শিকদার সাহেবের দিনলিপি - পর্ব ০৭ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


নির্মলেন্দু গুণের মোনালিসা নামের একটা কবিতা আছে,

চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই
সদ্য রজঃস্বলা এক কিশোরীরে–
যে জানে না, কী কারণে হঠাৎ এমন
তীব্র তুমুল আনন্দ-কাতরতা
ছড়িয়ে পড়েছে তার নওল শরীরে।
মনুর ভাষায় গৌরী, এইটুকুনু মেয়ে
চমকে ওঠে নিজের পানে চেয়ে–
দেখে তার অঙ্গজুড়ে ফুলের উৎসব।
মনে হয় ছড়িয়ে পড়েছে মর্ত্যে
নার্গিস আর বার্গিসের স্বর্গপুষ্পঘ্রাণ।
মাকে ডেকে মেয়েটি শুধায়–
‘আমার শরীরে ফুলের সৌরভ কেন?
মেয়েরা বুঝি ফুলের উদ্যান?’

মীরাকে দেখে তৎক্ষণাৎ আমার এই কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেল। সদ্য কৈশোরে পা দেয়া এক পুষ্প সে। সাধারণত আমি স্কুল কলেজের মেয়েদের দিকে তাকাই না। তাই কৈশোরের সৌন্দর্য আমার সেভাবে জানা নেই। গল্প উপন্যাস-কবিতায় পড়া পর্যন্তই। আজ মীরাকে দেখলাম, আপাদমস্তক দেখলাম। ভালো চোখে দেখলাম, অসভ্য চোখে দেখলাম। দেখে জানলাম কৈশোরের সৌন্দর্য। ওর হাত ধরে বুঝলাম… এই ফুলকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, যেন ছিঁড়ে যাবে!

আজ আমি আবারও প্রেমে পড়েছি ওর চোখে তাকিয়ে। ওইটুকু সময়ের মধ্যে ওর চোখে কতবার ডুবেছি জানি না। ওই চোখ দুটো স্বচ্ছ, রিক্ত অবিন্যস্ত। যেন আমি যা কিছু লিখে দেব তাই হবে ওই দুটি চোখের ভাষা।

প্রথম প্রথম আমার ভেতরে ভেতরে কিছুটা অস্বস্তি ছিল যে এত ছোট একটা মেয়ের সঙ্গে… কিন্তু দিনে দিনে আমার ভেতরকার অনুভূতিগুলো সেই অস্বস্তিকে হারিয়ে দিয়েছিল। আজ ওকে দেখে মনে হলো ওই অস্বস্তিটা ছিল এক অকারণ অস্বস্তি। প্রেম ভালোবাসার সম্পর্কে কিছুটা বয়সের পার্থক্য থাকলে ক্ষতি নেই। বরং এই পার্থক্যটা কোত্থেকে আচানক এক দায়িত্ব এনে দিল। মনে হলো অনেক যত্নে রাখতে হবে এই নিষ্পাপ ফুলকে। আমার চোখের সামনে একদিন এই ফুল বড় হবে। আমিও বড় হব। তাই তখনো সে আমার কাছে ফুলই থাকবে। আজীবন যেন এই ফুলের যত্ন নিতে পারি। এই ফুল থেকে আমি একটা বাগান করে ফেলব! সৃষ্টিকর্তা আমাকে সাহায্য করুন। ওই চোখে নিমজ্জিত থাকতে চাই সহস্ৰকোটি বছর ধরে।

রাফসান শিকদার
১৫ নভেম্বর, ২০০৯

একটু আগে ৩ ঘণ্টা কথা বলেছি মীরার সঙ্গে। অনেকদিন পর। জানি না কী বলি কিন্তু সময় বয়ে যায়। এরপর দেখি তিন-চার ঘণ্টা কথা বলে ফেলেছি। দেখা করে আসার পর একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সেই ঘোর কিছুটা কেটেছে। তবে সারাক্ষণ মাথায় কেবল মীরাই ঘুরছে। কথা কীভাবে বললাম? ও আচ্ছা তোকে তো বলা হয়নি বকুল, আমি মীরাকে একটা ফোন কিনে দিয়েছি। টাকা কোথায় পেলাম? আমার পিসির হেডফোনটা বিক্রি করে দিয়েছি। ওটা তো অত জরুরি কিছু না বল? তার চেয়ে জরুরি মীরার সঙ্গে কথা বলা। আবার টাকা জমিয়ে হেডফোন একটা কিনে ফেলব নাহয়। ঈদ আসলেই তো আবার সালামি পেয়ে বড়লোক হয়ে যাব।

রাফসান শিকদার
১৫ নভেম্বর, ২০০৯

একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। আজকাল আমার ক্ষুধা লাগে । ঘুম আসে না। দাড়ি কাটতে ইচ্ছা করে না। ক্যাম্পাসে যেতে ইচ্ছা করে । সারাক্ষণ ইচ্ছা করে কলাবাগানের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। দাড়ির ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম মীরা বলেছে, ওর আমার দাড়ি ভালো লাগে তাই কাটতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু বাকিগুলো?

প্রেমে পড়ে কি আমি পাগল হয়ে গেলাম রে? আমি মানুষটা সুবিধার না। সহজে প্রেমে পড়ি না কিন্তু প্রেমে পড়লেই পাগল হয়ে যাই। শান্তনার জন্য কি কম পাগল ছিলাম? কী করিনি ওর জন্য? অসম্ভব কতকিছুই তো অবলীলায় করেছিলাম! প্রেমে পড়লে সাহস, শক্তি, সামর্থ্য, আত্মবিশ্বাস সবকিছুই কি বেড়ে যায়?

বকুল জানিস, আমার কেবলই ভয় হয়! ঘরপোড়া গরু তো! কিন্তু আমি জানি মীরা শান্তনার মতো না। নিশ্চয়ই ও আমাকে ঠকাবে না। ওর মতো নিষ্পাপ মানুষের পক্ষে কাউকে ঠকানো সম্ভব না। ওরা কেবল মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসতে জানে। তবুও কোন আশঙ্কায় হঠাৎ হঠাৎ বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করে ওঠে?

রাফসান শিকদার
১৬, নভেম্বর, ২০০৯

মীরাকে দেখলেই ঘাম ছুটিয়ে দেয়া এক প্রগাঢ় অনুভূতি বুকের মাঝে মাদল বাজাতে শুরু করে। সকল নিষেধ অগ্রাহ্য করে অনুভূতিরা আচ্ছন্ন করে রাখে দিনভর, রাতভর। ওর হাসি ওর দৃষ্টি সবকিছু ক্ষণে ক্ষণে পাগল করে তোলে। নিষিদ্ধ ভাবনারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পুনরায় নিজেকে দমিয়ে রাখি। ও যে কেবল পুষ্পকুঁড়ি। আগে তো ওকে প্রস্ফুটিত পুষ্প হতে হবে।

আজ মীরা আগেরদিনের মতো চুপচাপ ছিল না। বেশ কথা বলেছে। মজার ব্যাপার কি জানিস বকুল? আমি যতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, ততক্ষণ ও ভুলেও আমার দিকে তাকায় না। আমি চোখ সরাতেই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। ভালোবাসার মানুষকে প্রাণভরে দেখার মাঝে এক অন্যরকম সুখ আছে। তা থেকে ওকে বঞ্চিত করি কী করে বল তো? তাই আমি ইচ্ছে করেই বারবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমাকে দেখার সুযোগ করে দিই।

রাফসান শিকদার
১৯ নভেম্বর, ২০০৯

বকুল শোন, তোর সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে আমার। হ্যাঁ মীরার ব্যাপারেই। তোকে ওর কথাই বেশি বলা হয় কারণ ওর কথা আমি কাউকেই বলতে পারি না। রাহিকে অবশ্য বলেছি কেউ এসেছে আমার জীবনে। কিন্তু বিস্তারিত কিছুই বলতে পারিনি। একমাত্র তোর কাছেই ওর সব কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। আলাপের বিষয়বস্তু হচ্ছে মীরার পাগলামি। এই মেয়ে তো ভয়াবহ রকমের পাগল হয়ে গেছে আমার জন্য। আমি যে ফোনটা দিয়েছি সেটা স্বাভাবিকভাবেই লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে। কথা ছিল প্রতি রাতে অল্প করে কথা হবে। লুকিয়ে লুকিয়ে আসলে খুব বেশি বলাও সম্ভব না। কিন্তু এই মেয়ে যা করছে! বাথরুমে লুকিয়ে কথা বলে, ছাদে লুকিয়ে কথা বলে। কোচিং-এ যাওয়ার সময় সারাপথ কথা বলতে বলতে যায়। কি না করে! তবু তার কথা বলা চাই! দুদিন পর পর দেখা করতে চায়। অসম্ভব মায়া জড়িয়ে হাত ধরে রাখে আমার। ভালোবাসার কথা মন খুলে বলে, যা কি না আমি কখনোই সেভাবে পারি না। আমি কাউকে সহজে ভালোবাসতেও পারি না। আবার ভালোবাসলে গলে পানি হয়ে যাই। তাই আমি পাগল হব-এটা স্বাভাবিক তাই বলে ওই পক্ষও এত পাগল হবে?

অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে জানিস? আমার ধারণা শান্তনা আমার সঙ্গে যত বেইমানিই করুক না কেন কখনো ভালোবেসেছিল। এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভালোবেসেছিল। কিন্তু সেই ভালোবাসায় কোনো পাগলামি ছিল না। অন্ধত্ব ছিল না। কিন্তু এই মেয়েটা? এমন করেও মেয়েরা ভালোবাসতে জানে! জানলেও ও এমন করে ভালোবাসছে কেন আমাকে? আমি তো এমনিতেই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, এবার কি তবে বদ্ধপাগল হব?

রাফসান শিকদার
২১ নভেম্বর, ২০০৯

ডায়েরিটার এতটুকু পর্যন্ত পড়ে মীরার প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। সে যেন টাইম মেশিনে করে ফিরে গেছে ১৪ বছর আগে। বুকের ভেতর নানারকম অনুভূতির জোয়ার ভাটা চলছে। এত ভালোবাসা! শুরুতেই এত ভালোবাসা ছিল তার জন্য রাফির? এত উতলা এত উত্তেজিত ছিল রাফি তাকে নিয়ে? অথচ তাকে কখনোই বুঝতে দেয়নি। একটা মানুষ এত চাপা স্বভাবের কী করে হয়? কেন হয়?

মীরা আবার ডায়েরিটা পড়া শুরু করল।
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp