আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন। বাড়ির কাছেই স্কুলটা ছিল আমার। তাই প্রতিদিন একাই যাওয়া আসা করতাম। স্কুলে যেতে আমার খুব ভালো লাগত। কারনটা পড়া লেখা ছিল না।
পড়া লেখায় আমি বরাবরই কাঁচা ছিলাম। ডাক্তার, ইন্জিনিয়ারিং হবার কোনও শখ কোনও কালই ছিল না। তাই পড়া লেখায় এত সিরিয়াস কখনো হইনি। কিন্তু এতটুকু বুঝতাম আজকাল একজন মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য পড়ালেখা করাটা অতন্ত্য জরুরি।তাই চালিয়ে যেতাম।
স্কুল আমার প্রিয় জায়গাটার মধ্যে একটি ছিল। কারন এখানে এসে আমি বিন্দাস চলতে পারতাম। বাসায় তো মায়ের বকনি থাকে ননস্টপ, আর রায়হান ভাইয়ের শাসন। উফ!
আমি এদের জ্বালায় হাফিয়ে উঠতাম।
'ভালোর মধ্যে ছিলাম আমি আর বাবা। বাবা বরাবরই নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করত তাদের মাঝে। তবে আমায় অনেক আদর করত। এই মানুষটিকে সব সময় আমার পাশে পেয়েছি। আমি যতই ভুল করিনা কেন, বাবা একটি হাসি দিয়ে শুধু বলত………ভুলই তো করেছে, কারো খুনত করেনি। বাদ দেও……………।
মা তখন বাবার উপর চরম বিরক্ত হতো। অথচ বাবার তাতে কোনও রিয়েকশন হতো না।'
বাবার পরে কেউ যদি আমায় বুঝতো তারা হলো আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ডসরা। আর এই ফ্রেন্ডসদের সাথেই আড্ডা, আর মাঝে মাঝে টিচারদের সাথে কিছু দুষ্টুমি করে দিনগুলো ভালোই চলছিল।
কিন্তু একদিন ঘটল এক অঘটন। আমি স্কুল ছুটির পর আমার কিছু ফ্রেন্ডসদের সাথে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছিলাম। ইউসুফ চাচার ঝালমুড়ি। আমাদের এলাকার বেস্ট ঝালমুড়ি উনি বানায়। শুধু আমাদের এলাকা না, তার ঝালমুড়ি খেতে অন্যান্য জায়গা থেকে লোকজন এসে ভিড় জমাতো।
এতদিন অবশ্য উনি ছিলেন না। শুনেছিলাম চাচা না-কী গ্রামে গিয়েছিল। উনার একমাত্র মেয়ের বাচ্চা হবে। তাই চাচাও এতদিন মেয়ের সাথেই ছিল। এত দিন পর চাচাকে পেয়ে সবাই ভিড় জমালো আবার।
আমিও চাচার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, চাচা খুব প্রাণবন্ত মানুষ। সবার সাথে খুব সুন্দর করে হেসে কথা বলে।তার সাথে কথা বলে কেউ বুঝতেই পাড়বে না, উনি অশিক্ষিত।
যেখানে আমাদের সমাজে শিক্ষিত লোকগুলো নিজের শিক্ষার অহংকারে এমন ভাব করে যে, অল্প শিক্ষিত মানুষ গুলো কে নগন্য মনে করে। কিন্তু তারা কেন বুঝে না, শিক্ষিত হলেই মানুষ হওয়া যায় না, মানুষ হতে হলে আগে নিজের মনুষ্যত্বকে জাগাতে হবে।
যাই হোক____আমাকে দেখে চাচা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, 'কেমন আছো মামুনি?'
'আলহামদুলিল্লাহ চাচা, জবাবে বললাম। আপুরতো বেবি হয়েছে! কী বেবি?'
চাচা আমার দিকে তাকিয়ে হাসিটা আরো একটু বড়ো করে বলল, 'একটা রাজকন্যা হইছে। দেখতে জানো একদম তোমার মত। টোকা দিলেই মনে হয় এহনি রক্ত ঝড়বে।'
আমিও চাচার কথায় একটা মিষ্টি হাসি দিলাম। কিন্তু আমার সেই হাসিটা হয়তো একজনের একদমই পছন্দ হয়নি। তার গায়ে জ্বালা বাড়িয়ে দিয়েছে। হঠাত কিছুর শব্দ ফেলাম। শব্দটা ছিল থাপ্পরের। কেউ আমাকে খুব জোরে একটা থাপ্পর মারল। না চাওয়া সত্যেও চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি পড়ল।
এতগুলো মানুষের সামনে কে এটা করল, তাকে তো আজ আমি মেরে কাবাব বানিয়ে রাস্তার কুকুর বিড়ালদের খাওয়াবো। এমন আকাশ পাতাল চিন্তা করে সামনে তাকাতেই আমার সব রাগ ফুস হয়ে হাওয়ায় উড়ে গেল।
এই প্যারা কোথা থেকে আসল, নিজের অজান্তেই মুখ ফসলে বলে ফেললাম।'
একজোড়া রক্তিম চোখ আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে এখনি আমাকে চিবিয়ে শরবত বানিয়ে চিনি ছাড়া খেয়ে ফেলবে। আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করতে যাব, তার আগেই জিসান নামের এই প্যারা আমার হাতটা ধরে টেনে বাইকে বসাল।
উনার এমন রুড বিহেভিয়ার আমার একদম পছন্দ না।সবসময় আমার সাথে এমন কেন করে? আমার সব বিষয় তার নাকটা না ঢুকালে কী হয় না।
নাহ! সে তবুও ঢুকাবে। কেন রে ভাই তুই আমার কে?শুধু ভাইয়ের বন্ধু বলে সহ্য করি। কিন্তু সব কিছুর একটা সীমা থাকে।
'বাইক বাসার সামনে এসে থামলে, আমি তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দৌঁড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলাম।'
•
মনটা ভীষন খারাপ, তাই ছাদে খোলা চুল গুলো ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছি। হালকা মৃদু বাতাস এসে চুলগুলোর সাথে যেন খেলা করছে। দূরের আকাশে কিছুটা মেঘ জমে যাওয়ায় সূর্যের গ্লানিটা কম লাগছে। মন ভালো করার মত একটা পরিবেশ, কিন্তু আমার মনটা ভালো নেই। একদম ভালো নেই।
একটুকরো ঘনকালো মেঘ যেন আমার মনের বাগানকে ঘিরে রেখেছে। আর যে কোনও সময় সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি নেমে পড়বে, আর আমাকে ভিজিয়ে দেবে। আর এতে আমার ঠাণ্ডা, কাশি,জ্বর হলেও কারো কিছু আসে যায় না। ঠিক যেমন আজ হলো।
আজকের ঘটনা জানার পরও রায়হান ভাইয়ের নিরব ভূমিকা আমার ছোট্ট মনটাকে অভিমানে ভরিয়ে দিল।রায়হান ভাইয়ের কাছে বোনের থেকে বন্ধুর মূল্যটা মনে হয় বেশি, তাইতো এমন করল।
শুধু কী রায়হান ভাই, আমার মায়েরও তো একই অবস্থা। জিসান বলতে পাগল সে। আমার মায়ের নজরে জিসান ভাই যা করে তাই ঠিক, তার কোনও কাজ ভুল হতেই পারে না। সে তো যথারীতি সবাইকে বলেই বেড়ায় তার দুটো ছেলে। রায়হান আর জিসান।
আমি যে তার এক মাত্র মেয়ে তার সামনে বার বার উঁকিঝুঁকি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি, আমার নামটাও বলো একবার, তাহলে জনসাধারণ মানুষ আমাকেও একটু চিনতে পারবে। কিন্তু নাহ!
প্রত্যেক বারের মত আমার ভাবনায় মা এক বালতি জল ঢেলে বলবে,
'কী এমন অসাধারণ কাজ করেছিস তুই, যে তোর নামের ঢোল পিটাব। আরে একবার তো ক্লাশে প্রথম হয়ে দেখা, তখন দেখবি আমি কী করি। এলাকার প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে তোর সুনামের জয় জয় করে বেড়াবো। দরকার পড়লে, তোর ছবিও দিয়ে আসব, যাতে রাস্তা ঘাটে সবাই তোকে চিনতে পারে।'
মায়ের এমন কথায় বারাবারের মত আমার এই পিচ্ছি মনটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম এই জনমে আমি ক্লাশে প্রথম হতেও পারব না, আর মায়ের মুখে নিজের জয়ধ্বনি শোনাও হবে না। হায়রে আমার কপাল! উনি থাক উনার দু'ছেলে নিয়ে।
জিসান ভাইয়ের প্রতি আমার মায়ের এই অগাধ ভালোবাসার একটি কারন আছে। জিসান ভাই রায়হান ভাইয়ের বাল্যকালের বন্ধু। তারা স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সব জায়গায় এক সাথে ছিল। এত বছরেও তাদের বন্ধুত্ব্যের কোনও ফাটল ধরেনি, বরং বেড়েছে।
মায়ের মুখে শুনেছিলাম, রায়হান ভাই আর জিসান ভাই যখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়তো, তখন একদিন স্কুল ছুটির পর দু'বন্ধু স্কুলের পাশের মাঠে ক্রিকেট খেলছিল। খেলার সময় হঠাত বলকে জোরে মারায় বল মাঠ থেকে রাস্তায় গিয়ে পড়ল।
রায়হান ভাই বেখায়াল হয়ে বলটা নিতে গেল। সামনে আসা ট্রাকটার দিকে কোনও ধ্যান ছিল না তার। কিন্তু জিসান ভাই ঠিক সময় এসে রায়হান ভাইকে ধাক্কা মারে। রায়হান ভাইয়ের কিছু না হলেও জিসান ভাই প্রচণ্ড ব্যাথা পায় সে দূর্ঘটনায়।"
এরপর থেকেই জিসান হয়ে উঠে আমার পরিবারের সরিষা ফুল। আর আমি হলাম তাদের বাগানের কাঁটা।আমাকে কেউ ভালোবাসে না। কেউ নাহ!
হঠাত মনে হলো আমার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি জিসান ভাই পেন্টের পকেটে হাত ডুকিয়ে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। আমি তাকাবার সাথে সাথে চোখগুলো অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল, 'এখানে কী করছিস তুই?'
আমি তার কথা শুনেও না শোনার ভান করে চলে যেতে চাইলাম। শুনবো না তার কথা। কেন শুনবো? আমাকে মেরে এখন ঢং করতে এসেছে।
কিন্তু কপাল আমার! পারলাম কোথায় আর যেতে। তার আগেই জিসান ভাই আমার হাতটা ধরে আটকে ফেলে। আমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে বলে____'এক কদমও নড়বি না, আমি না বলা পর্যন্ত।'
না চাইতেও দাঁড়াতে হবে। কারন তার কথা না শুনলে, নিজের কপালে নিজের কুড়াল মারা সমান। কখন না জানি কী করে বসে আল্লাহই ভালো জানে। আবার না মেরে বসে।
জিসান ভাই খুব গম্ভীর কন্ঠে বলল, 'বড়ো হচ্ছিস, শরীরের গঠনরূপে পরিবর্তন আসছে, এখনো কী তোকে বলে দিতে হবে রাস্তাঘাটে কীভাবে চলা ফেরা করতে হবে। নিজের ভি বেল্টাকে ও সামলাতে পারিস না। তাহলে পরিস কেন?
'জিসান ভাইয়ের এ কথায় আমি উনার দিকে আর চোখে তাকালাম। এখন মাথার সব নাটবল্টু গুলো কাজ করতে শুরু করল। আমি এতক্ষনে বুঝতে পারলাম, পাবলিকের সামনে আমাকে পেটানোর রহস্য কী?'
বুঝতে পেরে সাথে সাথে আমি লজ্জায় মাথাটা নিচু করে ফেললাম। ছি! এমন দূর্ঘটনা গুলো অলটাইম জিসান ভাইয়ের সামনেই কেন হয়।
তখন নিশ্চয়ই সবাই দেখেছে, সাথে জিসান ভাইও। ছি! কী লজ্জার বিষয়। ।আমার তো মাটি খুঁড়ে ডুব দিতে মন চাইছে।
আমার অবস্থা বুঝে জিসান ভাই বলল, 'আজ লাষ্টবার বলছি, এর পরও এমন ভুল দেখলে, আর এমন বেখায়াল ভাবে চলাফেরা করলে, তোর জন্য ভালো হবে না। আমাকে ভালো করেই জানিস তুই।
তোর ঘরে দু'টো সাদা ওড়না এনে রেখেছি। কাল থেকে ও গুলো পড়ে স্কুলে যাবি।'
আমি কী বলেছি শুনতে পেয়েছিস। একটু চিত্কার করেই বলল শেষের কথাটা।
''আমি তার ধমকে একটু কেঁপে উঠলাম, মাথা নেড়ে দ্রুত গতিতে হাঁ বললাম।'
'এখন রুমে যা, কিছুক্ষন পর সন্ধ্যার আযান দিবে। এই সময় কখনো ছাদে আসবি না। রুমে গিয়ে পড়তে বস।'
'তিশা আর এক মিনিটও অপেক্ষা করেনি। জান হাতে নিয়ে দৌঁড়ে নিচে চলে গেল।'
•
আজ জিসান ভাইয়ের পুরো পরিবার আসছে আমাদের বাসায়। শুধু তাওহিদ ভাইয়া ছাড়া। নিজের বিয়ের দাওয়াত নিজে দিতে হয়তো লজ্জা পাচ্ছে তাই হয়তো আসেনি।
'আর এছাড়া তাওহিদ ভাই খুব ব্যস্তও থাকে। জিসান ভাই থেকে তিন থেকে চার বছরের বড়ো হবে উনি।বিদেশ থেকে ডাক্তারী পড়ে এসেছে। এখন নিজেদের হাসপাতালের পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে।
ঢাকা শহরে প্রায় তিন তিনটি হাসপাতাল তাদের। এর মধ্যে একটাতে গরীব দুঃখীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়। এসব হাসপাতাল গুলো তাওহিদ ভাইয়া এখন একাই সামলায়। খুব বাস্তববাদী মানুষ না-কী তিনি। রায়হান ভাইয়ার মুখ থেকে শুনেছিলাম'
যাই হোক, তার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তানজিলা আপুর সাথে। তানজিলা জিসান ভাইয়ের বাবার বন্ধুর মেয়ে।দেখতেও বেশ সুন্দর।
তাওহিদ ভাই নিজের বাবা মায়ের পছন্দেই বিয়ে করবে বলে, কারো কোনও সমস্যা নেই এই বিয়ে নিয়ে। বিয়ে এক মাস পর। তাই কার্ড দেওয়া এখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে।
আমি মাত্র কোচিং থেকে বাসায় আসলাম। এসেই দরজার সামনে এত মানুষের জুতো দেখে মনে মনে ভাবলাম কে আসল এই সময়। চিন্তা করতে করতে কলিং বেল বাজাতে লাগলাম।
হঠাত চোখ গেল সামনের বিল্ডিং এর দিকে। কয়েকজন প্রতিবেশি উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে, হয়তো তাদের মনেও আমার মত কিউরিসিটি কাজ করছে।
আমি হাসতে হাসতে দরজা ধাক্কাতে যাব তার আগেই কেউ দরজাটা খুলে ফেলে আর আমি তার উপর পরে যেতে নিলেই সে আমার বাহু দু'টো ধরে ব্যালেন্স করে দাঁড় করায়। জিসান ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমিও তাকে দেখে একটা শুকনো হাসি দিয়ে ঘরে ডুকলাম।
ঘরে ডুকে জিসান ভাইয়ের পরিবারকে দেখে আমি শকড! পরে জানতে পারলাম তারা দাওয়াত দিতে না-কী এসেছে। জিসান ভাইয়ের মা আমাকে তার কাছে বসাল, আমার মাথাটা টেনে কপালে একটা আদর দিল। তার আমার প্রতি এতটা ভালোবাসা খুবই মুগ্ধ করল। উনি আসলেই অনেক ভালো, কিন্তু উনার মত ভালো মানুষের ঘরে এই তিতা করলা(জিসান)কোথা থেকে এল এটা বুঝতে পারছি না।
জিসানের মা তিশার মুখটা দুহাতে নিয়ে বলল, 'আমার ছেলেটা একদম ঠিকই বলেছে, তুমি আসলেই একটা চাঁদের টুকরা। তোমার হাসিতে মায়া লেগে আসে।'
'আমিতো তার কথা শুনে অবাকের চরম সীমায়।জিসান ভাই এসব বলেছে তার মায়ের কাছে আমার সম্পর্কে। বাট হোয়াই!'
'আমি আর চোখে জিসান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম,সেও নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। হয়তো লজ্জা পাচ্ছে। আমি তার এই হাসির রহস্য তখন বুঝতে পারিনি।'
'নিশি আর তিশা তো সেম বয়স তাই না আপা। তিশার মা বলল।'
'হুম, শুধু দুতিন মাসের বড়ো ছোটো ওরা।'
জানো তিশা তুমি যেদিন হয়েছিলে, রায়হান তো ভয়ে তোমাকে কলেই নিতে চায়নি। জিসানকে ফোনদিয়ে বলে, 'জানিস জিসান, বাবা না আমার জন্য একটা পুতুল নিয়ে এসেছে। একদম তুলতুলে পুতুল। একদম রুপকথার গল্পের পরীর মত দেখতে এই পুতুলটা।'
তখন জিসানও জেদ করে, 'সে এই মুহুর্তে এই পুতুলকে দেখবে। ওকে অনেক বুঝানোর পরও যখন শুনছিল না, তখন বাধ্য হয়ে রাত ১১ টায় তোমার আংকেল ওকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। রায়হান কোলে না নিলেও সেদিন তোমাকে জিসান কোলে তুলে নিয়েছিল।'
'আর তখনি সে আরেক আবদার করে বসে, এই পুতুল তার চাই। সে কাউকে তার পুতুল ধরতে দিবে না। এই পুতুল না-কী শুধু তার। রায়হান কে তো যথারীতি ধমকাতে লাগল, আজ থেকে এটা শুধু তোর পুতুল না, আমার ও। আমরা দু'জনি ওকে আগলে রাখব আজ থেকে। ঠিক আছে।'
আন্টির মুখে এসব কথা শুনে কেনো জানি খুব লজ্জা লাগছিল আমার। জিসান ভাইয়ের দিকেও তাকাতে পারছিলাম। জিসান ভাইয়ের মনে আমার জন্য এমন চিন্তাতো আমি কখনো কল্পনাও করেনি। কারন আমার কাছে জিসান ভাইকে টেবিলে পড়ে থাকা সেই ডিকশনারিটার মতচ মনে হতো, যেটার উপকারিতা থাকলেও পড়তে বরই বোরিং লাগে।
আমার কানে এখনো সেই কথাটা বাজছে, আমরা দু'জনেই ওকে আগলে রাখব। হুম,আগলেই তো রেখেছে।
জিসান নামক প্যারাটি আমার সমস্ত জীবনে জড়িয়ে আছে। ছোটোবেলা থেকেই আমি তার কড়া শাসন পেয়ে আসছি। উনি আমার সাথে ভালো করে একটু কথা বলেছে এমন কোনও দিন মনে নেই আমার। মনে পড়বেই বা কীভাবে,জিসান ভাই এমন কখনো করেনি।
সব সময় আমার উপর চিল্লাচিল্লি, হাউকাউ ছাড়া কিছুই বলত না। এখানে যেতে পারবি না, ওখানে যেতে পারবি না। এটা কেন করিস? ওটা কেন পরিস? উফ!......আমার পুরো লাইফ শুধু তার বিধিনিষেধ মানতে মানতে পার হয়েছে। উনি আমার কাছে একটা বিষাদময় মাথা ব্যাথা ছাড়া আর কিছুই না। আর এই মাথা ব্যাথা থেকে মুক্তি চাই আমি।
•
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল, এই এক মাস আমি একটু ভালোই ছিলাম। কারন জিসান ও রায়হান ভাই দু'জনেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো বিয়ের আয়োজনে। তাই আমাকে নিয়ে তাদের টেনশন টা একটু কম ছিল।আর আমার কাছে মনে হলো কত বছর পর আমি যেন কারো খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমিও আমার মন মর্জি মত চলতে লাগলাম।
দুদিন ধরে মায়ের কানের সামনে ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছি, শপিং এর জন্য। শপিং না করে দিলে বিয়েতে যাব না বলে দিলাম।
কিন্তু আমার মা বলে কথা। আমার কথা যেন কান দিয়ে যায়ই না তার। হতাশ হয়ে নিজের রুমে বসে হেডফোন কানে দিয়ে গান শুনছিলাম।
কিছুক্ষন পর মা কতগুলো শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে রুমে ডুকল। আমি মাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব তার আগেই মা বলে উঠল, নে তিশা তোর শপিং। গায়ে হলুদ, বিয়ে, বৌভাতে কী কী পড়বি সব আছে।
আমি পেকেটগুলো খুলে শকড এর উপর শকড হলাম।কারণ প্রতিটা ড্রেস অসাধারন। আর আমার পছন্দের রঙের। এর সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি ও আছে।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম, আমার মায়ের চয়েজ এত উন্নত হলো কী করে। আর মা শপিং করতে গেল কখন।আর আমাকে নিল না কেন?
.
.
.
চলবে……….......................................................