অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ০৬ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


মাহভিন হওয়ার পর ভিনার অনেক শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।শরীর ফুলে গিয়েছিলো,অপারেশনের কারণে তলপেটে রয়েছে চিরস্থায়ী দাগ।শখের চুল পড়ে গেছে গোছা ধরে।অবশেষে কোমড় অবধি চুল কেটে ঘাড় পর্যন্ত এনেছে,খাওয়া দাওয়ায়ও পরিবর্তন এনেছে অনেক।ওজন কমিয়ে আগের মত হয়ে গেছে ঠিকি,কিন্তু পেটের সেই দাগ আর যায়নি।তার চেয়ে বড় ক্ষত রয়ে গেছে মনে।সেই দাগ যাবে না,কখনোই না।

অনেক ইচ্ছা করে পুরোনো সেই মানুষদের সাথে যোগাযোগ করতে।কেমন আছে নওমি?কী করছে সাদ,আবির,কথা?প্রিতি আপু কি ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে?ওয়াসিম কি আরশিকে এখনো মনে রেখেছে?আরশি কি এখনোও বেঁচে আছে?

ফেসবুকে পিপল ইউ মে নো তে প্রায় সবার একাউন্টই আসে।কিন্তু ভিনা কাউকেই এ্যড করে না।জানার খুব তীব্র ইচ্ছা থাকলেও ওদের থেকে নিজেকে দূরে রাখে,কারণ ওরা এমন সময়ে ভিনার জীবনে এক্সিস্ট করত,যখন ওর জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সময় গিয়েছে।এদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য হলেও ভিনার নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে,এর জন্য সময় দরকার।Time is the best healer.

ড্রয়ার থেকে ভাইব্রেশনের আওয়াজ আসছে।ভিনা ড্রয়ার খুলে ছোট একটা কীপ্যাড ফোন হাতে নিলো।কাদের ফোন দিয়েছে।

-আপু,সাড়ে সাত হাজার টাকার একটা পার্সেল ছিলো মনে হয়,ঐ স্যার ফোন দিয়েছে অনেকবার,আপনি তো কোনো কিছু জানালেন না।

-যেভাবে গুছিয়ে রেখেছো,ওভাবেই রেখে দাও।যদি আবার ফোন দেয়,বলবা স্টক শেষ। 

-কিন্তু,সাড়ে সাত হাজারের পার্সেল।

-আমি দেখবো ব্যাপারটা।

-ঠিকাছে।

এই ফোন নম্বর শুধু গোটা কয়েক মানুষই জানে,যাদের সাথে প্রতিদিনই চলতে হয়।বড় টাচ মোবাইল প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে,তখন এই ফোনই ভরসা। ভিনা হিসাব নিয়ে বসলো,এই মাসে মোট ছেচল্লিশ হাজার আটশ টাকার পার্সেল গিয়েছে।এই সাড়ে সাত হাজারের পার্সেল গেলেই এই মাসের টার্গেট পূরণ হবে।তবুও এই পার্সেল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলো।কারণ ভালোমত জানা আছে,পার্সেল কার।

•••••••••••

ভার্সিটির শুরুতেই রুশানকে অসহ্য লাগা শুরু করলো ভিনার।প্রথমে ছ্যাচড়া ভাবলেও পরে বুঝতে পারলো এই ধরনের আদিখ্যেতা শুধু ভিনার সাথেই করা হয়।কীভাবে যেন এই ছেলে ভিনার রুটিন জেনে গেছে।প্রতিদিনই নতুন নতুন অজুহাতে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।একদিন ভিনার ধৈর্য্যর সীমা ছাড়িয়ে গেলো-

-রুশান,তোমার সাথে কথা আছে।তুমি আমার সাথে এক্ষনি ক্যান্টিনে আসো।

-অবশ্যই! 

রুশান অতি উৎসাহে ভিনার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো।মনে হচ্ছে যেন প্রেমালাপ করতে যাচ্ছে।
ভিনা এক কাপ কফি,এক কাপ চা নিয়ে রুশানের সামনে বসলো।রুশান দুই গালে প্রশস্ত হাসি দিয়ে বসে আছে।এরপর চা রুশানকে দিয়ে নিজে কফি নিলো।
রুশানের ভ্রু কুচকে গেলো-

-তুমি কফি নিলে?তুমি না কফি খাও না।

-আমি কফি খাই।ইভেন আমি কফিই খাই।

-তাহলে সেদিন মিথ্যা কেন বললে আমাকে?

-উহু,মিথ্যা বলিনি।মুডের উপর ডিপেন্ড করে সব।সেদিন কফি খাওয়ার মুড ছিলো না।

-বললেই পারতে।

-আগে বলো,তুমি আমার কে।

রুশানের হার্টবিট যেন মিস করলো। কী ছোট একটা প্রশ্ন,'তুমি আমার কে?' তিন শব্দের নিরীহ প্রশ্ন।তবুও রুশান উত্তর দিতে পারলো না।মাথা নিচু করে বসে থাকলো।

-কী হলো রুশান।কথা বলো।

-বন্ধু...

-একজন বন্ধুর আচরণ এমন হয়?গত একমাস ধরে কী করছো তুমি?

-কী করলাম আমি?

-ক্লাসের বাইরে এভাবে কেন দাঁড়িয়ে থাকো।ফেসবুকে তো নক দেয়াই যায়।

-তুমি তো নোটিফিকেশন দেখলেও মেসেজ সিন করবা না।

ভিনা বেশ বিব্রতবোধ করলো।রুশান একটুও মিথ্যা বলেনি।ভিনা কখনোই রুশানের মেসেজ সিন করে না সরাসরি। নোটিফিকেশন আসলেও না।কথা সত্যি হলেও এভাবে রুশানের কাছে ধরা খাওয়া মোটেও প্রসন্ন কিছু না।তাই জলদিই কথা ঘুরিয়ে ফেললো।

-আজকে কেন এসেছো?

-কিছু জিনিস কিনবো।

-কিনো।আমাকে কি দরকার। 

-তোমার পেজ থেকে কিনবো।

ভিনা আকাশ থেকে পড়লো।পেজ খুলেছে বেশিদিন হয়নি।সেভাবে কাউকে জানানোও হয়নি।তবুও রুশান কীভাবে যেন জেনে গেছে।

-কী কিনবে?ওখানে সবই মেয়েদের আর বাচ্চাদের প্রোডাক্ট।বিয়ে করে সংসার পেতেছো নাকি?

-না,এখনো না।কিন্তু জলদিই পাতবো।

-তাহলে এখন কী?

-আমার মার জন্য কিনবো।আমার খালার মেয়ের বাচ্চা আছে,ওর জন্য কিনবো।

-ঠিকাছে।যাই কিনো না কেন,ফেসবুকেই তো জানাতে পারতে।

-তুমি দেখতে না।

-আমি তোমার মেসেজ দেখি।

-উহু।তাহলে অবশ্যই জানতে আজকে আমার জন্মদিন এবং এই উপলক্ষে আমি তোমার সাথে ফর্মাল কফি ডেটে যেতে চেয়েছিলাম।অবশ্য না জেনে ভালোই হয়েছে।উই আর ইন এ ফর্মাল ডেট রাইট নাও।

ভিনা অর্ধেক কফি রেখেই উঠে দাঁড়ালো।রুশানকে কষে চড় মারতে ইচ্ছা করছে।এখন তেমন কেউ ক্যান্টিনে নেই,তবু মারলো না।খয়েরি চোখে ভালোবাসার আবেগ মেখে রুশান বসে আছে।চড় মারলে এই আবেগ আরো দ্বিগুণ হয়ে যাবে।অভিযোগ,অভিমানের জন্য হলেও কথা বলার বড় অজুহাত পাবে।

-দেখো রুশান।আবারো বলছি।বিহেভ ইওরসেল্ফ।তোমাকে ক্লাসের বাইরে যেন দাঁড়াতে না দেখি।

-ঠিকাছে।তাহলে অন্তত মেসেজ দিলে চেক করো।

-ঠিকাছে।করবো। 

-আর শোনো,আজকে আমার জন্মদিন না।

রুশান ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো।ভিনা আর অপেক্ষা করলো না।চলে এলো সেখান থেকে।

ক্যান্টিন থেকে বের হওয়ার মুখেই ফারজানার সাথে দেখা।ফারজানা অত্যাধিক বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

-এই অসভ্য ছেলে আজকেও দাঁড়ায়ে ছিলো তাইনা?

-বাদ দে।

-বাদ দিবো কীভাবে।তুই কফি খেলি কেন ওর সাথে?

-কথা ছিলো তাই।

-এসবদের চড় মেরে ঠিক করতে হয়।একসাথে কফি খেয়ে না। দুনিয়াটা কত খারাপ জানিস?ছেলে মানুষের ভরসা আছে কোনো।

-প্রেম তো করছি না।লিটারেলি কিছুই নেই আমাদের মধ্যে।

-তো এই ছেলে এমন করে কেন?মাত্র দুই মাসেই এত দরদ?প্রতিদিন ক্লাসের বাইরে দাঁড়ায় থাকা লাগে?

-মাত্র দুই মাসের ব্যাপার না।আরো তিন বছর আগে আমরা একসাথে কোচিং করতাম।

-আচ্ছা!পুরানো প্রেম!

-কিসের পুরানো প্রেম!কী সব বলিস তুই?

-তাহলে?

-জানি না ভাই এমন কেন করে।আমিও নিজেও সমস্যায় আছি।

-সেজান এসে জিজ্ঞেস করছিলো,ভিনার বয়ফ্রেন্ড নাকি ছেলেটা।আমি ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।

-হোয়াট!বয়ফ্রেন্ড?

-শুধু সেজান না।ক্লাসের সবাই ভাবে এই বদ ছেলে তোর প্রেমিক।

-আজব তো!এত ভাবে কেন এরা?

-ওদের দোষ কী।তুই ই দেখ,দূর থেকে তো এমনই মনে হয়।

-যন্ত্রণা!আমি দেখবো ব্যাপারটা।এভাবে কীভাবে চলে।

ফারজানা চলে গেলো জলদি।টিউশনি আছে।ফারজানার দিকে তাকালে আরশির কথা মনে পরে যায়।আরশিও অনেকটা এমনই ছিলো।কোথায় আছে মেয়েটা?

•••••••••••

বাসায় গিয়ে হালকা কিছু খেয়ে ফেসবুকে বসলো ভিনা।বেশ বিরক্তি নিয়েই ইনবক্সে রুশানের মেসেজগুলো দেখছে।

-কেমন আছো ভিনা?
-ঐ ছেলেটা কে?ঐযে শ্যামলা করে?তোমার দিকে কেমন করে যেন তাকায়।
-আজকে তোমার ব্যাগের সাইড চেইন খোলা ছিলো।তুমি তো ক্লাস থেকে বের হয়েই দৌড় দাও।আচ্ছা আমি কি এত খারাপ?
-তুমি প্রতিদিনই কফি খাও।আর সেদিন কী বললে?
-কার লেখা পড়তে ভালো লাগে?

স্ক্রল করে পড়তে পড়তেই নতুন মেসেজ আসলো।

-মিস ভিনা।আমি আপনার পেইজ থেকে এই প্রোডাক্টগুলো পার্চেজ করতে চাই।

নিচে প্রোডাক্টের লিস্ট দেয়া।পেজের প্রতিটা প্রোডাক্ট এক পিস করে আছে।মোট ছয় হাজার সাতশ আশি টাকার প্রোডাক্ট।অন্য কেউ হলে নির্ঘাত খুশি হয়ে যেত ভিনা।কিন্তু এটা রুশান,এবং এই কেনাকাটা ও শুধুমাত্র ভিনাকে খুশি করার জন্য করছে।সব বুঝে ভিনার ইচ্ছে করছিলো ছেলেটাকে ব্লক দিতে।কিন্তু দিলো না।এখানে পার্সোনাল ইস্যু আনলো না।চড়ের মত এখানেই নিজের ধৈর্য্য দেখালো।প্রফেশনালিজম না দেখালে বিষয়টা খুবই খেলো হয় যাবে।

অর্ডার কনফার্ম করে ভিনা রুশানে এ্যড্রেস নোট করে রাখলো অন্য কালি দিয়ে।এরপর নক দিয়ে বললো-

-কালকে দেখা করো।কথা আছে। 
.
.
.
চলবে..................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp