অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ০৮ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


রুশানের সাথে দেখা করে ভিনা আর ভার্সিটি গেলো না,যদিও একটা ক্লাস ছিলো।মন ভীষণ ভারি লাগছে।আজকে যেভাবে রুশানকে তুমি থেকে তুই তে নিয়ে আসা হয়েছে,অনেকটা এভাবেই কেউ আপনি থেকে তুমি তে এসেছিলো।হটাৎ করে বুক চেপে কান্না আসছে।যাবির যা করেছে,এরপর ওকে ক্ষমা করা যাবে না কখনো,চাইলেও না।কিন্তু ভিনা ভেতরে টের পায়,যাবিরকে এখনো ভালোবাসে ।এর মাঝে ওকে মনে করেনি ইচ্ছে করে,কিন্তু ভুলতেও পারেনি।রাস্তায় প্রায়ই যাবিরের সেই চেনা মুখ খুঁজে ভিনা।দুই বছরে মানুষের কি ভুলেও দেখা হয় না?একি শহরে থেকেও কীভাবে সম্ভব যাবিরকে একবারো দেখলো না?নাকি জেরিন ওকে নিয়ে চলে গেছে অন্য শহরে,অথবা অন্য দেশে?জেরিন কি জানে ভিনা যে যাবিরের সন্তানের মা?জেনে শুনেই কি বিয়ে করেছে ও?কত প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে এই মধ্য দুপুরে।জানে না এর উত্তর কবে পাবে,নাকি উত্তর না পাওয়াই শ্রেয়।যার জন্য এত প্রশ্নের উদ্ভব,সেই একদিন বলেছিলো,অজানার আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে,একে ইচ্ছেমত সাজিয়ে নেয়া যায়।এতকিছুর পর ও ভিনার ইচ্ছে হয় যাবির একবার আসুক,অনুতাপ নিয়ে আসুক।নিজের মেয়েকে একবার কোলে নেক।উপলব্ধি করুক,একজন তাকে কত ভালোবাসত।সত্যিকার অর্থে যাবিরকে ভুলে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না ভিনার পক্ষে।অন্তত মাহভিনকে নিয়ে এক ছাদের নিচে থেকে অবশ্যই না।মাহভিন যাবিরের একটা অংশ নিজের মাঝে বয়ে বেড়াচ্ছে,আর ভিনা সেটাকে ভালোবাসে।একজন প্রতারকের সন্তানের মা হয়ে,তাকে অনিচ্ছাকৃতভাবে ভালোবেসে,জীবনে কখনোই অন্য মানুষের হাত ধরা সম্ভব হবে না।মৃত হলেও ভালোবাসার যে অনুভূতি,সেটার অস্তিত্ব এখনো আছে,এটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।নাহলে রুশানের মত ছেলেকে এত সহজে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হতো না।ভিনা হটাৎ নিজেকে প্রশ্ন করলো,যাবির ওর জীবনে না আসলে রুশানের সাথে কী হত? কিছু হতে যে পারত,এটা কি অস্বীকার করা যায়?উহু....না,আর প্রশ্ন না,ভিনা নিজেকে থামিয়ে দিলো।

•••••••••••••••

-আমাকে তুই করে বলে ভিনা।এটা কী হলো ভাইয়া,এর চেয়ে তো আগেই ভালো ছিলো।প্রতিদিন এভাবে না দাঁড়ালে আজকে আমাকে অন্তত তুমি করে ডাকত।

-তুই এসব ছ্যাবলামি কোথায় শিখেছিস রুশান?তোকে কে বলেছিলো এসব করতে?

-ও না দেখলে আমাকে ভুলে যাবে,ইভেন প্রথম দেখাতেও ও আমাকে চিনে নাই।

-মেয়ের মেমোরি লসের সমস্যা আছে নাকি?

-না!ও এ্যকচুয়ালি আমাকে গোণায় ধরে না।

-বাহ্!তুমি মিয়া মেয়ের নাম ই মুখে নাও না,আর ও তোমারে তুই তুই বলে।তুই আবার এসব তামশার কথা আমাকে বলিস?

-আচ্ছা,বললাম না।

-মা তোর ব্যাপারে এসব শুনলে কী হবে ভেবেছিস?প্রফেসর জেবা হকের ছেলের পার্সোনালিটির সাথে এসব যায়?

-কী হবে পার্সোনালিটি দিয়ে।তোমরা আসলে বুঝতে পারছো না,আমি ওকে,মানে ভিনাকে কত ভালোবাসি।

-হাসি ঠাট্টায় আমরা অনেক কথাই বলি রুশান।ছোট থেকেই তুই আমাকে সব শেয়ার করতি,আমি বাঁধাও দেই নাই কোনো কিছুতে।কিন্তু এই ব্যাপারটা সেনসিটিভ। আই গেস তুই মেয়েটাকে সত্যিই ভালোবাসিস।

-গেস এর কী আছে,আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসি।

-তার মানে বিয়েও করবি?

-হ্যাঁ, করবো,অবশ্যই করবো।

-দেখ রুশান,প্রেমকে আমরা যত ইজিলি নেই,বিয়েকে কিন্তু নেই না।বিয়ে অনেক বড় ব্যাপার। তুই যে মেয়েকে পছন্দ করেছিস,সেটা নিজের জন্য করেছিস।কিন্তু প্রফেসর জেবা হকের জন্য সে কতটা স্যুইটেবল,সে বিষয়টা মাথায় রাখিস।ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড,অন্য কোথাও এ্যফেয়ার ছিলো কিনা,খোঁজ নিস।

-তুমি ভালোমত জানো,এসব আমার কাছে ম্যাটার করেনা।তোমার কাছেও একসময় করেনি।

-না করেও কী হয়েছে রুশান?আমার জীবনের আট বছর এভাবেই চলে গেছে।বাকী বছর ও চলে যাবে।

-তুমি আট বছরে দেশে তো আসলে না।আসলে সিনারিও ভিন্ন ও হতে পারত।

-শি ইজ এ মাদার অফ এ বিউটিফুল ডটার,নাও।

-তার মানে খোঁজ নাও তুমি.....

-খোঁজ নিয়েই বেঁচে আছি।

-লাভ কী হবে এতে?মা কি কখনো বুঝবে?

-বুঝতে হবে উনার। এত ইগো দিয়ে কী হবে?এর জন্যই বলি,ভেবে এরপর যেকোনো স্টেপ নিস।আমি চাইনা তোর জীবনে এই যন্ত্রণা কখনো আসুক।

-আমি তোমার মত একি ভুল করবো না।

-আমি চাইও না,তুই কর।

ফোন রেখে রুশান দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এই সম্পর্ককে আগানোর রাস্তা যে মসৃণ হবে না,সেটা ভালোমত জানে রুশান।আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিলো,পারবে তো?

••••••••••••

কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলো ফোনের শব্দে,ভিনা তাকিয়ে দেখলো,ফারজানা ফোন দিয়েছে।লাস্ট রিং হওয়া মাত্রই ফোন রিসিভ করলো।কানে ফোন দিতেই ফারজানা তেতিয়ে উঠলো।

-আজকে তুই ক্লাসে আসিস নি কেন?

-কিছু কাজ ছিলো।বাইরে ছিলাম।

-কার সাথে ছিলি?

-যার সাথেই থাকে,কী হয়েছে সেটা বল।

-তুই রুশানের সাথে ছিলি তাইনা?

-থাকলেও কী?আর শিওর হলি কীভাবে যে রুশানের সাথেই ছিলাম?

-আজকে ওকে ক্লাসের বাইরে দেখিনি।তোকেও দেখিনি। 

-বাহ্!চোখ কান তো ভালোই খোলা তোর।

-ভিনা,তোকে না বলেছি,রুশানের থেকে দূরে থাক।ও চ্যাংড়া ধরনের ছেলে।

-আমি কি তোর থেকে ছোট,যে এসব বুঝি না?আমার বুঝ আছে ফারজানা।

-কোথায় গিয়েছিলি তোরা?

-রেস্টুরেন্টে।

-রেস্টুরেন্টে!

-হ্যাঁ, গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো আমার।

-ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায় কী সমস্যা ছিলো?

-ঐ প্লেস আমার কাছে এ্যকুরেট মনে হয়নি। 

-এইযে গেলি তুই,সবাই এখন ভাববে তোরা সম্পর্কে আছিস।

-ভাবুক।আমার কোনো সমস্যা নাই।আমার বয়ফ্রেন্ড, আমার সম্পর্ক। 

-তার মানে তোরা সত্যিই প্রেম করছিস!!

-গাধার মত কথা বলবি না ফারজানা।দিন দিন তোর বুদ্ধি কমছে।শুরুতে তোকে অনেক সেন্সিবেল ভাবতাম আমি।প্রবলেম কী তোর?

-রিউমার অনেক বিশ্রী একটা ব্যাপার। আজকেও সেজান তোকে নিয়ে উল্টা পাল্টা বলছিলো।

-সেজান কে রে?সেজান একটা বাল।মুখ আর খারাপ করাবি না।প্রতিদিন আমাকে ব্রিফ করা লাগবে না কে কী বললো আমাকে নিয়ে।আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না।

-তুই এত ড্যাম কেয়ার কীভাবে ভিনা?

-সময় যাক,তুইও হবি।

-হবো না আমি।তুই এসব থেকে সাবধান থাক।

-আমাকে জ্ঞান দিতে আসিস না ফারজানা।যেটা জানিস না সেটা নিয়ে কথাও বলিস না।বিরক্ত লাগে।

কথাটা ফারজানার গায়ে লাগলো।ঠিকাছে বলে ফোন রেখে দিলো।ভিনাকে ও সবার থেকে আলাদা ভেবেছিলো।কী প্রয়োজন ওর রুশানের সাথে দেখা করার।ভিনা এক মুখে বলছে রুশানের সাথে ওর কিছু নেই,আবার রুশানের সাথেই বের হচ্ছে ও।কী আজব!
ঢাকার মেয়েরা মনে হয় এমনি। 

••••••••••••

ডাইনিং টেবিলে জেবা বসে আছেন।আজকে অনেক দিন পর উনি সকালে নাস্তার টেবিলে বসেছেন রুশানের সাথে। সাধারণত সকাল আটটা বাজেই উনি চলে যান ভার্সিটিতে,আজকে বিশেষ কোনো কারণে যাননি।রুশানের বাবা ফারুক সকাল দশটার আগে কখনো উঠেন না।ক্ষেত্রবিশেষে বারোটা পর্যন্ত ও যায় ঘড়ির কাটা।দুই মেরুর দুই মানুষ কীভাবে এক হয়ে এক ছাদের নিচে আছে রুশান জানে না,কিন্তু জানার খুবই আগ্রহ।রুশানের খালা সায়বা খুবই রসিক মানুষ। রুশানের সাথে তার সম্পর্ক বন্ধুর মত।সায়বাকে রুশান অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে কীভাবে বিয়ে হয়েছে,উনি একি উত্তর বরাবর দিয়েছেন

-আব্বায় দিছে ওরে।ওর কি মুরোদ ছিলো প্রেম করার?

রুশান খাবার টেবিলে জেবাকে দেখে খুবই অবাক হলো।খেয়াল করে দেখলো,আজকে ছুটিও না, ওয়ার্কিং ডে।

-গুড মর্নিং মা।

-গুড মর্নিং।

টোস্ট আর ডাবল পোচ দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো রুশানের।গত কয়দিন আলু পরোটা,পরোটা আর লুচি খেয়েছে। নতুন রান্নার মহিলা খুবই ভালো রান্না করে।

-ভার্সিটি কেমন যাচ্ছে তোমার?

-ভালোই।

-তুমি অনেক ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলে রুশান।ইচ্ছা ছিলো তোমাকে এ্যরোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবো।বুঝলাম না লাইফের কী টার্নিং পয়েন্টে তোমার কী হয়েছিলো।

রুশান মৌনতা বজায় রেখে খেয়ে যাচ্ছে জলদি।যেভাবেই হোক এখান থেকে উঠতে হবে।জেবা রুশানের প্রতিক্রিয়া না পেয়ে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন।তার ছেলেগুলো দিন দিন বেয়াদব হচ্ছে।বড়টা হয়েছে কয়েক বছর আগেই।ছোট ছেলেকে নিয়ে তাও আশা ছিলো কিছু।দেখে মনে হচ্ছে এটাও যাবে।

-কী ব্যাপার। কথা বলছো না কেন?

-পরিস্থিতি ছিলো না...মা।

-কেন ছিলো না?

টোস্টে শেষ কামড় বসিয়ে রুশান ব্যাগ নিয়ে দৌড় দিলো।

-আমার আজকে কুইজ আছে,লেট করতে পারবো না।আরেকদিন এসব নিয়ে কথা হবে।

জেবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুশানের দিকে তাকিয়ে আছেন।তার মনে ভীষণ ভয় কাজ করছে।রেহানের মত রুশান কোনো ভুল করে বসলে,পুরো জীবনই বৃথা তার। 

রুশান যথারীতি ভিনার ক্লাস শেষের অপেক্ষা করছে।তবে এবার কিছুটা দূরে,একটু লুকিয়ে,যেন সহজে চোখে না পরে।এই পুরো সিচুয়েশন ওর কাছে একটুও ভালো লাগছে না।কারণ এভাবে লুকিয়ে থাকলে এই সম্পর্ক কখনো আগাবে না।আবার ভয় ও আছে।ক্লাস শেষে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে ভিনা আবার কী করে বসে বলা তো যায় না।এবার যদি ভাই ই বানিয়ে ফেলে,মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না।

এসব ভাবছে আর এদিকে ওদিক হাঁটছে রুশান।এর মধ্যেই ভিনা ক্লাস থেকে বের হলো।আজকে ফারজানা দূরে গিয়ে বসেছে,কথাও বলেনি কোনো।আগে এমন হলে ভিনার পুরো দিন নষ্ট হয়ে যেত।কেন মুখ ফিরিয়ে নিলো,কেন কথা বললো না,কীভাবে রাগ ভাঙাবে এসব চিন্তায় চাপা পরে যেত।কিন্তু এখন বিন্দুমাত্র বিচলিত না।প্রতিটা মানুষের নিজের সীমারেখা জানা উচিত।ঠিক কতটুকু অন্য মানুষের জীবনে ইন্টারফেয়ার করা যায়,সেটার ন্যূনতম জ্ঞান সবার থাকা দরকার।ফারজানা নিজের সীমা অতিক্রম করছিলো,তাই ভিনাও স্পষ্টভাষী হতে বাধ্য হয়েছে।এ নিয়ে কোনো অপরাধবোধ নেই।

রুশান কে বিড়ালের মত লুকাতে দেখে ভিনা দাঁড়িয়ে গেলো।সামনে গিয়ে বললো-

-কী রে রুশান,এখানে কী করছিস?

-কিছু না।

-আমার জন্য ওয়েট করছিলি?কিছু বলবি?

-না....

-কাউকে ভালো লাগে?এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন।

রুশান ভালোমত জানে ভিনা এটা ইচ্ছা করে করছে।স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ উঁচু গলায়ই কথা গুলো বলছে ও।আশেপাশে বেশ কজন তাকিয়ে আছে।রুশান আর কথার উত্তর দিলো না।বেশ বিরক্ত লাগছে ওর।রুশানের পেছনেই ফারজানা দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা দেখছে।ভিনার মুখে তুই তোকারি শুনে বেশ অবাক এবং একই সাথে আশ্বস্ত ও হয়েছে।

যাক,ওরা শুধুই বন্ধু তাহলে। পরক্ষণেই মনে হলো ভিনা এতও খারাপ না।
.
.
.
চলবে....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp