প্রিয়তম স্বামীর থেকে পাওয়া ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে হতভম্ব আননে বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে আছে অষ্টাদশী কন্যা চিত্রলেখা। আঁখি জোড়া পানিতে টইটম্বুর। এই বুঝি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে বারবার। শরীরটা অসাড় হয়ে পড়েছে। হেঁটে ঘর অবধি যাওয়ার ক্ষমতা টুকুও অবশিষ্ট নেই। এই এক জীবনে তবে এটারই বাকি ছিল? এখন কোথায় যাবে মেয়েটা? তিনকুলেও যে নিজের বলতে কেউ নেই। না, না আছে তো। অসুস্থ শয্যাশায়ী বাবা, সৎ মা আর ওই যে দুটো বোন, এক ভাই আছে। খোঁজ না নিক, ওকে দেখতে না পারুক তবুও তো তারা আছে। কিন্তু তাদের কাছে যে ওর ঠাঁই মিলবে না। বুক ফেটে কান্না আসছে চিত্রলেখার। এই কোকিল কালো রুপ নিয়ে একটা সোনার মতো সংসার পেয়েছিল কিন্তু সেটাও পোড়া ভাগ্য কেড়ে নিলো। মানুষজন যে ওকে থু থু করবে। এখন ও কী করবে? গলায় ফাঁস দিবে নাকি? তবুও যে মুক্তি মিলবে না। ওপারে কী জবাব দিবে আল্লাহর নিকট? ম্লান মুখে আকাশ কুসুম ভাবনায় বুঁদ হয়ে পড়ল চিত্রলেখা।
ওর থেকে কয়েক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ডাকপিওন সামাদ ভাই। চিত্রলেখার পরিচিত। ওর আব্বার গ্রামের ছেলেটা। শহুরে বাবুর চিঠি তো সামাদ ভাইয়ের হাত দিয়েই পায়। এমনকি ওকে পড়ে শোনায় ও। অশিক্ষিত চিত্রলেখার যে একটা শব্দ পড়ার ও সামর্থ্য নেই। চিত্রলেখার খুব শখ ছিল পড়াশোনা করবে, ডাক্তার হবে, গ্রামে বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা প্রদান করবে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। সামাদের ভীষণ কষ্ট অনুভব হলো চিত্রলেখার জন্য। ডাকল,
"ওই চিত্রা? এহন কিতা করবি?"
শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রশ্নগুলো প্রবেশ করতেই ধ্যান চ্যুত হলো মেয়েটা। এতক্ষণে একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল। শরীরে জড়ানো একটা পুরোনো ছেঁড়া শাড়ি। যা দিয়ে বড়ো একটা ঘোমটা টানা। মুখটা ঢাকা পড়ে আছে তার আড়ালে। হাতের কব্জি অবধি ঢেকে রেখেছে বড়ো হাতার জোড়াতালি দেওয়া একটা ব্লাউজ। কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে আসছে ওর। বারকয়েক চেষ্টা করেও কথা বলতে পারল না চিত্রলেখা। অতঃপর নিজেকে একটু সময় দিলো। কিছু সময় নিয়ে নিজেকে সামলিয়ে নিলো,
"মুই কিচ্ছু জানি না সামাদ ভাই। আ..."
তৎক্ষণাৎ দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনিতে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল চিত্রলেখা। মুহুর্তেই দরদরিয়ে ঘেমে উঠল। আলগোছে শাড়ির আঁচল উঠিয়ে কপাল সহ সম্পূর্ণ মুখ মুছল। অকস্মাৎ পানির পিপাসায় গলা বুক শুকিয়ে এলো। পাশে নিভু নিভু আলোয় জ্বলতে থাকা হারিকেনটা হাতে তুলে নিয়ে ঘরের এক কোণে রাখা কলসের দিকে অগ্রসর হলো। কলসের পাশেই পানির গ্লাস রাখা আছে। ওখানে বসে ঢকঢক করে তিন গ্লাস পানি খেয়ে নিলো মেয়েটা। এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হলো। ওটা তাহলে নিছকই স্বপ্ন ছিল? বাস্তবতা নয়। শান্তির একটা বড়ো শ্বাস ফেলতে নিচ্ছিল তক্ষুনি স্মরণ হলো মুরুব্বিদের বলা একটা কথা। ফজরের আজানের সময় দেখা স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। তবে কী এটাও? আর ভাবতে পারল না চিত্রলেখা। শান্তির শ্বাস টুকু দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হলো। বুকব্যথা ক্রমশ বাড়ল।
মনের মাঝে এক আকাশসম অস্থিরতা নিয়েই উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল দরজার দিকে। ফজরের নামাজ পড়তে হবে। তারপর আবার সংসারের কাজ আছে। ঘুমানোর সুযোগ আর নেই। সারাটা দিন ভুতের ব্যাগার খাটতে হবে। সাথে শাশুড়ি, ননদের কটুক্তি তো ফ্রি।
••••••••••
"এই মা গি র ঝি ঘুম থেইক্যা ওঠ। আর কতখুন ঘুম পাড়বি? সক্কাল কী এহন হইয়াছে? সংছারের কাজকাম কে সারবো? কাইল্লা নাগিনীর শইরের আরামের শেষ লাই।"
বিষাক্ত কথাগুলো কর্ণ গোচর হতেই চিত্রলেখা তৎক্ষণাৎ উঠে বসল। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। অসহনীয় এক যন্ত্রণা দাপিয়ে চলেছে মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরনে। নামাজ পড়ে কখন যে দুচোখ এঁটে এসেছে সেই বিষয়ে অবগত নয় চিত্রলেখা। ওর শাশুড়ি জাবেদা বেগম একভাবে গালিয়ে চলেছে ওকে। এই পর্যায়ে দরজার ওপাশ থেকে বিকট শব্দ ভাসমান হতেই চিত্রলেখা নিজেকে কোনোরকমে ঠিকঠাক করে সেদিকে পা চালাল। দরজাটা খুলতেই শাশুড়ির রণমূর্তী চোখের পর্দায় ভাসল। শুকনো ঢোক গিলল চিত্রলেখা।
"আপনের ঘুম ভাইংগাছে মহারানী? উঠানে পায়ের দুটো ধুলো দিলে নিজেরে ধইন্য মনি কইরতাম। বেলা কত হইয়াছে হুছ আছে আপনের?"
"আম্মা, মোর শরীলডা ভালা লাগতাছে না। সকালে উইঠা কহন যে আবার ঘুম আসি গেছে মোর হুশ নাই। মুই এহনি সবডা কইরা দিতাছি।"
শাশুড়ির মুখনিঃসৃত তিক্ত বাণগুলো হজম করে নরম কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করল চিত্রলেখা। মেয়েটা বরাবরই নরম স্বভাবের। এতো কথা শুনিয়েও অপরপক্ষ দমল না। দাঁতে দাঁত পিষে তাচ্ছিল্য করে বলল,
"এই কাইল্লা প্যাতা শরীলে আবার অসুক ও হয়? মইরতে পারস না তুই? তুরে বিয়া কইরা মোর সোনার লাহান পোলাডার কপাল পুইড়াছে। চোক্কের ছমনে থেইক্যা দূর হ যা। কাজ সাইরা রান্না বসা গা। খিদের জ্বালায় মোর মাইয়াডা কানতাছে।"
কথাগুলো বলে জাবেদা বেগম নিজেই ধুপধাপ পা ফেলে ওখান থেকে চলে গেলেন। চিত্রলেখার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি নিঃশব্দে ঝরে পড়ল। পরক্ষণেই শাড়ির আঁচল দিয়ে সন্তর্পণে তা মুছে নিলো। ঝিমধরা মাথা যন্ত্রণা নিয়েই হাতের কাজ করতে উদ্যত হলো। তাছাড়া উপায় নেই। মেয়েটা নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে অনেক আগেই। ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই। খন্ডানোর সাধ্য কার আছে?
••••••••••
বাড়ির সকল কাজ সেরে বাড়ির পিছনের পুকুরঘাটে রাতের এঁটো বাসনপত্র ধুতে এসেছে চিত্রলেখা। এগুলো ধুয়ে নিয়ে যেয়েই রান্না বসাবে। শরীর মৃদু কাঁপছে। হয়তো জ্বর আসবে সেটারই আভাস দিচ্ছে। তবে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়েটার। সবার কথা ভাবতে যেয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবার ফুরসৎ মেলে না। হাতের কাজ প্রায় শেষ অমনিই কোথা থেকে দৌড়ে এসে ওর পাশে শান বাঁধানো সিঁড়িতে বসে পড়ল কাব্যতা। চিত্রলেখা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে চাইল। কাব্যতাকে দেখতেই ম্লান মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই জগতে এই একটা মানুষই আছে যার কাছে চিত্রলেখা মন খুলে সবটা বলতে পারে। ওর থেকে বয়সে একটু বড়োই হবে। কিন্তু আচরণ সমবয়সীর মতোই। খুব ভালো বন্ধু ওরা দুজন। বিয়ে হয়ে এসে এই একটা মানুষকেই নিজের বলতে পেয়েছে চিত্রলেখা।
"এই কোকিলা তুর মনডা ভালা আছেনি?"
কোকিলা সম্বোধনটা চিত্রলেখার খুব প্রিয়। কাব্যতা ওকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে এই নামে ডেকেছিল। ও জানতে চাইলে বলেছিল ও দেখতে কোকিলের মতোই কালো কিন্তু কণ্ঠস্বর এতটাই সুমধুর যা একবার শুনলে বারবার শুনতে মন চাইবে। তাই নাকি এই নাম দিয়েছে। কাব্যতা স্পষ্টভাষী। কথাতে কোনো মসলা মেশাতে জানে না। যা সত্য সেটাই মুখের উপর বলে দেয়।চিত্রলেখা সেদিন প্রাণ খুলে হেসেছিল। হয়তো জীবনে সেই প্রথম কেউ একজন ওর ভেতরের লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পেরেছিল তাই। চিত্রলেখার মুখের হাসি বাড়ল,
"ভালা আছি আপা। তুমি ভালা আছনি?"
"আছিরে, তুর মুখ দেইখ্যা মনে হইতাছে কিছু একটা হইয়াছে। আবারও ওই শাকচুন্নীডা তুরে কথা শুনাইছে তাই না?"
এই কথায় চিত্রলেখার মুখটা শুকিয়ে এলো। হারিয়ে গেল আনন উজ্জ্বল করে তোলা হাসি টুকু। ছোট্ট করে বলল, "না, আপা।"
"আমারে মিথ্যে কইবার চেইষ্টা করিস না কোকিলা। আমি তুরে খুব ভালা কইরা চিনবার আছি। একটা দিন ওগোর পিঠে লাঠি ভাইংলেই সবডা সোজা হইয়া যাইবো। সারা জীবনের মতো চুলকুনি সব মিইটা যাইবো গা।"
"আরে ওসব বাদ দাও আপা। সবডাই মোর কপাল। মুই মাইন্যা লাইছি সব।"
"হ, কপালের নাম কইরা সারাডা জীবন ওগোর লাত্থি ঝাটা খাইয়া যা। আর সেই মিনসে যে একটা বিয়া বইয়াছে সেইডাই বোধহয় ভুইলা গেছে।"
শহুরে বাবুর প্রসঙ্গ উঠতেই চিত্রলেখার মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে এলো। কতগুলো মাস দেখে না মানুষটাকে। চিঠিও পায়নি প্রায় দুমাস হতে চলল। তার উপর আজ ভোররাতে দেখা ভয়ংকর এক স্বপ্ন মস্তিষ্কে জেঁকে বসে আছে। সবমিলিয়ে আবারও বুক জুড়ে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। কাব্যতা পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
"মিনসে চিঠি টিঠি পাঠাইছে নি?"
"পাঠাই লাই আপা।" ছোট্ট করে উত্তর দিলো চিত্রলেখা।
"আমার কথাডা মিলায়ে নিস কোকিলা। ওই মিনসে নতুন লাং ধইরাছে। নইলে আটটা মাস বিয়া কইরা বউ রাইখা ক্যামনে থাহে শহুরে? শরীরের টান ও লাই মিনসের? ওই খোরাক ক্যামনে মেটায় গা?"
কাব্যতার এমন খোলামেলা কথায় চিত্রলেখা বেশখানিকটা লজ্জা পেল। পরক্ষণেই বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। কতকিছু মানসপটে ভাসল। আনমনে বলে বসল,
"শহুরে বাবু আমারে ভুলবার পারে লাই আপা। ঠিক চিঠি লেইখ্যা পাঠাইবো। ব্যস্ততার জন্যি হয়তো চিঠি লিখবার পারতাছে না।"
"হয় চিঠি লিখবার জন্যি সারাডা দিন, রাত লাইগ্যা যায়। তুই বোকায় রয়ে গেলিরে কোকিলা।"
কাব্যতার কণ্ঠতেই ফুটে উঠেছে একরাশ আফসোস। সবটুকু কেবল চিত্রলেখাকে নিয়েই। চিত্রলেখা জানে আপার সাথে কথাতে ও পারবে না। তাই চুপ থাকায় শ্রেয়। সত্য বলতে শহুরে বাবুর নামে কেউ খারাপ কিছু বললে ওর সহ্য হয় না। প্রথম ভালোবাসা, স্বামী বলে কথা। জগৎ সংসারে আল্লাহর পরে মেয়েদের কাছে স্বামীর ঊর্ধ্বে আবার কিছু আছে নাকি? একমাত্র ওই মানুষটার জন্যই এখানে তিনবেলা ঠিকমতো না খেয়ে, ভুতের মতো সারাদিন খেটে, মাটি কামড়ে পড়ে আছে। কাব্যতা আরও কিছু বলতে নিচ্ছিল কিন্তু জানালা দিয়ে জাবেদা বেগম চিত্রলেখাকে ডাক দিতেই থেমে গেল। চিত্রলেখা নিজেও আর দাঁড়াল না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে আজ। পাছে যদি আবার ঝামেলা করে বসে শাশুড়ি। আপার থেকে বিদায় নিয়ে তড়িঘড়ি করে বাড়ির দিকে ছুটল। সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল কাব্যতা। তাচ্ছিল্য হাসল। মানুষ যে এতটা বোকা হতে পারে সেটা চিত্রলেখাকে না দেখলে ওর জানাই হতো না। চোখের সামনে সবটা পরিষ্কার তবুও তা ধোঁয়াশা করে রাখা। না বোঝার ভান ধরা। কাব্যতার বড্ড মায়া হয় ছোট্ট মেয়েটার জন্য। ওর ক্ষেত্রে ভাগ্য এতটা নির্মম না হলেও পারত। বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। পর মুহূর্তেই কারোর কথা মনে পড়তেই উঠে দাঁড়াল। দুহাতে দুটো বেনুনী নাচানো অবস্থাতেই প্রস্থান করল। আপন মনে গান গেয়ে চলেছে গুনগুনিয়ে। জানালার আড়ালে থাকা দুটো চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ কাব্যতার প্রস্থানের দিকেই। অধর বাঁকিয়ে ক্রুর হাসল।
·
·
·
চলবে………………………………………