পেট্রা ঘুম থেকে উঠে দেখল সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। হাতে ক্যানোলা লাগানো, স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। বেডের পাশেই চেয়ারে বসে বসে স্মরণ ঘুমাচ্ছে। পায়ের কাছে রায়ান কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। উঠে বসল পেট্রা। প্রচণ্ড দুর্বল লাগছে। কী হয়েছে তার? সে হাসপাতালে। কেন? কয়েক সেকেন্ড কিছু মনে করতে পারল না। মনে করতে চেষ্টা করতেই মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো। এর মধ্যেই শুনতে পেল রায়ানের ফোন বাজছে। পেট্রা রায়ানের গায়ে হাত রেখে ডাকল, ‘রায়ান, ফোন বাজছে।
রায়ান ধড়মড় করে উঠে বসল। তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে একবার তাকিয়ে পেট্রার দিকে এগিয়ে দিল। বলল, ‘প্রিয়দা।
পেট্রা চমকে উঠল। এতদিনে ফোন করার কথা মনে হলো! স্মরণ ও রায়ান যে এখানেই আছে সেই হুঁশও তার ছিল না। ফোন ধরেই ধমক দিল, ‘হ্যালো প্রিয়, তোর কি আমাকে মানুষ বলে মনে হয় না? আমার ছেলেকে নিয়ে কোন জাহান্নামে গিয়ে পড়ে আছিস তুই? আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করলি না? ছেলের ওপর সব অধিকার তোর একার?
পেট্রার ধমকের শব্দে স্মরণের ঘুম ভেঙে গেল। স্মরণ তখন অবাক হয়ে এই অচেনা পেট্রার দিকে তাকিয়ে রইল।
যখন পেট্রার অভিমান উপচে পড়ে তখন সে এভাবেই ধমকায়। আর পেট্রার এই অভিমানী ধমক খেতে প্রিয়র বরাবরই ভালো লাগে। ধমক খেয়ে নিজের অজান্তেই প্রিয় হেসে উঠল। পেট্রা বলল, ‘খবরদার হাসবি না, হাসলে দাঁত ভেঙে দেব।’
ওদিকে রায়ান স্মরণকে বলল, ‘স্মরণ ভাইয়া, চলেন আমরা ডক্টরকে ডেকে আনি?
স্মরণ রায়ানের সঙ্গে বের হয়ে গেল। প্রিয় বলল, ‘বাবা তোর কাছে গিয়েছিল?
‘ফোন করেছিল।
‘আচ্ছা। তোর গলার স্বর এমন লাগছে কেন? তুই কি অসুস্থ?
‘অসুস্থ হই বা মরে যাই আমি, খবর নেওয়ার তুই কে?
প্রিয় নরম গলায় বলল, ‘এত রাগ করিস না দোস্ত। তখন আমি বাসা থেকে বের হয়ে না গেলে খুনোখুনি হয়ে যেত।
‘কেন, কী এমন হয়েছিল?
‘নিকিতা তোর সব চিঠি পুড়িয়ে দিয়েছে। সাথে আর যা যা ছিল সব।’
‘ওহ।’
পেট্রা চুপসে গেল। বুকের ভেতরটা হঠাৎ ফাঁকা ফাঁকা লাগল। প্রিয়। বলল, আমার মোবাইলে ল্যাপটপে তোর ছবি, কল রেকর্ডিং যা যা ছিল সব ডিলিট করে দিয়েছিল।
‘ব্যাকআপ ছিল না?
‘তা ছিল, রিকভার করে নিয়েছি পরদিনই। কিন্তু চিঠিগুলো তো আর কখনো পাব না। তা ছাড়া ঘটনা এখানেই শেষ না। এসব করেছে বলে রাগ করে নিকিতাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর সে এমন একটা কথা বলল যে আমিই বের হয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।’
‘কী এমন বলেছে?
