অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ০৭ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


রুশানের কাছে পার্সেল পাঠানো পর ভিনা সিদ্ধান্ত নিলো এই প্রথম,এই শেষ। ভিনার পার্সোনাল এবং বিজনেস,কোনো লাইফেই এই ছেলের ইন্টারফেয়ার মেনে নিবে না।এই ছেলে হিসেবে সম্বোধনের কারণ হলো,রুশানকে নিতান্তই বাচ্চা ছেলে মনে হয় ভিনার।ও ভেবেই পায় না কীভাবে একটা মেয়ে সমবয়সী ছেলের সাথে সম্পর্কে যায়,আবার বিয়েও করে!একরাশ বিরক্তিতে ভিনা ইনবক্স থেকে বের হলো।একসময় মনে হলো বয়সে বড় থাকলেই বা কী হয়?হাত তো ছেড়েই দেয় একসময়। জীবনের উপর ভীষণই অভিমান ভিনার।জীবনের কোনো সমীকরণই ওর মিলে না।

রুম থেকে বের হয়েই ভিনা দেখলো মাহভিন মাটিতে বসে বাটি থেকে বাদাম ফেলে সেটা টোকিয়ে খাচ্ছে।ভিনা জলদিই বাদাম গুলো হাত দিয়ে তুলে বাটিতে দিলো।বিনা সময় নষ্টে মাহভিন বাটি উপুড় করে বাদামগুলো ছড়িয়ে দিলো মাটিতে,এরপর ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে বেশ কষ্টে একটা করে উঠিয়ে বাদাম খাচ্ছে,মহাখুশিতে।বাদাম খাওয়ার এক পর্যায়ে মাহভিন ভিনার দিকে তাকালো,মাথা হালকা ঝাঁকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বাদাম সাধলো।মুহূর্তেই ভিনার সব বিরক্তি দূর হয়ে গেলো, মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে দিলো মাহভিনের।ওর বুক ক্ষণিকের জন্য ভারী হয়ে উঠলো এই ভেবে যে,আজকে রুপিন এই বাচ্চাটাকে নিয়ে দূরে চলে গেলে কী হতো?কী হতো যদি যাবিরের প্রেমে অন্ধ হয়ে ও সত্যিই এই বাচ্চা এ্যবোর্ট করে ফেলতো?

ভাবনায় ছেদ পরে মুনার ডাকে।

-কী ভিনা?প্রায়ই অন্যমনস্ক দেখি তোকে,কিছু নিয়ে চিন্তিত?কিছু হয়েছে?

-না তো।এমনিই আরকি ভাবছিলাম। 

-ঠিক তো?সিরিয়াস কিছু না তো?

-আরে না!

-মাহভিনের কান্ড দেখ।এই পিচ্চির নতুন অভ্যাস হয়েছে মাটিতে ফেলে খাবার খাওয়ার।দিনে চৌদ্দবার রুম মুছাই,চুমকি তো মহাবিরক্ত।

মুনা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।ভিনা অপলক সেই হাসির দিকে তাকিয়ে আছে।কী নির্মল প্রাণবন্ত সেই হাসি।একটা ছোট্ট মানুষ একসাথে দুইজন মানুষকে মাতৃত্বের অনুভূতি দিচ্ছে,কী ক্ষমতা! 

•••••••••••

রুশান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হালকা কোকড়া চুলগুলোকে বশ মানানোর চেষ্টা করছে।মেরুন রঙের শার্ট আর বাদামি প্যান্টে নিজেকে দেখে বেশ কনভিন্সড।ভিনা আজকে ওর সাথে দেখা করবে।ভাবতেই মুখে হাসি ছড়িয়ে গেলো।নিজের কৈশোরে ফিরে গেলো রুশান।যখন ভিনা ওর এলোমেলো চুল আর পুরোনো একটা ব্যাগ নিয়ে উদাস মনে ক্লাসে আসত। ভিনা কখনো টের ও পায়নি ক্লাসে এক জোড়া আবেগি চোখ পুরো মনোযোগ ওর দিকে দিয়ে রেখেছে।ভিনা ক্লাসে কখনোই নিয়মিত ছিলো না।কিন্তু যখনই আসতো,রুশানের হৃদকম্পন বেড়ে যেত।ভিনার প্রতিটা ব্যাপার লক্ষ্য করত রুশান।ভিনার ব্যাগে সবসময় একটা ডায়রি আর একটা বই রাখত।একদিন খেয়াল করলো সিগারেট ও থাকে সেই ব্যাগে।সিগারেট দেখার পর রুশান একদিন পুরো মনমরা হয়ে ছিলো।ভেবেছিলো এই মেয়েকে আর কখনোই ভালো লাগবে না।কিন্তু কৈশোরের রঙ্গিন চশমায় এসব ব্যাপার আর বেশিদিন বুকে বিঁধলো না।বরং শুষ্ক সেই ঠোঁট জোড়ায় সিগারেটের উত্তাপ দেখার জন্য মন উতলা হয়ে গেলো।এভাবেই দিন যেতে যেতে একদিন মকবুল স্যারের ঘটনা ঘটলো।মকবুল স্যার ধরা পরার পর গার্জিয়ানদের ভীড়ে কারো চোখে পরেনি একটা ছেলে ভিনার এই হ্যারাজ হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভে রাগে দুঃখে কেঁদে ফেলেছে।সেদিনের পর যখন ভিনা কোচিং এ আসা বন্ধ করে দিলে,রুশান তখন পাগল প্রায় হয়ে গেলো।ভিনার খোঁজে প্রতিদিন নওমির কাছে যেত ও।যেদিন শুনলো ভিনা আর আসবে না,রুশান নিজেও সেই কোচিং ছেড়ে দিলো।এর কিছুদিন পর আচমকা ভিনার ফোন থেকে কল আসলো যাবিরের জন্য টিউশন খুঁজে দিতে।রুশান নিজের খালাত ভাইয়ের রানিং হোম টিউটরকে এক প্রকার সিন ক্রিয়েট করে বাদ দিয়ে যাবিরের টিউশনির ব্যবস্থা করে,শুধুমাত্র ভিনার জন্য।এরকম ছটফট করতে করতেই প্রায় চার বছর পার হয়ে গেছে।ভিনার খোঁজখবর নিয়মিতই নিয়েছে এই সময়ে।যদিও সবসময় খবর পাওয়া সম্ভব হয়নি।মেয়েটা রহস্যময়তায় নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলো।যেদিন রুশান ভার্সিটিতে ভিনাকে প্রথম দেখে,ও খুশিতে পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিলো।ভাগ্য যে কিছুসময় কল্পনাকে বাস্তব হওয়ার সুযোগ দেয়,সেদিন প্রথম উপলব্ধি করে।পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ নিয়েই রুশান ভিনার ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।ভিনা রুশানকে আগানোর ইশারা দিয়ে ওর পাশে হাঁটা শুরু করলো। এই প্রথম খেয়াল করে দেখলো,রুশান দেখতে অসম্ভব সুন্দর।আজকের এই মেরুন রঙে ওকে রাজপুত্রের মত লাগছে।দামী পারফিউমের হালকা ঘ্রাণ আর হাতে পরা কালো রঙের রোলেক্স ঘড়িতে আভিজাত্য এসেছে পুরো লুকে।কিন্তু ভিনা হিসাব করে দেখছে নিজের ক্লাসের কোন কোন মেয়ে ওর প্রেমে পরতে পারে,কারণ এসব আর টানেনা ভিনাকে।ভালোবাসায় জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা ওর মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতাই নষ্ট করে দিয়েছে।জীবন মানেই বাস্তবতা এখন ভিনার কাছে,যেখানে নতুন প্রেমের শিহরণ নেই,বিয়ের রঙিন স্বপ্ন নেই।

বনানির ভালো একটা রেস্টুরেন্টে ভিনা রুশানের সাথে গেলো।ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়া মোটেও নিরাপদ মনে হয়নি ওর কাছে।রুশান নিজেকে অনেক কষ্টে শান্ত রেখেছে।উত্তেজনায় ওর শ্বাস ভারি হয়ে গেছে।ভিনা কী বলবে ওকে?ও কি বুঝে গেছে রুশান ওকে এখনো পাগলের মত ভালোবাসে?এই ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিবে আজকে?

রেস্টুরেন্টের কোণায় মানুষ কম এমন জায়গায় ভিনা বসলো।দুইটা কফি অর্ডার দিয়ে রুশানের দিকে সরাসরি তাকালো।এই দৃষ্টি রুশানের হৃদয় এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে।

-এরপর বলো।ক্লাসের বাইরে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকো কেন?

-তোমাকে দেখার জন্য।

-দেখতে চাও কেন?

রুশান এই রাখঢাক ছাড়া সরাসরি প্রশ্নে বেশ অস্বস্তিতে পরে গেলো।গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে ভিনা আবার জিজ্ঞেস করলো।

-কী হলো,কথা বলছো না কেন?

-তোমাকে দেখতে ভালো লাগে।

-দেখো রুশান,তুমি যে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকো,এটা কিন্তু সবার নজরে আসছে।কেউই এটা স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না।এটা নিয়ে রিউমার তৈরি হচ্ছে।

-রিউমার?কী রিউমার?

-তুমি আমার বয়ফ্রেন্ড।কিন্তু রিয়েল লাইফে আমরা ফ্রেন্ড ও কিন্তু না।

ভিনার এই কথায় রুশানের মন শতটুকরো হয়ে যাচ্ছে।চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আমি তোমাকে বিয়ে করবো জলদিই,তুমি আমার হবু বউ,বুঝলে?

-ফ্রেন্ড ও না,কথাটা ভুল।আমরা কিন্তু ফ্রেন্ড।

-আচ্ছা,আমরা ফ্রেন্ড রাইট?

-হ্যাঁ.... 

-তাহলে বলে রাখি,একটা ফ্রেন্ডের আচরণ এমন হয় না।বুঝলে?এখন থেকে তুমি এভাবে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে না।

-আচ্ছা....

রুশানের কথাই বলতে পারছে না।ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।ও কখনোই আশা করেনি ভিনা এসব কথা বলার জন্য ডাকবে।

-আরেকটা ব্যাপার...

-বলো..

ভিনা হেলান দিয়ে বসলো।এবার ও সবচেয়ে অস্ত্র ব্যবহার করবে।

-ফ্রেন্ডদের মধ্যে কিন্তু তুই তোকারি সম্পর্ক থাকে,জানো তো নিশ্চয়ই। 

রুশান কফি তে চুমুক দিতে গিয়েও দিলো না।ভিনার বাকী কথার শোনার আগেই মাটিতে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে।

-জানি তো।অনেকেই বলে,অনেকে বলে না।

-সবাই বলে।এর জন্যই আজকে থেকে আমরা একজন আরেকজনকে তুই করে ডাকবো।

রুশানের আশাভঙ্গের চূড়ান্ত হলো।নিজের লাল শার্টে কফি ঢেলে প্রতিবাদ জানাতে ইচ্ছে করছে।

-দেখো ভিনা,আমি তোমাকে তুই ডাকতে পারবো না।তুই অসম্মানের ওয়ার্ড।

-মোটেও না।এটা খুবই কম্ফোরটেবল ওয়ার্ড।

-আমি তোমাকে তুই ডাকতে পারবো না।

-আমি তো তোকে তুই ই ডাকবো। 

-প্লিজ ভিনা।

-তাহলে বন্ধুত্বের ও দরকার নেই।

-আচ্ছা....ডাকো তুমি।কিন্তু আমি ডাকবো না।

-চলবে।আমাদের সম্পর্ক হলো তুমি-তোকারির সম্পর্ক। বুঝছিস।

-হ্যাঁ বুঝেছি।

-এরপর থেকে যা বলার ফেসবুকে বলবি।ক্লাসের বাইরে থাকবি না।

-হুমমম..

রুশান এই অত্যাচার মুখ চেপে সহ্য করলো।ভিনা প্রসন্ন এক হাসি দিয়ে বিল পে করে চলে গেলো,ফিরেও তাকালো না।রুশান অতি শোকে পাথরের পরিবর্তে পাগল হয়ে কফির সাথে কোল্ড ড্রিংক খেয়ে বসে থাকলো এক ঘন্টা।
.
.
.
চলবে....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp