নওমি....
মেসেজ পেয়ে প্রোফাইলে ঢুকলো ভিনা।নাম দেয়া 'চন্দ্রা বতী'।
অনেক আগে,ক্লাস পার্টিতে নওমি সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরে এসেছিলো।অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো ওকে।সেদিন ভিনা নওমির নাম দিয়েছিলো 'চন্দ্রাবতী'। এই নাম পেয়ে নওমি অবাক হয়ে বলেছিলো
-কোথায় পাস এত সুন্দর নাম?আমার আর কাউকে লাগবে না,তুই ই আমার সব!
ভিনা ঝাপসা চোখে সব মনে করলো।প্রোফাইলের কভার ফটোতে ভিনার সেই প্রায় তিন চার বছর আগের রেস্কিউ করা বিড়াল এবং তার সপরিবারের ছবি।প্রোফাইল পিকচার অনেক আগে ভিনার দেয়া পুতুলের ছবি।প্রোফাইল দেখে বুঝলো,এক বছর ও হয়নি খুলেছে।
ভিনা বেশ সময় নিয়ে ভাবলো কী উত্তর দিবে,কীভাবে উত্তর দিবে।
-এত বড় হয়ে গেলো মিনি!আমার অবাক লাগছে সময় কীভাবে যায়।কেমন আছিস তুই?
-তুই চিনতে পারলি!আমি ভেবেছিলাম চিনবি না।
-চন্দ্রাবতীকে ভোলা যায়?
-আসলে ভেবেছিলাম....চিনলেও উত্তর দিবি না।কিন্তু তুই আগের মতই রয়েছিস রে ভিনা।
-না রে।বদলে গেছি অনেক।
-কিন্তু এখনো ক্ষমা করে দিস মানুষকে।
-ক্ষমা যদি করেই দিতাম,খোঁজ নিতাম অন্তত।কিন্তু এত অভিমান জমে গিয়েছিলো যে আর পারিনি।
-ঠিক করেছিস।তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে...
-বাদ দে না।খারাপ লাগে। আর আমি কখনোই ভুলবো না তুই আমার জন্য একসময় যা করেছিলি।আমি এখনো তোর কথা মনে করি নওমি।
-কতদিন পার হয়ে গেলো,তাইনা?
-মিনিদের দেখে তো তাই মনে হয়।
-মিনির তিনটা বাচ্চা।সেই বাচ্চাদের ও বাচ্চা আছে ছোট ছোট,ওদের দুইটাকে এ্যডোপশনে দিয়েছি।আর আছে একটা।
-বাব্বাহ!মিনি দেখি নানিও হয়ে গেছে!
-আসলেই।
শোন,অনেক কথা জমে আছে।আমি বেশিক্ষণ অনলাইন থাকতে পারবো না।দেখা করতে পারবি?
-পারবো,কবে সুবিধা হয় বল।
-কালকে বিকেল?
-ঠিকাছে।কোথায় দেখা করবি?
-কলোনি?
-না।আমি বাসা চেঞ্জ করে ফেলেছি।তুই এক কাজ কর,ধানমন্ডি আয়,ভালো কোনো জায়গায় খেয়ে নিলাম।
-কবে করলি!আর ধানমন্ডি?অন্য কোথায় যাওয়া যায় না?
ভিনার কাছে খটকা লাগলো।নওমি বরাবরই শৌখিন মেয়ে।ভালো পোষাক,ভালো খাবার ছাড়া কখনো চলেনি।আর ধানমন্ডি ওর প্রিয় জায়গার একটা।নতুন সুন্দর কোনো রেস্টুরেন্ট খুললেই নওমির সবার আগে যাওয়া চাই!আর এই ঘোরাঘুরির সঙ্গী হতো ভিনা।
-কোথায় যাবি বল?তুই যেখানে বলবি,সেখানেই আসবো।
-স্কুলের কাছে একটা ছোট ফাস্টফুডের দোকান ছিলো মনে আছে?ওখানেই আয়।
-ঠিকাছে।সাড়ে চারটায় ওখানে থাকবো।নাম্বার দিয়ে রাখ।দরকার হলে ফোন দিবো।
-আচ্ছা আরেকটা কথা ভিনা,বিড়াল নিবি?
-এখনি বলতে পারছিনা রে।প্রিতি আপুকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
-প্রিতি কে?
-লম্বা ঘটনা।আয় কালকে,সব বলবো।
-ঠিকাছে।
নওমি নাম্বার দিয়েই অফলাইন হলো।বিদায় ও জানাতে পারলো না।নওমির ফিরে আসায় ভিনা সত্যি অনেক খুশি।কিন্তু কোথায় যেন অনেক বড় পরিবর্তন এসেছে নওমির মধ্যে,এবং সেই পরিবর্তন যে ইতিবাচক না,সেটা বুঝতে পারছে ভালোমতো ।
ভিনা ফোন রেখে প্রিতির কাছে গেলো।প্রিতি একা বারান্দায় বসে আছে। ভিনার খেয়াল হলো,প্রিতির কাছে কোনো ভালো ফোন ও নেই।একজন মানুষ নিঃসঙ্গ হয়ে এত দীর্ঘ সময়ে কীভাবে থাকতে পারে,ভেবে শিউরে উঠলো।তখনি মনে মনে ঠিক করে নিলো কী বলবে।
-আমার রুমেও তো আসতে পারো নাকি?এখানে বসে আছো কেন?
-তুই ব্যস্ত ছিলি।পড়াশোনায় আছিস,তাই আর বিরক্ত করিনি।
-ইশশ আপু!এত্ত ফর্মালিটি!!
-কোনো ফর্মালিটি না।এটা তোর জন্য কেয়ার।পড়াশোনার চাপ আছে,আবার নতুন লাইফ,নতুন ফ্রেন্ডস!কম ব্যস্ততা তোর?মাহভিন'স এর কথা তো বাদই দিলাম।
-এত ভাবো কেন আমার ব্যাপারে?
-তুই আমার সব যে,তাই।আর ইচ্ছা করে অনেক ভালোবাসা আর কেয়ার দিয়ে তোর সব অতীত,কষ্ট মুছে দেই।
-সত্যি আমি তোমার সব?
-সত্যি আমার লক্ষ্মীটা!
-আমার একটা কথা রাখবে?
-এইরে!গেলাম ফেঁসে।আচ্ছা বল কী কথা।
-তোমার পড়াশোনা শুরু করে দাও না প্লিজ।
-দুই বছর হয়ে গেছে শেষ হয়েছে।এখন আবার কিসের কী!
-দুই বছর!দুই বছর ধরে তুমি ঘরে বসা!
-ওহহো ভিনা!বাদ দে তো।
-আপু প্লিজ!
-কী জ্বালাতো!অন্য কথা বল।
-ঐত।সবারই মুখে মুখে আহ্লাদ।ভালোবাসা এত্ত সোজা নাকি।
ভিনা কৃত্রিম অভিমান নিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুরে বসলো।
-আচ্ছা।পড়াশোনা শুরু করবো।
-প্রমিস?
-হ্যাঁ প্রমিস।
-কবে শুরু করবা?
-একটু সময়ে দে আমাকে। ভাবতে দে কিসের উপর মাস্টার্স করবো,কোথায় পড়বো।হুট করে বললেই হলো নাকি?
-বেশি সময় নিবে না কিন্তু!এই ধরো দুই সপ্তাহ।
-ধুর মেয়ে।
-দেখো তো!কথা শুনো না কেন তুমি?
-শুনবো তো লক্ষ্মী।আচ্ছা যা,আমাকে চার-পাঁচ মাস সময় দে।নিজেকে একটু জাতে আনি।
ভিনা এবার প্রতিবাদ করলো না।প্রিতি সত্যিই অনেক মায়াবি মেয়ে। কিন্তু অবহেলার জন্য চুল রুক্ষ হয়ে গেছে,চোখে কালি,চোয়াল ভাঙা,চোখ গর্তে।আসলেই একটু সময় নিয়ে নিজেকে ঠিক করা দরকার প্রিতির।প্রিতি নিজের জীবনের ঝড় সম্পর্কে কিছুই খোলাসা করে বলেনি।শুধু বলেছিলো,তার মা দ্বিতীয় বিয়ে করে বিদেশে স্যাটেল,মাসে মাসে টাকা পাঠায়।জীবনে একজনকে খুব ভালোবেসেছিলো, ভীষণ কষ্ট দিয়ে চলে গেছে।আরেক ভালোবাসার মানুষ বাবা,তার সম্পর্কে কিছুই কখনো বলেনি।ভিনা অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করে না,অপর পাশের মানুষ যতটুকু জানায়,ততটুকুতে নিজের জানার আগ্রহকে সীমাবদ্ধ রাখে।কিন্তু ভিনার বিশ্বাস,প্রিতির সেই পরিমাণ নির্ভরযোগ্য কাঁধ হতে পারলে,একদিন পুরো সত্যি জানবেই।
-আচ্ছা আপু।
ভিনা প্রিতির গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করলো।
-কী চাস?
প্রিতি চোখ ছোট করে ভ্রূ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
-ওমা!এত রুড?
-পেঁচাবি না।বল কী চাস?
-বিল্লি চাই বিল্লি!
-তুই বিড়াল পালবি?
-আমি না।তুমি পালবা।
এরপর ভিনা এক এক করে নওমির সব ঘটনাই বললো।এরপর বললো বিড়ালের কথা।
-আপু প্লিজ নাও না!প্লিজ প্লিজ!
-কয়টা?
-বেশি না তিনটা।একটা বড়,একটা মেঝ,একটা একদম ছোট।নিয়ে নাও প্লিজ!
-মুখে বললেই তো পালা যায় না।বিড়াল ঠিকভাবে পালতে হলে অনেক কিছু করতে হয়,অনেক যত্ন নিতে হয়।
প্রিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিনার বেবি ফেস করা মুখের দিকে তাকালো।
-তুই নিজের পালার জন্য নিচ্ছিস?নাকি আমার জন্য?
-বুঝতেই পারছো যখন,হ্যাঁ বলে দাও।ব্যস্ততা জীবনে অনেক দরকার।আর জানো?বিড়াল মেন্টাল থেরাপির জন্য ও ইউজ করা হয়।তোমার ডিপ্রেশন কমিয়ে দিবে অনেকখানি।নিয়ে নাও না আপু।
-এত ভাবিস আমার কথা?
-না।একটুও ভাবি না।
প্রিতি ভিনার মাথায় আলতো করে বাড়ি মেরে জড়িয়ে ধরলো ভিনাকে।মাঝে মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা জীবনে আসে এবং এই ভালোবাসা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাশে থেকে যায়।প্রিতির জীবনে ভিনা হচ্ছে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা।
পরেরদিন বিকেলে সময়ের একটু আগেই ভিনা চলে এলো সেই ফাস্টফুডের দোকানের সামনে।স্কুলে থাকার সময়ে এই দোকান ছিলো ওদের স্বর্গ।দশ এগারো বছর আগে বন রুটির মাঝখানে বিস্কিটের গুড়া দিয়ে বানানো ফ্রাইড চিকেনের টুকরা দিয়ে 'চিকেন বার্গার' নামের সেই খাবারই ছিলো তখনকার সময়ে অমৃত এবং হাইফাই ধরনের খাবার।ভিনা ভাবছে এখনো কি সেই একিরকম বার্গার বিক্রি করা হয়?
ভিনা নওমিকে ছাড়া ভেতরে ঢুকলো না।স্কুলের আশেপাশে সব জায়গার পরিবর্তন দেখছে হেঁটে হেঁটে। কত বদলে গেছে আশে পাশে সব!এমনকি স্কুলের বিল্ডিং ও হয়েছে নতুন।
এমন সময় কেউ কাঁধে হাত রাখলো।ভিনা চমকে ঘুরে তাকাতেই আকাশ থেকে পরলো।প্রথম কয়েক সেকেন্ড ধরতে পারলো না সামনে থাকা মেয়েটা কে।সুতির রংচটা সালোয়ার কামিজের সাথে বড় ওরনা।চুল খোঁপা করা, হাতে ছোট পার্স,মুখে নেই কোনো সাজসজ্জা।আগের মত কোনো দামী পার্ফিউমের ঘ্রাণ ও নেই।ভিনার সামনে এই কোন নওমি দাঁড়ানো!!