‘বলছি। তুই আগে শুদ্ধর সাথে কথা বলে নে। নিকিতা তোর জিনিসগুলো নষ্ট করেছে এটা শুদ্ধ কাল জেনেছে। তারপর থেকে মন খারাপ, অনেক কেঁদেছে।’
‘তুই এসব ওকে বলতে গেছিস কেন? এখন তো ও নিকিতাকে সহ্যই করতে পারবে না।’
‘শুদ্ধ বড় হচ্ছে। তা ছাড়া ওর আমার সম্পর্ক যা-ই হোক, সবার আগে আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে উঠতে চাই। তাই ওর জানার অধিকার আছে এমন কিছুই ওকে লুকাব না আমি।
‘শুদ্ধকে দে।’
শুদ্ধ ফোন ধরেই বলল, ‘মা, আই মিস ইউ।
‘আই মিস ইউ টু বাবা। বুকে আয়।
‘আসছি মা।’
কিন্তু মাকে না পেয়ে শুদ্ধ বাবার বুকের মধ্যে ঢুকে গেল। পেট্রার চোখে পানি এসে গেল। বলল, আমার বাবাটা নাকি কাল অনেক কেঁদেছে?
‘হ্যাঁ। নিকিতা আন্টি খুব পচা। তোমার সব জিনিস নষ্ট করে দিয়েছে। আই হেট হার। আর কক্ষনো মা বলব না। মেরে ফেললেও মা বলব না।
‘এত রাগ করতে হয় না বাবা। আমি তো তোমার বুকের মধ্যে আছি। কেউ সেখান থেকে আমাকে দূরে নিতে পারবে বলে?
‘কক্ষনো না। কোনোদিনও না।
‘তাহলে আর রাগ কোরো না। মা, তোমাকে অনেক অনেক চিঠি লিখব।’
‘কিন্তু বাবারগুলো?
‘বাবার কাছে আমার আরও অনেক কিছু আছে সোনা।
‘সত্যি? কই বাবা আমাকে দেখায় নি যে?
‘ওগুলো তো দেখানো যায় না বাবা।
‘বুঝতে পেরেছি।
‘মাকে একটা কথা বলো তো। কোথায় আছ তোমরা?
‘সরি মা, এটা তো বলা যাবে না।’
পেট্রা অবাক হয়ে গেল। ছেলেকে ট্রেনিং দিয়ে নিজের মতো বানিয়েছে প্রিয়! বলল, আমাকে বলো। আমাকে বললে কোনো সমস্যা নেই।
‘না মা। বাবা মানা করেছে। সরি মা। মাফ করে দাও আমাকে। তুমি যা যা বলতে মানা করেছিলে একটাও বাবাকে বলি নি।
‘ঠিকাছে বাবা, বলতে হবে না। যেখানে আছ, ভালো আছ তো?
‘অনেক ভালো আছি মা। আমরা অনেক সুন্দর জায়গায় আছি। এখানে সবকিছু খুব সুন্দর।
শুদ্ধকে বেশ উত্তেজিত লাগছে। কোথায় আছে ওরা? যেখানেই থাক, ভালো থাকলেই ভালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘ব্রেকফাস্ট করেছ?
‘হ্যাঁ মা। বাবা এত্ত সুন্দর করে খিচুড়ি রান্না করেছিল। আর সাথে ডিমভাজি। কী যে মজা হয়েছিল মা! তুমি যদি খেতে তাহলেই শুধু বুঝতে।’
হ্যাঁ, তোমার বাবা তো অনেক ভালো রান্না করে।’
‘আচ্ছা মা, তুমি বাবার সাথে কখনো পালিয়েছ?
কথাটা শুনে পেট্রার বুকের মধ্যে দামামা বাজতে লাগল। মনে পড়ে গেল ছোট্ট শুদ্ধকে কোলে নিয়ে গভীর রাতে প্রিয়র হাত ধরে কীভাবে পালিয়ে গিয়েছিল এককালে। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, এ কথা কেন বলছো বাবু?
‘বাবার সাথে পালানো অনেক মজা। বাবার কত বুদ্ধি! একদম সুপার হিরোদের মতো করে পালায়। আমরা কক্সবাজারে একটা লোককে বেঁধে রেখে পালিয়ে এসেছি। হি হি হি।’
শুদ্ধর এমন মনখোলা হাসি শুনে পেট্রার মনটা ভরে গেল। হেসে বলল, আমিও তোর বাবার সাথে একবার পালিয়েছিলাম। সাথে তুইও ছিলি।’
‘কই আমার তো কিছু মনে নেই!
‘তুই তো তখন ইটুখানি ছিলি বাবা। কোলের মধ্যে থাকতি সারাক্ষণ।
‘হি হি…’
পেট্রা এবার আরও হেসে বলল, ‘তোর বাবা তো এর আগেও দুবার তোকে নিয়ে পালিয়েছিল।’
‘সত্যি? কই আমি তো জানি না।’
‘ছোট ছিলি তো, বুঝতে পারিস নি। তুই ভেবেছিস ঘুরতে গেছিস।
‘এবার কিন্তু বুঝে ফেলেছি মা।
ছেলের খুশি দেখে প্রিয়র মনটা আনন্দে ভরে গেল। মা-ছেলে প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো গল্প করল। তারপর প্রিয় শুদ্ধকে গাইডের সঙ্গে রেখে স্টিমারের অন্যপ্রান্তে চলে গেল। গিয়ে বলল, ‘নিকিতা জেনে গেছে শুদ্ধ আমাদের ছেলে নয়। গ্রেটও দিয়েছে শুদ্ধকে নাকি সব বলে দেবে।
পেট্রা আঁতকে উঠে বলল, ‘নিকিতা কীভাবে জানল?
‘তোর চিঠি পড়ে।
‘ও কি সব চিঠি পড়েছে?
‘কে জানে!
‘ছি ছি, কত চিঠিতে কত কিছু লিখেছি! কী লজ্জার ব্যাপার হলো।’
‘তো? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ওসব কথা হতেই পারে। সে পড়ে অন্যায় করেছে। লজ্জা পেলে তার পাওয়া উচিত। আমরা কেন লজ্জা পাব?
‘নিকিতা চাবি পেল কোথায়?
‘জানি না। কোনোভাবে চুরিটুরি করেছিল বোধহয়। আর আমার মহান পিতা তো আছেনই।’
‘যা গেছে তা গেছে। কিন্তু আমার ভয় লাগছে শুদ্ধকে নিয়ে। ও যে অভিমানী ছেলে! ও আমাদের ছেলে না জেনে যদি কিছু করে বসে? তোর মনে নেই, একবার প্রিয়াঙ্কা দুষ্টুমি করে বলেছিল–তোকে তো পেট্রা টোকাইদের থেকে নিয়ে এসেছে। তারপর শুদ্ধ আমাদের কেউ না এটা ভেবে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল?
‘আমার ভয়টাও সেখানেই। নিকিতা যখন বলল শুদ্ধকে সব বলে দেবে, ভয়ে আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। তার মতো মেয়ে বলতেই পারে। অতিরিক্ত সাহস তার। তাকে যে ধোলাই দিয়েছিলাম তার পরে সে তোর চিঠি পোড়ায় কোন সাহসে ভেবেই পাচ্ছি না।’
‘একটা কাজ কর না।
‘কী?
‘তোর বাবা তো আমার কাছে শুদ্ধকে রাখতে দেবে না। কিন্তু হোস্টেলে রাখলে তো তার কিছু বলার থাকবে না। কোনো ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দে। কিংবা ইন্ডিয়াতে কোনো ভালো বোর্ডিং স্কুলে?
‘আমি শুদ্ধকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমার জীবন ও।
‘ওর ভালোর জন্য প্রিয়! সব সময় ও নিকিতার চোখের সামনে না থাকলে নিকিতা ওকে নিয়ে ভাববে না।’
প্রিয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি পারব না শুদ্ধকে ছাড়া থাকতে।
পেট্রা এবার ম্লান হেসে বলল, ‘শুদ্ধর সাথে তোর রক্তের সম্পর্ক, আমার সাথে রক্তের না। কিন্তু জন্মের পর থেকে ওকে বুকে করে বড় করেছি। আমি আছি কী করে ওকে ছাড়া? তোকে ছাড়াও তো আছি। বাবা-মা সবাইকে ছাড়া আছি। আমি তো ভালোই আছি। সবাইকে ছাড়াই থাকা যায়। কারও জন্য জীবন থেমে থাকে না প্রিয়।
প্রিয় কী বলবে বুঝতে পারল না। পেট্রার ওপর রাগও হচ্ছিল, মায়াও হচ্ছিল! দুজনই কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ রইল। তারপর পেট্রাই বলল, ‘তাহলে বরং প্রিয় তুই নিকিতাকে অবহেলা করা বন্ধ কর। দেখবি তোর একটু অ্যাটেনশন পেলেই সে এসব উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলবে না, উল্টাপাল্টা কাজও করবে না।’
‘তুই আসলে কী বলতে চাচ্ছিস পেট্রা? আমি কেন ওকে অ্যাটেনশন দিতে যাব? আমি কি ওকে শখে বিয়ে করেছি? কাউকে ভালোবাসা এত সোজা?
‘ভালোবাসতে না পারলে বাসিস না। কিন্তু অন্তত ওর পাওনাটুকু ওকে দে। দেখবি ওর মাথা একদম ঠান্ডা হয়ে যাবে তাহলে।
‘তুই এখন আমার সামনে থাকলে থাপ্পড় মেরে তোর দাঁত ফেলে দিতাম। অসভ্য মেয়ে কোথাকার!’
‘রাগ করিস না প্রিয়। এভাবে জেদ খাঁটিয়ে তুই শুদ্ধকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছিস। আজ নিকিতা হুমকি দিয়েছে, কাল যদি সত্যিই বলে দেয়? এই জেদ করে কী পাবি তুই?
‘আমি বাবর খানের কাছে হার মানব না।’
‘ইলজিক্যাল ইগো! তুইও ঠিক তোর বাবারই মতো। সেও ইগো দেখিয়ে ছেলেদের জীবন নষ্ট করেছে, তুইও করতে যাচ্ছিস। তোের বাবার সাথে তোর চুল পরিমাণ ফারাক নেই।’
‘পেট্রা!
প্রিয়র ধমক খেয়ে থেমে গেল পেট্রা। পরক্ষণেই ভাবল থামবে কেন সে! সে তো ভুল বলে নি। তাই মাথা ঠান্ডা রেখেই আবার বলল, ‘রাগ করিস না। ছেলেটার কথা ভাব। আর ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর, নিকিতার সাথেই তো থাকতে হচ্ছে। তোর নিকিতার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই সেটা তোর বাবা জানে না। হলেও তোর বাবা জানবে না। কিন্তু তুই এটা দিয়ে নিকিতাকে চুপ করিয়ে রাখতে পারবি? ওই মেয়েটাও তো তোকে শখে বিয়ে করে নি। বিয়ের আগে তো সে জানতই না কোন ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। জানলে নিশ্চয়ই বিয়ে করত না। স্বামী অবহেলা করলে সেটা একটা মেয়ের জন্য চূড়ান্ত অপমানের। এর চেয়ে অপমানের আর কিছু হয় না। আজ যদি সে কোনো অন্যায় করে, পাগলামি করে, ভুল করে তাহলে সেসব করতে তুই আর তোর বাবাই বাধ্য করেছিস।
প্রিয় তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘নিকিতার সাপোর্ট নিচ্ছিস?’।
‘নিকিতা কি আমার নিজের পেটের মেয়ে নাকি মায়ের পেটের বোন নাকি আমার প্রিয় বন্ধু যে ওর সাপোর্ট নেব? আমি একজন মানুষ হিসেবে, একজন মেয়ে হিসেবে নিরপেক্ষ কথা বলেছি। পরে একা হলে মাথা ঠান্ডা রেখে ভেবে দেখিস ভুল কিছু বলেছি কি না।
প্রিয় আর কিছু বলল না। পেটা আবার বলল, ‘তই কী করবি সেটা অবশ্যই তোর সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমার ছেলের কিছু হলে আমি তোকে ছাড়ব না। আমার ছেলে যেন আজীবন ভালো থাকে সেই দায়িত্ব তোকে নিতে হবে, নাহয় আমাকে দিতে হবে।
‘সবাই মিলে আমাকে থ্রেট দিতে লেগে গেছিস? তোকে ফোন করাটাই ভুল ছিল আমার!
‘আমি কোনো থ্রেট দিচ্ছি না…’
পেট্রাকে কথা শেষ করতে দিল না প্রিয়। লাইন কেটে দিল। পেট্রা আবার ডায়াল করতেই নম্বরটা বন্ধ পেল।
·
·
·
চলবে....................................................................................