-এসব কী বলছো বাবা?আমি মানি না এসব!
-যা বলেছি তাই করবে!আমি এর বেশি কিছুই শুনতে চাইনা,ব্যাস!
ভিনা কান্না করতে করতে চলে এলো রুমে।সোহেল ভিনাকে হোস্টেলে পাঠাবে,কারণ সোহেলের ধারণা ভিনা মাহভিনের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে।
আজকে এক সপ্তাহ হলো ভিনা বাসায় এসেছে।ভাগ্য ভালো ছিলো দেখে এই সমস্যা নিয়ে বেশি ভুগতে হয়নি।বাসায় বিশ্রাম নিয়ে শরীরের দূর্বলতাও কেটে গেছে।এই সময়ে মুনা অনেক যত্ন নিয়েছে, প্রতিদিন স্যুপ বানিয়ে খাইয়েছে,গভীর রাতে ঘরে এসে দেখে গেছে জ্বর ছিলো নাকি।সব ভালোই ছিলো।কিন্তু আজকে সকালে সোহেল হটাৎ রুমে এসে জানিয়েছে হোস্টেলের খোঁজ নিতে। প্রথমে পড়ার পরিবেশ,যাতায়াতের অসুবিধা নানা অজুহাত দেখালেও অবশেষে ভিনার যুক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে আসল কারণ বলে।সত্যিটা শুনে ভিনার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়।সোহেলের অটল অবস্থান দেখে ভিনা ভালোমত বুঝতে পারছে হোস্টেলে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায়ই নেই। কান্না করে পুরো চোখ মুখ ফুলে গেছে,আজ প্রায় বছর খানেক পর এভাবে কান্না করলো।কী মনে করে যেন আয়নায় তাকালো,কান্না করার কারণে অদ্ভুত হলেও ওকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে।এই সৌন্দর্য্য মায়াবী নাকি সম্মোহিনী?
সেদিন রাতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে,যাবির কি শুধুই ভুল করে ফেলেছিলো নাকি ভালোবাসার সামান্যতম অস্তিত্ব ছিলো ওখানে?
কলিংবেলের শব্দ শুনে ভিনা নিজের ঘরের দরজা ভিড়িয়ে দিলো।কারো সামনে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।হয়ত কাদের এসেছে নতুন প্রোডাক্টগুলো নিয়ে।কিন্তু ভিনাকে চমকে দিয়ে রুশান বাসায় এসেছে।ভিনা বিস্ফোরিত চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে,কিন্তু দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা একদম নেই।
রুশান সোহেল এবং মুনাকে সালাম দিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে।সবার কথার ধরণ শুনে মনে হচ্ছে রুশানের আসার কথা তারা আগে থেকেই জানে।ভিনার পুরো ঘটনা জানার কৌতূহল থাকলেও বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকায় উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পরলো।প্রায় দশমিনিট পরেই চুমকি দরজায় টোকা দিয়ে বললো সোহেল ডাকছে।ভিনা ঢোলা গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরা ছিলো, এর উপর বড় সুতির ওড়না পেঁচিয়ে বাইরে বের হলো।
সোহেল ভিনাকে এরকম অগোছালো ভাবে আসতে দেখে রীতিমতো চমকে গেলো।মুনা চোখের ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলো জুতসই কোনো কাপড় পরে আসতে।ভিনাও অন্যদিকে তাকিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিলো রুশান এমন আহামরি কেউ না যার সামনে সেজেগুজে আসতে হবে।ভিনার চোখে ও একটা ছ্যামড়া,এই ছ্যামড়াকে নিয়ে ওর মাথা ঘামানোর ইচ্ছা না থাকলেও দিন দিন তা মাথাব্যাথা হয়ে উঠছে।
সোহেলের পাশে ভিনা বসলেও একটু দূরত্ব রেখে বসলো।এই দূরত্ব ওর অভিমানের অস্তিত্ব জানান দেয়ার উপায়।
ভিনাকে দেখেই রুশান বলে উঠলো-
-এক সপ্তাহ ভার্সিটিতে আসলে না,তোমার খোঁজ না পেয়ে পরে আঙ্কেল কে ফোন দিলাম।আঙ্কেল ও আমাকে দাওয়াত দিয়ে দিলেন হটাৎ।
ভিনা হালকা হাসি দিয়ে বুঝালো খুব ভালো হয়েছে,আমি ধন্য।
-দাওয়াত না বাবা।তুমি হস্পিটালে দুইদিন অনেক কষ্ট করেছো।আপন মানুষ ছাড়া কেউ এত কষ্ট করেনা।
-হ্যাঁ রুশান,আমি সোহেলের কাছে সব শুনলাম।অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছো তুমি।মাহভিন অসুস্থ ছিলো দেখে আমি যেতে পারিনি,কী যে টেনশনে ছিলাম,পরে তোমার আঙ্কেল বললো তোমার ব্যাপারে।অনেক হেল্প করেছো।
-আরে না না আন্টি!কী যে বলেন।
রুশান লজ্জায় মাথা উঠাতে পারছে না।ভিনা চুপচাপ পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছে।দুইদিন হস্পিটালে মরার মতো পরে ছিলো ও।সোহেল এসে খাবার আর ঔষধ দিয়ে গেছে,নার্স এসে বাকী কাজে সাহায্য করেছে,এছাড়া দুইদিন দুনিয়ার কোনো খবরই ও জানে না।এখন বুঝতে পারছে রুশান সুযোগের সদ্ব্যাবহার করতে পিছপা হয়নি। এই দুইদিন ও সোহেলের সাথে থেকে নিজেকে পৃথিবীর উৎকৃষ্ট শ্রেণির ছেলের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।এই শ্রেণির ছেলেদের সাধারণত কোনো পরিবার মেয়ের বিবাহ উপযোগী মনে করে।কিন্তু রুশান নিতান্তই বাচ্চা ছেলে।এই ছেলেকে বিবাহ উপযোগী মনে না করলেও,সবার আচরণ কেমন যেন সন্দেহ জনক।
ভিনা সোহেল আর মুনার মনে কী চলছে জানে না।তবে যাই ই চলছে না কেন সেটাকে পানি দিয়ে বন্যা বানিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
-তোর বাসায় কেউ চিন্তা করেনি?হস্পিটালে যে এভাবে ছিলি,কেউ জিজ্ঞেস করেনি এ ব্যাপারে?
ভিনার মুখে তুই তোকারি শুনে সোহেল মুনা দুইজন দুইজনের দিকে তাকালো।রুশানের হাসি হাসি মুখ মুহূর্তের মধ্যে শুকিয়ে বালি হয়ে গেছে।হস্পিটালে নেয়ার সময় থেকে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত ও এই মেয়েটা ওকে তুমি করে বলেছে।এখন সুস্থ হয়ে, সেন্সে এসে আবোল তাবোল বলছে।
-আমার বাবা মা অনেক ভালো,কাউকে হেল্প করছি শুনে তারা আরো এনকারেজ করেছে আমাকে থাকার জন্য।এই বয়সে এসে বন্ধুর পাশে থাকার জন্য এসব চিন্তা করলে হবে?বলো?
রুশান এক নিঃশ্বাসে কী সুন্দর পরিপাটি করে মিথ্যা বলে ফেললো,ওর নিজেরি অবাক লাগছে।হস্পিটালে রাত বিরাতে থেকে,তাও আবার ড্রাইভারকে অন্য জায়গায় রেখে,কত বড় ছ্যাচা যে খেয়েছে রুশান আর রেহান ছাড়া কেউ জানে না।রুশানের এই তথাকথিত 'বেয়ারাপানা'র জন্য ওর মা বাবার মাঝে মৌখিক ডিভোর্স ও দৃশ্যমান সেপারেশন হয়েছে।
শুধু তাইনা,রুশানের হাত খরচ বন্ধসহ গাড়ি ব্যাবহারে নিষধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে।বর্তমানে রুশান খালা সায়বার দয়ার টাকা ও গাড়ি ব্যবহার করছে।এই গাড়ি আনতে গিয়ে অনেক ঝামেলাও হয়েছে।কিন্তু হবু শ্বশুরবাড়িতে একদম ভিখারির মত যেতে রুশানের প্রেস্টিজে লাগছিলো।
-তোমার মা বাবা তো তাহলে খুব অপেন মাইন্ডেড মানুষ, অনেক ভালো লাগলো শুনে।
মুনা বলে উঠলো।সোহেল ও সায় দিয়ে বললো-
-ফ্যামিলি ভালো দেখেই তো ছেলে এত ভালো।
সৌজন্য আর লজ্জার হাসি মুখে ধরে রাখতে রাখতে চোয়াল ব্যাথা হয়ে গেছে রুশানের।কিন্তু নিজের প্রশংসা শুনে সেই ব্যাথা প্রশমিত ও হয়ে গেছে।
মুনা এদিকে রুশানের সাথে ওর ফ্যামিলির ব্যাপারে নানা কথা জিজ্ঞেস করছে,রুশান ও ড্রয়িং রুমে রাখা ছবিগুলো ব্যাপারে কথা বলছে।
এই ফাঁকে চুমকি মাহভিন কে নিয়ে এলো।মাহভিন মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে।
রুশান মাহভিনকে দেখেই নিজের কোলে নিলো।ঘুম থেকে মাত্র উঠায় ওর মেজাজ বেশি একটা ভালো নেই। বেশ কিছুক্ষণ রুশানকে দেখে এরপর কান্না শুরু করে দিলো।ভিনা মাহভিনকে কোলে নেয়ার জন্য উঠতে গেলে সোহেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওখানেই থামিয়ে দিলো।কেউ কোলে না নেয়ায় মুনা মাহভিনকে কোলে নিয়ে বসেছে।
রুশান দেয়ালে টানানো ভিনার ছোটবেলার ছবি দেখে অনেক বেশিই অবাক হয়েছে।কারণ ভিনা আর মাহভিনের চেহারা আইডেন্টিকাল টুইনের মত।সৎ বোনদের চেহারায় এত মিল থাকতে পারে রুশানের ধারণা ছিলো না।মা মেয়ের চেহারায় মিল থাকতে পারে,আপন বোনদের চেহারায় ও মিল থাকতে পারে,কিন্তু সৎ বোনের?
এসব চিন্তা বাদ দিয়ে রুশান সোহেলের সাথে গল্প শুরু করলো।ভিনা এসবে চরম বিরক্ত হয়ে উঠে চলে আসছে।মেয়ের এই দাম্ভিক ব্যবহারে সোহেল অনেক অসন্তুষ্ট। মাহভিনের কারণে ভিনা স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে না,কারো সাথে মিশছে না এবং ভবিষ্যতেও একা থাকবে,এই ধারণা সোহেলের মনে শক্ত শেকড় গেথে ফেলছে।
দুপুরে খাবারের টেবিলে যখন সবাই একসাথে বসেছে,তখন সোহেল রুশানকে বললো-
-বাবা,তোমার জানামতে ভালো মেয়েদের হোস্টেল আছে?
ভিনা বিস্ফোরিত চোখে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।সকালের পরে ভেবেছিলো বিষয়টা ওখানেই শেষ, কিন্তু এখন দেখছে সোহেল এতটাই ধৈর্য্য হারা যে রুশানের কাছে জিজ্ঞেস করছে এসব ব্যাপারে।
রুশান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-কে আঙ্কেল?কার জন্য?
-ভিনার জন্য।
-ভিনার জন্য!!কেন?
-ভার্সিটি থেকে ওর অনেক কষ্ট হয়ে যায় যাওয়া আসায়।আবার সারাদিন শুধু ছোটবোন নিয়ে থাকে।পড়াশোনায় একটুও মন নেই।
নিজের ব্যাপারে এসব মিথ্যা অভিযোগ শুনে ভিনার ইচ্ছে করছে কাচের সব জিনিস ভেঙে ফেলতে।ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রেখে দ্রুত খাওয়া শেষ করছে তাই।
-ভিনা তো লাইব্রেরিতে থাকে আঙ্কেল।ওর তো ফ্রেন্ড সার্কেল ও নেই তেমন।ও পড়াশোনা করে না!
-আরো বেশি পড়তে হবে।আর যাতায়াতের জন্য অনেক চাপ পরে যায়।তুমি শুধু খোঁজ নিও তো।
ভিনা নিজের মৌনতা ভাঙলো-
-ও ছেলে মানুষ ও কী বুঝবে এসবের?
-ছেলে হয়েছে তো কী হয়েছে, খুঁজতে তো পারেই তাইনা?(সোহেল)
-জ্বি আঙ্কেল,সমস্যা নেই।আমি ভালো জায়গায় খোঁজ নিবো।(রুশান)
ভিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলো।রুশান বুঝতে পারছে কিছু একটা আছে এমন যেটা ও জানে না,এবং এখন সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার উপযুক্ত সময় ও না।
এই অস্বাভাবিক পরিবেশে রুশান বেশিক্ষণ থাকা উচিৎ মনে করলো না।তাই খেয়েই চলে গেলো।
সন্ধ্যাবেলা ভিনা সোহেলকে ডেকে নিজের ঘরে আনলো।
-বাবা,তুমি রুশানকে এ বাসায় কেন এনেছো?
-তুমি রুশানকে এত অপছন্দ কেন করো সেটা আগে বলো।
-পছন্দ করার মত কী আছে?
-তুমি কি কাউকেই পছন্দ করো না?তোমার বন্ধুবান্ধব কম কেন?
-এত বন্ধু দিয়ে আমি কী করবো?
-ভিনা তুমি যে স্বাভাবিক আচরণ করছো না,সেটা কি তুমি জানো?
-আমি এমনই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি বাবা।
-না।এসব মাহভিনের জন্য হয়েছে।তুমি তোমার অতীত নিয়েই পরে আছো।
-সবকিছুতে মাহভিনকে কেন টেনে আনছো বাবা?
-কারণ মাহভিনই এসবের কারণ।আমি ওকে দোষারোপ করছি না।ও ছোট বাচ্চা,কিন্তু ওর কারণে নিজের জীবনকে অনেক ইফেক্টেড করছো তুমি।
-তোমার ভুল ধারণা এটা।
-এতকিছু জানি না।তুমি হোস্টেলে যাচ্ছো।
-ঠিকাছে।যাবো,কিন্তু আমি যেখানে থাকতে চাবো,সেখানেই দিতে হবে।
-কোথায় থাকতে চাও?
-আমি জানাবো তোমাকে।এতটুকু আমাকে স্বাধীনতা দিতে হবে।
-ঠিকাছে....দিলাম।
-ধন্যবাদ।
সোহেল রুম থেকে চলে যাওয়ার পর ভিনা নিজের পুরোনো মোবাইল খুঁজে বের করলো।সিম না থাকলেও ফোন রেখে দিয়েছে।ফোনের ডায়াল নাম্বার গুলোতে যাবিরের নাম্বার রয়েছে।সেগুলো ছাপিয়ে ভিনা প্রিতির নাম্বার খুঁজে বের করলো। গেলে এ মানুষটার কাছেই যাবে।
ফোন নাম্বার নিয়ে ভিনা ডায়াল করলো নিজের নতুন নাম্বার থেকে।দোয়া করছে,যেন প্রিতি ফোন ধরে।
.
.
.
চলবে..................................................................