ভিনা নিজের বিস্ময়কে লুকিয়ে ফেললো দ্রুতই,কারণ নওমির এতে অস্বস্তি লাগতে পারে এবং নিজেকে ছোট মনে হতে পারে।
ভিনা নওমিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো-
-কত্তদিন পর দেখলাম তোকে,কতদিন পর!
নওমি কান্না করে দিলো ভিনার এই সরল আলিঙ্গনে। এত বড় অপরাধ করার পর ভিনার কাছে যে আগেরমতই ভালোবাসা পাবে,কখনোই ভাবেনি।এমনকি গতকাল ও মনে হয়েছিলো ভিনা যতই ক্ষমা করে দেক,আগের সেই বন্ধুত্ব কখনো ফিরে আসবে না।কিন্তু এই আলিঙ্গন মুহূর্তেই সেই ধারণা মুছে দিয়েছে।
নওমি কোনো কথা বলতে পারছেনা,ও জানেনা কী বলবে এই পরিস্থিতিতে,কোন মুখেই বা বলবে?কিন্তু বলার তো আছে অনেক কিছু।
ভিনা টেনে নওমিকে নিয়ে ফাস্টফুডের সেই দোকানে বসলো।এই দোকান ও বদলে গেছে।আগের চেয়ে আয়তনে বড় হয়েছে,সাজসজ্জা বদলেছে,বদলেছে মেনুও।
জুস আর দুইটা বার্গার অর্ডার দিলো ভিনা।নওমিকে কোনো সুযোগ না দিয়ে নিজেই বিল দিয়ে দিলো।এক দেখাতেই আন্দাজ করতে পেরেছে কত কষ্টে আছে নওমি।এরপর যেয়ে বসলো সুবিধামত জায়গায়।
-আমার চন্দ্রাবতী! বল কেমন আছিস তুই?
নওমি মাথা নিচু করে বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিয়ে বললো।
-আমি ভালো নাই ভিনা।গত দুই বছরে সব বদলে গেছে আমার।
-সব খুলে বল।আমি সব শুনবো।চেপে রাখিস না।
-কোনটা দিয়ে শুরু করবো? এত এত ঘটনা!
-তানভির ভাইয়ের টা দিয়ে শুরু কর।
-তানভির?হায়রে!ও তো চলে গেছে কবেই!
ভিনার সব শুনে নিশ্চুপ বসে থাকা ছাড়া উপায় ছিলো না।
নওমি সবসময়ই তানভিরের কাছে সময় চাইতো।পড়াশোনা,পরীক্ষা নানা কারণে বেশি সময় দিতো না তানভির।কিন্তু প্রায়ই দেখা করতো।যখনি দেখা হতো ভালো কোনো জায়গায় নিয়ে যেতো,ভালো গিফট আনতো,নওমির সব কথা শুনতো এবং সাপোর্ট ও দিতো ইমোশনালি।কলেজে ওঠার পর নতুন পরিবেশে নতুন ফ্রেন্ড সার্কেল হওয়ার পর সত্যি বলতে নওমির জীবনও বদলে গিয়েছিলো অনেকখানি।দুঃখজনক হলো,সার্কেলের তিনজন বান্ধবীর কেউই খুব একটা ভালো ছিলো না।ঘোরাঘুরি,আড্ডাবাজি,বয়ফ্রেন্ড নিয়ে কম্প্যারিজন এসবই চলতো তাদের মধ্যে।সেই সময় কাকতালীয়ভাবে নওমির মাও ছাড় দিচ্ছিলো।এসব কারণেই ভিনার সাথে দূরত্ব হয়ে গিয়েছিলো।এতকিছুর মাঝখানেও নওমি কখনো তানভিরের সাথে যোগাযোগ কমায়নি,বরং দিনশেষে তার নিজেরি অপেক্ষার সময় বাড়তে থাকে।তানভির দেখা করাও কমিয়ে দেয় ধীরে ধীরে।এবার অজুহাত হয় ভিন্ন,এবার অভিযোগ নওমি অনেক ইম্যাচিওর,কিছু বুঝে না।নওমি যখনি তানভিরের সাথে দেখা করতে যেত,ভিনার নাম নিয়ে বের হতো,কারণ নওমির মা হাফসা ভিনা ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতেন না।একদিন হুট করেই উনি ড্রাইভারের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে নওমির কাছে যাওয়ার পর দেখেন তানভিরকে,এবং ঘরে এসে ভয়ানক মারধোর করেন।একসময় নওমি অনেকটা বাধ্য হয়েই ভিনার উপর দোষ চাপায়। সেইদিনই হাফসা ভিনাকে ডেকে এনে অপমান করেন কোনো দেরী না করে এবং সুযোগ না দিয়ে।মূলত এই ঘটনার পর সব খুব দ্রুত বদলাতে থাকে,সেদিনের পর নওমির সাথে তানভিরের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।হাফসা কোনো বান্ধবীর সাথেই যোগাযোগ করতে দেননি।কলেজে গিয়ে সেই ফ্রেন্ড সার্কেলে আবার মিশতে গেলে,ওরাও খুব অস্বাভাবিক আচরণ করে।সবমিলিয়ে রেজাল্ট ও খারাপ হয়েছিলো,ভীষণ মানসিক চাপে ছিলো।প্রায় দুই মাস পর একদিন শুনতে পেলো ওর মা একদিনের জন্য বাইরে যাবে,সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসায় থাকবে না।ঠিক কী কারণে যাবে,জানান নি।সেদিন তানভিরের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয় নওমি।অনেক কষ্ট করে ফোন দিয়ে রিকোয়েস্ট করে দেখা করার জন্য।সেদিন ছিলো,ওর জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন।অনেক কায়দা করে ঘর থেকে বের হয় নওমি।
ঐদিন দুপুর বেলায় একটা রেস্টুরেন্টে তানভিরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।তানভির আসেও,কিন্তু একা না,মালিহা কে সঙ্গে নিয়ে।নওমি তানভিরের সাথে কথা বলতে আসলেও,কথা বলে শুধু মালিহা।জানায় ছয় মাস ধরে তানভিরের সাথে সম্পর্ক তার।নওমি অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করে,কান্না করে,করুণ কন্ঠে জানায় তানভিরের সাথে নিজের সম্পর্কের কথা।মালিহা প্রথমে শান্তভাবে হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করলেও,পরে অনেক খারাপ ব্যবহার করে।এর মধ্যে তানভির একটা শব্দ ও ব্যায় করে না।নওমি তানভিরকে প্রতারক বলার পরই মালিহা বলে-
-কী প্রতারণা করেছে ও?তোমার বয়স কত হ্যাঁ?ইনফ্যাচুয়েশনকে ভালোবাসার নাম দিও না নওমি।তানভির তোমার সাথে যাই করেছে,সেটা ওর মিস্টেক ছিলো।আর কীই বা এমন করেছে ও?সেক্স হয়েছে তোমাদের মাঝে?তোমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে?কিছুই তো করেনি!তাও একটা ভালো ছেলেকে নিজের ড্রামা দিয়ে নাজেহাল করছো,লজ্জা করে না তোমার?
নওমি হতভম্ব হয়ে গেলো সব শুনে,তানভিরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো,কিন্তু তানভির একবারো চোখ তুলে তাকালো না।
-হোয়াট হ্যাপেন্ড?ওর দিকে তাকিয়ে আছো কেন?ও কি তোমাকে বলে নাই তুমি অনেক ইম্যাচিউর?তোমার তো কমনসেন্স খাটানো উচিৎ।ওর মত এত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে তোমার মত এত ছোট মেয়ের সাথে কেনই বা রিলেশনে যাবে?ম্যাচিউরিটির লেভেল মিলবে?তোমরা পারোও!ভালোভাবে কথা বললেই প্রেমে পরে যাও,ক্যারেক্টার ঠিক করো আগে।
এসব শুনে নওমি পুরো ভেঙ্গে গিয়েছিলো ভেতর থেকে।এটা সত্যি তানভিরের সাথে কখনোই কোনো ইন্টিমেসি তৈরি হয়নি।কিন্তু নওমি সত্যিই ভালোবেসেছিলো।নিজের ভবিষ্যৎ সাজাতে চেয়েছিলো তানভিরের সাথে।অনেক স্বপ্ন বুনে রেখেছিলো।ফিজিকাল কিছু না হওয়ায়,এই মূল্যবান আবেগ খেলো হয়ে গেলো।ইনফ্যাচুয়েশন বলে ওর অনুভূতিকে মূল্যহীন করে দিলো।তাও করলো কে?একটা মেয়ে।
সেদিনই বাসায় গিয়ে জীবনের আরো বড় ধাক্কা খায়।জানতে পারে,ওর বাবা মার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।নওমির বাবা অন্যত্র বিয়ে করেছেন এবং সেখানে তার একটা ছেলেও রয়েছে সাত বছরের।মূলত এই কারণেই হাফসা দীর্ঘদিন মেয়েকে সময় দেননি।সেদিনের পর নওমির জীবন পুরো একশ আশি ডিগ্রি কোণে ঘুরে যায়।নওমির বাবা ভরণ পোষণ দিতে অস্বীকার করেন এবং অনেক ল্যাভিশ লাইফ থেকে এক ধাক্কায় মধ্যবিত্তের ঘরে এসে পরে নওমি আর তার মা।এতসব ঘটনার চাপে পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যায়।দুই রুমের ছোট ফ্ল্যাটে জীবন যাপন শুরু করে।স্বামীর এই প্রতারণায় নওমির মাও আংশিক মানসিক রোগী হয়ে যান।কিছু জমানো টাকা আর নানাবাড়ি থেকে সাহায্য নিয়ে চলছিলো দুইজন।
নওমি সব কিছু বলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলো।ভিনাও নিশ্চুপ থাকলো।নিজের জীবন সম্পর্কে বললো না আর কিছুই।কিছুক্ষণ পর নওমিই নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,
-তোর খবর কী বল।যাবির ভাইয়া কেমন আছে?
ভিনা ভূমিকা না করে নওমির ঘটনার আদলেই নিজের ঘটনা বললো।যথাসম্ভব কম মিথ্যা বলে জানালো,মানসিক শান্তির প্রয়োজনেই প্রিতির কাছে আছে ভিনা,প্রিতি ভিনার প্রতিবেশির আত্মীয় ছিলো।ভুলেও এটা জানায়নি যে,প্রিতি মালিহার পরিচিত ছিলো।কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়া ভিনার স্বভাব না।
-হায়রে!দুই বন্ধুই একি রকম বাস্টার্ড বের হলো।
ভিনা আস্তে করে উত্তর দিলো,
-হয়ত।
খাওয়া শেষ করে নওমি বললো-
-আরেকটা কথা ভিনা।বিড়ালগুলো নিতে পারবি?
-পারবো,তিনটা নিবো।
-সত্যি!অনেক থ্যাংক্স রে। আমার অনেক উপকার হলো।একটা রিকোয়েস্ট শুধু,মিনিকে নিস না।তুই জানিস,তোর এই মিনিই আমার দুঃসময়ে শেষমেষ পাশে ছিলো।আমি ওকে আমার সাথেই নিয়ে যেতে চাই।
-নিয়ে যেতে চাই মানে?কোথায় যাবি?
-খুলনা চলে যাচ্ছি।এই মাসের শেষই চলে যাবো।ঢাকায় থেকে আর পোষাবে না।আর নানির বাড়ি যাবো,এত বিড়াল নিতেও পারবো না।
ভিনা খানিকটা চিৎকার দিয়ে উঠলো।
-এসব কী?মাত্র আমাদের দেখা হয়েছে,সব ঠিক হয়েছে,এখনই কী বলছিস তুই!
-কিছু করার নাই।ওখানে যেয়ে যদি পারি কলেজে ভর্তি হবো আবার।দুই বছর পিছিয়ে গেলাম আমি।কখনো ভাবিও নি জীবনে এইদিন ও দেখবো।
-তুই এখানেই থাকবি।আমি তোর থাকার ব্যবস্থা করবো।আমার সাথে থাকবি,অথবা আমার বাসায় থাকবি।আমার বাবা তোকে অনেক স্নেহ করে।আমি সব ঠিক করে দিবো নওমি!প্লিজ তুই চলে যাবি না!
-আম্মুকে এই অবস্থায় একা রাখতে পারবো না রে।আম্মু ভীষণ কষ্টে পাথর হয়ে গেছে।ভাবতে পারিস,কত বছর ধরে আমার বাবা প্রতারণা করছিলো?আম্মুর কেমন লাগছে?
-কিন্তু নওমি....
-এই মা ছাড়া আর কেউ নাই আমার।আর শোন,আম্মুকে আমি সব বলে দিয়েছি,তোর কোনো দোষ ছিলো না।আম্মু তোর কথা অনেক মনে করে রে।পারলে মাফ করে দিস আমার মাকে।
-উনি মা হিসেবে যা করেছে,এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নাই।কিন্তু,তুই আরো আগে যোগাযোগ তো করতে পারতি।কী করলি এটা তুই?
-এই যোগাযোগ ও করতে পারতাম না ভিনা,এতটা গিল্টে ভুগছিলাম।রুশান সাহায্য করেছে আমাকে,আমাকে বুঝিয়েছে যে তুই আমাকে ক্ষমা করে দিবি।
-রুশান!
ভিনার বিস্ময় সীমা ছাড়ালো।
-হ্যাঁ রুশান।
অনেক ফিনানশিয়াল কষ্টে পরেছিলাম।লজ্জায় নিজের রিয়েল আইডি বন্ধ করে দিয়েছিলাম।প্রায় সাত মাস আগে রুশানের সাথে হুট করেই আমার দেখা হয়।তোর কথা জিজ্ঞেস করে আমাকে।আমি ওকে বলে দেই সব,যে কী কারণে তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব ভেঙে গিয়েছিলো।রুশান অনেক কষ্ট পেয়েছিলো যদিও,কিন্তু আমার এই ফেক ফেসবুক আইডি আর নাম্বার নিয়েছিলো।ওকে আংশিক বলেছিলাম ফ্যামিলিয়াল প্রবলেমের কথা।নিজের বাবার কথা বলতে অনেক লজ্জা লাগছিলো।ঐ সময়ে রুশান আমাকে অনেক হেল্প করেছে। আম্মু ভীষণ অসুস্থ হওয়ায়,হস্পিটালে ভর্তি করিয়েছিলাম।সেই সময়ে রুশান হিউজ একটা এমাউন্ট দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে।আমি এটাও জানিয়েছি যে এ টাকা আমি ফেরৎ দিতে পারবো না।তবুও আমার জন্য এতকিছু করেছে।আমি যেন ছোট না হই,এর জন্য কাউকে জানায়ওনি।রুশান কয় মাস আগে জানায় যে তুই ওর ভার্সিটিতেই পড়ছিস।আমি যেন তোর সাথে যোগাযোগ করি।আমি সাহস করতে পারছিলাম না।কিন্তু কয়দিন ধরে বেশ জোর দিয়েই আমাকে বলেছে।রুশানের কথাই ঠিক ছিলো রে,তুই আমাকে আগের মতই আপন করে নিলি।
কথাগুলো অনেক কষ্টে বললো নওমি।ভিনা জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলো ওকে।নিজেকে শান্ত করে নওমি বলে-
-বল কবে দিতে আসবো বিড়াল?
-তুই না,আমি নিতে আসবো। আমি আন্টির সাথেও দেখা করতে চাই।
-ঘরের অবস্থা ভালো না রে।
-আমার কাছে লজ্জা?
নওমি মলিনভাবে হাসলো।
-আমি এখন যাই।আম্মু অনেকক্ষণ ধরে একা।ভয় লাগে কখন না কী করে বসে।
ভিনা দোকান থেকে সেট মেনু কিনে নওমির হাতে দিয়ে বললো,আন্টির জন্য নিয়ে যা।
নওমি চলে যাওয়ার পর ভিনা রিকশা নিলো না। সন্ধ্যা নামার আগে এই বিষন্ন সময়ে গভীর ভাবনায় ডুব দিলো।রুশানকে সবসময়ই ইম্যাচিওর একটা ছেলে ভেবে এসেছে।এই রুশান এত চাপা স্বভাবের,সেটাই বা কে জানতো।এরপরে খুব অদ্ভুত সমীকরণ মিলালো ভিনা।আজ পর্যন্ত যেই ভিনাকে কষ্ট দিয়েছে,কাকতালীয়ভাবে সে কঠিন শাস্তি পেয়েছে।কিন্তু ভিনা কখনো কারো জন্য বদদোয়া করেনি।ছোট বেলায় শিউলি বলতো,কাউকে বদদোয়া দিলে নিজের সৌভাগ্য নষ্ট হয়ে যায়।এর জন্য কাউকে অভিশাপ বা বদদোয়া দিতে নেই।ভিনার মা শিউলি নিজেও জীবনে অনেক মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পেয়েছিলেন।তার বাবার বাড়ি,বিশেষ করে শ্বশুর বাড়ির লোকজন অনেক বেশিই কষ্ট দিয়েছিলো তাকে।কিন্তু ভিনা নিজের মা কে কখনোই তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে দেখেনি,এমনকি বদদোয়াও করতে দেখেনি।মায়ের এই শিক্ষা স্বাভাবিকভাবেই ভিনার ভেতরে গড়ে উঠেছে।কিন্তু ভিনা জানে,কিছু কষ্টে অভিশাপ দেয়া লাগে না,রুহের হায় লেগে যায় এমনিই।কিন্তু ভিনা চায় না তার কাছের মানুষগুলো এভাবে কষ্ট পাক।একটা অচেনা ভয় অযৌক্তিকভাবেই নিজের মাঝে গড়ে উঠছে,যাবির কি শাস্তি পেয়েছে?কত বড় সেই শাস্তি?
••••••••••
রেহান অনেক বছর পর মন খুলে কাঁদছে।
-সত্যি বাবা আমার জন্য এ কথা বলেছে?তুই বানিয়ে বলছিস না তো রুশান?
-বিশ্বাস করো ভাইয়া,আমি নিজেও অনেক অবাক হয়েছি।সত্যিই বাবা তোমাকে ছাড়া অনেক কষ্টে আছে।একজন মানুষের জন্য আমাকে আর বাবাকে কষ্ট দিও না প্লিজ।ফিরে আসো দেশে।
-কিন্তু,আমি মা কে ক্ষমা করতে পারবো না রুশান।তোর ধারণা নেই সেই ভুল বিয়ের কারণে নাবিহার কত ভুগতে হয়েছে!
-নাবিহা আপু থেমে থাকেনি,এগিয়ে গেছে এবং সে হ্যাপি আছে। এটাই তো তুমি চেয়েছিলে।তাহলে এখন তোমারো আগানো উচিৎ।
-আগাতে পারবো নাকি জানিনা।কিন্তু আমি বাবাকে আর কষ্ট দিবোনা।আমি এক মাসের ভেতরেই দেশে ফিরবো।আর খবরদার তুই এটা কাউকে জানাবিনা।আমি সোজা বাবার কাছে যেয়ে তাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই।
-প্রমিস ভাইয়া,আমি কাউকে জানাবো না।তুমি শুধু ব্যাক করো দেশে,কতদিন তোমাকে দেখিনা!
.
.
.
চলবে.......................................................................