সোহেল গম্ভীর মুখ নিয়ে ভিনার পাশে বসে আছে।বিকালের দিকে হুট করে ভিনা ফোন দিয়ে সব জানিয়েছে।মুখ অভিব্যাক্তিহীন রেখে বাসা থেকে বের হওয়া খুব কঠিন ছিলো।মুনা একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলো,পুরো মুখে আতঙ্ক ছিলো ওর ।সোহেল জানানো বলতে শুধু তলপেটে ব্যাথার কথা জানিয়েছে,কিন্তু মুনা সেটাকে অন্যভাবে নিয়েছে।সে ভাবছে ভিনার সাথে নিশ্চয়ই খুব খারাপ কিছু হয়েছে।বার বার ঘুরে ফিরে অস্থির হয়ে একটা কথাই বলছিলো,এত খারাপ দিনে এভাবে বের হওয়া উচিৎ ই হয়নি,এমন দিনে ভার্সিটিতে মানুষ জন খুব কম থাকে,কেন গেলো মেয়েটা।সোহেল চাইলেও বুঝাতে পারছে না কিছু,কারণ সত্যিটা এর চাইতেও কঠিন।
-দেখো একা যাবা না।আমাকে নিয়ে যাও।ওর পাশে একজন মেয়ে মানুষ থাকা প্রয়োজন।
-ছেলে মানুষ মেয়ে মানুষ কী?আমি ওর বাবা।বাবা বাবাই হয়।
-আমি ওর মা।আমাকে ওর প্রয়োজন বেশি।
এই অবস্থাতেও সোহেল হাসলো।আজকের এই উপলব্ধি মুনার আগে আসলে তার মেয়ের জীবন কত সহজ হয়ে যেত।আজকে হাসপাতালে ও থাকতে হত না।মানুষের উপলব্ধি আসে,কিন্তু এত দেরীতে কেন?অসময়ের উপলব্ধি পৃথিবীর অন্যতম মূল্যহীন ব্যাপার।
-তুমি এখন গেলে মাহভিনকেও নিয়ে যেতে হবে।আমি এটা চাচ্ছি না।পরে অসুস্থ হয়ে গেলে?
মুনা এ কথায় কিছুটা থামলো।তবুও যেতে চাচ্ছে ভীষণ। মুনার মুখ দেখে সোহেল বললো
-এক মেয়ের জন্য আরেক মেয়েকে কেন কষ্ট দিবা?তোমার তো ওখানে কোনো কাজ নেই,যা করার ডাক্তাররাই করবে।তুমি ঘরে থেকে দোয়া কালাম পড়ো।আমি ওখান থেকে ফোন দিয়ে জানাবো সব।
এই বলে সোহেল চলে গেলো হস্পিটালে।ইঞ্জেকশন দেয়ার পর ভিনার ব্যাথা অনেক খানিই কমে গেছে।তাই ঘুমিয়ে গেছে আধা ঘন্টা পরেই। সোহেল যখন ওয়ার্ডে আসলো তখন মেয়ের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে বেশ মায়া লাগলো।পাশে থাকা নার্সকে জিজ্ঞেস করলো ভিনার ব্যাপারে।
- ভারী জিনিস উঠাতে গিয়ে তলপেটে টান খেয়ে ইনফ্ল্যামেশন হয়েছে বোধহয়।
এতটুকু বলেই নার্সটা চলে গেলো অন্যদিকে।ডিউটি মাত্র শুরু হয়েছে।এত ব্যাখ্যা কে দেয়।
সোহেল চিন্তায় পরে গেলো।ভেবে দেখলো কোথায় সূত্রপাত এই ব্যাথার।খেয়াল হলো,গত পরশু মাহভিন কে কোলে রেখেছিলো সারাদিন।চিন্তার ভাজ পরলো কপালে, নিজের মেয়েকে নিয়ে অবসেসড হয়ে জীবনটাই না একা কাটিয়ে দেয়।এর একটা বিহিত করতেই হবে,নিজের মেয়েকে এভাবে তিল তিল করে বয়সের আগেই শেষ হয়ে যেতে দেখতে ভীষণ অশান্তি লাগছে সোহেলের।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনফরমেশন ডেস্কে গেলো কেবিনের খোঁজ করতে,জানানো হলো ঘন্টাখানেকের মধ্যেই একটা কেবিন খালি হবে,তখন চাবি দিয়ে দেয়া হবে। ইনফরমেশন ডেস্কের সামনে রাখা চেয়ারগুলোতে সোহেল বসলো।পাশেই কম বয়সী একটা ছেলে ঝিমুচ্ছে। কে জানে, কার জন্য এসেছে।
নানা কথা চিন্তা করতে করতে হটাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে ওয়ার্ডের দিকে গেলো ছেলেটা,সোহেল মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কার কাছে যাচ্ছে। মুহুর্তেই চমকে উঠলো যখন ঐ ছেলে ভিনার বেডের কাছে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে,পরক্ষণেই খেয়াল হলো ভিনা ফোনে বলেছিলো ওর এক ক্লাসমেট গাড়ি করে হস্পিটালে নিয়ে এসেছে।সম্ভবত এইজনই ভিনার সেই পরিচিত ক্লাসমেট।সোহেল সাথে সাথেই উঠে গেলো না,কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখতে লাগলো ছেলেটা কী করে।
রুশান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভিনার হাত চেক করলো,ক্যানোলা দিয়ে আর রক্ত উঠেছে কিনা দেখার জন্য,এরপর কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আছে নাকি।কপালে হাত দিয়েই চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো,ডেস্কে যেয়ে একজন নার্সকে জ্বর মাপার জন্য নিয়ে আসলো। এরপর একের পর এক প্রশ্ন করেই গেলো।শেষমেষ সেই নার্স ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলে চলে গেলো।রুশান প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো পুরো ওয়ার্ড জুড়ে।এরপর ইনফরমেশন ডেস্কে যেয়ে খোঁজ নিলো কোনো কেবিন খালি হয়েছে নাকি,এরপর আবার চেয়ারে এসে বসে ঝিমুতে লাগলো।
সোহেল পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে বোঝার চেষ্টা করলো ছেলেটা আসলে ভিনার কে হয়।শুধু ক্লাসমেট হলে এতটাও অস্থিরতা কাজ করতো না।এই ছেলে কি সেই ছেলে যার সাথে ভিনার সম্পর্ক ছিলো?
না,সেই ছেলে তো মারা গেছে ভিনা আগেই বলেছে।
সোহেল রুশানকে আবার ভালোমত খেয়াল করলো। রুশান চোখ খুলে তাকাতেই সোহেলের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো,এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো-
-কিছু বলবেন আঙ্কেল?
-তুমি কি ভিনার ক্লাসমেট?
-হ্যাঁ হ্যাঁ!আপনি কী ভিনার বাবা?
-হ্যাঁ
-থ্যাংক গড আপনি এসেছেন আঙ্কেল।ভিনা এত কেয়ারলেস!আপনাকে কল দিতেও কত যে লেট করছিলো!
-কেন?
-ঐযে,আপনি নাকি ওর ছোট বোনকে নিয়ে কোথায় যেন গিয়েছিলেন,এর জন্য।অনেক আদর করে ওর বোনকে,এটা ভালো,কিন্তু নিজের সিচুয়েশনটা তো বুঝতে হবে,নাকি?আবার আমাকেও বলে ওকে একা রেখে চলে যেতে।আপনি ভাবেন তো,ওয়ার্ডে ওকে একা রেখে গেলে কী হত?
-ঠিক বলেছো বাবা।অনেক ধন্যবাদ এত কষ্ট করার জন্য।সেই দুপুর থেকে এখানে আছো,টায়ার্ড হয়ে গেছো নিশ্চয়ই, এখন বাসায় যাও।
-না আঙ্কেল।আমি থাকবো এখানে। অন্তত কেবিন না পাওয়া পর্যন্ত আমাকে থাকতে দিন।
-আমি তো এসে পড়েছি,আমি দেখে নিবো সব।
-কেন আঙ্কেল?আপনি কি রাগ করছেন?আনকম্ফোরটেবল ফিল করছেন?
-না বাবা,আমি তোমার কথা ভেবেই বলছি।
-তাহলে আমি থাকি।
এরপর রুশান শুরু করলো সব বিস্তারিত বলা।কী হয়েছিলো ভার্সিটিতে,ভিনা নিজের ব্যাপারে একটুও ভাবেনা,নিজের ফ্যামিলি,ওর ভাইকে কত মিস করে,ওর মা কত স্ট্রিক্ট,বাবা কত রসিক ইত্যাদি ইত্যাদি।
সোহেল মনোযোগ দিয়ে সব শুনে গেলো।ছেলেটার মধ্যে কোনো আড়ষ্টতা নেই কিন্তু অসম্মান ও নেই। খুব সাবলীলভাবে সব কথা বলছে,তবে সেটা সীমার মধ্যে থেকে,যেটা সোহেলের ভীষণ ভালো লেগেছে।
কথা বলার মাঝখানেই কেবিন খালি হওয়ার কথা জানানো হলো,এরপর ভিনাকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হলো।ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে ভিনার।সোহেলকে দেখে প্রশান্তির হাসি দিলেও রুশানকে দেখা মাত্রই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
-তুমি যাও নাই এখনো?আমি না যেতে বললাম?তোমার সামনেই না বাবাকে ফোন দিলাম।
-দেখো ভিনা অসুস্থ অবস্থায় এত শাউট করা ভালোনা। ছোটখাটো মানুষ তুমি এত জিদ কিসের?হু?
ভিনার এতটাই মাথা গরম হলো যে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না।সোহেলকে ইশারা করলো ওকে চলে যেতে বলার জন্য।সোহেল ভিনাক আশ্বস্ত করে এরপর বের হয়ে এলো কেবিন থেকে।রুশানকে বললো-
-এখন চলে যাও বাবা।আমি তো আছি ওর সাথে,এখন তো কোনো চিন্তার কারণ থাকার কথা না,নাকি আমার উপর ভরসা নেই?
-লজ্জা দেন কেন আঙ্কেল?আপনি ছাড়া কে ওকে ভালো যত্ন নিবে।আমি চলে যাচ্ছি।
সোহেল রুশানকে হাসিমুখে বিদায় দিয়ে কেবিনে ফিরে এলো।আজকে সহ আরো একদিন থাকা লাগবে।হস্পিটাল থেকে দেয়া খাবার ও ওষুধ ভিনাকে খাইয়ে ঘুম পারিয়ে প্রায় রাত বারোটার দিকে নিজের খাবার কিনতে বের হলো।বের হওয়ার সময় দেখলো রিসেপশনের সামনে বসে রুশান ঘুমাচ্ছে।
.
.
.
চলবে..................................................................