দেজাভ্যু?
না,কারণ আগের ঘটনা কোনো কল্পনা ছিলো না।আগেও ঠিক এমন পরিস্থিতিতে পরেছিলো ভিনা।এভাবেই একজন গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো।ভিনা চোখ মেলে রুশানের দিকে তাকিয়ে আছে। রুশান ভীষণ ছটফট করছে,ড্রাইভারকে দ্রুত গাড়ি চালাতে বলছে।ভিনার হাত ছাড়ছে না এক মুহূর্তের জন্যও।
গতবার গাড়িতে যাবির আর নওমি ছিলো।যাবির ছিলো ধীর স্থির ধরনের মানুষ। ও গাড়িতে বসেই ওর বন্ধু তানভিরকে বলেছিলো পুরো ঘটনা,যেন হস্পিটালে পৌঁছানো মাত্র ট্রিটমেন্ট শুরু হয়ে যায়।এছাড়া কোনো অস্থিরতা ছিলো না।
এবার দুইজনের কেউই নেই।নওমিও বেশ কষ্ট দিয়ে দূরে সরে এসেছে, আর যাবির পুরো জীবনই এলোমেলো হয়ে করে দিয়ে গেছে।তবুও এদের দুইজনের অনুপস্থিতি প্রচন্ড পীড়া দিচ্ছে।ভিনার চোখ থেকে পানি পরা থামছে না।একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি জীবনে কেন হলো,ভিনা বুঝতে পারছে না।
-অনেক বেশি ব্যাথা করছে ভিনা?আর কিছুক্ষণ, এরপর ই আমরা হস্পিটালে চলে আসবো।পানি খাবে একটু?
ভিনা মাথা নাড়ালো,এরপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো।রুশান ওর হাতের কব্জি বারবার চেক করছে।বোকা ছেলে!এত সহজে কি মৃত্যুআকাঙ্ক্ষী মানুষের মৃত্যু হয়?
•••••••••••
হস্পিটালে পৌঁছে ভিনা ইনফরমেশন ডেস্কে ডাক্তার সোমার নাম্বার চাইলো।রিসেপশনিস্ট জানালো,ডাক্তার সোমার আজকে চেম্বার নেই।
ভিনা রাগ হয়ে বললো-
-আমি নাম্বার চেয়েছি,জিজ্ঞেস করিনি চেম্বার আছে নাকি।নাম্বার দিন আমাকে।
অগত্যা রিসেপশনিস্ট বেশ সময় লাগিয়ে নাম্বার দিলো ভিনাকে।ভিনা একটা চেয়ারে বসে ডাক্তার সোমাকে কল দিলো।রুশান পাশেই বসে আছে,এক হাত দিয়ে ভিনাকে ধরে রেখেছে।প্রায় দশ বারো বার কল দেয়ার পর উনি কল রিসিভ করলেন।
-ম্যাম,আমি ভিনা বলছিলাম।
-ভিনা?হু ভিনা?
ভিনা লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেললো।রুশান পাশেই বসা। কী বলে ব্যখ্যা দিবে বুঝতে পারছে না।কিছুক্ষণ সময় নিয়ে অবশেষে উত্তর দিলো-
-মিসেস জুয়েলের ভাতিজি,ভিনা।
-আচ্ছা আচ্ছা!বলো ভিনা।এতবার ফোন দিলে,কোনো ইমার্জেন্সি?
-হ্যাঁ ম্যাম।আমার তলপেটে ভীষণ ব্যাথা করছে।আর প্রচুর ব্লাড ক্লট যাচ্ছে,আমি ভেবেছিলাম পিরিয়ড,কিন্তু আমার খেয়াল হলো যে পিরিয়ডের ডেট এখনো আসেনি।
-মাই গুডনেস!তুমি এখন কোথায় আছো?
-সেন্ট্রাল হস্পিটালে।
-থাকো ওখানে,আমি আসছি।
ভিনা ফোন রেখে হেলান দিয়ে বসলো।পরে খেয়াল হলো রুশানের হাতে মাথা দিয়ে বসেছে,তাই তৎক্ষণাৎ মাথা সড়িয়ে ফেললো।
-থ্যাংক্স রুশান।এখন যাও তুমি।বাকীটা আমি হ্যান্ডেল করে নিবো।
-কী যাবো?কোথায় যাবো?
-বাসায় যাবে।
-তোমাকে একা ফেলে?কখনো না।
-আমি ছোট বাচ্চা না রুশান।
-তবুও আমি এই অবস্থায় একা রাখতে পারবো না তোমাকে।তোমার বাসায় ফোন দিয়েছো?
-দিবো।বাবা বাইরে আছে একটু।
-তো?উনাকে এখানে আসতে বলছো না কেন।
-বাবা মাহভিনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে।
-মাহভিন কে?
ভিনার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না।এত প্রশ্ন কেন করে ছেলেটা?তবুও উত্তর দিতে হলো।
-মাহভিন আমার ছোট বোন।
- মিথ্যা কথা।তুমি একা ছিলা না?
-ওর বয়স আট মাস।
-আচ্ছাআআআ....
রুশানের চোখে মুখে বিস্ময়। ভিনার এত ছোট বোন হবে ধারণা করেনি।ভিনার বয়সে কত মানুষের নিজেরি তো বাচ্চা হয়ে যায়।এসব ভেবে শেষে মুচকি হাসলো।
-কী ব্যাপার? কী হয়েছে?
-আঙ্কেলের মনে হয় বাচ্চা কাচ্চা অনেক পছন্দ তাইনা?
ভিনা এক দৃষ্টিতে রুশানের দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়ের ভয়বহতা বুঝতে পেরে রুশান তাই চুপ হয়ে গেলো। তবে বেশিক্ষণ নীরবতা পালন করা রুশানের মত চঞ্চল ছেলের পক্ষে সম্ভব না,হলোও তাই।
-শোনো ভিনা।আমি চাই তোমার মাইন্ড ডাইভার্ট হোক।তোমার ব্যাথা যে আনবেয়ারেবল,সেটা তোমার গায়ের জ্বর দেখেই আমি বুঝে গিয়েছি।এছাড়া অন্য কোনো মিনিং এ আমি কথা বলিনি।
ভিনা আর কথায় কর্ণপাত করলো না,অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো।কিছুই ভালো লাগছে না।সারাজীবনে যাদের সঙ্গ চেয়ে এসেছে,তাদের কাউকেই নিজের জীবনের সাথে বেঁধে রাখতে পারেনি। শুধুমাত্র একজন মানুষের মৃত্যু কীভাবে যেন সব পরিবর্তন করে দিলো।আজকে শিউলি বেঁচে থাকলে না সোহেল দ্বিতীয় বিয়ে করত,না যাবিরের সাথে ওর সম্পর্ক এভাবে শেষ হয়ে যেত,না মাহভিন আসত....
যদিও মাহভিনের জন্মকে কখনো ভিনা অভিশাপ হিসেবে নেয়নি।কিন্তু আক্ষেপ একটাই,ভুল সময়ে এই পৃথিবীতে এসেছে বাচ্চাটা।নাহলে নিজের মেয়েকে নিজের বুকে আগলে বড় করতে পারত।মাহভিন এভাবে না আসলে,আজকে হয়ত যাবিরও ওর সাথে থাকত।কিন্তু তখন যাবিরের আসল রূপ দেখা সম্ভব হত না।ভুল মানুষের সাথে জীবন কাটানোর পর হয়ত উপলব্ধি হত।তাহলে যা হয়েছে তাতো ভালোই হয়েছে।ভালো হওয়ার পরও কেন সুখি না ভিনা?কিসের হাহাকার এত বুকে?
এসব ভাবতে ভাবতেই ডাক্তার সোমা এসে পড়লো।ভিনাকে হুইল চেয়ারে করে রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।রুশান বাইরেই অপেক্ষা করছে।
-ওয়েল,খুলে বলো কী হয়েছে।ফোনে কিছুই ঠিকমতো শোনা হয়নি।
-তলপেটে ভীষণ ব্যাথা। সহ্য করার মত না।জায়গাটা ফুলেও গেছে খানিকটা,ব্লাড ক্লট ও যাচ্ছে।
-তোমরা অল্প বয়সী মেয়েরা যে কী যন্ত্রণা করো,বলার মত না।সিজারের পর তোমাকে বলেছিলাম কিছুদিন রেস্টে থেকে বেশি মুভ না করতে,তুমি শোনোনি আমার কথা।আবেগ দিয়ে নিজেদের জীবন শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি নেই।এখন বলো,রিসেন্টলি ব্যাথা ট্যাথা পেয়েছিলে নাকি?
-হ্যাঁ, মানে মাহভিন,আমার মেয়ে,ওকে কোলে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে তলপেটে টান পরেছিলো বেশ জোরে।
-যাও,ওই বেডে শোও।
ভিনা কোনোমতে টেবিল ধরে ধরে বেডে যেয়ে শুয়েছে।ডাক্তার সোমা অনেক্ষণ এক্সামিন করার পর বললেন-
-এন্ড্রোমেট্রোসিস হয়েছে মনে হচ্ছে।সিজারের জায়গার আশেপাশের টিস্যুগুলোতে ইনফ্ল্যামেশন হয়েছে।এটা শুধু মাসল পুলের জন্য হয়নি।সিজারের দীর্ঘদিন পর খুব সংখ্যক মানুষের এমন হয়।বাই দা ওয়ে এসেছো কার সাথে?
-ফ্রেন্ড....
-ছেলে না মেয়ে?
-ছেলে....
-জানে তোমার সিজারের ব্যাপারে?
-না।আমার ক্লাসমেট আসলে।ওর গাড়ি ছিলো দেখে নামিয়ে দিয়ে গেছে।
-চলে গেছে?
-এতক্ষণে চলে যাওয়া কথা।কেন?
-তোমাকে হস্পিটালে ভর্তি হওয়া লাগবে।
ভিনা করুণ গলায় বললো-
-শুধু মেডিকেশনে গেলে হয় না?ভর্তি হওয়া জরুরি?
-তোমার কি তাড়াতাড়ি মারা যাওয়ার অনেক ইচ্ছা?এখন তো অন্তত আমার কথা শোনা উচিৎ।
-ঠিকাছে....
-বাসায় জানিয়েছো?
-না...
-জানিয়ে দাও।আমি রিসেপশনে বলে দিচ্ছি,এ্যজ সুন এ্যজ পসিবল একটা এসি রুমের ব্যবস্থা করতে।এখন আপাতত ওয়ার্ডে রাখছি।
সময় নষ্ট না করে ডাক্তার সোমা ওয়ার্ড বয়কে কল করে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বললেন।ভিনা পেটে হাত দিয়ে হুইলচেয়ারে চুপচাপ বসে থাকলো।মাথা পুরো শূন্য হয়ে গেছে।হস্পিটালে ভর্তি হওয়া মানে মুনার সত্যিটা জেনে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়া।
ওয়ার্ডে শিফট করার পর একজন ডাক্তার এসে হাতে ক্যানোলা লাগিয়ে দিলো।এরপর একটা ইঞ্জেকশন দেয়ার পনের মিনিট পর স্যালাইন লাগিয়ে দিলো।পুরো সময় রুশান পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো।হাতে স্যালাইন দেয়ার সময় কিছু পরিমাণ রক্ত টিউবে এসে পরেছিলো।এসব দেখে রুশান তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে।এরপর ভিনা চুপ করতে বলার পর রুশান শান্ত হলো।এরপর চেয়ার টেনে এনে ভিনার পাশে বসে আছে।
-কিছুই বুঝলাম না। তোমাকে হস্পিটালে থাকতে হবে?হটাৎ করে এখানে নিয়ে আসলো যে?
-হ্যাঁ।
-কী হয়েছে? একটু বলো আমাকে?হস্পিটালে কেন ভর্তি হতে হচ্ছে?
-সবকিছুতে ইন্টারফেয়ার করতে নেই রুশান।তোমার বুঝতে হবে তুমি একটা ছেলে।বন্ধু হিসেবে যতটুকু দায়িত্ব পালন করা দরকার,তার চেয়ে বেশি করেছো।এবার যেতে পারো তুমি।
-প্রশ্নই আসে না।তুমি এখনো বাসায় জানাও নি।বাসা থেকে কেউ আসার পর আমি যাবো।
ভিনা তর্কে গেলো না।কীভাবে পুরো বিষয়টা সামলানো যায়,তাই ভাবছে।অবশেষে অনেক্ষণ ভাবার পর সোহেলকে ফোন দিয়ে সব জানালো।
.
.
.
চলবে.....................................................................