পেট্রা অপেক্ষা করছিল প্রিয় রেকর্ডিংটা শুনে ওকে ফোন করবে। কিন্তু অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল। এখনো ফোন করছে না কেন? এসব ভাবতে ভাবতেই ফোন এল।
‘হ্যালো।
‘হা প্রিয়, শুনেছিস?
‘হ্যাঁ।
‘দেখ, নিকিতা আমাদের এভাবে ভুল বুঝবে, এটা ঠিক না। আমি ওকে বোঝাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওর প্রচণ্ড মাথাগরম। ও শুনছিল না আমার কথা। তুই ওকে বোঝ। আবার রাগারাগি করিস না।’
‘এখন বোঝা, এখন শুনবে? কাল ও আমাদের ৩০০ ফিটের ওখানে দেখেছে, চুমু খাওয়ার সময়। তাই এত কাহিনি। তোর যা বলার তুই সরাসরি ওকে বল। ওকে বোঝনোর সাধ্য আমার নেই।’
প্রিয় ফোনটা নিকিতার হাতে দিল। নিকিতা হ্যালো বলতেই গলার স্বর শুনে পেট্রার মনে হলো মেয়েটা কাঁদছে। প্রিয় কি ওকে বকা দিয়েছে? রেকর্ডিংটা তো সে এ জন্য পাঠায় নি। ওই কথাগুলো মুখে বলতে পারবে বলেই রেকর্ডিং দিয়েছে। পেট্রা বলল, আপনি কি কাঁদছেন?
নিকিতা বলল, ‘না।’
পেট্রা স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে নিকিতা কাঁদছে, তবু যখন বলতে চাইছে না, থাক। ওদিকে প্রিয় ইশারা দিল মাফ চাওয়ার জন্য। নিকিতা বলল, ‘সকালে আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। আজেবাজে কথা বলেছি। কাজটা ঠিক হয় নি। আমাকে মাফ করে দেবেন।
পেট্রা বলল, ‘মাফ চাইতে হবে না। যদিও ব্যাপারটা নিয়ে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করা যেত, তবু আপনার খারাপ ব্যবহারের কারণে আমি কিছু মনে করি নি। আসলে স্বামীর সাথে সম্পর্ক ঠিক না থাকলে কোনো মেয়েরই মাথা ঠিক থাকে না। জানি না আপনার সঙ্গে প্রিয়র সম্পর্ক কতটুকু কিন্তু আমার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, এটা সত্যি। আমাদের নিয়মিত ফোনেও কথা হয় না, দেখাও হয় না। কারও জন্মদিন বা ক্রিসমাস–এ রকম খুব স্পেশাল কোনো দিনে হয়তো দেখা হয়, কিন্তু প্রতিবছর না। আমাদের এত বছর ধরে সম্পর্ক ছিল, দেখা হলে আমরা দূরে থাকতে পারি না। তাই বলে আমাদের মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক নেই। কাল যতটুকু দেখেছেন, অতটুকুই। আর এসবের জন্যই আমরা সহজে দেখা করি না।’
নিকিতা চুপ। পেট্রা আবারও বলল, আমাকে শত্রু ভাবার কিছু নেই। কারণ, প্রিয়র সাথে আমার সম্পর্ক আর কখনোই জোড়া লাগবে না। তাই যোগাযোগ রাখার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া আপনাদের বিয়ের জন্য আমাদের সম্পর্ক ভেঙেছে, ব্যাপারটা এমনও কিছু না। আমাদের সম্পর্ক অনেক আগেই ভাঙা হয়েছে। আপনি যদি চলেও যান, তবু আমি প্রিয়কে পাব না। আমাদের সমস্যাটা আপনি নন। আমাদের সমস্যাটা অন্য জায়গায়, সেই সমস্যাটা আপনি আসার অনেক আগে থেকেই। আপনি চলে গেলে আরেকজনকে আনা হবে ওর বউ বানিয়ে। সেই আরেকজন আপনার মতো করে আমার ছেলেকে আদর-যত্ন না-ও করতে পারে। তাই আমি মনেপ্রাণেই চাই আপনি প্রিয়র সাথে থাকুন, আপনাদের সংসার সুখের হোক।’
নিকিতা এবারও কোনো কথা বলল না। পেট্রা একটু থেমে আবারও বলল, ‘প্রিয় প্রায়ই আমার সাথে দেখা করতে চায়, আমি তার মেসেজের রিপ্লাই দিই না। ফোন ধরি না। আমি আমাদের বিচ্ছেদ মেনে নিয়েছি, কিন্তু প্রিয় মানতে পারে নি। জেদ ধরে বসে আছে। আমার বিয়ে হয়ে গেলে দেখবেন আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি একটু ধৈর্য ধরে থাকুন। আজ আপনাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, দেখবেন একদিন হুট করেই হয়ে যাবে। আপনার সাথে কথা বলে আমার মনে হয়েছে আপনার খুব মাথাগরম। কোনো ব্যাপারে এ রকম মাথা গরম করে কিছু করবেন না, প্লিজ। কারণ, প্রিয়র অনেক মাথাগরম। সে রেগে গেলে তাকে ঠান্ডা করা মুশকিল। সংসারে দুজনই মাথাগরম থাকলে, সেই সংসারে অশান্তি হতে থাকে। প্রিয় খুব অসহায়। তার সাথে রাগারাগি করবেন না। তাকে বুঝুন, ভরসা দিন, আশ্রয় দিন। এখন এটা তার খুব প্রয়োজন। আপনার কাছে সে এসব পেলে আপনি তাকে পেয়ে যাবেন। আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি না। বড় বোনের মতো কিছু কথা বললাম শুধু।
নিকিতা অবাক হয়ে যাচ্ছে পেট্রার কথা শুনে। পেট্রা এত ভালো, এত কিছু বোঝে! এ জন্যই বোধ হয় আজও প্রিয় তাকে এত ভালোবাসে! নিকিতা এবার বলল, ‘আপু, প্রথমে প্রিয় জোর করছিল বলে আমি আপনার কাছে মাফ চেয়েছিলাম। এখন মন থেকে মাফ চাইছি। আপনাকে আমি ভুল বুঝেছিলাম। সকালের ঘটনার জন্য এখন আমার খুব লজ্জা লাগছে।’
পেট্রা স্বাভাবিকভাবেই বলল, ওসব আমি মনে রাখি নি। আর সকালের ঘটনাটা প্রিয়কে জানিয়েছি বলে রাগ করবেন না। ছোটরা ভুল করে। আমাদের বড়দের দায়িত্ব থাকে হোটদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া। ভুল না ধরিয়ে দিলে তারা শিখবে কোথা থেকে? সকালেই এই কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি শুনছিলেন না। প্রিয়কে না বললে আপনি এভাবে আমার কথাগুলো শুনতেন না। তাই বলতে বাধ্য হয়েছি। তা ছাড়া, আমি যে দোষ করি না, তার বোঝা কাঁধে নেই না।’
‘বুঝতে পেরেছি।’
তারা যতক্ষণ কথা বলছিল, প্রিয় চুপ করে সব দেখছিল। পেট্রা ফোন কেটে দিতেই নিকিতা ফোনটা প্রিয়কে ফেরত দিল। প্রিয় ফোনটা নিয়ে বাইরে চলে গেল।
—————
‘ফর গড সেক, পেট্রা, এমন কথা বলিস না। আমরা তো কোনো সম্পর্ক রাখছি না, তাহলে মাঝেমধ্যে একটু দেখা করলে ক্ষতি কী?
‘ক্ষতি আছে। আমাদের একদমই দেখা করা উচিত না। হঠাৎ দেখা হলেও না-দেখার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। কারণ, আমরা আর যাই হোক বন্ধু হয়ে আর থাকতে পারব না। দেখা হলেই স্বামী-স্ত্রীর মতো আচরণ করতে থাকব। এটা অন্যায়।
‘তুই তো আর কিছু করিস না। অন্যায় করলে আমিই করি।’
‘কিন্তু আমি তোকে বাধা দিতে পারি না, এটা আমার অন্যায়।
‘তুই তো আমাকে বাধা দিস, আমিই শুনি না।’
‘তর্কাতর্কি করতে ফোন করি নি। যেটা চলছিল, সেটাই শেষ করার জন্য ফোন করেছি। আজকে আমার কাছে প্রতিজ্ঞা কর, আর কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে আমার সামনে আসবি না তুই। আজ আমি ফোন নম্বর চেঞ্জ করব। বাসায় বা অফিসে কোনোভাবে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করবি না।’
প্রিয় উতলা হয়ে জানতে চাইল, ‘তোর ছেলে? ওর সাথেও কোনো যোগাযোগ রাখবি না?
‘রাখব। নিকিতা বা আঙ্কেলের মাধ্যমে। ওর সাথে যোগাযোগ করার জন্য তোকে লাগবে না। প্লিজ প্রিয়, মুক্তি দে আমাকে। আমি এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না।
‘ঠিকাছে, যা মন চায়, কর। তোকে জোর করার অধিকার তো আমি কবেই হারিয়ে ফেলেছি!’
‘আরেকটা কথা আছে আমার।’
‘বল।
‘নিকিতাকে মেনে নে।’
‘পারব না।’
‘প্লিজ প্রিয়। ও যে পরিস্থিতিতে আছে, একটা মেয়ের জন্য সেটা সহ্য করা কতটা কষ্টকর, তা তুই পুরুষমানুষ হয়ে বুঝবি না। তাও সে সব সহ্য করে কেন আছে, বুঝিস না? তোকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সে।’
‘কে বলেছে ভালোবাসতে?’
‘ভালোবাসা কি বলেকয়ে হয়?
‘উফ, জ্ঞান দিস না। অন্য কথা বলার থাকলে বল, না হলে জাহান্নামে যা। অসহ্য লাগছে তোকে আমার। ফোন রাখ তো।
‘রাখছি, আমার কথাগুলো ভেবে দেখিস। যেভাবেই হোক, তোদের বিয়ে হয়েছে। এখন মেনে নেওয়াই ভালো। ওকে না মানলেই যে আমরা আবার এক হতে পারব, তা-ও তো না।’
‘তোকে জোর করে ডিভোর্স পেপারে সাইন করানো হয়েছে। আর আমি এখনো ডিভোর্স পেপারে সাইন করি নি।
‘না করলেই কী? কিছুই করতে পারবি না তুই। কারণ, তোর হাত পা বাঁধা।
‘হাত-পা বাঁধা বলেই এখন আমার সাথে যে যা পারছে তা-ই করছে। কখনো আমার বাপ, কখনো তুই! যা পেট্রা, আর আটকাব না তোকে।
পেট্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রিয় ফোন রেখে দিল।
—————
রাত বাজে একটা। শুদ্ধ বলল, ‘নিকিতা আন্টি, কোথায় গেল আমার বাবা? এখনো আসছে না কেন? কখন আসবে?
নিকিতা কী জবাব দেবে? গলা আর মাথাব্যথায় মরে যাচ্ছে আর এদিকে শুদ্ধকে কিছু বোঝানো যাচ্ছে না। ওদিকে প্রিয় ফিরে আসছে না, কোথায় গেল সেই চিন্তায় দিশেহারা লাগছে। বলল, ‘বাবা একটা কাজে গেছে শুদ্ধ। কাজ শেষ হলেই চলে আসবে। প্লিজ, তুমি ঘুমিয়ে যাও।
শুদ্ধ শুয়ে পড়ল কিন্তু ওর ঘুম আসছে না। বাবা কোথায় গেল? বাবা। দূরে গেলে তো ওকে বলে যায়। তাহলে আজ কী হলো বাবার?
আজ যা হয়েছে তাতে নিকিতা আরেকটু হলে মরে যেত। এত চেঁচামেচি হলো, কেউ এল না! কাজের মেয়েরাও না। কারই-বা সাহস আছে? শ্বশুর বাড়ি ফেরার পর কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই তাকে বলেছে। অথচ সে একবার খোঁজও নিল না। সে আজ এটুকু বুঝেছে, প্রিয় যত বড় অপরাধ করুক না কেন শ্বশুর সাহেব টু-শব্দ করবেন না, যতক্ষণ না তার গায়ে লাগে ব্যাপারটা। আর প্রিয়র ভালোবাসা পাওয়ার জন্য জেদ করার কোনো মানে হয় না। কখনো তা পাওয়া যাবে না। প্রিয় একটা বদমেজাজি ঘাড়ত্যাড়া ছেলে। তাই বলে যে তার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে পারে, সেটা কখনো বোঝে নি সে। এই তো কত হাসি-ঠাট্টা করত তার সঙ্গে। নিজে গিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছে। ফার্স্ট সেমিস্টারের অ্যাসাইনমেন্ট করে দিয়েছে। মাঝেমধ্যেই পড়তে বসাত, ঘুরতে নিয়ে যেত। কত ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল! আজ এসব করে সে কি প্রিয়র মন থেকে একেবারেই উঠে গেল? তার কি এখন চলে যাওয়া উচিত? কিন্তু কোথায় যাবে সে? সব ছেড়ে বাপের বাড়িতে গেলে তো সঙ্গে সঙ্গে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। কী করবে? এসব ভাবতে ভাবতেই পেট্রার বলা কথাগুলো মনে পড়ল। আবার আশার সঞ্চার হলো মনে। আচ্ছা, পেট্রা এটা বলল কেন যে প্রিয় অসহায়? কোন দিক দিয়ে অসহায় প্রিয়?
রাত দুটায় প্রিয় বাড়ি ফিরল। ঘরে ঢুকে দেখল শুদ্ধ ঘুমাচ্ছে। নিকিতা বসে আছে পাশে। প্রিয়কে দেখে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। প্রিয় কাছে গিয়ে শুদ্ধকে আদর করল। চিন্তায় সম্ভবত শুদ্ধর ঘুমটা গভীর ছিল না। প্রিয় আদর করতেই শুদ্ধ জেগে গেল। বলল, ‘বাবা, কোথায় গিয়েছিলে তুমি?
প্রিয় শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘একটা কাজে গিয়েছিলাম, বাবা। এখন আছি তোর কাছে, ঘুমা।
প্রিয় শুদ্ধর সঙ্গে শুতেই শুদ্ধ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। শুদ্ধ ঘুমালে প্রিয় উঠে গেল। ওঠার সময় দেখতে পেল নিকিতার গলায় তার দশ আঙুলের ছাপ পড়ে গেছে। ভয়ংকর লাগছে। ইশ, এত জোরে ধরেছিল! কোনো হুঁশই ছিল না তখন। কত ব্যাথা না যেন পেয়েছে। প্রিয় ফার্স্ট এইড বক্স থেকে একটা অয়েনমেন্ট বের করে নিকিতার সামনে রেখে বলল, এটা গলায় লাগাও, ব্যাথা কমে যাবে।’
অভিমানে নিকিতার বুকের ভেতর থেকে কান্না উঠে এল। প্রিয়র দিকে তাকিয়েই বলল, ‘দরকার নেই।
‘দরকার আছে, অনেক ব্যথা পেয়েছ। লাগাতে বলছি লাগাও।’
কোত্থেকে যেন সাহস চলে এল। এতক্ষণ যার ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ছিল, তাকেই এখন আর ভয় লাগছে না। বলল, ‘পারব না আমি।’
‘নকশা কম করো।’
এ কথা বলেই প্রিয় নিকিতাকে টেনে দাঁড় করাল সামনে। তারপর চুল সরিয়ে গলার দাগগুলোর ওপর দিয়ে অয়েনমেন্ট লাগিয়ে দিল। নিকিতা নিশ্চুপ। চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল অনবরত। প্রিয় বলল, ‘উফ, ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবে না। চোখ মোছো।
নিকিতা চোখ মুছল। প্রিয় বারান্দায় গিয়ে বসল। সিগারেটও খেতে ইচ্ছা করছে না আজ। একটু পরই পাশে নিকিতাকে দেখতে পেল। নিকিতা বলল, ‘আমি বসি?
‘ইচ্ছা।’
নিকিতা বসল কিন্তু কিছু বলল না। সে জানে না সে কেন প্রিয়র কাছে এল। কিছুক্ষণ পর প্রিয় খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘সরি নিকিতা। তোমার গায়ে হাত তোলা ঠিক হয় নি আমার। আসলে হুঁশ ছিল না তখন। কী যে করছিলাম, তা আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না।’
নিকিতা চপ। প্রিয় শান্ত স্বরে বলল, ‘কিন্তু তুমিও খুব ভুল করেছ। তুমি যা-ই দেখো, যা-ই ভাবো, যা-ই বোঝ না কেন, সেটা নিয়ে তোমার আমার সাথে কথা বলা উচিত ছিল। তুমি তা না করে চলে গেলে পেট্রাকে গালাগালি করতে। তুমি জানো, এই মেয়েটাকে ভালোবেসে আমি ওর সর্বনাশ করেছি? কী করে নি ও আমার জন্য? আর আমি ওর কোনো সম্মান রাখতে পারি নি। আমার বাবা ওকে চূড়ান্ত অপমান করেছে। ব্ল্যাকমেল করে ডিভোর্স আদায় করেছে। কীভাবে ওকে আর আমাকে আলাদা করা হয়েছে, তা জানলে শিউরে উঠবে তুমি। ওর নিজের বাবা যত দিন বেঁচে ছিল, ওর সাথে কথা বলে নি। ওর মা ওকে উঠতে-বসতে অপমান করে। ওর আত্মীয়স্বজন ওকে অপমান করে। বলাবলি করে যে শুদ্ধ আমাদের অবৈধ বাচ্চা। ওর বিয়ে হচ্ছে না, আমার আর শুদ্ধর কথা জানতে পেরে একটার পর একটা বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে ওর। বয়সও হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই আমাদের দেশে খ্রিষ্টান পাত্র পাওয়া মুশকিল। এসব প্রেশার ওর মায়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। সেই প্রেশারগুলো মা আবার ওকে দিচ্ছেন। তুমিও ওকে অপমান করলে, নিকিতা!
প্রিয় অন্যদিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল। নিকিতা খেয়াল করল শেষ কথাটা বলার সময় প্রিয়র গলাটা কেঁপে উঠল। নিকিতার ভীষণ খারাপ লাগল। প্রিয় কিছু সময় চুপ থেকে আবার বলল, ‘অথচ বিয়ের রাতে যখন আমি তোমাকে বলেছিলাম আমি তোমাকে স্ত্রীর জায়গা দিতে পারব না, তখন তো তুমি মেনে নিয়েছিলে। পরদিন তুমি বাপের বাড়িতেও চলে গিয়েছিলে। সেখানে সমস্যা হওয়ায় যখন তুমি চলে এসেছিলে, তখন তোমাকে কিছু শর্ত দিয়েছিলাম, মনে আছে?
‘আছে।’
‘কী, বলো তো?
‘বলছিলে তোমার ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপারে নাক গলাতে পারব না। স্ত্রীর জায়গাও চাইতে পারব না। শুদ্ধকে কষ্ট দিতে পারব না।’
‘তুমি সব শর্ত মেনে নিয়েছিলে?
‘হ্যাঁ।
‘তাহলে আজ এই তুচ্ছ ঘটনাটা নিয়ে পেট্রাকে গালাগালি কেন করলে? তোমার কি মনে হয় নি এটা নিয়ে আমার সাথে কথা বললেই হত?
নিকিতা চুপ। প্রিয় বলল, ‘ভালো যখন বাসতে পারব না, তোমাকে অন্তত ভালো রাখতে চেয়েছিলাম আমি। এ জন্যই আমি তোমাকে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছি। সব ধরনের স্বাধীনতা দিয়েছি। তোমার সাথে বন্ধুর মতো মিশেছি। এটা কি ভুল ছিল আমার? তার জন্যই তুমি এতটা অধিকার খাটাতে চলে গেলে? যে অধিকারটা কিনা আমি তোমাকে কখনো দিই নি!
নিকিতা মাথা নিচু করে রইল। প্রিয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তুমি হয়তো জেনে খুশি হবে, পেট্রা আজ ফোন নম্বর চেঞ্জ করেছে। আমি দেখা করতে চাইলে দেখা করত না, তাই মাঝেমধ্যে হুট করে ওর সামনে চলে যেতাম। আজ ও আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে, যাতে এই কাজটা আর কখনো না করি। খুশি হয়েছ তুমি?
নিকিতা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মার খাক আর যা-ই হোক, যে উদ্দেশ্যে এ কাজ সে করেছিল, তা তো সফল হলো! যোগাযোগ না থাকলেও মাঝেমধ্যে যে একটু-আধটু হতো, সেটা তো বন্ধ করা গেছে। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে, সে প্রিয়কে এত কষ্ট দিতে চায় নি। প্রিয়র অবস্থা
দেখে প্রচণ্ড খারাপ লাগছে তার। দুজন আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর প্রিয় ঘরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। নিকিতা উঠে প্রিয়র সামনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রিয় জিজ্ঞেস করল, ‘কী?
নিকিতা প্রিয়কে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সরি প্রিয়। আমি সত্যি বুঝতে পারি নি।
প্রিয় নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
·
·
·
চলবে...................................................................................