প্রিয়তা স্বভাবে ছিল মারাত্মক দুষ্টু প্রকৃতির মেয়ে। ওকে একজায়গায় স্থির করে বসিয়ে রাখার চেয়ে বড় সফলতা দুটো ছিলোনা। ঐটুকুন একটা মেয়ে সারাদিন কীকরে এতো দৌড়ঝাঁপ করে বেড়ায়, এতো শক্তি কোথায় পায় তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতোনা মিতা। সারাদিন এই এক মেয়ের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠতো ও। সেই সঙ্গে ওর পাকা পাকা কথা শুনে আশেপাশের মানুষজনও হতভম্ব হয়ে বসে থাকতো।
অথচ প্রিয়তার এই দুষ্টুমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ছিল সুমনার। কানের কাছে সারাদিন এমন চিল্লাপাল্লা করা। দৌড়দৌড়ি বড় বেশি অসহ্য লাগতো তার। যারফলে প্রায়ই প্রিয়তাকে ধমকের ওপর রাখতো সে। মাঝেমাঝে মারধর করতো। মায়ের ধমক খেয়ে থামাতো দূরে থাক, আরও জোরে চিৎকার করে কান্না করে ঘর মাথায় তুলতো সে। কোলে তুলে রুমে নিয়ে গিয়ে সেই কান্না থামাতে একপ্রকার যুদ্ধই করতে হতো মিতাকে।
অন্যদিকে শওকতের প্রতি প্রিয়তার টান ছিল অন্যরকম। শওকত খুব কম সময় বাড়িতে থাকতো। কিন্তু যতক্ষণ থাকতো খুশি হয়ে যেতো প্রিয়তা। বেশিরভাগ সময়ই সে দৌড়ে উঠে পড়তে চাইতো বাবার কোলে। কিন্তু শওকত কখনই কোলে তুলে নিতোনা প্রিয়তাকে। আলতো হাতে সরিয়ে দিতো প্রতিবার। প্রিয়তা কাঁদলেও শুনতে না পাওয়ার ভান করেই এড়িয়ে যেতো শওকত। বিগত পাঁচবছরে কখনও প্রিয়তাকে কোলে নেয়নি সে।
প্রিয়তাকে যখন স্কুলে ভর্তি করা হলো, প্রিয়তা অবাক হয়ে দেখল বেশিরভাগ বাচ্চার সঙ্গেই তাদের বাবা এসেছে। বাকিদের সঙ্গে মা। কিংবা উভয়ই। কিন্তু ওকে নিয়ে গেল মিতা! সঙ্গে ছিল বশির। ব্যস ওখানেই মাটিতে বসে পড়ে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল প্রিয়তা। সবার বাবা-মা এসেছে, ওর কেন আসেনি? এক্ষুনি আসতে হবে তাদের। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। মেয়েটার হাত-পা দাপড়ানো কান্না দেখে অসহায় হয়ে পড়ল বশির আর মিতা। বাপতো পড়ে আছে ঢাকাতে, মা এখন অফিস ছেড়ে ভুলেও আসবেনা। কিন্তু সেকথা এই অবোধ বাচ্চাটাতে বোঝাবে কে?
শেষমেশ না পেরে বশির ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ' তুমি আমার ভালো আম্মু না? বাবা-মাতো কাজে ব্যস্ত আছে। এজন্যই আমাদের পাঠিয়েছে।'
প্রিয়তা ঠোঁট ফুলিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ' বাড়ি যাব।'
বশির বলল, ' আম্মু! তুমি এখানে ক্লাস করতে এসেছো না? দেখো কত নতুন নতুন বাচ্চা আছে এখানে। সবাই একসঙ্গে খেলবে, বই পড়বে।'
' না না না।' প্রিয়তা জেদে অনড়। কান্নার দমকে গলা কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর।
বশির তখন বলল, ' যদি আজকে তুমি ঠিকঠাক সবগুলো ক্লাস করো। নতুন নতুন বন্ধু বানাও, তাহলে স্কুল শেষে আমরা পার্কে যাব। তুমি, আমি, মিতা মা। অনেকক্ষণ খেলব আমরা। অনেকগুলো খেলনা কিনব।'
আরও নানারকম কথাবার্তা বলে প্রিয়তার মন ভোলালো সেদিন বশির। প্রিয়তার সঙ্গে বশিরের সম্পর্কটাও বেশ অন্যরকম তৈরী হয়েছে। বশিরকে পেলে মাঝেমাঝে মিতার কথাও ভুলে যায় ও। সেদিন কথামতোই স্কুলশেষে মিতা আর প্রিয়তাকে নিয়ে পার্কে যায় বশির। প্রিয়তাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটল, বরফপানি খেলল, খেলনা কিনল। দীর্ঘক্ষণ দৌড়দৌড়ি, খেলাধুলা করে অবশেষে প্রিয়তা ক্লান্ত হল। বশির একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল ওদের নিয়ে। প্রিয়তার মাথাটা নিজের কোলের ওপর রেখে ওকে শুইয়ে দিশ। ক্লান্তিতে বশিরের কোলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল ও।
পাশ থেকে মিতা পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকল দুজনের দিকে। তা দেখে বশির বলল, 'এভাবে তাকিয়ে আছো যে?'
মিতা মৃদু হাসল, 'তোমার ধৈর্য্যশক্তি অনেক বেশি। এভাবে কেউ কারো জন্যে অপেক্ষা করেনা। কিন্তু আমি ভীষণ নিরুপায় জানো? এই বাচ্চা মেয়েটাকে ফেলে চলে যেতে পারবনা আমি। ঐ বাড়ির পরিবেশ কতটা জঘন্য হয়ে গেছে তুমি কল্পনা করতে পারবেনা।'
বশির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ' আমি জানি।'
' রাতের বেলায় প্রতিদিনই ঝগড়া হয় আপা আর ভাইয়ার মধ্যে। কী বিশ্রী ভাষায় একে অপরকে গালিগালাজ করে ভাবতে পারবেনা। প্রিয়তাকে আমি আগেভাগেই ঘুম পাড়িয়ে রাখি। কিন্তু শানটা প্রায়ই শুনে ফেলে সব। আপার বিষয়েতো জানোই। দুলাভাইটাও আজকাল কীসব করে বেড়াচ্ছে। বাড়িটা একটা নরক হয়ে আছে পুরো। ওকেযে কীভাবে এসব থেকে আগলে রেখেছি তা কেবল আমিই জানি। আমি না থাকলে ও দিশেহারা হয়ে যাবে। আমাকে তুমি ভুল বুঝোনা।'
মৃদু হেসে একহাতে মিতাকে নিজের দিকে টেনে নেয় বশির। মৃদু হেসে বলে, 'আমি না বুঝলে তোমাকে আর কে বুঝবে মিতা। বরং আমি ভীষণ স্যরি, তোমাকে আর রাণিকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারছিনা বলে। সেই সামর্থ্য আমার নেই। তবে বেশিদিন না। খুব তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা হবে দেখে নিও। ততদিন একটু ধৈর্য্য ধরো। খোদা নিশ্চয়ই আমাদের সহায় হবেন। তুমি শুধু আমার ওপর বিশ্বাস রেখো মিতা। যেকোন পরিস্থিতিতে আমার ওপর বিশ্বাস রেখো।'
•••••
মিতাকে প্রথমবার দেখামাত্র মাথা ঘুরে যায় কাশেম হকের। সে সুমনাকে অত্যধিক সুন্দরী মনে করতো। কিন্তু মিতাকে দেখার পর তার সেই ভুল ভাঙে। সেদিন বাড়ি ফিরে সারারাত ঘুম হয়না তার। মিতার চেহারার সেই অপরূপ সৌন্দর্য। ছোট্ট প্রিয়তার পেছন পেছন যখন মেয়েটা দৌড়ে নামছিল, শরীর একেকটা বাকের মুভমেন্ট পুরো মগজে গেঁথে গেছে কাশেমের। এমন দৃঢ় কামনা এর আগে কখনও অনুভব করেনি সে। সুমনা নয়, সেই মুহুর্ত থেকে সে মিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেল। একটা অস্থির রাত কাটানোর পর কাশেম সিদ্ধান্তে পৌঁছলো যে মিতাকে তার লাগবে। আর মিতাতো সুমনারই বোন। সুমনাকে যখন জ্বালে ফাঁসাতে পেরেছে, মিতাও ফাঁসবে। নিশ্চয়ই ফাঁসবে। ভালোয়, ভালোয় না ফাঁসলে অন্য উপায়তো আছেই।
এরপর থেকে কাজের উছিলায় প্রায়ই শওকতের সঙ্গে তার বাড়িতে আসতো কাশেম। প্রথমে অল্প, এরপর ঘনঘন আসা শুরু করল। শওকতের সন্দেহ এড়াতে পলাশসহ বাকি সবার সঙ্গে ভাব জমালো। মাঝেমাঝে শান আর প্রিয়তার জন্যে খেলনা, খাবার জিনিসপত্রও নিয়ে আসতো। শওকতের সামনে সুমনার সঙ্গে ধাপে ধাপেই ক্যাজুয়াল সম্পর্ক তৈরী করল যাতে কারো মনে কোনরকম কোন সন্দেহ তৈরী না হয়। এসব করতে করতে কেটে যায় দুটো মাস। সেই দু'মাসে কাশেম মির্জা পরিবারের কাছে খুবই পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে। যদিও মিতার সঙ্গে সেরকম কোন আলাপ আলোচনার সুযোগ করে উঠতে পারেনি কাশেম। কারণ কাশেমের সামনে খুব একটা পড়তোনা মিতা। যতটুকু পড়তো আগ বাড়িয়ে কথাবার্তা কাশেম নিজেই বলতো। অজ্ঞাত কারণেই মিতার পছন্দ ছিলোনা কাশেমের দৃষ্টি। ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতো ও। সেকারণেই দূরত্ব বজায় রাখতো লোকটার থেকে। এমনকি প্রিয়তাকেও কাশেমের কাছ থেকে দূরে দূরে রাখতো। আড়ালে কাশেমকে এক খারাপ লোক বলেই বোঝাতো সবসময়। একটা পঁচা রাক্ষস বলে পরিচয় দিতো।ফলসরূপ প্রিয়তা বেশ ভয় পেতো কাশেমকে। দূরে দূরে থাকতো।
মিতার সঙ্গে এই ভাব জমিয়ে উঠতে না পাড়ার বিষয়টা কাশেমের হজম হয়ে উঠলোনা সহজে। এ অভিজ্ঞতা তার বেশ নতুন। বরাবরই তার সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বের প্রেমে মেয়েরা উন্মাদ হয়ে যায়। সেখানে ঐ পুঁচকে মেয়েটা কি-না ওকে পাত্তা দিচ্ছেনা! টানা দুইমাস এতোরকমভাবে চেষ্টা করার পরেও কোনভাবেই মেয়েটার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না! ব্যপারটা অবাক করার সঙ্গে কাশেমের পৌরুষের অহংকারেও ভয়ংকর আঘাত করল। ভেতরকার জানোয়ারটা যেন আরও বিভৎসভাবে জেগে উঠল।
একদিন বসার ঘরে একাই বসেছিল কাশেম। অপেক্ষা করছিল শওকতের জন্যে। মিতা চা দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় খপ করে ওর হাত ধরে ফেলল কাশেম। মিতা বুকে যেন হাতুরির আঘাত পড়ল। হতভম্ব হয়ে আশেপাশে দেখে ভীতিগ্রস্থ চোখে তাকাল কাশেমের দিকে। ভয়ে অস্থির হয়ে বলল, ' হাত ছাড়েন। এটা কীধরণের ব্যবহার।'
ছাড়ার বদলে আরও শক্ত করে মিতার হাত ধরল কাশেম, 'সবসময় এতো দূরে দূরে থাকো কেন মিতা? বোঝনা তোমাকে কতটা পছন্দ করি আমি? তোমার আমাকে ভালো লাগেনা?'
মিতার শরীর শিরশির করে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে, ' না লাগেনা! হাত ছাড়ুন।'
কোনমতে ছাড়িয়ে সেদিন প্রায় দৌড়ে পালায় মিতা। ওর ভেতর ভেতর হওয়া অনুভূতিটা সত্যি প্রমাণিত হয় সেদিন। সেইসঙ্গে প্রচণ্ড এক ভয় এসে বাসা বাঁধে মনে।
•••••
এরমধ্যে হঠাৎ শানকে ঢাকা পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সুমনা। সুমনার মতে এখানকার চেয়ে ঢাকার পড়াশোনার মান ভালো। শান বড় হয়েছে। এগারো বছর বয়স। হোস্টেলে থাকতে অসুবিধা হবেনা। কিন্তু শানের অসুবিধা ছিল। ও কিছুতেই নিজের ঘরবাড়ি, মিতা, প্রিয়তা, পরিচিত স্কুল, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে যেতে রাজি হচ্ছিলোনা। যাওয়ার কথা শোনামাত্র কান্নাকাটি শুরু করেছিল। খাওয়াদাওয়া সব প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করেনি সুমনা। সে তার সিদ্ধান্তে অটল। কিন্তু মিতার তা সহ্য হচ্ছিলোনা। ছোট থেকে মানুষ করেছে ছেলেটাকে ও। তাকে দূরে পাঠাতে হবে! সেখানে ছেলেটা নিজেই যেতে চাইছেনা। তাই সুমনাকে বলেছিল, 'ওতো এখনো অনেক ছোট আপা। আর কয়েকটা বছর থাকুক না?'
সুমনা ঝাড়ি দিয়ে বলেছে, 'সব বিষয়ে এতো কথা কেন বলিস? ছেলেটা আমার নাকি তোর? ওর জন্যে কী ভালো হবে কী খারাপ হবে আমি বুঝব। তোর নাক গলাতে হবেনা।'
অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করলেও কিছু বলতে পারেনা মিতা। নিজের রুমে গিয়ে মুখে ওড়না চেপে কেঁদে ফেলে। এটাতো সত্যি মিতা ঐ বাড়িতে অন্যের আশ্রয়ে থাকে। অন্যের টাকায় খায়, পড়ে। সন্তানটাও ওর নিজের নয়। শানকে কোলেপিঠে করে মায়ের মতো মানুষ করলেও ওর ওপর কোন অধিকার নেই মিতার।
ঢাকা নিয়ে যাওয়ার সময় শান দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরে রেখেছিল মিতাকে। সে কিছুতেই যাবেনা। হাউমাউ করে কেঁদে বলেছিল, 'আমি যাবোনা মিতা মা! আমি যাবোনা!'
বুকে পাথর চেপে চুপ থাকতে হয়েছিল মিতাকে। ছোট্ট প্রিয়তা মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কান্নাকাটি করেছিল। শানের গেঞ্জি খামচে ধরে সেকি ঘর কাঁপানো কান্না! ভাইকে সে যেতে দেবেনা। কিন্তু এসব কিছুতেই মন গলেনি নিষ্ঠুর সুমনার। একপ্রকার টেনে হিঁচড়েই শানকে নিয়ে চলে যায় সে। শওকত তখন বাড়িতে ছিলোনা। যদিও তাকে জানানো হয়েছিল। সে দ্বিমত করেনি। ছেলেকে সে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু তার মনে হয়েছে দূরে কোথাও থাকাটা শানের জন্যেই ভালো।
শান যেদিন চলে যায় সেদিন প্রিয়তাকে ঘুম পাড়িয়ে ছুটে বশিরের কাছে চলে যায় মিতা। প্রিয় মানুষের বুকে মাথা রেখে দীর্ঘক্ষণ কাঁদে। বশির বাঁধা দেয়না। ওকে বুকে নিয়ে নীরবে বসে থাকে। মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসে বশির। ওর ইচ্ছে করে ঐ পাষন্ড মানুষগুলোর আশ্রয় থেকে সরিয়ে এনে মিতাকে নিজের কাছে আগলে রাখতে। যাতে তার জোছনার জীবনে আর কোন আমাবশ্যা না আসে। কিন্তু সেপথে বাঁধা কেবল ঐ ছোট্ট মেয়েটা। রাণী।
•••••
এদিকে শওকতের গ্রুপটা বেশ দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সোলার সিস্টেমের সঙ্গে পার্টনারশিপে করা প্রজেক্টটা কোনভাবে সফল হলে ভীষণ লাভ আছে তার। এই লাভের মুখ একবার দেখলে পেছন ফিরে আর কোনভাবেই তাকাতে হবেনা তাকে। তার এই সাফল্যে তুমুল লাভ হচ্ছি কাদের হক আর কাশেম হকের। রাজনৈতিক অপকর্ম ঘটাতে ডার্ক নাইটই সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করতো তাদের। যদিও বদলে পাওয়া শেল্টারটাও শওকতের দরকার ছিল ভীষণ। সুমনার প্রতি সেই তীব্র ঘৃণা একবিন্দুও কমেনি শওকতের। ঐ মহিলার আশেপাশে যতক্ষণ থাকে গা রিরি কর তার। সেই সময়টুকুর ফ্রাসটেশন দূর করে বাহিরে করে বেড়ানো অপকর্ম দিয়ে। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে করে বেড়ানো নৃশংস খু*নগুলো যেন তার সাইকোপ্যাথেরই প্রমাণ ছিল। এদিকে সুমনার
ও শওকতের দূরে থাকা নিয়ে সেরকম কোন মাথাব্যথা ছিলোনা। নিজের চাহিদা মেটানোর অনেক উপায় ছিল তার কাছে।
এরমধ্যে হঠাৎই শওকতের ঢাকায় যাওয়া পরিমাণ বাড়ল। মাসে বিশদিনই ঢাকায় কাটিয়ে দিতো শওকত। এতে অবশ্য কাশেম হকের সুবিধা বেশ জোরদার হল। এবার সুমনার সঙ্গে প্রায়শই মির্জা বাড়িতে যাতায়াত শুরু করল সে। মাঝেমধ্যে কাশেমের সঙ্গেই বেরিয়ে যেতো সুমনা। ফিরতো এক দুদিন পর, কিংবা পরেরদিন সকালে। ব্যপারটা বেশ দৃষ্টিকটু লাগতো মিতার। প্রিয়তা তখনও খুব ছোট। মাত্র পাঁচ বছর। এসব বোঝার বয়স ওর ছিলোনা। সুমনা সেভাবে কখনও কাছে নিয়ে বড় করেনি প্রিয়তাকে। মেয়েটা যখন নিজে থেকে উৎসাহ নিয়ে ছুটে যেতো সুমনার কাছে, অল্প সময় পরেই খুব বিরক্তবোধ করতো সে। বকাবকি করে পাঠিয়ে দিতো মিতার কাছে। ফলসরূপ সুমনা ওর মা। এইটুকু ছাড়া বিশেষ কোন অনুভূতি তৈরীই হয়নি কখনও প্রিয়তার মনে। মিতার তখন মনে হয়, ভাগ্যিস শান ঢাকা আছে। নয়তো মায়ের এধরণের নোংরামো বোঝার বয়স ওর হচ্ছে। এবয়সেই কী ভয়ংকর দাগ পড়তো বাচ্চাটার মনে! এদিকে কাশেমের আগ বাড়িয়ে, গায়ে পড়ে মিতার সঙ্গে কথা বলা, গায়ে হাত দেওয়ার মাত্রা দিনকে দিন বাড়ছিল।
মিতা প্রায় ভাবতো শওকতকে বলার কথা। কিন্তু তারপর ভাবতো, এমনিতেই সংসারটা অশান্তিতে পরিপূর্ণ। এসব বললে ঝামেলা কমবে না বরং বাড়বে। তবে সুমনাকে বলেছিল, ' এসব কিন্তু ঠিক করছোনা আপা। তোমার সংসার আছে, ফুটফটে দুটো বাচ্চা আছে। ওদের কথাটা অন্তত ভাবো। তোমার কী মনে হয় ভাইয়া কিছু জানেননা। নিশ্চয়ই জানেন। তবুও কিছু বলছেনা মানে তোমার গুরুত্বযে তার জীবনে আর নেই সেটা বুঝতে পারছো? এভাবে সবটা ধ্বংস করে দিওনা।'
কিন্তু কোন লাভ হয়নি। বরাবরের মতোই বিকট ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে সে মিতাকে। সেইসঙ্গে থাকা খাওয়ার খোটাতো আছেই।
•••••
এসবের মধ্যে কাশেমের উত্ত্যক্ততা বাড়ছিল খুব ধীরক্রমে। প্রথমে হুটহাট একা পেয়ে নিজের ভালোলাগার কথা আওড়েও যখন কাজ হয়নি, তখন ধীরে ধীরে অধিকারসুলভ আচরণ করতে শুরু করল যে। মিতা ভয় পেয়ে যেতো, যতটা সম্ভব দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করতো। কিন্তু কাশেম যেন যোকের মতো লেগে ছিল পেছনে। শুরু শুরুতে মুখোশের আড়ালে থাকলেও একপর্যায়ে আসল চেহারা বের হল তার। সে চেহারা মিতার জন্যে ছিল আরও ভয়ংকর। কুপ্রস্তাবতো ছিলোই। সেইসঙ্গে রীতিমতো হুমকি, ধমকি দিচ্ছিল সে মিতাকে। শওকত দূরে থাকতো।বাড়িতে পুরুষ বলতে কেবল থাকতো পলাশ। সেও খুব কম সময়ই থাকতো বাড়িতে। সুমনাতো নিজের দুনিয়ায় ব্যস্ত থাকা মানুষ, প্রিয়তা খুবই ছোট। এসবের মধ্যে নিজেকে ভীষণ একা, অসহায় মনে হতো মিতার। কাউকে কিছু বলে ওঠার সাহসও করতে পারছিল না। ওর ইচ্ছে করতো সব ছেড়েছুড়ে বশিরের কাছে চলে যেতে। পৃথিবীতে ঐ একটা লোকই ওর আপন। যার কাছে ও সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। কিন্তু তখনই প্রিয়তার চেহারাটা ভেসে উঠতো ওর চোখের সামনে। ঐ মেয়েটাসহ বশিরের পরিবার কোনভাবেই মানবেনা মিতাকে।
•••••
এরমধ্যে একদিন সকালে শওকত আবার বেরিয়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে। কবে ফিরবে তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। কাশেম হক সেই দুপুর থেকে পরে আছে মীর্জাবাড়িতে। আছরের আজানের পরপর প্রিয়তাকে নিয়ে ছাদে গিয়েছিল মিতা। দুজনে খেলছিল, দুষ্টুমি করছিল। এরমধ্যেই সেখানে কাশেম উপস্থিত হয়। কাশেমকে দেখামাত্র ভয় পেয়ে যায় প্রিয়তা। দৌড়ে মিতার পেছনে গিয়ে জামা খামচে ধরে দাঁড়ায়। মিতা নিজেও ভয় পেয়ে যায়। তবুও প্রিয়তাকে, 'তুমি রুমে যাও মা। আমি আসছি।'
প্রিয়তা একমিনিটও না দাঁড়িয়ে ছুটে চলে যায়। ভয় পেয়েছে ভীষণ ও। মিতা নিজেও চলে যেতে নিলে খুব বাজেভাবে নিজের দিকে টেনে ধরে কাশেম। ভীষণ ব্যথাতুর ভাবে। ব্যথায় চেয়েও বেশি প্রচণ্ড ভয়ে শিউরে ওঠে মিতার শরীর। কাশেমের চোখমুখ খুব ভয়ংকর শক্ত। শক্ত গলাতেই, 'শেষবার বলছি মিতা রাজি হয়ে যাও। জাস্ট একবার! কেউ জানবেনা। সুমনাও না। ভালোভাবে বলছি চেনোনা তুমি আমাকে। আমার ক্ষমতা তুমি জানোনা। ভয়ংকরভাবে পস্তাবে তুমি পড়ে।'
ঘৃণায় শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে মিতার। মুখ তেঁতো হয়ে ওঠে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে থু থু মেরে দেয় কাশেমের মুখে। কাশেম কোন প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগেই বুকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসে ছাদ থেকে। মিতার যাওয়ার দিকে হিংস্রভাবে চেয়েথাকে শওকত। মুখে লেগে থাকা থুথুতে হাত দিয়ে ভাবে, ভদ্রভাবেই কাজটা করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু লোকজনের তার ভদ্রতা পছন্দ না।
•••••
বশিরকে কাশেমের এই ব্যপারটা বলতে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিল মিতা। অপমানবোধ হচ্ছিলো ভীষণ। সেকারণেই ভাবল সুমনাকেই আগে বলা উচিত। তার বোন বিগড়ে গেছে, উচ্চবিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছে। কিন্তু নিজের বোনের কোন ক্ষতি সে কখনই করবেনা। তার সম্মানহানিকে সুমনা কখনই সমর্থন করবেনা। এই সমস্যার সমাধান নিশ্চয়ই সে করবে। সেই চিন্তা করেই মিতা সুমনার কাছে গিয়ে বলে ফেলল কাশেমের এধরণের ব্যবহার সম্পর্কে।
মিতাকে অবাক করে দিয়ে সপাটে ওর গালে চড় বসিয়ে দিল সুমনা। আক্রোশঢালা কন্ঠে বলল, ' এখন আর কাউকে না পেয়ে কাশেমের দিকে চোখ দিয়েছিস? আমি না থাকতেতো আমার হাজবেন্ডের সাথে অকাজ-কুকাজ করে বেরিয়েছিস। আজকালতো কানাঘুষায় শুনি কোন এক বেকার, বখাটে ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াস, সঙ্গে আমার মেয়েটাকেও নিয়ে যাস। এখন আবার কাশেম! একটা দিয়ে হয়না তোর? অমন সুন্দর, বড়লোক ছেলে দেখেই মাথা ঘুরে গেছে তোর তাইনা?নিজের চেহারা দেখেছিস? ওর মতো ছেলে তোর পেছনে ঘুরবে? স্বপ্ন দেখিস? শওকত আজই ঢাকা গেছে তাই। আসুক এবার! ঘাড় ধরে বের করব তোকে বাড়ি থেকে। বয়সতো কম হয়নি। বিয়ে করে বিদেয় হচ্ছিস না কেন বলতো?'
মিতা হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকল সুমনার দিকে। কষ্ট, লজ্জা, অপমানে দম বন্ধ হয়ে এলো ওর। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে নামল। ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরে নিজের রুমে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদল। ওর কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল প্রিয়তার। অর্ধঘুমে মিতাকে কাঁদতে দেখে নিজেও কেঁদে ফেলল। মিতা প্রিয়তার কান্না থামানোর মতো মানসিক শক্তি পেলোনা। কেবল মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল। ও নিজের কান্নাই থামাতে পারছিলনা সেদিন। বাবা-মাহীন পৃথিবী কত নিষ্ঠুর, যন্ত্রণাময় তা প্রতি মুহূর্তে হাড়ে হাড়ে টের পায় ও।
•••••
' তুমি এগুলো আমায় আগে কেন বলোনি মিতা? কয়েকমাস কম মনে হচ্ছে তোমার কাছে?'
বশিরের ধমকে মাথা নিচু করে রাখল মিতা। নরম গলায় বলল, ' আমি তখনও বুঝিনি লোকটা এতো বেশি ডেসপারেট হয়ে উঠবে।'
বশিরের চেহারায় চাপা ক্রোধের সঙ্গে চিন্তাও, ' তুমি ঐ বা*স্টা*র্ডটাকে চেনোনা মিতা। আমি জানি। ওর বাহিরের কর্মকান্ড জানলে শিউরে উঠবে তুমি। ভয়ংকরসব কর্মকাণ্ড থাকা সত্ত্বেও কেউ কিচ্ছু করতে পারেনা জাস্ট বিকজ অফ হিজ ফা** পাওয়ার! আর তোমার ঐ বোন। বোন না ডাইনি ওটা! এতো নোংরা কোন মহিলা হতে পারে!'
মিতা শুকনো এক ঢোক গিলে আকড়ে ধরে বশিরের হাত। ওর নিজেরও ভেতর ভেতর ভীষণ ভয় লাগছে। বশির হঠাৎই মিতার হাতের ওপর নিজের হাত রেখে বলল, ' মিতা প্লিজ, চলো বিয়ে করে ফেলি।'
কথাটা শোনামাত্র মিতা তাকাল ওদের খানিকটা দূরে আপনমনে খেলতে থাকা ছোট্ট প্রিয়তার দিকে। বশিরও সেদিকে তাকিয়ে বলল, ' আমি জানি। আপাতত তুমি বিয়ে করে চলো আমার বাড়িতে। পরে ধীরেসুস্থে আমি বাড়ির লোকেদের বুঝিয়ে রাণীকেও নিয়ে আসব আমাদের কাছে। আই প্রমিজ।'
মিতা বলল, ' এসব শুনেও তুমি এইকথা বলছো! ঐকদিনের জন্যেই বা কার কাছে রেখে আসব আমি ওকে? ঐ মহিলার কাছে? ওর শৈশবটা পুরো নষ্ট হয়ে যাবে বশির!'
বশির কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই প্রিয়তা দৌড়ে চলে এলো ওদের কাছে। 'বশির কাকা' বলে লাফিয়ে উঠল বশিরের কোলে। মুখে খিলখিলে হাসি। স্বভাবতই নিজের পাকা পাকা কথা বলতে শুরু করল।
বশির প্রিয়তার গাল টেনে দিয়ে বলল, ' শোন মা, জীবনে আর যাই হোস তোর এই মিতা মায়ের মতো ভালো মানুষ হবিনা। এতো ভালো হয়ে আসলে কিছু পাওয়া যায়না। লোকে হয়তো প্রশংসার বন্যা বইয়ে দেবে, কিন্তু ভালো থাকতে কেউ দেবেনা। জীবনে যেটা চাইবি, যাই ভালোবাসবি তা পেতে যা করা লাগে করে ফেলবি। এনিথিং। কে কী বলল, ভাবল হু কেয়ারস্? কেউতো আর দু টাকা দিয়ে বলবেনা, যা ভাই, যা লাগবে কিনে খা।'
মিতা সজোরে বশিরের বাহুতে কিল বসিয়ে বলল, 'ছোট বাচ্চাটাকে কীসব শেখাচ্ছো! এমনিতেই দুষ্টুর একশেষ। কেউ ওর কলম নিয়ে গেলে ও গিয়ে হাত কামড়ে দেয়। এইসবস শিখে শেষে বড় হলে দেখা যাবে ছো*রা ব*ন্দু*ক নিয়ে লোকেদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে!'
বশির বলল, 'ভালোতো! এলাকায় আমিও শার্টের কলার তুলে তুলে বলব, কথাবার্তা সাবধান। আমি কিন্তু গুন্ডা মেয়ের বাপ।'
মিতা দ্বিতীয়বার মারতে এলে প্রিয়তাকে তুলে সামনে ধরে নিজেকে আড়াল করল বশির। মিতা হেসে ফেলল। দুহাতে মুখ চেপে খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল প্রিয়তাও। খানিকক্ষণ বশিরের সঙ্গে দুষ্টুমি করে আবার লাফিয়ে চলে গেল খেলতে।
মিতা উদাস চোখে তাকিয়ে রইল সেদিকে। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, ' যদি আমার কিছু হয়ে যায়,
আমার প্রিয়টাকে তুমি তোমার কাছে নিয়ে যেও বশির। ওকে দেখে রেখো। পৃথিবীতে আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই বিশ্বাস করো। কেউ না থাকার যন্ত্রণা সহ্য করা যায়। কিন্তু সবাই থেকেও কেউ না থাকার যন্ত্রণা অনেক ভয়ংকর। আমার ঐ ছোট্ট মেয়েটা সহ্য করতে পারবেনা। বয়সের আগেই বড় হয়ে যাবে। আশেপাশের ঐ নিষ্ঠুর মানুষগুলো ওর ভেতরের এই নিষ্পাপ অস্তিত্বকে পিষে মেরে ফেলবে। আমার নিষ্পাপ, দুষ্টু প্রিয়'টা মরে যাবে। থেকে যাবে শুধু ওদের রাণী। আর কখনও কেউ ওর ভেতরের সেই প্রিয়কে জাগাতে পারবেনা। তুমি তা হতে দিওনা প্লিজ।'
বশিরের বুকের ভেতরে কেউ যেন ছু*রি চালিয়ে দিল। অদ্ভুত যন্ত্রণায় কেমন কুকড়ে উঠল ও। ঝট করে মিতাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলল, ' কোথাও যাবেনা তুমি মিতা। কোথাও না। তুমি আমার জীবনের একমাত্র জোছনা। তোমাকে ছাড়া আমার জগত অন্ধকার হয়ে যাবে বিশ্বাস করো। তুমি না থাকলে পাগল হয়ে যাব আমি। একদম পাগল হয়ে যাব।'
মিতা ফুপিয়ে কেঁদে ফেলল বশিরের কথায়। মনযে ভয়ংকরভাবে কু ডাকছে।
•••••
এইকয়েকমাসে মিতা সম্পর্কে আরও গভীরভাবে খোঁজখবর নিয়েছে কাশেম হক। সবরকম তথ্য সংগ্রহের পর জানতে পারে বশির সম্পর্কে। মিতার সঙ্গে বশিরের সম্পর্কের কথাও জানতে পারে। ওর দলের এক লোক প্রস্তাব দিয়েছিল বশিরকে সরিয়ে ফেলার ব্যপারে। কিন্তু পরিষ্কার নিষেধ করেছে কাশেম। কারণ আছে। পরেরবছর আবার নির্বাচন। বর্তমানে তাদের দলের অবস্থা এমনিতেও খুব শক্তপোক্ত জায়গায় নেই। জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে তাদের প্রতি। বিরোধী দলগুলোও বেশ ভালোভাবেই তার সুযোগ নিচ্ছে। সুতরাং এই মুহূর্তে সরাসরি প্রয়োজনহীন একটা খু*ন করা যাবেনা। কিন্তু মিতার বিষয়টা মাথা থেকে কোনভাবেই বের হয়নি কাশেমের। জীবনের এতগুলো মাস অন্যকোন মেয়ের পেছনে ব্যয় করেনি সে। সুতরাং এখনতো পিছিয়ে আসার প্রশ্নই ওঠেনা। গত বিকেলে মুখে মারা সেই থুথু তার ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই আগুন কাশেম নিভিয়ে ছাড়বে।
নিজের ফ্লাটে বসে সিগারেট টানতে টানতেই এইধরণের কথাবার্তা ভাবছিল কাশেম। এরমধ্যেই সুমনা আসে। কাশেম হাত বাড়িয়ে নিজের বাহুবন্ধনে ডাকে সুমনাকে। সুমনা গিয়ে বসে কাশেমের পাশ ঘেষে। কাশেম নিজ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতেই সুমনা বলে ওঠে, 'এবার তাহলে মিতার ওপর চোখ পড়েছে তোমার?'
সিগারেটে টান দিতে গিয়েও থেমে যায় কাশেম। সুমনার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে, ' বলে দিয়েছে তোমাকে?'
সুমনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ' আর কোন মেয়ে পাওনি? ও-ই কেন? আমার চেয়ে বেশি সুন্দর ও?'
কাশেম এবার হো হো করে ঘর কাঁপিয়ে হাসল। সুমনার থুতনি ধরে আদর করে বলল, ' মাই জেলাস পেট! আমার কাছেতো সবমেয়েকেই সুন্দরী লাগে। তবে তুমি স্পেশাল। অন্যসব মেয়েদের দিয়ে আমার একবারেই হয়ে যায়। কিন্তু তোমাকে দিয়ে হয়নি। ইউ আর লাইক মাই রেড ওয়াইন সুইটহার্ট। যত পুরোনো হয় তত নেশা বাড়ে। বাট বাট বাট! তোমার বোনটা আমার ইগো হার্ট করে ফেলেছে, জ্বলছে ভীষণ। জ্বালাতো কমাতে হবে বলো? জেনে যখন গেছোই। সাহায্য করো আমায়!'
সুমনা ভ্রু কুঁচকে বলল, ' যদি না করি?
সিগারেটে সুখটান দিয়ে অ্যাশট্রেতে ফেলল কাশেম। নাক দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ' শওকত ভাইকে বলতে হবে আমাদের ব্যপারে। তাছাড়াও, তোমার এই আরাম-আয়েশের সুন্দর জীবন স্পয়েল করে দিতে আমার বেশিক্ষণ লাগবেনা ডার্লিং! চয়েজ ইজ ইওরস্। জাস্ট একটা রাত! ব্যবস্থা করে দাও, আ'ল রিওয়ার্ড ইউ।'
সুমনা তাকিয়ে রইল কাশেমের দিকে। মিতাকে আজকাল এমনিতেও সহ্য হয়না ওর। রূপের খুব অহংকার হয়েছে। কাশেমেরও নজর কেড়েছে! একটা শিক্ষা এই মেয়েটাকে দিতেই হয়। সুমনা মাথা নেড়ে বলল, ' বেশ! করে দিচ্ছি ব্যবস্থা। তবে বাকিটা তোমাকেই সামলাতে হবে।'
•••••
কেটে যায় আরও কয়েকটা দিন। এরমধ্যে কাশেম আর কোনভাবে বিরক্ত করেনি মিতাকে। আসেও নি মির্জা বাড়িতে। মিতা নিজেও ভীষণ সতর্ক থাকে আজকাল। তাও ভেতর ভেতরে কেমন অস্থিরতা কাজ করে। খুব খারাপ কিছু হওয়ার ভয়ে বুক থরথর করে কাঁপে সারাক্ষণ।
তীব্র বিষণ্নতার মধ্যে এক পশলা খুশির খবর ভেসে এলো মিতার জীবনে। বশিরের চাকরি হয়ে গেছে। খুশিতে কেঁদে ফেলল মিতা। বহুবছর এমন খুশি হতে পারেনি সে। বশিরের চোখেও তখন পানি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ওদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। এরচেয়ে আনন্দের, এরচেয়ে সুখের আর কী হতে পারে? মিতা বশিরের দুগালে হাত রেখে বলে, 'এবার নিজের বাসায় কথা বলো প্লিজ। প্রিয়র বিষয়েও বলো।'
বশির বলে, ' এখন না। আমি জানি ওরা একটা ঝামেলা করবেই। রাণিকে সহ তোমায় মানতে চাইবেনা। আর এসব সেটেল করতে করতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। এতোটা সময়ের রিস্ক আমি নিতে পারব না। তুমি এক আজ করো। কাল সকালে রেডি হয়ে রাণিকে নিয়ে সোজা চলে আসবে ক্যাম্পাসের সামনে। ওখান থেকে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করব আমরা। তারপর সোজা বাড়ি যাব।'
' কিন্তু...'
বশির মিতার হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলে, ' কোন কিন্তু না। আর কোন রিস্ক নেওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। তোমাকে হারাতে পারবনা আমি মিতা। এই শাড়িটা পড়ে আসবে কাল। আমি নিজে পছন্দ করে কিনেছি।'
মিতা আবার কেঁদে ফেলে। এবার খুশিতে। প্রচণ্ড খুশিতে। কোনকিছু না ভেবে ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ও বশিরকে। বশিরও ধরে। ভীষণ শক্ত সে আলিঙ্গন। যেন এই আলিঙ্গন থেকে একবার মুক্ত হলে আর কোনদিন ধরা হবেনা। কোনদিন না!
•••••
সেদিন বাড়িতে গিয়ে মিতা দেখে সুমনা কোথায় যেন চলে গেছে। ব্যপারটা নতুন না। এমন প্রায়ই রাত বাইরে কাটিয়ে আসে সুমনা। পলাশও দুদিন যাবত বাড়িতে নেই। ও গিয়ে পৌঁছতেই কাজের মহিলা সব গুছিয়ে বিদায় নিল। প্রিয়তা তখন ঘুমোচ্ছে। এইসময় প্রিয়তা সাধারণত ঘুমোয় না। মিতা কপালে হাত রেখে দেখল জ্বর এসেছে মেয়ের। বর্ষাকাল। বাইরে ঘনঘন বৃষ্টি হয়। মেয়েটাও বারণ না শুনে ভিজে বেড়ায়। বাঁধিয়েছে জ্বর এখন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিতা। ভারি কম্বল বের করে কম্বলসহ প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল। বহুদিন পর মনটা বেশ ফুরফুরে ওর। এরমধ্যে বাচ্চাটা অসুস্থ না হলেও পারতো।
প্রিয়তার পাশে শুয়ে মিতাও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল রাতের বেলা। বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। চোখ খুলতেই দেখল প্রিয়তা জেগে গেছে। শুয়ে শুয়ে এটাওটা নেড়ে একা একা খেলছে। মিতা কপালে হাত রেখে দেখল, জ্বর কমেনি মেয়ের একটুও। কাছে নিয়ে প্রিয়তাকে আদর করল মিতা। প্রিয়তা তেমন কথা বলতে পারছেনা, গলা বসে আছে। মিতা বিছানা থেকে নামতে খেলে হাত শক্ত করে ধরল প্রিয়তা। অস্ফুট স্বরে বলল, ' আমায় রেখে যেওনা মা!'
কেন যেন মিতার চখে জল চলে এলো। প্রিয়তার গালে চুমু খেয়ে বলল, ' তোকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে আমার? স্যুপ বানিয়ে আনছি। ঔষধ খেতে হবে।'
ফ্রেশ হয়ে প্রিয়তার জন্যে সুপ বানাতে গেল মিতা। স্যুপ খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিতে দিতে বলল, 'এখন কেমন লাগছে হ্যাঁ? বারবার বলি সিজন ভালো না। বৃষ্টিতে ভিজবেনা। কথা শোননা কেন প্রিয়?'
সিরাপের তেঁতো স্বাদে চোখ খিঁচে মাথা ঝাঁকালো প্রিয়তা। চোখ খুলে কোনমতে বলল, 'আমার নামতো রাণী। তুমি সবসময় প্রিয় বলে কেন ডাকো?'
মিতা মিষ্টি করে হাসল। টেনে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল প্রিয়তার উত্তপ্ত শরীর। মাথায় চুমু খেয়ে বলল, 'কারণ তুইতো আমার প্রিয়। শুধু আমার না, সবার প্রিয়। তোর জন্মই হয়েছে সবার প্রিয় হওয়ার জন্যে। এই পাপের রাজ্যের রাণী হওয়ার জন্যে না।'
ছোট, অবুঝ প্রিয়তা বুঝলনা মিতার কথার অর্থ। কেবল লেপ্টে রইল নিজের সত্যিকারের মায়ের বুকে। শরীরে তখন ওর ধুম জ্বর। আবার ঘুম ধরেছে প্রিয়তার চোখে। তাকাতে পারছেনা সে ঠিকভাবে। গলার অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে ধীরে ধীরে। মিতা ওকে শুইয়ে দিয়ে বলল, 'ঘুমিয়ে পরো আম্মু। সকালে ঝট করে জ্বর চলে যাবে।'
প্রিয়তা চোখ বুজল। মিতা ধীরে ধীরে জলপট্টি দিয়ে দিল ওর মাথায়। অনেকটা সময় পর মিতার চোখ হঠাৎ বশিরের দেওয়া ব্যাগটার ওপর গিয়ে পড়ল। ঠোঁটে লাজুক হাসি ফুটল ওর। এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিল। ভেতরে হাত গলাতেই বেরিয়ে এলো লালরঙা একটা শাড়ি। আয়নার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল ও। প্রতিবিম্বের দিকে তাকাতেই গাল লাল হয়ে উঠল মিতার। শাড়ি হাতে রেখেই দুহাতে মুখ ঢেকে হেসে ফেলল। মিতার মন চাইল শাড়িটা একবার পড়ে দেখতে। নিজেকে ধরে রাখতে পারল না মিতা পড়ে ফেলল শাড়িটা।
শাড়িটা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজেকে অন্যরকম লাগল ওর। কাল এই শাড়ি পড়ে বশিরকে বিয়ে করবে ও। বশিরের বউ হবে। বশিরের বউ! আরও একবার লজ্জায় লাল হল মিতা। মুখ ঢেকে হাসল। সেইসঙ্গে স্বস্তি পেল এইভেবে যে এই নরকে আর থাকতে হবেনা ওকে। ওর প্রিয়কে। শানতো দূরেই আছে। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে শানকেও নিজের কাছে রাখবে ও। এই অন্ধকার জগত নিষ্পাপ এই বাচ্চাদুটোর জন্যে না।
ভীষণ খিদে পেয়েছে মিতার। রাতে কিছু খাওয়া হয়নি তখনও। এদিকে সময় পুরো মাঝরাত। তাই শাড়িটা না বদলেই কিচেনের দিকে পা বাড়ালো মিতা। খাবার গরম করে খাবে। এদিকে তেষ্টাও পেয়েছে। তাই ডাইনিংয়ে গিয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি নিল মিতা। গ্লাসটা হাতে তুলতেই 'খট' করে একটা শব্দ পেল । চমকে উঠল ও। বাড়িতেতো কেউ নেই। কীসের আওয়াজ! আতঙ্ক নিয়ে দু'পা এগোতেই থেমে গেল। সারা শরীর শিরশির করে উঠল। হাত থেকে পড়ে ভেঙ্গে গেল পানির গ্লাসটা। কাশেম হক!
হ্যাঁ কাশেম হক ঢুকেছে বাড়িতে। কিন্তু কীকরে! মিতার স্পষ্ট মনে আছে ও দরজা লক করেছিল তাহলে! হাত-পা ঠান্ডা হয়েছে জমে যাওয়ার অবস্থা হল মিতার। পিছিয়ে গিয়ে কোনভাবে উচ্চারণ করল, ' আপনি ভেতরে কীকরে এলেন?'
কাশেম উত্তর দিলোনা। কিন্তু খুবই ভয়ংকরভাবে হাসল। চোখদুটো জ্বলছে যেন। মিতা নিঃশ্বাস আটকে এলো। কাশেমের উদ্দেশ্যে বুঝতে বাকি নেই ওর। মিতা দৌড় নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে লক করে দিল। ভীষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ও। থরথর করে কাঁপছে হাতপা। বাইরে তখনও ভীষণ বৃষ্টি। ও টালমাটাল পায়ে কোনরকমে বিছানার কাছে গিয়ে প্রিয়তাকে ঠেলে তুলল। ছোট্ট প্রিয়তা হঠাৎ ঘুম ভাঙায় কেঁদে ফেলল। মিতা দ্রুত মুখ চেপে ধরল ওর। অস্থির গলায় বলল, ' চুপ মা চুপ!'
এরপর প্রিয়তাকে ধরে বিছানার সামনে নিচে বসিয়ে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল, 'শোন মা, আমাদের ঘরে সেই রাক্ষস লোকটা ঢুকে পড়েছে। তোমাকে বলেছিলাম না দূরে থাকতে? সে। ঐ রাক্ষসটা খুব খারাপ। ছোট ছোট বাচ্চাদের ধরে ধরে খেয়ে ফেলে। তুমি এখন চুপচাপ বিছানার নিচে লুকিয়ে থাকবে। একদম বের হবেনা। ঐ রাক্ষসটা যদি রুমে চলে এসে আমাকে মারে, তবুও বের হবেনা।'
প্রিয়তা এমন ভয়ংকর কথা শুনে আতঙ্কিত চোখে তাকাল। কেঁদে ফেলল হাউমাউ করে। এমিতেই ভীষণ জ্বর। গলা বসে আছে একদম। এদিকে মিতা ইতিমধ্যে দরজায় খটখট আওয়াজ শুনছে। মিতা বলল, 'ভয় পেওনা। আমিতো বড়। তাই ও শুধু আমাকে মারতে পারবে। খেয়ে ফেলতে পারব না। কিন্তু তুমি বের হলেই কিন্তু খেয়ে ফেলবে। ভেতরে যাও। একদম ভেতরে গিয়ে বসে থাকবে। বের হবেনা একদম। যাও!'
প্রিয়তা সত্যিই প্রচণ্ড ভয় পেল। হামাগুড়ি দিয়ে একদম বিছানার নিচের এককোণে বসে রইল। প্রচন্ড ভয়ে থরথর করে কাঁপছে বাচ্চা মেয়েটা। রাক্ষস দেখলেই খেয়ে ফেলবে ওকে। কী ভয়ংকর!
প্রিয়তাকে লুকিয়ে উঠে দাঁড়াল মিতা। ওর মাথা কাজ করছেনা। হাতপায়ের কম্পনও থামছেনা। দরজার ওপাশে ক্রমাগত আওয়াজ হচ্ছে। সারাবাড়িতে আর কেউ নেই। এতোবড় বাড়ি থেকে ওর চিৎকার বাইরেও যাবেনা। কে বাঁচাবে ওকে! চাবি দিচ্ছে কাশেম! কিন্তু চাবি পেল কোথায়! মিতা দ্রুত টেবিল থেকে একটা ছুরি নিল। ছোট সাইজ ছুরিটার। সেটা নিজের কাছে লুকোলো ও। এরপর একটা চেয়ার নিয়ে রাখল দরজার সামনে। দৌড়ে টেবিলটার নড়াতে চেষ্টা করছিল এমন সময় খুলে গেল দরজাটা। কাশেমের সবল ধাক্কায় চেয়ারটাও সরে গেল অনায়াসে। মিতা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল কাশেমের দিকে। কাশেম শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, 'তোমার কী মনে হয় মিতা? আজ আমি আটঘাট না বেঁধেই এসেছি। এতো সুন্দর শাড়ি পড়ে আমার জন্যেই তৈরী ছিল বুঝি?'
মিতা পিছিয়ে গিয়ে ভয়ে জমে যাওয়া বলল, ' কাশেম ভাইয়া ছেড়ে দেন আমাকে। শওকত ভাই জানলে কিন্তু খারাপ হবে অনেক। ভালোয় ভালোয় বলছি চলে যান।'
কাশেম বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে এগিয়ে গেল মিতার দিকে। মিতা পালানোর পথ পাচ্ছেনা। কোনদিক দিয়ে সরে যাওয়ার উপায় দেখছেনা। তাও দৌড়ে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু কাশেমের শক্ত হাত ধরে ফেলল মিতাকে। শাড়ির ফাঁক দিয়ে সকামে স্পর্শ করল মিতার কোমর। সারা শরীরে যেন আগুন জ্বলে উঠল মিতার। পেছন লুকোনো ছু*রি ধরা হাতটা সামনে এনে সবেগে বসিয়ে দিতে চাইল কাশেমের গলায় কিন্তু লাভ হলোনা। তার আগেই খপ করে সেই হাতটা ধরে ফেলল কাশেম। বলল, ' এমন তেজি মেয়ে আমার অনেক বেশি পছন্দ মিতা সোনা। দেখলেই শরীরে আগুন ধরে যায়।'
বলে হাতটা মুচড়ে ধরতেই ছু*রিটা পরে গেল হাত খসে। মিতা কেঁদে ফেলল। কাশেম ওর গাল চেপে ধরে বলল, 'অনেকগুলো মাস অপেক্ষা করেছি আজকের রাতটার জন্যে সোনা। যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই তোমার। আমার সঙ্গে বিছানায় আসা ছাড়া। চুপচাপ যা হচ্ছে হত দাও। কেউ জানবেনা। নইলে...'
চোখ বিষ্ফোরিত হয়ে উঠল মিতার। ভীতগ্রস্থ হয়ে মাথা নাড়ল। কাশেম নিজের পূর্ণ বাসনা নিয়ে ঝুঁকে মিতার ঠোঁটে চুমু খেল। লাজ, ঘেন্নায় শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল মিতার। ঐ মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে হল ওয। ছটফট করে উঠল নিজেকে ছাড়াতে। কাশেম মুখ তুলতেই প্রচণ্ড ঘৃণায় থুথু ছুড়ল কাশেমের মুখে। কাশেমের ভেতরে পোষা রাগে যেন ঘি পড়ল। কষিয়ে একটা চড় মারল সে মিতার গালে। উল্টে টেবিলের ওপর পড়ল মিতা। ঠোঁট ফেঁটে রক্ত বেরিয়ে এলো। সশব্দে কেঁদে ফেলল অসহায় মেয়েটা।
এদিকে বিছানার নিচে বসে জমে আছে প্রিয়তা। প্রচন্ড ভয়ে নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। চোখদুটো বিস্ফোরিত অবস্থায় খোলা। কাশেমের কথা, মিতার কান্না সবটাই কানে যাচ্ছে তার। কিন্তু বুঝছেনা মস্তিষ্ক। শুধু জানে, ঐ রাক্ষসটা মিতাকে মারছে! ওকে পাওয়া মাত্রই খেয়ে ফেলবে।
কাশেম এগিয়ে গিয়ে মিতার মাথাটা টেবিলে সজোরে চেপে ধরে। ঝুঁকে কানের কাছে ফিসফিস করে করে বলল, ' থুথু মারস তুই আমারে খা*** বাচ্চা। চেনোস আমারে? দেখ আজকে তোর কী হাল করি মা**।'
বলে একটানে পেছনে বাঁধা ব্লাউজের ফিতাটা খুলে ফেলল। মিতা ছটফট করে উঠল। চিৎকার করে কাঁদল। মিতাকে ছেড়ে ওর শাড়ির আঁচল ধরল। ছাড় পাওয়ায় মিতা দৌড়ে পালাতে চাচ্ছিল কিন্তু আঁচলের টানে থামতে হল ওকে। মিতা এবার বড্ড অসহায় হয়ে পড়ল। গায়ের জোরে এই হিংস্র জানোয়ারটার সঙ্গে ও কোনভাবেই পেরে উঠবেনা। তাই নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে, শাড়ির আঁচলটা বুকে চেপে রেখেই হাত জোর করে বলল, 'দয়া করে ছেড়ে দিন আমাকে কাশেম ভাই। কালকে আমার বিয়ে। এমন করবেন না আমার সাথে। আমার মরা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা। হাত জোর করছি। আল্লাহর দোহাই লাগে ছেড়ে দিন।'
কাশেমের মন গলল না বিন্দুমাত্র। উল্টে বিশ্রী হেসে আঁচলটা একটানে খুলে নিয়ে বলল, ' তাহলেতো ভালোই! কাল রাতের জন্য আজ রিহার্সাল করে নাও। পার্ফরমেন্স ভালো হবে।'
মিতা দুহাতে নিজের বুক ঢাকার সুযোগটাও পেলোনা। তার আগেই আরও একটানে শাড়ির বাকি অংশটাও খুলে ফেলল। মিতা টাল সামলাতে না পেরে উপুড় হয়ে পড়ল বিছানায়। শাড়িটা দিয়ে মুখে লেগে থাকা থুথু মুছল কাশেম। অতঃপর সেটা ফ্লোরে ফেলে, পায়ে পিষে এগিয়ে এলো। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল মিতা। মুখের সামনে বশিরের সেই সরল মুখটা ভেসে উঠল। কত স্বপ্ন আর উৎসাহ পিয়ে সে শাড়িটা দিয়েছিল মিতাকে। মিতা উঠতে নিলেই ওকে পুনরায় বিছানায় ধাক্কা দিল কাশেম। দুহাতে চেপে ধরল বিছানায় সঙ্গে। মিতা ছটফট করে উঠল, কিন্তু পারলনা কাশেমের শক্তির সঙ্গে। মিতা চিৎকার করে উঠল, ' আল্লাহ! আল্লাগো!'
'চুপ কর।' আরও একটা চড় পড়ল মিতার গালে।
কাশেমের হিংস্র থাবায় দমবন্ধ হয়ে এলো মিতার। সজোরে চিৎকার করে উঠল। কিছুক্ষণ আগে গায়ে লাল শাড়ি জড়িয়ে যে স্বপ্নের দুনিয়া ও সাজিয়েছিল। তা এক বিভৎস জানোয়ারের লালসা নিমেষেই পিষে ফেলল দুপায়ে। মিতার সাজানো স্বপ্ন, সংসার সব যেন ধীরে ধীরে চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল। ও হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চেয়েও পারল না। দূরে সরে গেল বশির। অনেক দূরে।
বন্য কোন জানোয়ারের মতোই মিতার শরীরে নিজের আধিপত্য প্রদর্শন করল কাশেম। ক্লান্ত, শক্তিহীন মিতা নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করল কিন্তু হেরে গেল নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে। বিছানার নিচে বসে থাকা প্রিয়তা দুহাতে কান চেপে ধরল। ভাঙা গলায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। রাক্ষসটা এতো কেন মারছে ওর মিতা মাকে। এই আওয়াজে ও শ্বাস নিতে পারছেনা। ও বের হতে চায়, ঐ রাক্ষসটাকে থামাতে চায়। কিন্তু ওতো ছোট। ওকে খেয়ে ফেলবে রাক্ষসটা। ও মনে মনে আল্লাহকে বলল, ও বড় হয়ে যেতে চায়। এক্ষুনি বড় হয়ে যেতে চায়। তাহলে ও বের হতে পারবে। মিতা মাকে বাঁচাতে পারবে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের কাছে নিষ্পাপ মনের প্রার্থনাটুকুও বড়বেশি ঠুনকো হয়ে গেল সেদিন।
আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল মিতার গলার চিৎকার, নিস্তেজ হয়ে গেল শরীর। ওপরে ধীরে চলতে থাকা ঐ সিলিংফ্যানে নিষ্ঠুর আওয়াজ যেন বোঝাল রাতটা কত নির্মম, নিষ্ঠুর বিভৎস!
সেইরাতে এক দু'বার নয় পরপর তিনবার ধ*র্ষ*ণ করল কাশেম হক মিতাকে। অন্ধকার বিছানার নিচে বড় হয়ে যাওয়ার প্রার্থনা করতে করতে অতিরিক্ত ভয় আর ট্রমায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ছোট্ট প্রিয়তা। পৃথিবীর অন্ধকার হয়ে উঠল আরও জঘন্য, নির্মম।
সেদিনের আকাশ ছিল গুমোট মেঘলা, বাইরের টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ। সকাল হলেও চারদিক থমথমে অন্ধকারাচ্ছন্ন। অন্ধকারাচ্ছন্ন মিতার রুমটাও। বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে ঠান্ডা ফ্লোরে বসে আছে মিতা। লাশ শাড়িটা পরে আছে কয়েকহাত দূরে। পড়নের ব্লাউজটা ছেড়া, বোতামগুলো এইমুহূর্তে অর্ধেক লাগানো। তাও এলোমেলোভাবে। কোমর ছাড়ানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। চোখের জল শুকিয়ে দাগ পড়ে গেছে গাল আর কার্নিশজুড়ে। চোখজোড়া কেমন স্তব্ধ, তাকিয়ে আছে শূন্যে। খানিক বাদে বাদে কেঁপে উঠছে র*ক্ত জমাট বাঁধা নিচের ঠোঁটটা। জনমদুখী জীবনের সবচেয়ে নির্মম, জঘন্য, অপমানজনক রাত কাটিয়েছে সে কাল। কাশেম নামক ঐ নিকৃষ্ট পুরুষের নোংরা স্পর্শ ওর সারা শরীরজুড়ে। এই স্পর্শ শুধু ওর শরীর নয়, ওর আত্মাসহ কুলষিত করে দিয়েছে। কাশেমের একেকটা নির্মম স্পর্শ ওর থেকে ওর সম্ভ্রমের সঙ্গে জীবনটাও হনন করে নিয়েছে। নিষ্ঠুরতার শেষ সেখানেই হয়নি। শেষবার নিজের খায়েশ মেটানোর পর চলে যাওয়ার আগে মিতার মুখে থুথু মারে কাশেম। থুতনি চেপে ধরে বলে, 'আজ রাতের কথা কেউ জানলেও আমার কিচ্ছু ছিড়তে পারবেনা। সেটা তুমি ভালো করেই জানো। কিন্তু তুমি সমাজে মুখ দেখাতে পারবেনা। তাই একদম চুপ থাকবে। তারপরও আজরাতে যা হয়েছে তা যদি ভুল করেও কেউ টের পায়, তুলে নিয়ে আমার ছেলেদের হাতে ছেড়ে দেব। মুখে চুনকালি লেপে এলাকা ছাড়া করবে সবাই তোমাকে। আর হ্যাঁ, তোমার বোনও সবটাই জানে। বাড়ির চাবি ঔই দিয়েছে আমাকে। তাই কারো সাহায্য পাওয়ার কথা চিন্তাও করোনা।'
শারিরীকভাবে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া মিতার মনটাও সেমুহূর্তে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। লজ্জা, ঘেন্না, অপমানে সেইমুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছা করে। শেষে কি-না ওর নিজের বোন এর এতোবড় সর্বনাশ করল! করতে পারল! কিছুক্ষণ ওভাবেই শুয়ে, নির্জীব বস্তুর মতো পরে থাকে বিছানায়। অনেকক্ষণ তীব্র ব্যথা আর যন্ত্রণায় অবশ হওয়া শরীরটা টেনে নিয়ে ফ্লোরে বসে। চারপাশ ভীষণ অন্ধকার, অর্থহীন লাগে। এই জীবন, এই মুখ, এই শরীর নিয়ে আর কোনদিন কারো সামনে দাঁড়াতে পারবেনা ও। যে প্রিয়র কথা ভেবে ভেবে জীবনের এতোবড় নির্মম ত্যাগ করতে হল, সে মুহূর্তে ভুলেই যায় সেই ছোট প্রিয় একাকি পরে আছে অন্ধকার বিছানার তলে।
প্রিয়তার যখন জ্ঞান ফিরল তখন সবকিছু ভয়ংকর নীরব, স্তব্ধ। ছোট্ট মেয়েটা পিটপিট করে চোখ খুলে আবিষ্কার করল, বিছানার নিচের অন্ধকারে পরে আছে সে। শক্তি নেই শরীরে, ভীষণ খারাপ লাগছে। ক্ষণিকের জন্যে সে ভুলে গেল সেই রাক্ষসের কথা। হঠাৎ অন্ধকারে নিজেকে আবিষ্কার করে প্রচণ্ড ভয়ে দম আটকে আসল ওর। প্যানিক করে ওঠল। অস্থির হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসল বিছানার নিচ থেকে। অস্থির, হতভম্ব চোখে মিতাকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কলিজায় পানি আসল ওর। কিন্তু মিতার এমন অবস্থা এমন কেন? ওর মনে পড়ল রাতে সেই রাক্ষসটা এসেছিল। রাক্ষসটা কী খুব মেরেছে ওর মাকে? প্রিয়তা হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যায় সেদিকে। মিতার গা বেয়ে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে। শরীরে তখনও ভীষণ জ্বর প্রিয়তার, গলা শুকিয়ে আছে, ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। প্রিয়তা মিতার কাঁধে মুখ গুঁজে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, 'ভয় করছে মিতা মা।'
গলা এখনো বসে আছে প্রিয়তার। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু মিতা নির্বিকার, জড়বস্তুর মতো বসে রইল সেভাবে। অবোধ প্রিয়তা বুঝলনা কী ঘটে গেছে। মিতার দুগাল ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল, 'মিতা মা ভয় করছে আমার। কথা বলো।'
মিতার দৃষ্টি শূণ্য। বরাবরের মতো মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ও বলল না, "ভয় কীসের। মিতা মা আছেতো।" মিতার চোখে কেবল গতরাতের বিভৎস স্মৃতি ভেসে উঠছে। সেই নোংরা মুহুর্ত। কাশেমের বলা সেই শেষ কথা। আড়চোখে একবার নিজের শরীরের দিকে তাকাল ও। বশির! ঐ মানুষটার সামনে কীকরে দাঁড়াবে ও? কোনমুখে দাঁড়াবে। বশির কোনদিন আর গ্রহন করতে পারবে ওকে? যদি পারেও, ও কোনদিন পারবেনা বশিরের মুখোমুখি হতে। এই মুখ বশিরকে দেখানোর আগে মরে যাওয়া শ্রেয়। এতোবড় লজ্জা নিয়ে ও বেঁচে থাকতে পারবেনা। নিজের শরীর এখন ঠিক কতটা অপবিত্র তা অনুভব হতেই থরথর করে কেঁপে ওঠে মিতা। অধিক শোকে মস্তিষ্ক তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। ধাক্কা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল প্রিয়তাকে। চিৎকার করে বলল, 'বেরিয়ে যা এই রুম থেকে। এক্ষুনি বেরিয়ে যা।'
প্রিয়তা হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে আবারও হামাগুড়ি দিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল মিতাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, 'আমি তোমাকে ছেড়ে যাবনা। আমার ভয় লাগে।'
মিতা ফের ধাক্কা দিয়ে বলল, ' ছাড়! ছুঁস না আমায়। একদম ছুঁসনা!'
কিন্তু নাছোড়বান্দা প্রিয়তা আবারও চেপে ধরল মিতাকে। কাঁদকে কাঁদতে বলল, ' না না না। আমার ভয় লাগে। ছাড়বনা।'
মিতাকে কেমন বিকারগ্রস্ত লাগল। জগতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক যেন শেষ হয়ে গেছে ওর। প্রিয়তাকে সরিয়ে ব্যথায় জমে আসা শরীরটা নিয়ে কোনমতে দাঁড়াল। প্রিয়তার বাহু ধরে ওকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল দরজার দিকে। চিৎকার করে বলল, 'চলে যা এখান থেকে। দূরে যা আমার থেকে দূরে।'
প্রিয়তাকে দরজার বাইরে ছুড়ে দিল মিতা। কিন্তু প্রিয়তা যোকের মতো লেপ্টে রইল মিতার সঙ্গে। মিতার পা আকড়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। কান্নার দমকে কেঁপে ওঠা ভাঙা গলায় বলল, ' না না যেতে দেবনা। আমার একা ভয় লাগে আমায় ছেড়ে যেওনা।'
এপর্যায়ে ডুকরে কেঁদে উঠল মিতা। কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে নিষ্পাপ মেয়েটার কান্না দেখে। আপন মনেই ক্ষমা চাইল শিশুটির কাছে। ভাঙা অসহায় গলায় বলল, 'ক্ষমা করে দিস আমায় মা। তোকে আগলে রাখার দায়িত্বটুকু মাঝপথে ছেড়েই পালিয়ে যাচ্ছি।'
বাক্যটা শেষ করামাত্র প্রিয়তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল মিতা। মেয়েটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠাস করে বন্ধ করে দিল দরজাটা। ভয়ে কেঁপে উঠল প্রিয়তা। একাকিত্বের ভয়! মিতা ছাড়াযে এখানে আর কেউ নেই। যদি আবার রাক্ষস আসে? মিতা না থাকলে ওকে কে বাঁচাবে? ওর কী হবে? প্রিয়তা আরও জোরে চিৎকার করে কাঁদল। জোরে জোরে ধাক্কাল দরজাটা। জ্বরে বসে যাওয়া গলাটা চিৎকার করে কাঁদায় আরও বসে গেছে। আওয়াজ বের হতে চাইছেনা। তবুও সেই চিকন, অস্ফুট আওয়াজেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকল প্রিয়তা, ' মিতা মা, ভয় করছে আমার মিতা মা। দরজা খোল মিতা মা। আমার ভয় করছে। কোথায় যাবে তুমি? যেওনা।'
মিতা খুলল না দরজা। প্রিয়তা কাঁদতে কাঁদতে আরও জোরে ধাক্কালো দরজা। চেঁচাল, 'খোলনা মা। দরজা খোল।'
সেই হৃদয়বিদারক আর্তনাদ যেন কানে আসছেনা মিতার। খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে বশিরের দেওয়া সেই শাড়িটা ফ্লোর থেকে তুলে নিল ও। ওদের জীবন, সম্পর্কের সঙ্গে এই শাড়িটাকেও নিজের স্পর্শে অপবিত্র করে দিয়েছে ঐ জানোয়ার। মিতা জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে একটা চেয়ার নিয়ে রাখল বিছানার ওপর। শরীরটা চলতে চাইছেনা। পা দুটো ভীষণ ভাড়ি ঠেকছে। দাঁড়িয়ে থাকতে দম আটকে আসছে। সেই ব্যথা আর যন্ত্রণা আরও নিষ্ঠুরভাবে মনে করিয়ে রাখল ওর সঙ্গে ঘটা এই অঘটনকে। চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে শাড়িটা শক্ত করে বাঁধল মিতা। তৈরী করল মারণফাঁস। সেই ফাঁস গলায় পড়ার আগে পঁচিশ বছরের ছোট্ট জীবনটা চোখের সামনে ভেসে উঠল মিতার। শানকে শেষবার দেখতে মন চাইল। বাইরে প্রিয়তা এখনো কাঁদছে। মেয়েটার সত্যিই আর কেউ রইল না। যন্ত্রণায় বুক ফেঁটে এল মিতার। মন চিৎকার করে অভিযোগ করল, 'কেন এমন করলে আপা? আমিতো তোমার কোন ক্ষতি করিনি। তাহলে আমার এতোবড় ক্ষতি কেন করলে? কেন বাঁচতে দিলেনা আমায়? আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসতাম আপা। কিন্তু আজ অভিশাপ দিচ্ছি, এর শাস্তি তুমি পাবে। খুব জঘন্যভাবে পাবে। পাবেই।'
শুধু সুমনা নয়, সৃষ্টিকর্তার প্রতিও ভীষণ অভিমান হল মিতার। এতোবড় অবিচার ওর সঙ্গেই কেন হল? এতো নিষ্ঠুর বিচার খোদা করতে পারলেন? সবকিছু কেমন গুলিয়ে এলো মিতার। ওর মনে হল ওর সামন দাঁড়িয়ে আছে বশির। ওকে ছুঁতে চাইছে। কিছু বলতে চাইছে। চোখমুখে বশিরের তীব্র আতঙ্ক। অথচ কোনভাবেই পৌঁছতে পারছেনা মিতার কাছে।গাল বেয়ে অশ্রু নামল মিতার। ফাঁসটা গলায় পড়ে বলল, 'তোমার সঙ্গে আমার আর সংসার করা হলোনা বশির। ওরা করতে দিলোনা। তোমার বউ হওয়ার স্বপ্ন আর কোনদিন পূরণ হবেনা। আমাদের আর কোনদিন দেখা হবেনা। কী করব বলো? তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর যোগ্যতা আমার আর নেই। আমায় ক্ষমা করো।'
কথাটা বলে চোখ বুঝল মিতা। চোখ থেকে দু ফোঁটা শেষ অশ্রু গড়িয়ে নামল। ডান পায়ের সমস্ত ভর ঠেলে দিল চেয়ারের মাথায়।
•••••
সুমনা ফিরে এলো তারও একঘন্টা পর। মনে মনে প্রস্তুত হয়েই এসেছিল সুমনা। জানে এসে কী দৃশ্য দেখবে। কিন্তু এসে দেখল মিতার ঘরের সামনে ফ্লোরে বসে কাঁদছে প্রিয়তা। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছেনা মেয়েটার। শুধু হিঁচকি দিচ্ছে, লালা গড়িয়ে পড়ছে মুখ দিয়ে। কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে গেছে হলদে ফর্সা চোখমুখ। থমকে দাঁড়াল সুমনা। একি! দরজা বন্ধ কেন? কাশেমতো চলে গেছে। তবে? দরজা আটকে কী করছে মিতা, সুমনা দ্রুত এগিয়ে এলো সেদিকে। নিজের মাকে দেখে শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠল প্রিয়তা। দুহাতে জড়িয়ে ধরে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। প্রিয়তাকে একহাতে জড়িয়ে সুমনা ভীত গলায় বলল, 'কাঁদছো কেন? মিতা কোথায়?'
প্রিয়তা ফোঁপাতে ফোঁপাতে হাত তুলে দেখাল বন্ধ দরজার দিকে। সুমনা চোখ বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। হঠাৎ চেনা এক আশঙ্কা বাঁধল মনে। দ্রুত ব্যাগ হাতরে চাবি বের করল সুমনা। ঘেমে উঠেছে ও। চাবি দিতে গিয়ে হাত ফসকে গেল দু'বার। দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে সঙ্গে সঙ্গে সুমনা থমকে দাঁড়াল। শরীর জমে গেল ওর। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখল, সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে মিতার নিথর শরীরটা। ঘাড় বেঁকে আছে একদিকে, চোখদুটো বিস্ফোরিত অবস্থায় খোলা। ঘন আঠালো র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে মুখের এককোণে দিয়ে।
সুমনার পেছনে প্রিয়তাও ছুটে এলো। উদ্দেশ্য মিতাকে এসে দৌড়ে জাপটে ধরবে। কোথাও যেতে দেবেনা। কিন্তু ছোট ছোট পা দুটো দমকে থমকে গেল। স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মিতার দিকে। মিতার অমন বিভৎস চেহারা দেখামাত্র চোখ উল্টে এলো প্রিয়তার। আছড়ে পড়ল ফ্লোরে।
সেই শব্দে ঘোর কাটল সুমনার। হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল ঐটুকু মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। সুমনা জোরে শ্বাস নিতে নিতে আবার দেখল মিতাকে। এটা কী হল! মিতা একি করল! মরে গেল! কিন্তু সুমনাতো চায়নি সেটা। ওতো শুধু নিজের স্বার্থ পূরণ আর অনেকাংশে মিতার প্রতি হিংসে থেকেই কাজটা করে ফেলেছে। তাই বলে মরে যেতে হবে? কিবা এমন হয়েছিল? কেউতো জানতোওনা যদি মিতা মুখ না খুলতো। এটা করার কী দরকার ছিল? বুকের ভেতরটা ভার হয়ে উঠল সুমনার। ছোটবেলা থেকে হেসেখেলে একসঙ্গে বড় হয়েছে। সে মেয়েটা আর নেই! ওর জন্যেই নেই!
হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করল সুমনা। ব্লান্ডার হয়ে গেছে। এখন শুধু কাশেম না, ও নিজেও ফেঁসে যাবে। জেল! কথাটা চিন্তা করতেই গলা শুকিয়ে এলো সুমনার। ভুলেই গেল তার পায়ের কাছে তার নিজের গর্ভে, সাড়ে সাতমাস লালন করা মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। যার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ঐটুকু একটা মেয়ের মস্তিষ্কের জন্যে পরপর দু'বার এমন নির্মম শক পেয়ে অজ্ঞান হওয়াটা যে কত ভয়ংকর ক্ষতির, তা বোঝার মতো কেউ রইল না।
সুমনা কোনমতে প্রিয়তাকে কোলে তুলে নিয়ে গেল নিজের বেডরুমে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলো রুম থেকে। লক করে দিল দরজাটা। অতিরিক্ত ভয় আর উত্তেজনায় ভুলেই গেল ঘরটা ভীষণ অন্ধকার। লাইটটা জ্বালানো উচিত। নয়তো উঠে ভয় পাবে মেয়েটা।
সুমনা কোনমতে দৌড়ে এলো বাড়ির ল্যান্ডলাইন টেলিফোনের কাছে। ব্যাগে থাকা ছোট ডাইরিটা বের করে কাশেমদের বাড়ির ল্যান্ডলাইনে নাম্বার খুঁজে ডায়াল করল। প্রথমে ধরল বাড়ির এক কার্মচারি। তাকে বলে, কাশেমকে ডেকে আনা হল। নিজের এতোদিনের সাধনা পূরণ করে, ভোরবেলা বাড়ি ফিরেছে কাশেম। ছাড়া গায়ে ঘুম দিচ্ছিল আরামে। হঠাৎ ঘুম ভাঙানোয় ভীষণ রেগে গেছে সে। রিসিভার কানে তুলে বিরক্তি নিয়ে বলল, 'হ্যালো।'
সুমনা জোরে শ্বাস নিতে নিতে জানাল, ' মি-মিতা সু-সু*ইসাইড করেছে!'
থমকে গেল কাশেম। চোখের ঘুম উড়ে গেল। থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণের জন্যে। শেষমেশ সু*ইসাইড করে ফেলল! একি নতুন ঝামেলা! এরজন্যে মরে যাওয়ার কী আছে! মেজাজ ভীষণ খারাপ হল কাশেমের। এদিকে সুমনা প্যানিক করে গেছে, ভয়ে রীতিমতো কেঁদে ফেলেছে ও। তা টের পেয়ে মেজাজ আরও চড়ল ওর। ধমক দিয়ে বলল, 'চুপ করো। ফ্যাঁচফ্যাঁচ করোনাতো! ভাবতে দাও।'
মুখে হাত দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ভাবল কাশেম। ধূর্ত মস্তিষ্ক এধরণের অপরাধ লুকোতে পারিবারিকভাবেই ভীষণ দক্ষ। তাই উপায় পেতে বেশিক্ষণ লাগল না। মুহুর্তের মধ্যেই সাজিয়ে ফেলল আরও একটা নির্মম ছক। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ' তোমার মেয়ে কোথায়? দেখেনিতো কোনভাবে?'
সুমনা ভ্রুকুটি করে বলল, 'কাল রাতেতো ও বাড়িতেই ছিল। তুমি দেখোনি?'
শরীর শিরশির করে উঠল কাশেমের। প্রিয়তা ছিল কাল ওখানে? দেখেছে নাকি সবটা? কতটা দেখেছে? আগে যদি টের পেতো তাহলেতো মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করতো। এখন কী হবে? কাশেম আরও রেগে গিয়ে বলল, ' সেটা তুমি আগে বলবেনা আমাকে! যাই হোক, কোথায় ও?'
' সুমনাকে ওভাবে দেখে জ্ঞান হারিয়েছে। রুমে শুইয়ে রেখে এসছি।'
খানিকটা স্বস্তি পেল কাশেম। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, 'গুড! শোন, কী করতে হবে আমি ভেবে রেখেছি। বাসা থেকে বেরিয়ে যাও এক্ষুনি। এরপর যা যা বলছি তাই তাই করবে। বাকিসব আমি সামলে নেব। তুমি শুধু খেয়াল রাখবে তোমার মেয়ে যেন কারো সামনে কিছু বলতে না পারে। গট ইট?'
সুমনা কেমন অদ্ভুত একটা ঘোরে আছে। কী হচ্ছে, কী করছে কিছু বুঝতে পারছেনা। কাশেম আবার বলল, ' তাড়াতাড়ি বের হও। আরেকটা কথা, বশিরের বন্ধু কিংবা পরিচিত কাউকে চেনো?'
চমকে উঠল সুমনা। কাশেমের পরিকল্পনা বোধ হয় ধরতে পেরেছে ও।
•••••
বশির আজ নতুন একটা সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। গায়ে মিষ্টি সুগন্ধি লাগিয়ে তৈরী করেছে নিজেকে। এতোগুলো বছর যাবত দেখে আসা স্বপ্ন পূরণ হবে তার। ওর জীবনের জোছনা, ওর মিতা ওর বউ হবে। ওদের একটা ছোট্ট সংসার হবে। সেই সংসারে মিতাকে আদর সোহাগে ভরিয়ে রাখবে ও। রাণীও থাকবে ওদের সঙ্গে। বাচ্চাটা ভীষণ মিষ্টি। আশেপাশে থাকলেই মন ফুরফুরে হয়ে যায়। তাছাড়া ওদেরওতো বাচ্চা হবে। কী সুন্দর ঝলমলে এক সংসার হবে। কল্পণা করতেই ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল বশিরের। মনটা শান্তিতে ভরে গেল।
ক্যাম্পাসের সামনে বসে অপেক্ষা করতে করতেই স্বপ্নের সেই দুনিয়া সাজাচ্ছিল বশির। কিন্তু মিতা আসছেনা কেন এখনো? আজকের দিনেও কেউ এভাবে অপেক্ষা করায়? গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে তখনও। তাই বোধহয় দেরী হচ্ছে। কথাটা চিন্তা করেই আরও একবার সময় দেখল বশির। হঠাৎ এক সহপাঠী দৌড়ে এলো বশিরের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে জানাল, ' ঐ শুনছিস? মিতা নাকি গলায় ফাঁস দিয়ে মারা গেছে!'
খবরটা বজ্রপাতের মতো বাজে বশিরের কানে। দুনিয়া থমকে যায়। চারপাশ অন্ধকার লাগে। আগেপিছে না তাকিয়ে ছুটে লাগায় মির্জা বাড়ির উদ্দেশ্যে। এই খবর মিথ্যা, এমনটা হতেই পারেনা। আজতো ওদের বিয়ে। ও গিয়ে দেখবে মিতা একদম ঠিক আছে। বউ সেজে তৈরী হচ্ছে ওর জন্যে। সারারাস্তা উন্মাদের মতো দৌড়াল বশির।
মির্জা বাড়িতে ঢোকার সময় কোন বাঁধা পেলোনা বশির। ঐ মুহূর্তে সে নিয়ে চিন্তা করার মতো মানসিক অবস্থাও ছিলোনা ওর। বাড়ি নীরব দেখে বশির শরীর হালকা হয়ে এলো। ভুয়া খবর ছিল তবে! মিতার কিছু হলে ঘর কখনই এতো নীরব থাকতোনা। এমন মজা কেন করা হল ওর সাথে?
মিতার ঘরটা কোনদিকে বশির জানতো। কথায় কথায় বহুবার বলেছিল মিতা। তাও চোখে না দেখায় গুলিয়ে ফেলতো। কিন্তু খোলা দরজা পেয়ে সেখানেই ঢুকল ও। মিতা আর প্রিয়তা নিশ্চয়ই সেখানেই আছে। তৈরী হচ্ছে।
ভেতরে ঢোকামাত্র নিঃশ্বাস থমকে গেল বশিরের। মুহূর্তের জন্য মনে হলো বুকের ভেতরে কেউ যেন পাথর দিয়ে তীব্র আঘাত করেছে। সামনের সিলিং ফ্যানে ঝুলে আছে তার সমস্ত পৃথিবী। যে মেয়েটার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেও এক সুন্দর সংসারের ভবিষ্যৎ দেখেছিল। যে হাসির জন্য তার সব লড়াই জিতে যাওয়ার সাহস জাগত। সে এমন বিভৎসভাবে ঝুলে আছে!
চিৎকারগুলো সব গলাতে আটকে গেল। ঠোঁট শুকিয়ে গেল তপ্ত মরুভূমির মতো। ধীরে ধীরে কাঁপতে থাকা হাতে এগিয়ে গেল বশির। প্রতিটি পা যেন মাটিতে নয়, তার নিজের আত্মায় পড়ছে। হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরল মিতার ঠান্ডা পায়ের আঙুলগুলো।
হঠাৎই শরীর ঝংকার দিয়ে উঠল ওর। আকড়ে ধরল মিতার ঝুলন্ত শরীর। চিৎকার করে ঊঠল, 'না, না, না, এটা হতে পারে না। মিতা! মিতা! এটা কী করলে মিতা! এমন করতে পারোনা তুমি আমার সাথে।'
বশির অস্থির হয়ে শাড়িটা খুলে ফেলল সিলিং ফ্যান থেকে। মিতাকে নিথর শরীরটা নিয়ে বসল বিছানার ওপর। শ্বাস নিতে পারছেনা বশির। কেমন ঝিম ধরে আসে চারপাশটা। মিতার শরীরের একেকটা দাগ আর পোশাকের অবস্থা দেখামাত্র বশির বুঝে ফেলল কী ঘটেছে। শাড়িটাওতো ওরই দেওয়া! মিতা পড়েছিল! দ্রুত সেই শাড়ি দিয়ে মিতার শরীরটা ঢেকে ফেলল বশির। হাত দিয়ে বন্ধ করে দিল খোলা চোখজোড়া। নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে ফেলল বশির। কণ্ঠ ভেঙে এলো ওর। গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো ছিন্নভিন্ন এক আর্তনাদ, 'মিতাআআআ!'
দেয়ালগুলোও যেন কেঁদে উঠল বশিরের চিৎকারে, 'কেন এমন করলে মিতা? আমিতো ছিলাম তোমার সঙ্গে। কেন একটু বিশ্বাস করতে পারলেনা আমাকে? তোমাকে যেকোন অবস্থায় গ্রহন করতে পারতাম আমি। কেন তা বুঝলেনা?'
তৎক্ষণাৎ হুরমুর করে ভেতরে ঢুকল সুমনা। পেছন পেছন আরও অনেক মানুষ। এরা সবাই এই এলাকারই বাসিন্দা। বশির তাকাল সেদিকে। ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুমনা ওর দিকে আঙুল তুলে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, 'এইযে! এই ছেলেটা! এই ছেলেটা! আমার বোনকে ধ*র্ষ*ণ করে খু*ন করেছে! আমি এসে দেখি আমার বোনকে ও...'
বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সুমনা। বশির হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। সদ্য প্রিয়তমাকে হারিয়ে এমনিতেই ভেঙে গেছে সে। এরা এসব কী বলছে! এরমধ্যেই তিনচারজন লোক তেড়ে এলো বশিরের দিকে। বশিরকে টেনে সরিয়ে আনতে চাইল। কিন্তু বশির শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরল মিতাকে। চিৎকার করে বলল, 'যাবনা আমি কোথাও। ছাড়ো আমাকে। আজ বিয়ে আমাদের। মিতা ওঠো! ওঠোনা! বিয়ে করবেনা? সংসার করবেনা আমার সাথে? মিতা দেখো আমি তোমার জন্যে বর সেজে এসেছি। তাকাও, দেখো! দেখোনা!'
বশিরের কথা কারোও কানে গেলোনা। উত্তেজিত জনতা আরও কয়েকজন তেড়ে এলো। সবাই মিলে টেনে হিঁচড়ে বশিরকে সরিয়ে আনতে চাইল মিতার কাছ থেকে। বশিরের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ও একইকথা পাগলের মতো আওড়ে যাচ্ছে। ওর আর মিতার আজ বিয়ে। মিতা উঠবে। ওকে বিয়ে করবে। ওদের সংসার হবে। টেনে হিঁচড়ে মিতার কাছ থেকে সরানো সলো বশিরকে।
মির্জাদের এলাকায় বেশ নামডাক। সেই বাড়ির মেয়েকে কি-না ধ*র্ষ*ণ করে খু*ন করেছে! লোকজন টেনে-হিঁচড়ে বশিরকে বাড়ির সামনের রাস্তায় এনে ফেলল। টানা হিঁচড়েতে ছিড়ে গেছে বশিরের পাঞ্জাবিটা। কাঁদায় পড়ে নোংরাও হয়ে গেল সেটা। ঐ মুহূর্তে এলাকার লোকজন, বিশেষকরে পুরুষসমাজ আক্রোশে অস্থির হয়ে উঠল। সবাই হয়ে উঠল ন্যায়বিচারের ঠিকাদার। সবাই এগিয়ে এসে গনপিটুনি দিতে শুরু করল বশিরকে। কলার ধরে টেনে তুলে মুখে, চোখে, বুকে, পেটে সব জায়গায় সজোরে ঘুষি বসাল যে যার মতো। মারের দমকে পুনরায় মাটিতে পড়ল বশির। মুখ দিয়ে র*ক্ত বেরিয়ে এলো। কয়েকজন তার ওপরেই এলোপাথাড়ি লাথি শুরু করল। রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের টুকরো ছুড়ে ছুড়ে আরও বেশি র*ক্তাক্ত করে দিল। সোজা মাথায় এসে লাগল দুটো ইট। যন্ত্রণায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো বশিরের। নিঃশ্বাস আটকে এলো। ও চিৎকার করে বলতে চাইল একাজ ও করেনি। ও মিতাকে ভালোবাসতো। তাকে অপবিত্র করার কথা, খুন করার কথা ও ভাবতেও পারেনা। কিন্তু পারলনা বলতে। কেউ শুনলোনা।
এতো মেরেও মন ভরল না অনেকের। কেউ কেউ লাথি নিয়ে এলো। লাথির আঘাতে উত্তাল জনগণ ছেলেটাকে প্রায় মিশিয়ে ফেলল মাটির সঙ্গে। আর কয়েকটা আঘাত এসে লাগল মাথাতেই। কিছু বলার, বোঝার, করার বিন্দুমাত্র অবকাশ পেলোনা বশির। অসহ্য ব্যথায় শরীর ছেড়ে দিল ওর। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল চোখজোড়া। কর্দমাক্ত মাটিতে, র*ক্তা*ক্ত বশিরের নিথর শরীরটা সমাজের ন্যায়বিচারের জ্বলজ্বলে নজির রেখে দিল।
প্রতিদিন চোখের সামনে এতো এতো অন্যায়-অবিচার ঘটে। সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চোখের সামনে কত নিকৃষ্ট কাজ করে বুক ফুলিয়ে চলে যায়। মানুষ কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে তা। অথচ একটা সাধারণ ছেলে, যার কোন ক্ষমতা নেই। যার অন্যায়টুকু কেউ চোখে দেখে অবধি নি। তাকে শাস্তি দেওয়ার বেলায় সবাই কত সাহসী! সবাই তখন সমাজের বীর লিঞ্চারস!
এরমধ্যেই পুলিশ আসে ঘটনাস্থলে। বশিরের নিথর শরীরটা তুলে নিয়ে যায় তারা। সেইসঙ্গে মিতার লাশটাও। তারা জানে তাদের করণীয়। ইতিমধ্যে এমপি কাদের হক এবং তার পুত্র কাশেম হক কথা বলেছে তাদের সঙ্গে।
•••••
দ্বিতীয়বার জ্ঞান ফেরার পরেও নিজেকে অন্ধকারে আবিষ্কার করে প্রিয়তা। মারাত্মক ভয় পেয়ে সজোরে চিৎকার করতে যায় ও। কিন্তু পারেনা। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছেনা। হা করে জোরে জোরে শ্বাস নেয় প্রিয়তা। মিতার বিভৎসভাবে ঝুলে থাকার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই শিউরে ওঠে ও। কিন্তু প্রচন্ড ভয়ে বিছানা থেকে নামার সাহস অবধি করতে পারলনা। পেছাতে পেছাতে দেয়াল ঘেঁষে বসে গুটিয়ে বসল। ভয়ে, অন্ধকারে দম আটকে আসল বাচ্চাটার। মনে হল এক্ষুনি ঐ রাক্ষসটা এসে ওকে খাবলে ধরবে, খেয়ে ফেলবে। প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ আছে। একটু পানি দরকার। প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে মিতাকে ডাকতে চাইল ও। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলল। কিন্তু মিতা এলোনা। এসে নিজের বুকের জড়িয়ে ধরে ওকে অভয় দিলোনা। একটাবারও ওকে খাইয়ে দিলোনা। একপর্যায়ে নাক দিয়ে র*ক্ত বেরিয়ে এলো মেয়েটার।
তার কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। প্রিয়তার মনে হল মিতা এসেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু লাইট জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে চোখ ধাধিয়ে গেল আলোতে। সুমনা এসেছে! প্রিয়তার নাকে রক্ত দেখে চমকে উঠল সুমনা। এগিয়ে এসে কোল তুলে নিল। প্রিয়তা সুমনার গলা জড়িয়ে ধরে নেতিয়ে পড়ল। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর। সুমনা দেখল গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছেনা। সেইসঙ্গে নাক দিয়েও রক্ত এসেছে। এইমুহূর্তে হাসপাতালে নিতে হবে। এমন করুণ দৃশ্য দেখেও সবার আগে নিজের স্বার্থটাই চোখে পড়ল সুমনার। প্রিয়তার অসুস্থ হয়ে যাওয়াটা তারজন্যে নিরাপদ। সে সবাইকে বলেছে প্রিয়তা ওর সঙ্গে ছিল। ফিরে এসে মিতাকে ঐ অবস্থায় দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ব্যপারটা প্রমাণ করতে আর কোন ঝামেলাই হবেনা আর। ওকে কোলে তুলেই সুমনা বেরিয়ে গেল হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
•••••
শওকতকে খবরটা দেওয়া হয় টেলিফোনে। সংবাদ পেয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে শওকত। মিতার চেহারাটা চোখের সামনে ভাসে একবার। বশির এমন করল! ছেলেটাকেতো ভালো বলেই জানতো সে। তারপরই মনে পড়ে গেল সুমনার কথা। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ভাবল, সুমনাকেওতো ভালো দেখেই ভালোবেসেছিল শওকত। ভালোইতো ছিল সুমনা। কিন্তু মানুষের মন, বদলাতে কতক্ষণ। ও নিজেই কী ভালো আছে আর? চরিত্র ছাড়া বাকিসবইতো পাপে পরিপূর্ণ করে ফেলেছে এতোদিনে।
খবর পাওয়ার পর সোজা শানের স্কুলে যায় শওকত। শানকে নিয়েই চট্টগ্রাম ফিরে আসে। মিতাতো শানের একপ্রকারের মা-ই ছিল।
মিতাকে যখন দাফন করা হল, প্রিয়তা তখন হাসপাতালের বিছানায় পরে আছে। আর বশির তখন পুলিশ কাস্টাডিতে। অমন গণপিটুনির পরেও আরও মারা হচ্ছে তাকে। স্বীকারোক্তির নাম করে। বশির কেবল বারবার সেই এককথাই আওড়ে গেছে। যা কে শোনার প্রয়োজনও মনে করেনি।
শওকতকে আর পলাশকে বলা হয়েছে প্রিয়তা মিতার অমন দশা মেনে নিতে পারেনি। সেকারণেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ডাক্তার বলেছে, মস্তিষ্কে চাপ পড়েছে ভীষণভাবে। সেইসঙ্গে কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়েছে সাময়িকভাবে। মিতার মৃত্যুটা শানের জন্যে কম ধাক্কার ছিলোনা। সেইসঙ্গে বোনের এমন অবস্থা! মিতাকে দাফনের পর থেকে প্রিয়তার সঙ্গেই আঠার মতো লেপ্টে ছিল শান। প্রিয়তা কান্নাকাটি করতো, মিতার কাছে যাওয়ার বায়না ধরতো। কিন্তু মিতার কাছে যাওয়ারতো কোন উপায় নেই। একটাই উপায় আছে শুধু, মৃত্যু।
•••••
মেডিকেল রিপোর্টসহ, সাক্ষী এবং বাকি সমস্ত প্রমাণ প্রস্তুত হল বশিরের বিপক্ষে। তবে পুলিশি তদন্ত একটু খুটিয়ে হলে অতি সহজেই প্রমাণ হয়ে যেতো বশির নির্দোষ। কিন্তু পুলিশসহ, গোটা ব্যবস্থাটাই রাজনৈতিক দলের পকেটে ছিল। কাশেম নিজ দায়িত্বে, সরাসরি হস্তক্ষেপে নিজের সুবিধামতো সব প্রমাণ তৈরী করল। কাস্টাডিতে বশিরকে সবরকমের অত্যাচার করে চেষ্টা করা হয়েছিল, দোষ ঘাড়ে তুলে নেওয়ার জন্যে। কিন্তু বশির কেবল মিতার জন্যে বিলাপ করে গেছে। অত্যাচারের একপর্যায়ে হঠাৎই ভীষণ চুপ হয়ে যায় সে। একদম নির্জীব কোন বস্তুর মতো।
এদিকে প্রিয়তার জীবনটা যেন থমকে ছিল। কথা বলতে না পারা। মিতার অনুপস্থিতি। সারাদিন দৌড়দৌড়ি করে বাড়ি মাথায় তোলা মেয়েটা একদম শান্ত হয়ে বসে থাকতো বিছানার এক কোণে। হাত-পা গুটিয়ে রাখতো। কেঁপে উঠতো অকারণেই। খেতে চাইতোনা কোনভাবেই। ঐটুকু মেয়েটার অমন দশা দেখে মাঝেমাঝে পিতৃভাব জেগে উঠতো শওকতের মধ্য। নিজ হাতে খাইয়ে দিতো। কিন্তু খানিকবাদে তা মিলিয়েও যেতো। সুমনার কাছে গোটা ব্যপারটা তখনও একটা ঘোর। কী থেকে কী হল, কী করল নিজেও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছিলনা।
•••••
আদালতে দোষী প্রমাণিত হয় বশির। তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। গোটা সময় একটা টু শব্দ অবধি করেনা ছেলেটা। দাঁড়িয়ে থাকে মূর্তির মতো। বিশাল খবর ছড়িয়ে পরে, "বিবাহের জন্যে রাজি না হওয়ায়, ফাঁকা বাড়িতে প্রেমিকাকে ধ*র্ষ*ণ করে খু*ন করল প্রেমিক।" দেশজুড়ে ঘৃণ্য এক ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিতি পেল বশির।স্বাভাবিকভাবেই জনগণের বিদ্বেষের পাত্রে পরিণত হল বশিরসহ ওর গোটা পরিবার। বশিরের বৃদ্ধা মায়ের পক্ষে সেই ধকল বেশিদিন নেওয়া সম্ভব হলোনা। জোয়ান ছেলের অমন পরিণতি, তারওপর সমাজে এমন লজ্জা! সবমিলিয়ে একদিন রাতে ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা গেলেন উনি। বাবাহীন বশিরের পরিবারটা মোটামুটি বড় হলেও মা-ই ছিল সবকিছু। মায়ের মৃত্যুর খবর গিয়ে পৌঁছলো জেলে। পুলিশের কড়া প্রটেকশনে বশিরকে 'লাস্ট ভিজিট' অনুমোদন দিয়ে সীমিত সময়ের জন্যে আনা হল। নিজের মাকে শেষ দেখার জন্যে। মায়ের মৃত্যু সংবাদেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিল না। নিষ্প্রাণ ছিল তার চলন।
এদিকে বশিরের আসার খবর শুনতে পায় প্রিয়তা। সুমনা পলাশের সঙ্গে আলোচনা করছিল এই নিয়ে। ও শানের কাছে আবদার করে বশিরের কাছে যাবে। এতোদিনে প্রথম ইশারায় হলেও নিজে থেকে কিছু বলেছে প্রিয়তা। চেয়েছে। শান সিদ্ধান্ত নেয়, দূর থেকেই একবার দেখিয়ে আনবে বশিরকে। বাড়িতে কাউকে না বলেই প্রিয়তাকে নিয়ে চলে যায় বশিরদের বাড়িতে।
বশিরের মায়ের লাশের সামনের শোকাবহ পরিবেশে ঘটে যায় আরেকটা শোকের ঘটনা। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বশির, হঠাৎই উন্মাদের মতো হাসতে শুরু করে। সকলে চমকে যায়। ভীতি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘক্ষণ হাসার পর আবার হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলে বশির। মাটি আকড়ে সেকি হৃদয়বিদারক কান্না। সকলে স্তব্ধ হয়ে যায়। কারো বুঝতে বাকি থাকেনা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে বশির। পাগল হয়ে গেছে।
ঐসময়ই প্রিয়তাকে নিয়ে ঐখানে পৌঁছেছিল শান। বশিরকে ওভাবে কাঁদতে দেখে শানের হাত ঝাড়া দিয়ে দৌড় দেয় প্রিয়তা। আগের মতো এক দৌড়ে লাফিয়ে উঠবে বশিরের কোলে। বশির হেসে জড়িয়ে ধরবে, আর কাঁদবেনা। কিন্তু বশিরের কাছে পৌঁছনোর আগেই ওকে দেখে চিৎকার করে ওঠে বশির। সেই চিৎকারে থমকে যায় প্রিয়তার ছোট্ট পা জোড়া। দাঁড়িয়ে যায় হতভম্ব চোখ নিয়ে। বশির হুংকার দিয়ে বলে, ' তোর জন্য! তোর জন্যে হয়েছে সব। তোর জন্যেই আমার মিতা আমার আমার কাছে আসতে চায়নি। তোর জন্যে। সবকিছুর জন্যে তুই দায়ী, তুই। তোর জন্যে আজ আমার কেউ নেই। মিতা নেই, মা নেই। তোরও থাকবেনা। অভিশাপ দিলাম, তোরও কেউ থাকবেনা। তুই যাকেই ভালোবাসবি সেই চলে যাবে তোকে ছেড়ে। তুই নিজে সরাবি তাকে। তুই নিজে সরাবি। অভিশাপ এটা! অভিশাপ।'
বশিরের বোধ রইল না নিজের বলা কথার। বোধ থাকলে পাঁচ বছরের একটা বাচ্চাকে অভিশাপ দেওয়ার পাপ বশির অন্তত করতোনা।
প্রিয়তা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বশিরও ওকে বকল! ভালোবাসেনা ওকে আর! কান্নার আগমনে ঠোঁট কেঁপেকেঁপে উঠল প্রিয়তা। ছোট শিশুটা জানলোনা, কিছুক্ষণ আগে কী ভয়ংকর অভিশাপ দেওয়া হয়েছে তাকে।
·
·
·
চলবে……………………………………………………