সোহাগি সাঁঝমল্লার - পর্ব ১৮ - মিথিলা মাশরেকা - ধারাবাহিক গল্প

– তুমি সরোয়ার হামিদের সাথে যোগাযোগটা কমিয়ে দাও বাবা। 

চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন মোশাররফ তালুকদার। কপাল কিঞ্চিৎ ভাজ করে বড়ছেলের দিকে তাকালেন তিনি। মাশফিক সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে ছিল। তবে ওর দৃষ্টি ছিল মেঝের দিকে। আসিফ তালুকদারও মোবাইল থেকে চোখ তুলে ওরদিকে তাকালো। মোশাররফ তালুকদার মুখে তোলার পরিবর্তে চায়ের কাপ নামিয়ে বললেন,

– এসিপির সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেবো মানে? 

– কমিয়ে বলতে. . .পারলে বাদ দিয়ে দাও।

– হঠাৎ এ কথা?

মাশফিক চোখ তুলে বাবাকে চায়ের কাপ টিটেবিলে রাখতে দেখল। তার প্রতিক্রিয়া গুরুতর ছিল। অবশ্য ওর বলা কথাটাও তো গুরুতরই ছিল। কিন্তু এরপর ও যা বলতে চলেছে, সেটার থেকে কম। পরের কথাগুলোকে কি বিশেষণ দেবে তা বুঝেই পেল না মাশফিক৷ ও চোখ নামিয়ে নিতেই আসিফ তালুকদার বলল,

– ব্যপার কি মাশফিক? সায়াহ্ন হামিদ আবারো কোনো ঝামেলা করেছে তোর সাথে?

স্বামীকে সন্ধ্যের চা দিয়ে মিসেস মোশাররফ দোতালায় রুবির কাছে যাওয়ার জন্য রওনা হচ্ছিলেন। সাঁঝও সেখানেই। কিন্তু আসিফের গলায় সায়াহ্নর নাম শুনে থেমে গেলেন তিনি৷ এগিয়ে এসে স্বামীর পেছনে এসে দাড়ালেন। মোশাররফ তালুকদার একদফা ছোটভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আবারো ছেলের দিকে তাকালেন। বহু কষ্টে তিনি সায়াহ্নর প্রথমদিনের করা ঝামেলাকে নজরআন্দাজ করেছিলেন। কিন্তু পরের ঘটনাটা পরোয়া না করার মতো ছিল না। তার হাত থেকেই সেদিন সাঁঝকে কোলে তুলেছিল সায়াহ্ন। আর এ বিষয়টা আরপাঁচটা বাবার মতো তারও সহনীয় লাগেনি। সায়াহ্নর ওপর কিছুটা রাগ তাই মোশাররফ তালুকদারেরও আছে। কিন্তু তাইবলে সরোয়ার হামিদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করার পক্ষপাতীও তিনি নন। তাছাড়া এই ঘটনা মাশফিক, আসিফ কেউই জানে না। তাহলে ওরা এমন কথা কেন বলছে? বেশ কিছুক্ষণ ওর জবাবের অপেক্ষা করার পর মোশাররফ তালুকদার বললেন,

– কথা শেষ করো মাশফিক।

– ওই ছেলে আজ সাঁঝকে প্রোপোজ করেছে!

সাঁঝ সবেই আহিকে কোলে নিয়ে নিচে এসেছিল। মাশফিকের কথা শুনে দরজাতেই পা থামে ওর। কয়েকহাত দূরে দাড়িয়ে ও স্পষ্ট দেখল, মাশফিকের কথা শুনে ওর বাবা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন ওর দিকে। মা, চাচার চেহারার রঙও উড়ে গেছে। মাশফিক মাথা নেড়ে অধৈর্য্যের মতোকরে বলতে লাগল,

– আমার সামনে ও সাঁঝকে ভালোবাসার কথা বলছিল! ওই ছেলের এত্তবড় সাহস যে ও. . .

– কোন ছেলে মাশফিক?

রুবির আওয়াজ শুনে মাশফিক থেমে যায়। কিছুটা চকিত চোখে তাকাতেই দেখে রুবি সামনে। আর পাশেই আহিকে কোলে নিয়ে সাঁঝ দাঁড়িয়ে। বোনের আটকে থাকতে দেখে মাশফিক গলা ঝেরে বলল,

– স্ সাঁঝ? ঘরে যা তুই। বৌমা তুমিও যাও। পরে কথা বলছি তোমার সাথে।

সাঁঝ আহিকে নিয়ে নিজের নিয়ে ঘরের দিকে রওনা হচ্ছিল। কিন্তু রুবি ওরথেকে আহিকে নিয়ে নিলো। তারপর আসিফের পাশে বসে গিয়ে মাশফিককে বলল,

– আমি আসার পর তালুকদার নিবাসের কোনো কথা আমাকে ছাড়া হয়নি। আজ হুট করে এমন নিয়ম করছো যে?

সাঁঝ আটকায়। রুবির অধিকারবোধ দেখে তাজ্জব হয়ে বসে রইল মাশফিকও। রুবিকে ছাড়া তালুকদার নিবাসে কখনো হয়নি তার মানে এই ছিল যে, ওরা সবার মতামতকে প্রাধান্য দেয়। তারমানে এই নয় যে ওরা সব কথাতেই সবাইকে রাখতে বাধ্য! এ পরিবারের কাউকে যদি কখনো বোঝানো হতো, তার সামনে কোনো আলোচনা হবে না, নিসন্দেহে ওরা সরে যেত। কেউই রুবির মতোকরে বসে যেত না। সাঁঝ পুনরায় নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই মোশাররফ তালুকদার বললেন,

– তোমাকে ঘরে যেতে হবে না সাঁঝ। এদিকে এসো।

ধীরপায়ে এসে সাঁঝ মাশফিকের সোফার হাতলে বসে গেল। মাথা নামিয়ে অপরাধীর মতো বসে রইল চুপচাপ। আর ঠিক এটাই চাইছিল রুবি। সাঁঝের সামনে ওর জীবন নিয়ে আলোচনা হোক! যাতে ওর মাথায় ঢোকে, ওর এখন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা উচিত। রুবি মাশফিককে উদ্দেশ্য করে বলল,

– বললে না মাশফিক? কোন ছেলে সাঁঝকে ভালোবাসার কথা বলেছে?

– ভালোবাসি বলুক আর যাই বলুক না কেন, সায়াহ্ন হামিদকে আমি কখনোই সাঁঝের জীবনে এলাও করব না! End of discussion!

ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই সায়াহ্নর নাম নিয়ে মাশফিককে দাঁতে দাঁত পিষতে দেখলো অভ্র। পাঁচমিনিটের জন্য পড়তে বসায় যা যা অগোচরে রয়ে গিয়েছিল, তা সবটাই মাশফিকের একবাক্যেই বুঝে আসে ওর। একটা ছোট্ট দম ফেলে চোখ বন্ধ করে নিলো সাঁঝ। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডেই চকিত হয়ে চোখ মেলল ও। ওই কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ওর চোখের সামনে দিয়ে পেরিয়ে যায় শেষ বিকেলের সেই মুহুর্ত আর সায়াহ্ন হামিদের বলা কথাগুলো। দিবার প্রশ্ন, মানহার অস্তিত্ব, সায়াহ্নর উত্তর, ওর অস্তিত্ব, ওর কানে সায়াহ্নর স্পর্শ, হাতে হলুদ বাগানবিলাস, চোখে অতলস্পর্শী প্রেম আর মুখে এক সহজ স্বীকারোক্তি– আমি তোমাকে ভালোবাসি সাঁঝ!
সুজি কোত্থেকে যেন এসে ঝাপিয়ে সাঁঝের কোলে উঠে বসলো। ওকে আগলে নিয়ে শুকনো ঢোকে গলা ভেজায় সাঁঝ। বিকেলের এতোগুলো ঘটনার মাঝে একমুহূর্তের জন্যও পলক ফেলতে পারেনি ও। কেন পারেনি, ও জানেনা। না জানে সায়াহ্ন হামিদের চলে যাওয়ার পর একফোঁটা অশ্রু ওর গাল ছুঁয়েছিল কেন। আর নাইবা জানে, এখন এই সবকিছু ওর চোখের সামনে কেন। 
মাশফিকের কাছে সায়াহ্ন হামিদ নামটা শুনতেই রুবির ভ্রু কুচকে আসে। নামটা চিনতে ওর অসুবিধা হলো না। ও জানে এটা সেই মানুষের নাম, যার কারণে সাঁঝ-কামরুলের বিয়েটা ভেঙেছিল। মোশাররফ তালুকদার হাতের মুঠো ঠোঁটের কাছে রেখে চিন্তা করছিলেন কিছু। একসময় বললেন,

– ও সাঁঝকে পছন্দ করে বলেই কি ওর বিয়েটা ভেঙেছিল?

– উহু। এমন হলে সায়াহ্ন হামিদ সেদিনই সরাসরি বলতো। কোনোকিছুর পরোয়া করতো না। 

জবাব অভ্র দিয়েছিল। মাশফিক ছোটভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আবারো দৃষ্টি নোয়ালো। ওর কাছেও একই জবাবটাই ছিল। আসিফ তালুকদার বললেন,

– তুই তখনই আমাকে কল করলি না কেন মাশফিক? এখন কি করা যায়?

– তখন মাশফিক কল করলে তুমি কি করতে আসিফ? প্রোপোজই তো করেছে ও সাঁঝকে! তখন হোক বা এখন, তোমাদের কাছে কোনো ভ্যালিড রিজন আছে ওকে কিছু করার?

রুবির পাল্টা প্রশ্নে আসিফ জবাব দিতে পারলো না। মাশফিক বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– তুমি চিন্তা করোনা বাবা। আপাতত ব্যস সরোয়ার হামিদের সাথে ওঠাবসা বাদ দাও, তাতেই হবে।

– এরপর যদি ওই ছেলে ওর ফ্যামিলিকে সাথেকরে সাঁঝের বিয়ের সমন্ধ নিয়ে এ বাসায় চলে আসে? তখন?

ড্রয়িংরুমে উপস্থিত ছয়জোড়া চোখই রুবির দিকে নিবদ্ধ হয়। প্রত্যেকের প্রসারিত চাওনি। তাতে অবাক, বিস্ময়। আর সেকেন্ডের ব্যবধানে মাশফিকের সে বিস্ময় মেজাজ খারাপে পরিণত হয়।প্রথমবারের মতো ও রুবিকে খিঁচানো আওয়াজে বলল,

– কিসের বিয়ে? কিসের সমন্ধ? ওই ছেলের সাথে কোনো বিয়েটিয়ে হবেনা সাঁঝের!

– কেন? কি এমন দোষ ওর?

মাশফিক যতো দ্রুত তেতে উঠেছিল, ধপ করে তত দ্রুতই নিভে গেল। এবার সাঁঝ বাদে গোটা তালুকদার পরিবার ওর দিকে তাকাল। এর জবাবে কি বলবে মাশফিক? কি খুঁত আছে সায়াহ্ন হামিদের? কি দোষ আছে? মাশফিক রুবির থেকে দৃষ্টিচুরি করলো। দ্রুত পলক ফেলে নিচে দেখতে দেখতে বলল,

– অ্ অনেক দোষ! অনেক দোষ আছে!

– বলো! শুনি একটাদুইটা।

মেঝের টাইলসের মোজাইকের মাঝে সায়াহ্ন হামিদের দোষ খুঁজছিল মাশফিক। মস্তিষ্কে ঘাটাঘাটি করেও বলার মতো কিছু পেল না ও। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে, বহু কষ্টে কথা বার করলো,

– আমার বোনকে অপমান করেছিল ও!

– And he didn’t apologise?

ফ্যালফ্যাল করে রুবির দিকে চেয়ে রইল মাশফিক। কি জবাব দেবে ও এখন? ওর সামনেই তো সায়াহ্ন সাঁঝকে সরি বলেছিল। তাও একবার না। কয়েকবার! আড়স্ট কন্ঠে বলল,

– ও একটা সম্পর্কেও ছিল।

– তাইনাকি? তা এটা তুমি কি করে জানলে? আমি নিশ্চিত তুমি নিজে থেকে খোঁজ নাওনি৷ এখন প্লিজ বলো না ওই তোমাকে জানিয়েছে? তোমার ভাষ্যমতে ছেলেটা তো এতো সৎ না I guess!

– ও সত্যিই ভালো ছেলে না বৌমা!

– তাহলে তুমি কি প্রেফার করো? কি করলে ও ভালো ছেলে হতো? তোমার বোনকে তোমার সামনে ‘আই লাভ ইউ’ না বলে রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে টিজ করলে?

আরো একদফায় বলার কিছু ছিল না মাশফিকের কাছে। কোনোকিছু না পেয়ে ও এবার নিজের শেষ যুক্তিটাই পেশ করলো,

– সায়াহ্ন সিগারেট খায়!

– Yeah! That could be a discussion! You guys please carry on! All the best!

রুবি চোখ উল্টে বিরক্তি প্রকাশ করলো। তারপর মেয়েকে দুলাতে দুলাতে চলে গেল ওখান থেকে। মোশাররফ তালুকদার মেয়েকে ডাকলেন। বাকিদের মতো সাঁঝও এতোক্ষণ অবাক হয়ে রুবির যুক্তি শুনছিল। মাশফিকের মতো এতটা না হলেও, ওউ ধরার চেষ্টা করছিল, ভুলটা কোথায় বলল সে। বাবার ডাকে হুশ ফেরে সাঁঝের। মোশাররফ তালুকদার মেয়েকে এগিয়ে তারপাশে বসতে বললেন। চুপচাপ সেটাই করলো সাঁঝ। সুজিকে নিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসলো ও। একহাতে মেয়ের কাধ জড়িয়ে, মেয়ের মাথা বুকে নিলেন মোশাররফ তালুকদার। তারপর ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

– যা হবার হয়েছে। তুমি এসব নিয়ে কোনো টেনশন নিওনা। আমরা আছি। 

অভ্র নিজের কাধের দিক তাকিয়ে একটা ছোট দম ফেলল। তালুকদার নিবাসে আরকোনো কথা হলো না বিষয়টা নিয়ে। কিন্তু অভ্র স্থির হতে পারলো না। মাঝরাত অবদি জেগেও একহরফও পড়া হলো না ওর। পরেরদিন কলেজে গিয়ে ক্লাসে ঢুকেই আগে দিবার বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে গেল ও। দিবা পাশেরজনের সাথে হাসতে হাসতে কথা বলছিল। অভ্রর উপস্থিতিতে ও থেমে গিয়ে সামনে তাকালো। অভ্র বলল,

– কথা ছিল।

– শুনতে পারি। একটা শর্তে।

– কি?

– ক্লাসশেষে আমার সাথে বসে আইসক্রিম খেতে হবে। 

– ওকে।

চাপা হাসির সাথে অভ্রর পেছনপেছন বাইরে আসলো দিবা। একটু সরে আসতেই অভ্র ব্যস্তভাবে বলল,

– কি বলেছিলাম তোমাকে আমি? আর সায়াহ্ন ভাইয়া এটা কেন করলো?

– তুমি দুইটার জবাব জানো, আমি একটার। সেকেন্ডটার জবাবটা তুমিই দাও। কি করেছে ভাইয়া?

চোখ বন্ধ করে কপাল চেপে ধরলো অভ্র। এমনটাই আশা করেছিল ও। ভাইয়ের কর্মকাণ্ডের খবর নেই দিবার। অভ্র চোখ মেলে বলল,

– গতকাল বিকেলে সায়াহ্ন ভাইয়া আপুইকে প্রপোজ করেছে! তাও আবার মাশফিক ভাইয়ার সামনে!

– Really? ওয়াহ্ মেরে ভাই! প্রপোজও করে দিলি? তোর তুলনা হয়না! 

খুশি হয়ে গিয়েছিল দিবা। ভাইয়ের কাজকে গর্বের ধরে নিয়ে নিজেরসাথেই কথা বলছিল ও। অভ্র কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলল,

– ওয়াহ্ বলছো? এটা ওয়াহ্ বলার মতো কাজ?

– সিটি মারার মতো কাজ ইয়ার! কিন্তু আমি তো কখনো ভাইয়ার কাজকে এপ্রিশিয়েট করি না, এজন্য আর বাড়ালাম না। ওয়াহ্ অবদিই ঠিক আছে।

– দিবা, বোঝার চেষ্টা করো আর সায়াহ্ন ভাইয়াকে বুঝাও! সে. . . 

– ভাইয়াকে? বুঝাব? হাসালে!

– হেসো না! আমার গোটা ফ্যামিলি রেগে আছে তার ওপর! তার প্রোপোজাল কেউ কোনোদিনও মানবে না!

– Then I have a suggestion for your গোটা ফ্যামিলি অভ্র! সায়াহ্ন হামিদ, তালুকদার নিবাসের হবু মেয়েজামাই– তোমরা নিজেরাই এটা নিজেদের বুঝানো শুরু করে দাও। আগেথেকে প্র্যাকটিস করতে থাকলে তোমাদেরই সুবিধা হবে। 

কয়েকদন্ডভর চেয়েচেয়ে দিবার আত্মবিশ্বাস দেখল অভ্র। এরপর ওর মনমস্তিষ্কই ওকে জানান দিলো, দিবার আত্মবিশ্বাস ভুল না! সায়াহ্ন হামিদকে নিয়ে যে কারো এমন বিশ্বাসই হবার কথা। সেখানে দিবা তো তার বোন! অভ্র মাথা নাড়িয়ে বলল,

– ভাই-বোন দুইটাই পাগল! 

– Yeah! তোমাদের দুই বোন-ভাইয়ের জন্য!

বুকে হাত গুজে দিবা রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়ালো। অভ্র আবারো অবাকচোখে দেখল ওকে। তারপর হনহনিয়ে ক্লাসে চলে গেল। পেছন থেকে চেচিয়ে “আইসক্রিম!” বলে ওকে শর্তের কথা মনে করিয়ে দিলো দিবা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে ছোট তালুকদারের চলে যাওয়া দেখল দিবা। তারপর ভাইয়ের জন্য খুশি হলো ও। হাতেপায়ে, মুখেচোখে মারামারি করলেও ও সায়াহ্নকে প্রচন্ড ভালোবাসে। বেপরোয়া ভাইটার জন্য ও সর্বোত্তমটাই চেয়েছিল। আর ওর মন বলছে, সায়াহ্নর জন্য সাঁঝের চেয়ে ভালো আরকেউ হতে পারত না, পারবে না!
কলেজ থেকে ফিরে ডোরবেল বাজালো দিবা। দরজা খুলে দিয়ে ওর মা আবারো ড্রয়িংরুমের বড় জানালার ইন্ডোর প্লান্টগুলোর কাছে চলে গেল। দিবা ভেতরে ঢুকে সোফাতেই ব্যাগ রেখে বসে গেল। পায়ের মোজা খুলতে খুলতে ভাইয়ের ঘরেরদিকে উঁকি দিলো ও। মিসেস সরোয়ার নিজেরমতো ব্যস্ত থেকে বললেন, 

– ঘরে যা না মা! এখানে বসেবসেই মোজা খুলতে হবে তোর?

– ভাইয়া কোথায় গো মা? অফিসে?

মিসেস সরোয়ার থামলেন। মেয়ে তার ছেলের খোঁজ করছে, বিষয়টা যেন হজম হলো না তার। এদিকে গত বিকেলের আগঅবদি সায়াহ্নর চালচলনও অন্যরকম ছিল। গোটা তিনদিন বাসা থেকে বেরোয়নি ও। যদিও এখন পুরোপুরিভাবে স্বাভাবিক সে, তবুও মিসেস সরোয়ার কিছুটা সন্দিহান হয়ে জবাব দিলেন,

– ঘরেই। সন্ধ্যার শো আজ। 

– ও। তা তোমার গুণধর ছেলে যে মাশফিক তালুকদারের ওপর দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে দিয়ে এসেছে, জানো এ বিষয়ে কিছু?

সায়াহ্নকে রুম থেকে বেরোতে দেখেই কথার সুরই পাল্টে দিলো দিবা। মিসেস সরোয়ার প্রসারিত চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। কিন্তু এমন সুরতোলা কথাটা শোনার পর সায়াহ্ন বোনের দিকে তাকালো না। সোজা ফ্রিজের কাছে গিয়ে সফট ড্রিংকের ক্যান বের করলো ও। তাতে দুবার চুমুক দিয়ে, সোফায় বসে ফোনে মনোযোগ দিলো। মিসেস সরোয়ার বললেন,

– মাশফিকের ওপর বুলডোজার চালিয়েছে মানে? 

– মানেটা তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো না! তিনদিন বাসায় ঘরকুণো হয়ে থাকার পর কাল বিকেলে সে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কেলোটা কিভাবে করে আসলো, শুধাও শুধাও?

অতি আগ্রহে বাবু হয়ে বসে গেছে দিবা। সায়াহ্নর তখনো হেরফের নেই। আগের মতোই ফোন দেখতে ব্যস্ত ছিলো ও। মাঝেমধ্যে ক্যানে চুমুক দিচ্ছিল। মিসেস সরোয়ার গাছের যত্ন করা ছেড়ে দিলেন। বেসিনে হাত ধুয়ে, আচলে হাত মুছতে মুছতে ছেলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

– দিবা কি বলছে সায়াহ্ন? আবার কি করেছিস তুই? 

– তেমন কিছুনা। ব্যস মাশফিক তালুকদারের সামনে তার বোন সাঁঝকে প্রোপোজ করে এসেছি। 

একেবারে স্বাভাবিক ভঙিতে জবাব দিয়েছিল সায়াহ্ন। ওর ভঙিমা এতোটাই হেয়ালীভরা ছিল যে ও ফোন থেকে চোখটাও তোলেনি। কিন্তু মিসেস সরোয়ারের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। হাসি আর হাততালির সাথে দিবা সোফায় হেলান দিয়ে বসে গেল। সরোয়ার হামিদ ঠিক সেসময়ই বাসায় ঢুকছিলেন। তিনি দরজা লক না করা নিয়ে দিবাকে বলতে উদ্যত হচ্ছিলেন। কিন্তু ছেলের কথা কানে যেতেই তিনি নিজের কথা ভুলে গেলেন। সেইসাথে অনুধাবন করলেন, কেন গত কয়েক ওয়াক্তের নামাজে মোশাররফ তালুকদার তার সাথে শীতল ব্যবহার করছিলেন। হতাশায় মাথা দুলালেন সরোয়ার হামিদ। এগিয়ে আসলে মিসেস সরোয়ার তাকে ইশারায় বুঝালেন, ‘দেখো ছেলের কান্ড।’ সরোয়ার হামিদ প্রথমবার ছেলের কাজে স্ত্রীকে চিন্তা করতে দেখছিলেন। বেশ গুরুতরভাবে তিনি সায়াহ্নর সামনের সোফায় বসতে বসতে বললেন,

– কি করেছো সায়াহ্ন! এভাবে কেউ ভাইয়ের সামনে বোনকে প্রোপোজ করে?

– সেটাই! ছেলেটা অসুস্থ! 

সায়াহ্ন ক্যানে চুমুক দিয়ে মোবাইলে তাকিয়েই হাসল। এটা ওর মা! আর তার চিন্তা আরপাঁচটা মায়ের মতো নিজের ছেলেকে নিয়ে না! তার চিন্তা আরেকজনের ছেলেকে নিয়ে! মাশফিককে নিয়ে! দিবা ততক্ষণে চুলের বিনুনি খুলতে শুরু করেছে। সরোয়ার হামিদ ছেলের জবাব না পেয়ে বললেন,

– প্রেমে পরে বুদ্ধিসুদ্ধি গেছে নাকি তোমার? আমাদের বলতে! আমরা তালুকদার নিবাসে একেবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতাম! তুমি প্রোপোজ করতে গেছো কেন? জানোই তো তালুকদাররা বাড়ির মেয়েকে প্রেম করতে দেবার মতো লিবরেল না।

– এমনভাবে বলছো, যেন তুমি তোমার মেয়েকে প্রেম করতে দেবার মতো লিবরেল? 

চুইংগাম চিবাতে চিবাতে চুলের আরেকটা বিনুনি খুলছিল দিবা। ভাইয়ের প্রশ্নে চমকে পাশে তাকালো ও। সরোয়ার হামিদ যে সায়াহ্নর তালে তাল মেলাবেন, এটা আশা করেছিল ও। তাই বিয়ের কথা ওঠায় এ পরিবারের কেউই অবাক হয়নি। কিন্তু সায়াহ্ন কি বলে বসলো? এটা কি এমন প্রশ্ন করার সময়? ফোনে টাইপিং করতে থাকা সায়াহ্ন তখনো নিস্প্রভ। মিসেস সরোয়ার ওর পাশে বসে গিয়ে আস্তেকরে চড় লাগালেন ওর হাতে। সরোয়ার হামিদ বললেন,

– কেন সন্দেহ আছে তোর? তোর বেলায় যেহেতু থাকছি, দিবার বেলাতেও থাকব! তবে সেটা অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর! 

– এ্ এখন তুই টপিক পাল্টাস না ভাইয়া! তোর বিয়ের কথা হচ্ছিল এখানে!

চতুর বোনের কথা পাল্টানোর প্রয়াস দেখে শব্দ করে হেসে ফেলল সায়াহ্ন। মিসেস সরোয়ার বললেন, 

– হাসবি না একদম! ব্লান্ডার তো করেই এসেছিস! এখন বল আমরা কবে যাব তালুকদার নিবাসে?

– ওহো মা! এতো অধৈর্য্য কেন হচ্ছো?

– কেন হবে না? ছেলে তার প্রথমবার সিরিয়াস প্রেমে পরেছে! সে অধৈর্য্য হবে না তো কে অধৈর্য্য হবে?

বাবার কথায় ছোট্টকরে শ্বাস ফেলল সায়াহ্ন। উঠে দাড়িয়ে টি-শার্টটা ঠিক করলো ও। তারপর বেশ স্পষ্টভাবে বলল,

– আমি আপাতত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজটা শিখছি। আর এ কদিন সাঁঝও সময় নিক। বুঝেশুনে এ সম্পর্কে হ্যাঁ বলুক ও। তোমরা তারপর যেও তালুকদার নিবাসে। আমি চাইনা তোমরা এমন কোথাও যাও যেখানে তোমাদের না শোনার দশমিক এক পার্সেন্টও চান্স আছে। কোনোরকমের অনিশ্চয়তার মাঝে ‘প্রস্তাব’ নিয়ে যেতে হবে না তোমাদের। তোমরা গেলে একেবারে বিয়ের ‘পাকাকথা’ বলতেই যাবে। কারো অমত, দ্বিমত, বহুমত, কোনোমত শুনতে না! So wait untill I make sure of that!

বলা শেষ করে দুই নখের ডগার মাঝে মোবাইল ঘুরালো সায়াহ্ন। ট্রাউজারের এক পকেটে হাত গুজে, হেলেদুলে ঘরে চলে গেল নিজের ঘরে। মাথা দুলিয়ে হাসলো দিবা। ভাইয়ের ঘরের দরজার দিক চেয়ে মৃদ্যুস্বরে বলল,

– ওর চাল্লুমি তো আমার, তোমার, মায়ের, কারো ডিএনএ'র সাথেই স্যুট করে না। সত্যি বলো তো বাপি? এটাকে ঠিক কোথায় কুড়িয়ে পেয়েছিলে? 

হতবাক হয়ে মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন সরোয়ার হামিদ। তার নামের আগে ‘এসিপি’ শব্দটা এমনিএমনি আসেনি। চাকরীজীবনে বহু জটিল কেইসের সমাধা করেছেন তিনি। ডিপার্টমেন্টে তাকে অন্যতম চৌকস পুলিশ অফিসার গণনা করা হয়। অথচ তার মেয়েই আজ তাকে তার বুদ্ধি নিয়ে খোঁচাচ্ছে– তার ছেলের চতুরতা নাকি তার সাথে মানানসই না! 
দুনিয়াটা আসলে রোস্টারদের!
·
·
·
চলবে……………………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp