অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ২৭ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-তিথিকে একটু পড়িয়ে দিও,ওর পরীক্ষা সামনে।জানি প্রাইভেটে পড়ো,তবুও দেখাতে তো পারবেই। 

কাকন কথাগুলো বাঁকাভাবে বলে চলে গেলেন।ফারজানা ক্ষোভ নিয়ে ঘরে ঢুকে বসলো।ঘর বললেও ভুল হবে,মেইড সার্ভেন্ট রুম এটা।আগের মেইডকে বিদায় দিয়েছেন,কারণ ঘরে ফারজানা আর ছুটা বুয়া আছে।ফারজানার নিজের মামির কথা শুনে খাওয়ার রুচি চলে গেছে।একটা মানুষ কীভাবে সব কথায় খোঁটা দিতে পারেন না দেখলে বিশ্বাস হতো না কখনো। 

হাত মুখ ধুয়ে তিথিকে নিয়ে পড়াতে বসলো ফারজানা।তিথি ক্লাস টু তে পড়ে।এতটুকু বয়সেই মায়ের 'গুণ' খুব ভালোমত নিজের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে।নাক মুখ কুঁচকে বসেছে ফারজানার সামনে।চোখ অন্যদিকে ফেরানো,পড়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ফারজানা তিথিকে ডাকলো-

-তিথিসোনা,এইদিকে তাকাও।আজকে ইংলিশ এই স্টোরি শেষ করতে হবে।

-ইউ আর সো ক্লামসি এন্ড দিজ স্টোরি ইজ জাস্ট এ বুলশিট!

ফারজানার ইচ্ছা করছে এই বেয়াদব পিচ্চিকে চড় মেরে কান মুচড়ে সোজা বানিয়ে ফেলতে।এই বয়সে যখন পড়তে চাইতো না তখন ফারজানার মা ডাল ঘুটনি দিয়ে পিটিয়ে পড়তে বসাতেন।বাসায় ডালঘুটনি শোয়ার ঘরেই থাকতো,রান্নাঘরে শুধু প্রয়োজনের সময় নেয়া হতো।আজকালকার বাচ্চাগুলো শাসনের অভাবে বেয়াদব হচ্ছে।তিথি এর জ্বলন্ত প্রমাণ।

ফারজানা নিজেকে সামলে নিয়ে আবার চেষ্টা করালো পড়ানোর।কিন্তু লাভ হলো না।তিথি কখনো অন্যদিকে তাকিয়ে আছে,কখনো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না,আবার কিছুক্ষণ পরপরই ট্যাব হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।এই পুরো সময়ে একটা জিনিস সে ভালোমতো করেছে,সেটা হলো পা দিয়ে অনবরত ফারজানাকে লাথি দেয়া।এতটুক বাচ্চার হালকা এই লাথিতে কিছু না হলেও,যে পরিমাণ অসম্মান এই মেয়ে করছে,তাতে ফারজানার ভেতর ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে।অনেক কষ্টে পড়ানো শেষ করে ফারজানা ঠান্ডা চোখে তিথিকে বললো-

-পা সড়াও তিথি।এসব খুবই বাজে অভ্যাস।

তিথি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে আবার সমানতালে লাথি দিতে লাগলো।ফারজানা নিজের পা সড়িয়ে নিলেও তিথি সড়ে বসে আবার ঠিকি একি কাজ করে যাচ্ছে।অনেক কষ্টে রাগ চেপে রেখে ফারজানা উঠে দাঁড়ালো।তিথির দিকে প্রচন্ড রাগ নিয়ে একবার তাকিয়ে কাকনের ঘরে গেলো।

-মামি,একটা কথা ছিলো।

-কী কথা?

-তিথিকে নিয়ে,আসলে..

-থামো থামো।আগে বলো পড়ানো শেষ করেছো?

