অফিসে প্রবেশ করার সাথে সাথেই বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী মানুষটার শক্ত কণ্ঠের এমন বাণী শুনে কিনজার চেহারায় অসহায়ত্ব ফুটে উঠল মুহূর্তের মাঝেই। আজকে যে আবার কতক্ষণ ধরে তার তেঁতো কথা হজম করতে হবে কে জানে!
"কী হলো? উত্তর দিচ্ছেন না যে? না কি কী অযুহাত দেবেন সেটা ভাবছেন?"
পুনরায় প্রশ্নের মুখে পড়ে কিনজা থমথমে গলায় উত্তর দিল,
"ঢাকা শহরের জ্যাম সম্পর্কে আপনি তো অবগত স্যার। আমি যত তাড়াতাড়িই বের হই না কেন, জ্যামের জন্য অফিসে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়।"
"আপনি একাই ঢাকা শহরে থাকেন। আর আমরা তো ভিনগ্রহে থাকি তাই না?"
কিনজা মাথা নত করে উত্তর দিল,
"সবাই ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারলেও আমি পারি না। তার জন্য আমি দুঃখিত। আগামীকাল থেকে আরো দ্রুত বের হওয়ার চেষ্টা করব।"
"শুনুন মিস লেট লতিফ, রাইয়ান তওকীর প্রিয় সময়ের অপচয় পছন্দ করে না। আমি আপনাকে শেষবারের মতো ওয়ার্ন করছি। আর একদিনও যদি আপনি দেরি করে অফিসে প্রবেশ করেন তাহলে আমি অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হব। এখন কাজে লেগে পড়ুন। আপনার জন্য তো আর সময় বসে থাকবে না। অনেক কাজ পেন্ডিং আছে। সময়ের মধ্যে সব কাজ যেন শেষ হয়।"
কথাগুলো বলে গটগট পায়ে হেঁটে রাইয়ান চলে গেল কিনজার পাশ কাটিয়ে। কিনজা কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সেদিকে। তারপর তপ্ত শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল নিজের ডেস্কের দিকে।
কিনজার ডেস্কের পাশের ডেস্কে বসেই রূপন্তি কাজ করছিল। এই মেয়েটার সাথে কিনজার একাধিক সম্পর্ক রয়েছে। একদিকে বেস্ট ফ্রেন্ড অন্যদিকে ক্লাসমেট আবার একইসাথে কলিগ। দু'জনের স্বপ্ন এক। তাই পথচলাও শুরু হয়েছিল একসাথেই। সে আজ থেকে আট/নয় বছর আগের কথা। কলেজের সময় থেকে তাদের পরিচয়। সেই থেকে শুরু তাদের বন্ধুত্ব। সময়ের সাথে কিনজা আর রূপন্তির বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। আজ তারা তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে।
কিনজাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে রূপন্তি জিজ্ঞেস করল,
"কী হয়েছে? আজকেও স্যারের বকুনি খেয়েছিস?"
কিনজা ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল,
"হুম, এ আর নতুন কী!"
রূপন্তি ফাইলের দিকে চোখ রেখে বলল,
"রাইয়ান স্যার সময়ের ব্যাপারে খুব সচেতন। তাই এক মিনিট দেরি করলেও তার বকুনির হাত থেকে রেহাই নেই। আমি তো এই ভয়ে সময়ের আগে আগে বের হই এখন। তবুও ভয়ে থাকি। এই আমি একটু দেরি করে অফিসে ঢুকব আর ওমনি স্যার আমাকে এত্তগুলো কথা শোনাবে।"
কিনজা মুখ ভার করে বলল,
"আমি তো তাড়াতাড়িই বের হই। তবুও কেন যেন দেরি হয়ে যায়।"
"আচ্ছা ছাড় সেসব কথা। আগে বল খেয়ে বের হয়েছিস?"
"না রে, না খেয়েই এত দেরি হয়। খেয়ে বের হতে গেলে তো এক ঘন্টা দেরি করে অফিসে ঢোকা লাগবে।"
"মা তোর জন্য চালের আটার রুটি আর গরুর গোস্ত রান্না করে পাঠিয়েছে। সময় বের করে খেয়ে নিবি কিন্তু। ঐ টেবিলের উপর খাবার রাখা আছে।"
"আচ্ছা"
দুই বান্ধবীর কথার মাঝে ফারহান এসে বলল,
"রাইয়ান স্যার তার রুমে আমাদের সবাইকে ডেকেছে। দ্রুত চলে এসো তোমরা।"
কথাটা শুনে রূপন্তি আর কিনজা একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একসাথেই বলে উঠল,
"আবার!"
স্যার যেহেতু ডেকেছে সুতরাং যেতে তো হবেই। কিনজা চেয়ার ছেড়ে উঠে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
"নির্ঘাত আজ আমাদের উপর আরো পাঁচটা কেস সলভ করার দায়িত্ব দেবে।"
রূপন্তি এ কথা শুনে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
"এই সিআইডি টিমে যুক্ত হয়েছি মাস দুয়েক হলো। সেই থেকে শুধু কাজই করে যাচ্ছি।"
"তুই তো দুই মাস আগে এলি। আমি যে পাঁচ মাস যাবত এই রাইয়ান স্যারের অত্যাচার সহ্য করছি। ভাই বিশ্বাস কর, একটা মিনিটও কারোর সাথে কথা বলার সুযোগ নেই।"
কথা বলতে বলতে রাইয়ানের রুমের সামনে এসে দাঁড়াল দু'জন। কিনজা দরজায় নক করে বলল,
"আসতে পারি স্যার?"
রাইয়ান পেছন ফিরে না তাকিয়েই বলল,
"কাম ইন"
তারা দু'জন ভেতরে প্রবেশ করে এসপি কামরুজ্জামান খানকে দেখে কিনজা বলল,
"স্যার আপনি এখানে!"
কামরুজ্জামান খান কিনজাকে দেখে বলল,
"দুই বান্ধবী একসাথেই চলে এসেছ দেখছি। বসো তোমরা। আজ আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কেস নিয়ে আলোচনা করব। এজন্যই মূলত আমি আজ এখানে উপস্থিত হয়েছি।"
কিনজা একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। তার পাশেই রূপন্তি বসল। কামরুজ্জামান খান সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে রাইয়ানকে জিজ্ঞেস করল,
"এখানে সবাই উপস্থিত আছে?"
"জি স্যার, সবাই উপস্থিত আছে।"
"আমি তাহলে শুরু থেকেই সবটা শুরু করি। প্রথমেই রাইয়ান তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমি। কারণ তুমি যেভাবে তোমার টিম লিড করছ এবং একের পর এক জটিল কেস সমাধান করছ তাতে করে তোমার প্রশংসা না করলে অন্যায় হয়ে যাবে।"
রাইয়ান বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে উঠল,
"স্যার, এটা আমার দায়িত্ব। রাইয়ান তওকীর প্রিয় কখনো তার দায়িত্বের সাথে আপোষ করে না। আমি যা করেছি সবটাই দায়িত্বের জায়গা থেকে করেছি।"
কামরুজ্জামান খান স্মিত হেসে বললেন,
"তা আমি বেশ ভালোভাবেই জানি। আচ্ছা এবার আসল কথায় আসা যাক। গত তিন মাসে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ২২/২৩ জন মেয়ে মিসিং হয়েছে। একের পর এক মেয়ে মিসিং হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ এর কোনো সুরাহা করতে পারছে না। মেয়েগুলোর বয়স খুব বেশি নয়। ১৭ থেকে ১৯ বছর বয়সের মধ্যে হবে। এখন এই কেসটা তোমাদের সলভ্ করতে হবে। আর কোনো মেয়ে মিসিং হওয়ার আগেই তোমরা এর পেছনের কাহিনি খুঁজে বের করবে। এবং এটা বেশ জটিল একটা কেস। উপরমহল থেকেও যথেষ্ট প্রেশার আছে। তাই চেষ্টা করো যত দ্রুত সম্ভব কেসটা সলভ্ করতে।"
"স্যার এই কেসের সমস্ত ডিটেইলস আমার চাই।"
"হ্যা অবশ্যই। এই কেসটার দায়িত্বে এতদিন ইন্সপেক্টর সজীব ভূঁইয়া ছিল। তুমি ওর সাথে দেখা করতে পারো। আর এই কেস নিয়ে এতদিন যা যা তদন্ত করা হয়েছে তার সমস্ত রিপোর্ট এই ফাইলে আছে। আশা করি এটা তোমাকে সাহায্য করতে পারবে।"
রাইয়ান ফাইলটা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে বলল,
"আমি যত দ্রুত সম্ভব এই কেসটা সলভ্ করব আমার টিম মেম্বারদের সাহায্যে।"
"আজ তাহলে আমি উঠি। শুভকামনা রইল তোমাদের জন্য।"
"ধন্যবাদ স্যার।"
কামরুজ্জামান খান রাইয়ানের উপর দায়িত্ব দিয়ে চলে গেলে রাইয়ান এবার তার টিম মেম্বারদের উদ্দেশ্য করে বলল,
"আমার টিমে এই মুহূর্তে আপনারা নয়জন আছেন। কিনজা, রূপন্তি, দিয়া, মহুয়া, অথৈ, ফারহান, সিয়াম, রাকিন, অভ্রনীল, আপনারা প্রত্যেকেই নিজেদের যোগ্যতায় এখানে এসেছেন। আমি আশা করব নিজেদের দায়িত্ব পালনে কোনো প্রকার গাফিলতি করবেন না আপনারা। আমাদের হাতে নতুন একটা কেস এসেছে। আমি চাই আপনারা এই কেসে নিজেদের সর্বোচ্চ এফোর্ট দিন।"
সবাই সমস্বরে বলল,
"ইয়েস স্যার!"
