চিত্রলেখার সংসার - পর্ব ১০ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


          দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা 'কুন্দ' নদীর চরে বসে আছে চিত্রলেখা। সংস্রবশূন্য দৃষ্টি নিবিষ্ট নদীর তরঙ্গে। শরীর বেজায় ক্লান্ত। প্রথমত অসুস্থতা তার উপর দীর্ঘ একটা সময় দৌড়ের উপরে ছিল। পায়ের ক্ষতটা যন্ত্রণায় টনটন করছে। মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত। পায়ের মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রনাটা সম্পূর্ণ কায়া বিষিয়ে তুলছে। মাথাটা ঝিম মেরে আছে। শীর্ণ দেহখানা নিস্তেজ হয়ে আসছে। 

সেই রাতে মেয়েটা বুদ্ধি করে একটা বড়ো ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছিল। অতঃপর পিছু ছুটে আসা মানুষগুলো ফিরে যেতেই প্রাণ হাতে নিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে ছুটে এসেছে। এই কয়দিনের শক্ত খোলস মুহূর্তেই খসে পড়ল। বুকে হাত রেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল চিত্রলেখা। নিঃশব্দে গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল তার নিজ ধারায়। আলগোছে আনন ঢেকে রাখা নিকাবটা কপালে তুলে দিলো। দৃশ্যমান হলো ম্লান মুখখানি। মুছল না চোখের পানি। সেভাবেই নিভৃতে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদল। কিন্তু না, বুকের ভার কমল না। হয়তো মনের সবটুকু আর্তনাদ প্রকাশ করতে পারলে একটু শান্তি মিলত। 

ওর শহুরে বাবু ওকে ভালোবাসে না। অন্য কাউকে ভালোবাসে। তার সাথে এই একজীবনে সংসার পাতবে। প্রতিনিয়ত তাকে ছুঁয়ে দেখবে। শহুরে বাবুকে নিয়ে ওর ছোট্ট জীবনের সংসারের স্বপ্ন আর কখনোই পূরণ হবে না। ও এই মায়া কাটাতে পারবে না। মানুষ চাইলেই যে সব পারে না। ওকে বুকে আগলিয়ে রাখার মতো একটা মানুষ নেই এত্ত বড়ো ধরিত্রীতে। ও কি এতটাই ফেলনা? এমন ভাগ্য কেন হলো ওর? ওর ভালোবাসার মানুষটা কেন ওকে ভালোবাসল না? এই যাতনা সহ্য করতে অপারগ মেয়েটা। হাত, পা থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। কম্পিত দুহাতে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে উঠল। অস্পষ্ট স্বরে আওড়াল,

"মোরে কেন ভালাবাসলেন না শহুরে বাবু? মোর ছোট এই জীবনের ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্নগুলা তো আপনারে ঘিইরাই ছিল। এই একজীবনে আপনে মোর হলে খুব কি ক্ষতি হইয়া যাইত? নাই বা ঠকাতেন মোরে। ভালা থাকবার পারতাম মোরা।"

মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরন কঠিন একটা সত্য উপলব্ধি করল। ওর এই জীবনের কোনো মূল্য নেই। আর যেই জীবনের মূল্য নেই সেই জীবন রেখে কী লাভ? এই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরবে ও। উঠে দাঁড়াল তৎক্ষণাৎ। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সামনে। নদীর স্বচ্ছ জ্বলে ভেসে উঠল ওর প্রতিবিম্ব। পানিতে দৃশ্যমান মেয়েটার উপর বড্ড মায়া হলো চিত্রলেখার। ইস! ওই মেয়েটা সর্বহারা। নিজের বলতে কিছুই নেই তার। একটু বুকে জড়িয়ে আদর করে দিতে মন চাইল ওর। ভাবনার অথৈ সায়রে বুঁদ হয়েই ডান পা টা সামনে এগিয়ে দিলো। তক্ষুনি গ্রামের কিছু মহিলা কোমরে থালাবাসন নিয়ে নদীর ঘাটে উপস্থিত হলো। নতুন কাউকে দেখতেই একজন হিন্দু মহিলা শুধালেন, "ওগো মাইয়া কেডা তুমি? এইহানে কিতা করো?"

চিত্রলেখার হুঁশ ফিরল। ক্লান্ত মস্তিষ্কের ঘোর ভাঙল। ঝড়ের গতিতে দুই পা পিছিয়ে এলো। এটা কী করতে চলেছিল ও? একজন বিশ্বাসঘাতকের জন্য এত বড়ো বোকামি কীভাবে করতে পারছে এখনো! নিজের করা কাজে নিজের উপরই ভীষণ রাগ হলো ওর। দুগালে থাপড়াইতে মন চাইল। ও শুধু নিজের জন্য বাঁচবে আর কারোর জন্য না। মহিলার করা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নদীর পানিতে চোখ মুখ ভালোভাবে ধুয়ে নিলো। গায়ে জড়ানো ওড়নার একাংশ তুলে সন্তর্পণে মুখটা মুছে নিলো। নিকাব নামিয়ে পুনরায় মুখটা ঢেকে ফেলল। ওর এমন ব্যবহারে মহিলা গুলো একটু অবাকই হলেন। আরেকজন মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন,

"মাইয়া নতুন নাহি এই গেরামে?"

চিত্রলেখা এতক্ষণে ফিরল ওনাদের দিকে। এখন বেশ সতেজ লাগছে নিজেকে। মুচকি হেসে প্রত্যুত্তর করল, "জি, মুই নতুন।"

"তা থাহো কুন গেরামে?" জবাব পেতেই আবারও পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল সেই মহিলা।

"মোর কোনো বাড়ি লাই কাকিমা। মুই ভবঘুরে। যেখানে রাইত সেখানেই কাইত। কিন্ত এখন একডা কাজের সন্ধানে বের হইয়াছি।"

"তুমার বাপ মা লাই?"

"রইয়াছে তো।"

"তুমারে দেখে লাই?"

"রক্তের সম্পর্ক সবসময় আপন হইবার পারে না কাকিমা। মোরা হগ্গলে পরিস্থিতির শিকার গো। যার যার পেটের দায়ে সে সে ছুটতাছে। কে রাখে কার খবর?"

কথাগুলো শুনে ওই মহিলার ভীষণ মায়া হলো চিত্রলেখার উপর। কী মিষ্টি মেয়েটা। তার উপর প্রথম সাক্ষাতে এই চমৎকার ব্যবহার, মিষ্টি 'কাকিমা' সম্বোধনে উনি একটু গললেন বটে। সেধে সাহায্য করতে চাইলেন,

"তুমার কষ্টডা বুঝতাছি মাইয়া। আইচ্ছা হুনো আইজ এই গেরামের জমিদারগের বড়ো পুত্তুর, আমগোর হগ্গোলের ভালাবাসার বড়ো বাবু আসতাছে। উনি খুবই দয়ালু বুঝিলে মাইয়া। আইজ জমিদার বাড়িত খাবার দাবারের সেই আয়োজন করা হইয়াছে। তুমি মোর লগে যাইবা ওইহানে? তুমারে একখান কামের ব্যবস্তা কইরা দিমুনে। মুই ও ওইখানে কাম করি।"

চিত্রলেখার মনটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। কে বলেছে এই জগতে ভালো মানুষ নেই? এই যে প্রথম সাক্ষাতে একজন অপরিচিত অসহায় মেয়েকে সাহায্য করার মতো মন মানসিকতা কয় জনের আছে? এখনো ভালো মানুষের অস্তিত্ব আছে বলেই পৃথিবীটা সুন্দর উপভোগ্য। হতে পারে কেবল ওর সাথেই স্বার্থান্বেষী মানুষগুলোর দেখা হয়েছে। তাই বলে পুরো মানবকুলকে তো ও দোষারোপ করতে পারে না। এ যে বড়ো অন্যায়। তবে দুঃখের বিষয় চিত্রলেখা এত সুন্দর সুযোগটা গ্রহণ করতে পারল না।‌ কারণ ওর পরিকল্পনা একটু আলাদা। আর সেভাবেই চলবে ও। মুখের হাসি বাড়ল ওর,

"মোর মতোন অভাগীর কথা ভাববার লাইগ্যা ধইন্যবাদ কাকিমা। কিন্তু মুই নিজেই নিজের জন্যি কিছু করবার চাই। মুই ঠিক একডা উপায় বের কইরা লামু। থাকুন আপনেরা মুই যাইগা।"

মুখের কথা শেষ করে নিজের ব্যাগটা তুলে শ্লথ গতিতে ওখান থেকে প্রস্থান করল চিত্রলেখা। হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। তবে অন্যকে বুঝতে দিতে নারাজ। সবাই আরেকদফা আশ্চর্য হলো। কী অদ্ভুত মেয়ে! জমিদার বাড়িতে কাজ করার মতো এত সুন্দর সুন্দর সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে নাকি? নির্ঘাত ওই মেয়ে পাগলী হবে। তা নয়তো কী!

••••••••••

শিকদার মহল। গ্রামে লোকমুখে প্রচলিত পাঁচ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই মহল। দোতলা বিশিষ্ট সুবিশাল একটা বাড়ি। চারপাশে সবুজের সমাহার। সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরাওকৃত। লোহার শক্ত গেট পেরিয়ে শিকদার মহলে পদার্পণ করতে হয়। যেখানে সবসময় দুজন প্রহরী পাহাড়া দেয়। আজ অবশ্য দুজন পাহাড়াদার থাকলেও সবার ঢোকার সুযোগ আছে। বড়ো বাবুর আদেশ বলে কথা। না করার সাধ্য কারোর নেই।

দুপুরের সূর্যের তীব্র দাবদাহ মাথায় করে বড়ো লোহার গেট টার সম্মুখে এসে দাঁড়াল চিত্রলেখা। মহলের সামনে মানুষের সমাগম। হাজার হাজার মানুষের অবস্থান। ও গুটি গুটি পায়ে ভেতরে এগিয়ে গেল। একটা গাছের নিচে নিজেকে কিছুটা আড়াল করে দাঁড়াল। বলা যায় না কখন কার নজরে পড়ে যায়। সুউচ্চ গাছগুলোর ছায়াতলে সবাই জিরোচ্ছে। কেউবা বসে আছে কেউবা দাঁড়িয়ে আছে। কিছু একটা নিয়ে চাপা কানাঘুষা চলমান সকলের মাঝে। সবগুলো অপরিচিত মুখের মাঝে অদূরে একটা পরিচিত মুখের দেখা মিলল। কাব্যতা এসেছে ওর মায়ের সাথে। চিত্রলেখার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। গাছের সাথে আরও লেগে দাঁড়াল। খেতে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। গাছের ছায়াতলেই বড়ো মাদুর বিছিয়ে লাইন দিয়ে বসিয়ে খেতে দেওয়া হবে।

কিছু সময় পেরোতেই চাপা গুঞ্জনটা থেমে গেল। শান্ত নীরবতা বিরাজ করল মহলের প্রাঙ্গণ জুড়ে। সবার দৃষ্টি লক্ষ্য করে চিত্রলেখা নিজেও ওই দোতলার সুবিশাল বারান্দার দিকে তাকাল। দেখল একজন যুবক এবং একজন যুবতী মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের শরীরেই জড়ানো সফেদ রঙা পোশাক। যুবকের সুবিশাল দেহে এটেসেটে আছে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি এবং পাজামা। মুখে চাপ দাড়ি আর গোঁফটা সুন্দর একটা আকৃতিতে দুদিকে বাঁকিয়ে রাখা। ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুলগুলো পরিপাটি করে রাখা হয়েছে। যার একাংশ কপালের উপরে পড়ে আছে। হাতে জ্বলজ্বল করছে একটা দামী ঘড়ি। দুহাত পিছনে রেখে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুবক। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবিষ্ট নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অতি সাধারণ মানুষ গুলোর দিকে। সবার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে। যুবকের দেখা পেয়ে সকলের খুশি আকাশচুম্বী।

যুবকের পাশে দাঁড়ানো যুবতীর রুপ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। কী অপূর্ব, অপরুপ সেই রুপ! দুধে আলতা শরীরের রং। সেই দেহে সাদা রঙের শাড়িটা একটু বেশিই মানিয়েছে। সুদীর্ঘ কৃশলা পিঠজুড় ছড়িয়ে আছে। কানে গুজে রাখা একগুচ্ছ শুভ্র গোলাপ।গোলাপের পাপড়ির মতো দুটো পাতলা গোলাপী ঠোঁট। মুচকি হাসি লেগে আছে অধরপল্লবে। ঠোটের নিচে কালো কুচকুচে তিলটা জ্বলছে। ওটা সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে যেন। মায়া ভরা দুটো নেত্র। যেথায় কাজল লেপ্টে আছে। বারান্দার রেলিংয়ে রাখা দুটো আলতা রাঙা গৌর বর্ণের হাত। কেমন যেন তাক ধরে গেল চিত্রলেখার। নারীর এই ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যে সাথে সাথেই চোখ ফেরাতে পারল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল। 

"ওইডা জমিদার বাড়ির বড়ো পুত্র সাকরান সাইর শিকদার, আমগোর বড়ো বাবু। ঢাকা শহুরের বড়ো একজন ডাক্তার। বিদেশ থেইক্যা লেখাপড়া কইরাছেন। আর পাশডাই দাঁড়ানো ওইডা হচ্ছে বড়ো বাবুর বাগদত্তা শশীলতা শিকদার। চোখধাঁধানো সৌন্দর্যের জন্যি গ্রামের মাইনসে মধুমালতি ডাকে।"

অতিব পরিচিত কণ্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই চিত্রলেখা চকিতে পাশ ফিরে চাইল। চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। ছোট্ট করে বলল, "কাব্য আপা।"

একটু অন্যমনস্ক হতেই চলতি একজন মানুষ ক্ষতবিক্ষত পা টাতেই পাড়া দিয়ে চলে গেল। গতকাল থেকে না খাওয়া মেয়েটা। তার উপর এই ক্ষত। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। সম্পূর্ণ শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। ক্ষত থেকে গলগলিয়ে রক্ত ঝরছে ততক্ষণে। এই পর্যায়ে মেয়েটার সহ্য শক্তি ফুরাল। পারল না ওই যাতনা সইতে। ধরণি ক্রমশ অন্ধকারের চাদরে মুড়িয়ে গেল। ঢলে পড়ল কাব্যতার বুকের উপর। কাব্যতা চিৎকার করে উঠল। মুহুর্তেই ছোট খাটো জটলা বেঁধে গেল জায়গাটাতে। নিস্তব্ধ পরিবেশ কোলাহলে মুখরিত হলো।
·
·
·
চলবে………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp