কথা বলছিল।’
‘তখন তুমি ওই ফ্রেন্ডকে মেরেছিলে?
‘আরে নাহ। শোনোই না, ওর কথা শুনে আমি পেট্রার দিকে তাকাই এবং তখনই খেয়াল করি, মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। চোখে পড়ার মতো সুন্দর হয়েছে। আমি তো ওকে সব সময় শক্ৰই ভেবেছি, কখনো তো ওভাবে তাকিয়ে দেখি নি।
‘তারপর?
তারপর থেকে আমার চোখ আপনাআপনি ওর দিকে চলে যেত। আমি দেখতাম ওকে। একদিন স্পোর্টস ক্লাসে ওর পা কেটে গিয়েছিল। স্পোর্টস টিচার আমাকেই বলল ব্যান্ডেজ করে দিতে। কারণ, এই কাজটা আমি ভালো করতাম। আমি দিলামও। আর হাঁ করে চেয়ে দেখছিলাম ওর পা কতটা সুন্দর। ও নিজেও অবাক হয়ে দেখছিল আমি ইদানীং শত্রুতা কম করি। নিজ হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি, এটা তো অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু ওই দিন এত কাছে থেকেও আমরা দুজন দুজনের সাথে কোনো কথা বলি নি।
‘তারপর কী হলো?
‘তারপর হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার মাঝখানে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এল ম্যাথ এক্সাম দিতে। ওর রোল নম্বর এক আর আমার দুই তাই পরীক্ষার হলে ও আমার সামনে। আমার পরীক্ষা শেষ করে ওর খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি, ও একটা উপপাদ্য শুরু করে বসে আছে। বাকিটা সম্ভবত ভুলে গেছে। আমি ওই উপপাদ্যটা লুজ পেজে করেছিলাম। ওই পেজটা আলাদা করে এমনভাবে রাখলাম, যাতে ও পেছনে তাকালে দেখতে পায়। আমাদের ক্লাসরুম অনেক বড় ছিল। টিচাররা সাধারণত পেছন দিকেই ঘুরঘুর করত বেশি। তো আমি ওর চুল ধরে টান দিলাম। ও অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল। আমি ইশারায় বোঝলাম আমার খাতা থেকে দেখে নিতে। ও খুব অবাক হয়েছিল, তবে দেখেছিল। খাতা জমা দিয়ে বের হওয়ার পর ও আমার কাছে এসে থ্যাংকস দিল আর বলল, আমি না দেখালে ও লিখতে পারত না। জ্বর নিয়ে পড়েছিল, তাই ভুলে গিয়েছিল। আমিও বললাম যে আমি বুঝেছি ব্যাপারটা, সে জন্যই সাহায্য করেছি। এত থ্যাংকফুল হওয়ার কিছু নেই। অন্য কোনো এক্সামে আমাকে হেল্প করে শোধ করে দিলেই হবে। এ কথা বলার পর ও হেসেছিল। সেদিনই প্রথম খেয়াল করলাম, ওর হাসিটা ভীষণ সুন্দর, চোখ দুটোও সুন্দর।
‘তারপর প্রেম হলো কবে? কী করে?
প্রিয় নিকিতার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল।
নিকিতা বলল, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে এমন রহস্যময় হাসি দিচ্ছ কেন?
প্রিয় মিটিমিটি হেসে বলল, ‘বারে, তোমার না অভিযোগ যে আমি তোমার দিকে তাকাই না? এখন তাকিয়েছি, এটাতেও দোষ?
‘আমি বলি নি দোষ। সেভাবে তাকালে তো জীবন ধন্য হয়ে যেত কিন্তু তোমার এই দৃষ্টিটা রহস্যময়।’
প্রিয় একইভাবে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটে মুচকি হাসি। নিকিতাও তাকিয়ে রইল, যেভাবেই তাকাক না কেন, আজ প্রথম প্রিয় হাসিমুখে তার চোখের দিকে তাকিয়েছে। কিছুক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার পর প্রিয় বলল, তোমার চোখে আমি হিংসার আগুন দেখছি, নিকিতা।’
নিকিতা চোখ সরিয়ে নিল। ইতস্তত করে বলল, ‘কই, না তো।’
‘তুমি কীভাবে আমাকে ভালোবাসলে, বলো তো?
নিকিতা এই প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। প্রিয় আবার বলল, ‘প্রথম প্রথম তত বোধ হয় খুব ঘৃণা করতে আমাকে।
হ্যাঁ, করতাম।’
‘তাহলে অনুভূতিটা বদলে গেল কী করে?
‘তোমরাও তো প্রথম প্রথম দুজনকে ঘৃণা করতে। পরে তো ঠিকই ভালোবেসেছিলে।’
‘আমাদের ব্যাপার আর তোমার ব্যাপার এক না।
‘তুমি আমার স্বামী! স্বামীকে ভালোবাসার জন্য কোনো কারণ লাগে না।’
‘তুমি কি বলতে চাও দুনিয়ার সব মেয়ে তার স্বামীকে ভালোবাসে?
‘মেয়েটার কোনো পিছুটান না থাকলে অবশ্যই বাসে।
‘তোমার পিছুটান থাকলেই আমার বড় সুবিধা হতো।
‘কেন? তুমি তো বলেছিলে তোমাদের সম্পর্ক আর কখনো জোড়া লাগা সম্ভব না। তাহলে আমি থাকলে অসুবিধা কী?
‘আসলে তুমি অনেক ভালো মেয়ে। আমার পরিবার তোমাকে ঠকিয়েছে, আমার গিলটি ফিলিং হতো। আর যেদিন থেকে তুমি আমাকে ভালোবাসো, সেদিন থেকে আরও বেশি খারাপ লাগে। তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে, বাকি জীবনটা তো তোমার পড়েই আছে। চলে গেলে আবার সব নতুন করে শুরু করতে পারবে। সুখী হবে।
প্রিয়র মুখে এমন কথা শুনে বড় ভালো লাগছে নিকিতার। মানুষ ঠিকই ওপরে ওপরে খারাপ ব্যবহার করলেও ভেতরে তাকে নিয়ে ভাবে! শ্বশুর বাবা ঠিকই বলেন। প্রিয় অনেক ভালো মানুষ। নিকিতা বলল, আমি তোমার সাথে সুখী হতে চাই। ভালোবাসা কি ফেরানো যায়, বলো? এত কিছুর পরও তুমি কি পেরেছ ফেরাতে?
প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই কথাটা ঠিকই বলেছ।’
প্রিয় ভাবছিল ভাগ্য কেন এমন খেলা করল! নিকিতা তাকে আনমনে দেখে আরেকটু কাছে গিয়ে বসল। প্রিয় টের পেল না। নিকিতা হাঁটুতে মুখ খুঁজে প্রিয়র দিকে মাথা দিয়ে বলল, বাদ দাও না। তোমার রাগী রাগী মুখটাও ভালো লাগে, হাসিখুশি মুখ তো ভালো লাগেই; কিন্তু এই বিষণ্ণ মুখটা একদম ভালো লাগে না।’
প্রিয় নিকিতার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল। নিকিতা বলল, ‘তোমাদের কাহিনিটা কন্টিনিউ করো।’
‘তোমার তো শুনতে খারাপ লাগছে।’
‘একদম না। বরং বাকিটা জানতে ইচ্ছা করছে। তুমি বলো প্লিজ।
প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালিশে হেলান দিয়ে বলতে শুরু করল, ‘আমার জন্ম, ছোটবেলা সব সাভারে কেটেছে। পেট্রা ক্লাস থ্রিতে সাভারে এসেছিল। কারণ ওর বাবা তখন সাভারে ট্রান্সফার হয়। তারপর থেকে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা সাভারেই থাকতাম।
‘আচ্ছা।’
‘ক্লাস এইটের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা পর্যন্ত বলেছি।
‘হুম।
‘পরীক্ষার পর দুই সপ্তাহ ছুটি ছিল। এই দুই সপ্তাহে আমি অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। আমার শুধু পেট্রাকে দেখতে ইচ্ছা করত। খুব মিস করতে লাগলাম ওকে। কিন্তু বুঝতাম না এমন কেন লাগত। স্কুল খোলার পর। আমি ওকে দেখে শান্তি পেলাম। সারাক্ষণ শুধু তাকিয়ে থাকতাম ওর দিকে। তখন আমরা প্রতিদিনই টুকটাক কথাবার্তা বলতাম। আস্তে আস্তে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। ফাইনাল পরীক্ষায় ও ফাস্ট হলো আর আমি সেকেন্ড। এই প্রথম সেকেন্ড হয়েও আমার খারাপ লাগল না। বাসায় আসার সময় ভাইজান আমাকে বলল, ‘কী ব্যাপার প্রিয়, তুই সেকেন্ড হয়েছিস অথচ মন খারাপ করছিস না!”
নিকিতা বলল, ‘ভাইজান কে?
প্রিয় বলল, আমার বড়ভাই, রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। মাসহ।
‘সরি। আমি জানতাম কিন্তু খেয়াল ছিল না।
‘ইটস ওকে। ওই অ্যাকসিডেন্টের কথা আমি মনে করতে চাই না। যাই হোক, আমি ওকে ভাইজান বলে ডাকতাম। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সে, আমার আইডল ছিল। সে তখন ক্লাস টেনে পড়ত, আমাদের স্কুলেই। ভাইজান ওই কথা জিজ্ঞেস করতেই আমি বললাম, সমস্যা কী, পেট্রাই তো ফাস্ট হয়েছে, অন্য কেউ তো না।
ভাইজান অবাক হয়ে বলল, শালা, এত দিন তো পেট্রা ফার্স্ট হতো বলেই তুই দুনিয়া উদ্ধার করতি।
আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। আমি নিজেও খুব অবাক হলাম। বললাম, না, মানে ভাইজান, এখন তো ও আমার বন্ধু হয়ে গেছে।
ভাইজান বলল, তুই কি ওর প্রেমে পড়েছিস প্রিয়? খবরদার, এই ভুল করিস না। ও খ্রিষ্টান, এটা মনে রাখিস। বাবা জানলে খুন করে ফেলবে। তাও তোকে না, পেট্রাকে।
আমি ভাইজানকে বললাম, আরে না ভাইজান, প্রেমে কেন পড়ব? জানি তো ও খ্রিষ্টান।
কিন্তু তারপর থেকে আমি ভাবতে লাগলাম, আসলেই কি আমি ওর প্রেমে পড়েছি? দিনরাত শুধু এ কথাই ভাবতাম। অস্থির লাগতে লাগল এই ভেবে যে, কবে স্কুল খুলবে? অবশেষে স্কুল খুলল। ক্লাস নাইনে আমরা দুজনই সায়েন্সে চলে গেলাম। আমাদের সব বন্ধুই অন্যান্য গ্রুপে। এ কারণেই আমরা একা হয়ে গেলাম। তাই আমি প্রতিদিন আগে আগে স্কুলে যেতাম এবং ওর পাশে বসতে চেষ্টা করতাম। পেট্রাও মানা করত না। তত দিনে বুঝে গেছি আমি পেট্রাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু যেহেতু ও খ্রিষ্টান, ওর সাথে তো প্রেম হওয়া অসম্ভব। ওর থেকে দূরেও থাকতে পারতাম না। তাই ভেবেছিলাম অন্তত ওর বেস্ট ফ্রেন্ডের জায়গাটা আমার হোক। আস্তে আস্তে আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম। তখনই আমরা তুই তুই করে বলতে শুরু করি। আমরা পড়াশোনায় দুজন দুজনকে সাহায্য করতাম। দুজনই ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, ইংলিশ আর ম্যাথ স্কুলের টিচারদের কাছে পড়তে শুরু করলাম। বুঝতেই পারছ, স্কুল, পড়তে যাওয়া–সব মিলিয়ে সারা দিন একসাথে থাকতাম। আস্তে আস্তে এমন অবস্থা হলো যে একজনকে ছাড়া আরেকজনের চলত না। ভাইজানও তত দিনে বুঝে গেছে যে আমি পেট্রাকে ভালোবাসি। কিন্তু আগবাড়িয়ে কিছু বলত না। ক্লাস নাইনের হাফ ইয়ার্লি এক্সামের পর স্কুল আবার বন্ধ। স্যারের বাসায়ও পড়তে যাই না। সপ্তাহখানেকের ছুটি! আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম পেট্রাকে দেখার জন্য। তখনকার যুগে তো আর মোবাইল এত অ্যাভেইলেবল ছিল না। আমাদের বাসায় ল্যান্ডফোন ছিল। ভাইজানের পারসোনাল মোবাইল ছিল, ও তো তখন কলেজে পড়ত। পেট্রা প্রায় প্রতিদিনই ওর বাবা বা মায়ের মোবাইল থেকে টিঅ্যান্ডটি ফোনে বা ভাইজানের ফোনে ফোন করত। তখন আমাদের কথা হতো। এবং আমি বুঝতে পারলাম, পেট্রাও আমাকে মিস করে। তা না হলে ছোট ছোট সব কারণে ও আমাকে ফোন করবে কেন?
নিকিতা জিজ্ঞেস করল, ‘আসলেই কি আপুও তোমাকে ভালোবাসত? পরে নিশ্চয়ই জেনেছ?
হ্যাঁ, জেনেছি। পেট্রাও ক্লাস নাইনে ওঠার পরই বুঝে ফেলেছিল আমি ওকে ভালোবাসি। আস্তে আস্তে ও নিজেও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিল, আমি মুসলিম বলেই ও ব্যাপারটা চেপে রেখেছিল।
‘আচ্ছা, তারপর?
‘ছুটির মধ্যে চার-পাঁচ দিন হয়ে গেল দুজন দুজনকে দেখি না। পাগলপ্রায় অবস্থা আমার। ভাইজানকে বাসা থেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে সব বললাম। ভাইজান বলল ও আগেই বুঝেছিল। আমি ভাইজানের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, কী করব?
ভাইজান বলল, দ্যাখ, অনেক সময় এমন পরিস্থিতি আসে যে মনকে কোনোভাবে সামলানো যায় না। পেট্রাও বোধ হয় তোকে ভালোবাসে। এখন তো তোর পক্ষে নিজেকে সামলানো আরও মুশকিল। যাতে তুই ভালো থাকবি, তা-ই কর। কিন্তু আগেই বলে রাখি, আমি তোকে গ্যারান্টি দিতে পারি, বাবা-মা জীবনেও মানবে না এই সম্পর্ক। তবে হ্যাঁ, তুই যা-ই করিস না কেন, আমি আজীবন তোর পাশে থাকব।
আমি সেদিন সারা দিন ভাবলাম, ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে পারলাম না। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম, মন যা চাইবে তা-ই করব, কিছু ভাবব না। ভাবতে গেলেই সব গুলিয়ে যায়। রাতে মন চাইল পেট্রাকে দেখব। যদিও এক এলাকাতেই থাকি কিন্তু পেট্রার বাসা তো চিনি না, কীভাবে যাব? এমন সময় পেট্রা ভাইজানের মোবাইলে ফোন করল। আমি বললাম, পেট্রা, তোর বাসাটা কোথায় রে? ঠিকানা দে। পেট্রার অভ্যাস ছিল, প্রশ্ন করলে আগে উত্তর দিত। তারপর কারণ জানতে চাইত। সেদিনও বাসার ঠিকানা বলে তারপর জানতে চাইল কেন চাইলাম। আমি বললাম, আমি আসছি, ফোন কাছে রাখিস।
ও বলল, রাত বাজে একটা, প্রিয়। তুই এখন কেন আসবি?
আমি বললাম, খুব জরুরি কাজ আছে, আমাকে আসতেই হবে। আমি তোকে একটা জিনিস দেব।
ও বলল, ঠিকাছে, কাল সকালে আয়।
আমি খামোখাই ওকে ধমক দিলাম। বললাম, আমাকে এক্ষুনি আসতে হবে। এই মুহূর্তে।
ও বলল, এত রাতে বের হতে পারব না।
আমি বললাম, আমি জানি না তুই কীভাবে বের হবি। আমি গিয়ে ফোন করব।
আমার জেদ দেখে ও বলল, আচ্ছা আয়, তোর বাসা থেকে এখানে আসতে কতক্ষণ লাগবে?
আমি তো অনুমতি পেয়ে মহাখুশি। বললাম, দশ মিনিট।
ও বলল, আমাদের বাসায় শুধু আমরাই থাকি। একতলা বাসা। বাসার পেছনে আমবাগান আছে। আমি দশ মিনিট পর ওখানে থাকব। তুই আগে এলে অপেক্ষা করবি, আমি আগে গেলে আমি অপেক্ষা করব। কিন্তু ফোন দিস না। ফোন চুরি করে এনেছিলাম, আবার চুরি করে রেখে আসতে হবে।
আমি আমবাগানে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে পেট্রা চলে এল। ও চোরের মতো এসে ফিসফিস করে বলল, কী ব্যাপার, কী এমন জিনিস দিতে এসেছিস? কাল পর্যন্ত কি আমরা মরে যেতাম?
আমি বললাম, আমাকে দিতে এসেছি।
ও ভয় পেয়ে গেল। ও চাচ্ছিল না আমি প্রপোজ করি। বলল, প্রিয়, তুই পাগল হয়ে গেছিস। তুই বাসায় যা।
এ কথা বলে ও চলে যাচ্ছিল। আমি ফট করে বলে ফেললাম, আই লাভ ইউ।
ও বলল, ফর গড সেক, এই কথাটা ভুলেও বলিস না। তুই মুসলিম, আমি খ্রিষ্টান। আমাদের ভালোবাসা অপরাধ, পাপ।
এটুকু বলে প্রিয় থেমে গেল। নিকিতা বলল, তারপর কী হলো? প্রিয় বলল, তারপর আর কী? ও আমাকে ফিরিয়ে দিল। আমি অনেক বোঝালাম, সারা জীবন পাশে থাকার প্রমিজ করলাম। কাজ হলো না। ও হঠাৎ কান্নাকাটি শুরু করে দিল। বাসায় চলে যেতে চাচ্ছিল। তারপর যেতে দিলাম, আমিও বাসায় ফিরে এলাম।
নিকিতা জিজ্ঞেস করল, তাহলে প্রেম হলো কবে?
‘ফাইনাল পরীক্ষার সময় হয়েছিল। বাকিটা আবার কাল বলব। এখন ঘুমাব। অলরেডি তিনটা বাজে। কাল অফিস আছে, ভোরে উঠতে হবে।’
‘আচ্ছা, ঠিকাছে।
প্রিয় শুয়ে পড়ল। নিকিতাও আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে প্রিয় ঘুমানোর জন্য গল্প বলা বন্ধ করে নি। হয়তো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। ওর মুখটা কেমন যেন হয়ে গেছে। ও কি প্রপোজালের রাতের কথা সব বলেছে, নাকি কিছু স্কিপ করেছে? নিকিতার কেন যেন খুব খারাপ লাগছিল প্রিয়র জন্য। ইচ্ছা করছিল প্রিয়কে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রাখতে। কিন্তু সেই অধিকারও তত তার নেই।
নিকিতার ধারণা সত্যি। প্রিয় শুয়ে পড়ল ঠিকই কিন্তু ঘুমানোর জন্য নয়। আজ তো কিছুতেই ঘুম আসবে না। নিজের আবেগপ্রবণ চেহারাটা নিকিতাকে দেখাতে চাচ্ছিল না, তাই শুয়ে পড়েছে। স্মৃতিগুলো একটু ঝাপসাও হয় না কেন? কত বছর আগের কথা। অথচ মনে হয় যেন কয়েক দিন আগেরই ঘটনা। পেট্রা চোরের মতো পা ফেলে ফেলে এসেছিল আমবাগানে। প্রিয় প্রপোজ করেছিল। পেট্রা কোনোভাবেই মানছিল না। যখন চলে যাচ্ছিল, তখন প্রিয় তার হাত ধরে থামিয়েছিল। পেট্রা বলছিল, ‘প্রিয়, কী করছিস? হাত ছাড়, আমাকে যেতে দে।
প্রিয় পেট্রাকে গাছের সঙ্গে ঠেকিয়ে মুখ চেপে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই আমাকে ভালোবাসিস না?
পেট্রা অনেক চেষ্টা করেও প্রিয়র হাত সরাতে পারল না। তারপর ইশারায় বোঝাল যে, মুখ চেপে ধরে রাখলে বলবে কীভাবে? প্রিয় বোকা বনে গেল। মুখ ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘বল, সত্যি কথা বলবি।’
পেট্রা বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে বলেছিল, ‘হারামি, মুখ চেপে ধরার যোগ্যতাও নাই? নাকসহ কেউ ধরে? আরেকটু হলে আমি মরে যেতাম।
প্রিয় ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘আনসার মি।’
পেট্রা খুব স্বাভাবিক গলায় মিথ্যা কথাটা বলেছিল, না, আমি তোকে ভালোবাসি না।
‘তুই নিশ্চিত?
‘শতভাগ নিশ্চিত। তুই শুধু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
প্রিয় সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে পেট্রার মুখটা ধরে গাছের সঙ্গে ঠেকিয়ে চুমু খেয়েছিল ঠোঁটে। পেট্রা প্রচণ্ড অবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভালো তো সেও বাসত। সে টেরও পেল না কখন তার হাত দুটো প্রিয়কে জড়িয়ে ধরল। কখন তার ঠোঁট জোড়া প্রিয়র ঠোঁটের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিল। প্রিয়ই একসময় থেমেছিল। হেসে বলেছিল, তার মানে তুইও আমাকে ভালোবাসিস। নাহলে একটা চড় মারতি এক্ষুনি।’
পেট্রা তখন কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল। কারণ, ওই মুহূর্তেই সে বুঝেছিল, সে শুধু ভালোই বাসে না প্রিয়কে, সে প্রিয়কে চায়ও। প্রিয় পেট্রার হাত দুটো নিজের দুহাতে ধরে দুই হাঁটু গেড়ে বসল। পেট্রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। প্রিয় পেট্রার হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বলল, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই হাত কখনো ছাড়ব না, আজীবন তোর পাশে থাকব। প্রতিজ্ঞা করছি, ধর্ম, পরিবার, সমাজ–কোনো কিছু আমাকে তোর থেকে দূরে সরাতে পারবে না। প্রতিজ্ঞা করছি, কখনো তোকে কাদাব না। প্রতিজ্ঞা করছি, তুই ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে আমার জীবনে আসবে না। প্রতিজ্ঞা করছি, পরীক্ষার হলে তোকে একা রেখে বের হব না। প্রতিজ্ঞা করছি, তোকে প্রতিদিন চালতার আচার কিনে দেব। প্রতিজ্ঞা করছি, বৃষ্টির মধ্যে টংদোকানে বসে চা খেতেও আপত্তি করব না আর। প্রতিজ্ঞা করছি, তোর সব প্র্যাকটিক্যাল আমি করে দেব। আর…’।
পেট্রা এসব শুনতে শুনতে কাঁদছিল। প্রিয় থেমে যাওয়ায় জিজ্ঞেস করল, আর কী?
প্রিয় আমতা আমতা করে বলল, আর ঐশ্বরিয়ার পেটের দিকেও তাকাব না।’
শেষ কথাটা শুনে পেট্রা কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দিল। প্রিয়ও হাসল। বলল, ‘মজা করছি না। আমি সত্যি এগুলো করব।
পেট্রা হাত ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এটা হয় না, তুই চলে যা। আমরা যেমন বন্ধু ছিলাম, তেমনই থাকব আজীবন।
এ কথা বলে পেট্রা চলে গিয়েছিল। প্রিয়ও বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। একটুও মন খারাপ করে নি। কারণ ওর ভেতর একটা আত্মবিশ্বাস চলে এসেছিল। পেট্রা যত যা-ই বলুক, ওকে ভালো তো বাসে। ওই মুহূর্তে ওটাই যথেষ্ট ছিল। তার ওপর জীবনের প্রথম চুমুর অনুভূতিটা প্রিয়র মস্তিষ্কে আর কিছু আসতে দেয় নি। হাসতে হাসতে সিটি বাজাতে বাজাতে চলে গিয়েছিল। সারা রাত একফোঁটা ঘুমাতে পারে নি। কী সুখের রাত যে ছিল!
অথচ সেই সুখানুভূতির কথা ভাবতেই আজ চোখে জল এসেছে প্রিয়র।
প্রিয় চোখ মুছে পেছন ফিরে দেখল নিকিতা ঘুমিয়ে পড়েছে। কত সহজে ঘুমিয়ে যেতে পারে মানুষ। ও কেন পারে না? পেট্রা কি ঘুমাতে পারে? খুব সম্ভবত পারে না। পেট্রা কী করছে এখন? ফোন করবে? ফোন করলে কি ধরবে পেট্রা? প্রিয় বিছানা থেকে পা নামিয়ে বসল কিছুক্ষণ। তারপর স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ধীর পায়ে ওয়ার্ডরোবের কাছে গেল। এই ওয়ার্ডরোবের চারটা ড্রয়ারই লক করা থাকে, যার চাবি শুধু প্রিয়র কাছেই আছে। ওপরের ড্রয়ারটা খুলল প্রিয়। এই ড্রয়ারে পেট্রার স্মৃতিবিজড়িত সব জিনিসপত্র আছে। সবকিছুর ওপর হাত বুলিয়ে নিল। তারপর ড্রয়ারটা বন্ধ করে দ্বিতীয় ড্রয়ারটা খুলল।
দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ–এই তিনটা ড্রয়ার ভর্তি হয়ে আছে পেট্রার লেখা অজস্র চিঠি। প্রতিদিন রাতে চিঠি লিখত তারা। ক্লাসে দিত দুজন দুজনকে। কিন্তু শর্ত ছিল, বাসায় যাওয়ার আগে কেউ চিঠি পড়তে পারবে না। ওরা কেউই শর্ত ভাঙে নি। দুজনেই রাত হলে চিঠি পড়ত। কলেজে উঠে দুজনই পারসোনাল মোবাইল পেয়েছিল। অনেক রাত পর্যন্ত ফোনে কথা বলত ওরা। তারপরও চিঠি লেখা কখনো বন্ধ হয় নি। বিয়ের পর যখন একসঙ্গে থাকত, তখনো দুজনই সারা দিনে কোনো এক ফাঁকে চিঠি লিখে লেটার বক্সে ফেলে রাখত। একইভাবে দুজনই লেটার বক্স চেক করত। সবগুলো চিঠিই যে বড় তা নয়, অনেক ছোট ছোট চিঠিও আছে। শেষ চিঠিটা প্রিয় পেয়েছিল নিকিতার সঙ্গে ওর বিয়ের দিন।
প্রিয় একটা চিঠি উঠিয়ে ভাঁজ খুলল। কালি ছড়িয়ে লেখা এপাশ ওপাশ হয়ে গেছে। তবু পড়া যাচ্ছে। প্রিয় পড়তে শুরু করল,
‘আমার প্রিয়,
মাত্রই তোর সাথে কথা বলে ফোন রাখলাম। এখন পড়তে বসেছি। কিন্তু পড়তে ইচ্ছা করছে না। আমি মেডিকেলে চান্স পাব না দেখিস! তুই ঠিকই পেয়ে যাবি। তখন আমরা দুজন আলাদা জায়গায় পড়ব। প্রতিদিন আর দেখা হবে না। এসব ভেবে আরও মন খারাপ লাগছে। এসব কথা পড়ে রাগ করিস না, প্লিজ। কী করব বল, তোর থেকে দূরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না তো।
জানিস, এখন আমার তোর হাতের টমেটোভর্তা খেতে ইচ্ছা করছে! সাথে ভর্তায় মাখা তোর হাতটা চেটে চেটে খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পাব কোথায়? ছি ছি, কী সব ইচ্ছা করে আজকাল আমার! সব তোর দোষ।
-তোর পেট্রা
প্রিয় চিঠিটা পড়ে আবার ভাজ করে রাখল। ডয়ার লক করে দিল পানি খেলো, পুরো বাড়িতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। তারপর ঘরে ফিরে সিগারেট ধরাল। সিগারেট টানতে টানতে ঘরের মধ্যেই এদিক-ওদিক পায়চারি করতে লাগল। বদ্ধ ঘরের মধ্যে ধোয়া জমতে শুরু করল। ধোয়ায় তার চোখ জ্বলতে লাগল। ভালোই হলো, এই সুবাদে বেশ কিছুটা চোখের জল বেরিয়ে আসতে সুযোগ পেল। সিগারেট একটা শেষ হতেই দ্রুত হাতে আরেকটা ধরাল। একটু ড্রিংক করতে পারলে ভালো হতো, ঘুমাতে পারত। কিন্তু বাড়িতে কিছু নেই, সেই কবে শেষ হয়েছে। তারপর আর আনা হয় নি। মন্ত্রীসাহেবের ঘরে আছে কি না কে জানে! আর থাকলেও নিশ্চয়ই ওপরেই রেখে যায় নি। এসব ভাবতে ভাবতেই আজান দিয়ে দিল। প্রিয় অবাক হলো না। এ রকম কত নিঘুম রাত কেটেছে তার জীবনে, সেই হিসেব নেই।
নিকিতা চোখ খুলে দেখল প্রিয় তাকে ডাকছে, ‘নিকিতা? এই নিকিতা? আরে ওঠো।’
নিকিতা ঘুমের চোখেই যখন দেখল প্রিয় অফিসের জন্য রেডি, তখন লাফিয়ে উঠল। কম্বল সরাতেই দেখল তার শাড়ি ঠিক নেই। সঙ্গে সঙ্গেই প্রিয় অন্যদিকে তাকাল। নিকিতা শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল, ‘ইশ,
সরি সরি। এত দেরি হয়ে গেছে, তুমি আমাকে ডাকো নি কেন?
প্রিয় তার স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘সমস্যা নেই। আমি তোমাকে ডাকতাম না। দরজা লাগানোর জন্য ডেকেছি। কাজের লোকদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি চলে গেলে তোমার এভাবে ঘুমানোটা বিপজ্জনক, মন্ত্রীসাহেবের বাসা তো, শত্রুর অভাব নেই।’
নিকিতা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘তুমি পাঁচ মিনিট সময় দাও আমাকে, আমি নাশতা রেডি করে দিচ্ছি।’
‘আমি নাশতা করে নিয়েছি।’
নিকিতা অবাক হয়ে বলল, ‘কী নাশতা করেছ? কে বানাল?
‘ব্রেড ছিল দেখলাম। টোস্ট-ওমলেট বানিয়ে নিয়েছি।’
‘সরি, তোমাকে কষ্ট করতে হলো। আমি টেরই পাই নি তুমি কখন উঠেছ।
প্রিয় হেসে বলল, ‘এত অপ্রস্তুত হওয়ার কিছু হয় নি। আমার নাশতা তৈরি করা তোমার চাকরি নয়। দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি বেরোচ্ছি।
·
·
·
চলবে...................................................................................