মিটিং শেষে যে যার মতো কাজে লেগে পড়ল। কিনজা বিগত ঘটনাগুলোর একটা সামারি বের করার জন্য প্রতিটা ঘটনা খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। এর মাঝেই দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে গেলে সবাই একসাথে খেতে বসল। খেতে খেতে রূপন্তি বলল,
“এবারের কেসটা একটু জটিল তাই না?”
পাশ থেকে ফারহান উত্তর দিল,
“জটিল বলেই তো আমাদের কাছে এসেছে। সহজ হলে তো আর আমাদের কাছে আসত না।”
মহুয়া মুখটা ভার করে বলল,
“এতগুলো মেয়ে এমনি এমনি মিসিং হয়নি। নিশ্চয়ই ওদের জীবন সংকটাপন্ন। কে জানে কী কী হচ্ছে ওদের সাথে!”
খাওয়ার মাঝে সবাই নানান কথা বললেও কিনজা চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। তার মুখে কোনো কথা নেই। তা দেখে রাকিন বলে উঠল,
“তুমি এত চুপচাপ কেন? কাজের বাইরে একটা কথাও বলো না। সবাই এখানে কথা বলছে। আর তুমি চুপচাপ বসে আছ।”
কিনজা এবার খাওয়া থামিয়ে বল,
“আসলে আমার কাজ ব্যতীত অন্যান্য সময় চুপ থাকতেই ভালো লাগে।”
“কিন্তু কেন?”
রূপন্তি কিনজাকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই উত্তরে বলল,
“আসলে ও একটু ইন্ট্রোভার্ট টাইপের মেয়ে। খুব কম কথা বলে।”
“হ্যা কথা কম বলে। কিন্তু কাজের বেলায় আমাদের চেয়ে বোধহয় ওই বেশি কাজ করে। সারাদিন তো কাজের মাঝেই ডুবে থাকে মেয়েটা।”
অভ্রনীলের কথায় কিনজা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপচাপ নিজের খাওয়া শেষ করে নিজের জন্য এক মগ কফি বানাতে গেল। তখনই সেখানে রাইয়ান এসে হাজির হলে কিনজা তাকে দেখে খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে এভাবে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে দেখে রাইয়ান বলল,
“আপনি চাইলে আপনার কফি বানিয়ে নিতে পারেন।”
“না স্যার, সমস্যা নেই।”
রাইয়ান নিজের কফির মগটা হাতে নিয়ে কিনজাকে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কি বরাবরই এমন অল্পভাষী?”
কিনজা মুচকি হেসে উত্তর দিল,
“না একটা সময় আমি অনেক কথা বলতাম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কথা বলা কমে গিয়েছে। এখন আর এত কথা বলতে ভালো লাগে না।”
রাইয়ান আর কিছু না বলে চলে গেল। কিনজাও নিজের মতো কফি বানিয়ে নিয়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসল। এরপর সে একের পর এক ঘটনাগুলো সাজাতে শুরু করল। আগামীকাল সবার রিপোর্ট সাবমিট করতে হবে। তাই কিনজা কোনো কাজই ফেলে রাখতে চাইছে না।
·
·
·
চলবে……………………………………………………