-হ্যাঁ। 

-কালকে কিন্তু ওর এক্সাম,পরীক্ষা যেন খারাপ না হয়।

কাকন পায়ের উপর পা তুলে টিভি দেখছেন।বাসায় উনার কাজ হলো টিভি দেখা,মাসে মাসে ছুটা বুয়া পরিবর্তন করা,স্বামীর সাথে দুর্ব্যবহার করা এবং নিজের মেয়েকে অযথা আহ্লাদ দিয়ে মাথায় তোলা।উনি এমন ভাব দেখাবেন যে তিথি তার জীবনের সব,কিন্তু দায়িত্বের বেলায় অবহেলা করবেন ষোল আনা।শুধু এখানেই ক্ষান্ত হন না,তার মেয়ের প্রতিটা ভুলের জন্য অন্যের উপর দোষ চাপান বেশ সুনিপুণ ভাবেই। 

-দাঁড়িয়ে আছো যে?কিছু বলবে?

-আসলে মামি তিথি কথা শুনতে চায়না।

-কী করলো আবার ও?এত ছোট বাচ্চা আমার,অথচ দোষ ধরতে ছাড়ো না।কী হয়েছে?

-পড়ায় মনোযোগ দেয় না,আর বেয়াদবি করে।

-কী বেয়াদবি শুনি?

-অযথা লাথি মারে,কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়না।

-এতটুকু বাচ্চার ছোঁয়ায় কী পা ভেঙে গেছে?ডাক্তার ডাকবো?হস্পিটালে যাওয়া লাগবে?কী করবো বলো।

ফারজানার খুব অসহায় লাগছে।এর মধ্যে তিথি এসে কাকনের পাশে বসেছে।চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি।এত ছোট বাচ্চার মনে কত কলুষতা! 

-মামি,ব্যপার ব্যথার না,ব্যাপার হলো বেয়াদবির।

-যার বাসায় থাকছো তার বাচ্চার নালিশ করা মনে হয় খুব আদব না?

ফারজানা মাথা নিচু করে রাখলো।এরপর কাকনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।গেস্ট রুম খালি পরে আছে,কিন্তু সেখানে থাকা যাবে না।কাকনের বোন এবং অন্যান্য আত্মীয়রা আসলে এখানে থাকে। তারা বছরে তিন-চার বার আসবে।কিন্তু তাদের জন্য এতবড় ঘর সারাবছর খালি রেখে ফারজানাকে খুপরির মত জায়গায় থাকতে দিয়েছে।প্রচন্ড মাথা ব্যথা করায় নিঃশব্দে রান্নাঘর থেকে টি ব্যাগ নিয়ে গরম পানিতে অনেক্ষণ ডুবিয়ে রেখে চা খেলো।

মানুষের ভাগ্য ও বলতে হয়!
মনে মনে ভাবছে ফারজানা।ভিনার জীবন কত সাজানো।দেখতে খুব আহামরি না হলেও কেন যেন খুব ভালো লাগে।ক্লাসের অনেক ছেলেই ভিনাকে পছন্দ করে।বাবার টাকা আছে অনেক,প্রায়ই গাড়ি নিয়ে আসে।সৎ মা থাকলেও শুনেছে উনিও খুব ভালোবাসে ভিনাকে।রূপ,গুণ,অর্থ সবই আছে এই মেয়ের জীবনে।শুরু থেকেই ভিনাকে নিয়ে মনের মধ্যে সবসময় কোথায় যেন খুব চিনচিনে ব্যথা হতো।একজন মানুষের জীবন এত সুন্দর কেন হতে হবে?ভিনার সাথে বন্ধুত্ব রাখার কারণ হলো ক্লাসে বেশিরভাগ ই ছেলে মেয়েই ফারজানার সাথে সহজে মিশেনি।এক ভিনা ছাড়া কেউ ভালোমতো কথাও বলে না। কিন্তু এই কারণে ভিনাকে যে ভালো লাগে তা না,বরং কাছ থেকে ভিনাকে দেখে আরো যন্ত্রণা হয় মনে।রুশানকে ভার্সিটিতে বেশ কয়েকবার দেখেছিলো। বারো বছর গার্লস স্কুল কলেজে পড়ে এই কো এডুকেশনে এসে রুশানকে দেখেই প্রেমে পরে গেছে সহজে।একদিন হটাৎ দেখে রুশানকে ভিনার সাথে।এরপর তো রুটিন হয়ে দাঁড়ায় রুশানের ভিনার জন্য অপেক্ষা। 

হায় ভিনা!এখানেও বাজিমাত করা লাগলো?এরপর কতরাত ফারজানা কেঁদে কাটিয়েছে এর হিসাব নেই।আর সেদিন?রুশান যে অস্থির হয়ে ভিনাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠালো?সেদিন পায়ের তলা থেকে মাটি সড়ে গিয়েছিলো।হিংসার যন্ত্রণা ছিড়ে খাচ্ছিলো ভেতরটাকে।ভিনাকে সেদিনের পর থেকে সহ্যই হচ্ছিলো না।ক্যারেক্টারলেস মেয়ে একটা!রিলেশন নাই,আবার ঠিকি কথা বলে।নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে ওদের মাঝে,নাহলে রুশান এত পাগল হবে কেন?ছেলে মানুষ মনে হয় এমনি এমনি এমন করে?বুঝালেই হলো কিছু নেই?

যদিও ভিনা রুশানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে,তাতে কী?নিশ্চয়ই অন্য ছেলেতে মন গিয়েছে।কিছুদিন রুশানের সাথে ঘুরাফিরা করে এখন ভাল্লাগে না তাই পরিচয় করিয়েছে।এতই যখন ভালো,আগে কেন পরিচয় করালো না?সবই নাটক।সেদিন আবার রিদওয়ানের পাশে বসে ক্লাস করলো।রিদওয়ান যে ভিনাকে পছন্দ করে এটা ফারজানা ভালোমতো জানে।আগে রিদওয়ানকে একটু ভালো লাগলেও এখন অসহ্য লাগে।কীসব ভেড়া এগুলো?আর ভিনা কী এসব বুঝে না?ঠিকি বুঝে।ইচ্ছা করে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায়।

সৃষ্টিকর্তাও অদ্ভুত,ভিনার মত মানুষদের একেবারে সব কিছু ঢেলে দিয়েছেন,আর ফারজানা এখানে ধুকে ধুকে বেঁচে থাকছে।ছোট ঘর,ফ্যানও চলে না ঠিকমতো।এদিকে মাও হাত খরচার টাকা দিতে পারছে না নিয়মিত।এতসব টানাটানি! এত অপমান!অথচ জীবনে কখনো প্রেম করেনি,কত ভালো মানুষ সে।উহু,সৃষ্টিকর্তা বড় অবিচার করছে। 

মোবাইলের শব্দে নিজের প্রশ্ন আর উত্তরের মিথ্যা কাল্পনিক জগৎ থেকে ফারজানা বের হয়ে আসলো।রুশান মেসেজের উত্তর দিয়েছে।

-পড়া বিষয়ক যা কথা বলবে ফেসবুকে বলো।আমি ব্যস্ত থাকবো ভার্সিটির পরে।

ফেসবুক?ফারজানার তো এন্ড্রয়েড মোবাইলই নেই। অনেক সমস্যায় পরে গেলো। রুশানের মেসেজ পেয়েই অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে।কতদিনের সাধনার পর রুশানের সাথে যোগাযোগের সুযোগ পেয়েছে।এটা কোনোভাবেই হাত ছাড়া করা যাবে না।যেভাবেই হোক,একটা ব্যবস্থা করা লাগবেই।কোনোভাবে যদি রুশানের সাথে বিয়ে হয়ে যায়,আর কখনো পিছনে ফিরে তাকানো লাগবে না।রুশানের অর্থবিত্ত সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে ফারজানার ভিনা হিসাব কষেই ছেলে ফাঁসায়!ফালতু মেয়েলোক!

ভিনার প্রতি অযৌক্তিক একরাশ ঘৃণা নিয়েই ফারজানা স্বপ্ন দেখতে লাগলো রুশানের কালো রঙের গাড়ি থেকে সুন্দর জামা পরে নামছে।জীবন কত সুন্দর হয়ে যাবে একবার রুশানের সাথে বিয়ে হলে।

না,যেকোনোভাবেই হোক,ফোনের ব্যবস্থা করা লাগবে।পরেরদিনের যে কুইজ আছে,সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে ফারজানা ফোন কীভাবে কেনা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে থাকলো।সঠিক উপায়ে টাকার যোগাড় হবে না বুঝতে পেরে জীবনের প্রথম বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো।রাতের খাবারের সময় যখন সবাই খেয়ে বসেছে,ঠিক তখনি কাকনের রুমে গিয়ে ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করলো।কাকন একদমই কেয়ারলেস ধরনের মানুষ।সংসারে কোনো হুশ নেই।এদিক সেদিক টাকা পরে থাকে।এ বিষয়গুলো লক্ষ্য করেই ফারজানা সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে।এত বড় পদক্ষেপ নেয়ার পরেও ফারজানার কোনো অনুতাপ হলো না।আসলে প্রেমে পরা মানুষকে ছকে ফেলা যায়না।

••••••••••••

রেহানকে কাছে পেয়ে সায়বা নিজের পুরোনো অনিচ্ছাকৃতভাবে করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে কোনো ত্রুটি রাখছেন না।সারাদিন রেহানের কাছে বসে থাকেন।এত বছর আগের ঘটনা,তবুও দহন আগের মতই।কী হতো সেদিন যদি জোর করেই মেয়েটাকে নিজের বাসায় নিয়ে আসতো?অন্তত আজকে রেহানের এই মলিন চেহারা তার দেখা লাগতো না।নিজের সন্তান আর বোনের সন্তানের কোনো পার্থক্য করেননি।বিশেষ করে রেহানকে উনি বেশিই আদর করেন।সায়বা মন থেকে দোয়া করেন নামাযে,যেন রেহানের জীবনে এমন কেউ আসে,যে তার কলিজার টুকরার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।

সায়বা রেহানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ঘরে আসলেন।নিজের বোনের ইগো দেখে অবাক হচ্ছেন।একবারো ফোন দেননি জেবা।ছেলে যে দুইদিন ধরে সায়বার বাসায় আছে,একবার দেখতেও আসেননি। সায়বার বিশ্বাস ছিলো,জেবা যদি একবার মাথায় হাত বুলিয়ে রেহানের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতো,সব ঠিক হয়ে যেত।কিন্তু এমন হবে না।জেবা কখনোই এই কাজ করবেন না।সায়বা বুঝতে পারছেন,এই বোনের প্রতি তার ভয় কোনো শ্রদ্ধা না।এই ভয় হলো শুধু ভয়,যেখানে কিঞ্চিৎ ঘৃণা মিশানো রয়েছে।

•••••••••••

ভিনার কাধের উপর ছোট বিড়ালের বাচ্চাটা গুটিসুটি মেরে এলিয়ে আছে।এর নাম 'চকো'। চকো বেশিরভাগ সময়ে ভিনার কাছে থাকে।আর বড় বিড়াল 'ব্ল্যাকবেরি' থাকে প্রিতির কাছে।প্রিতি ইদানিং খুব ফুরফুরে মেজাজে থাকে।গান শুনে,বিড়ালদের সাথে সময় কাটায়,বিভিন্ন স্ন্যাক্স বানিয়ে খায়।আর ভিনার সাথে কথা বলার পরিমাণ ও বেড়েছে।আগে কখনো ডেকে নিয়ে কথা বলতো না।ভিনা নিজেই এসে কথা বলতো প্রিতির সাথে। এখন প্রিতি ভিনাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কথা বলে,রান্না করে খাওয়ায়।আর সবসময় কথার শেষে বলে

-জানিস ভিনা,এইযে আমার কথা তুই ভাবিস,এটা আমার খুব শান্তি লাগে।কেউ আমার কথা ভাবছে,আমার কথা চিন্তা করে কিছু করছে,এসব জেনেই আমার মধ্যে শান্তি কাজ করে।এই শান্তি মনে থাকলে জীবন ভালো লাগতে থাকে।

-তোমার জীবনে এমন ভালোবাসার মানুষ আরো পাবে তুমি। নিজেকে গুছিয়ে নাও,জীবন এমনিই সুন্দর হয়ে যাবে।

প্রিতি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।ভিনা জানে প্রিতি ভাবছে এসব নিতান্তই অবাস্তব।কিন্তু এসব অবাস্তব না।সৃষ্টিকর্তা কখনো অবিচার করেন না।
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp