ভিনা শুয়েছিলো নিজের রুমে,ঘর অন্ধকার করে,পর্দা টেনে।আজ থেকে ঠিক এক বছর আগের ঘটনাগুলো স্পষ্ট মনে পরছে,কেমন আশাহীন বিষন্ন ছিলো সেসময়!সোহেল ঘর থেকে বের করে দিলো,রুপিন দূর করে দিলো,যাবির প্রতারণা করে হাত ছেড়ে দিলো।যাদের কে ছাড়া জীবনে বেঁচে থাকাই অসম্ভব মনে হতো,তারাই এক এক করে দূরে সড়িয়ে দিয়েছে।
-আসবো?
সোহেল দরজায় নক করলো।ভিনা চোখ মুছে বেড সাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলো।আজকে প্রিতির কাছে যায়নি,রয়ে গেছে।অনেকদিন পর নিজের ঘরে থেকে দুঃখ যেন জেঁকে বসেছে।
-বসো বাবা।
-শরীর ভালো?
-হুম।
-চশমা নিয়মিত পরছো?
-হ্যাঁ,এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
-রাতে খেলি না,খাবার নিয়ে আসি?
-না,ইচ্ছা করছে না।
-আগের কথা ভেবে কী হবে বল।আগাতে তো হবে।
ভিনা মাথা নিচু করে আছে।ফোঁটা ফোঁটা পানি পরছে জামার উপর।সোহেল যে বুঝতে পেরেছে মন ভারের কারণ,এইটাই অনেক।
ভিনাকে চুপ থাকতে দেখে সোহেল নিজেই কথা শুরু করলো।
-মাহভিনস নিয়ে রুশানের সাথে কথা হয়েছে?
-হ্যাঁ, কাদের ভাই এসে পরছে,তাই জানিয়ে দিয়েছি না আসতে।
-ওর মতামত জিজ্ঞেস করেছিলি?
-কী মতামত?
-ও আসলেই কাজ ছাড়তে চায় নাকি?
-রুশান কেন নিজের উপর ঝামেলা আনবে বলো।
-এটা ঝামেলা মনে করছে না রুশান।ও সত্যি কাজ করতে চায়,কিন্তু তুই চাইলে।
-আমি চাচ্ছি না ও কাজ করুক।
-কেন?
-আমি চাইনা রুশান আমার লাইফের কোনো ক্ষেত্রেই ইনভলভ হোক।মাহভিন'স নিয়ে কাজ করতে গেলে এই বাসায় ওর নিয়মিত আসা লাগবে।দরকার কী এতকিছুর?
-মানুষ সারাজীবন একা থাকতে পারেনা ভিনা।
ভিনা ভ্রু কুঁচকে সোহেলের দিকে তাকালো।এই কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে।
-আমি একা না বাবা,তোমরা আছো,প্রিতি আপু আছে।আমার কাউকে দরকার নেই।
-আমরা সবসময় থাকবো না।
-তখন একাই থাকতে পারবো।নিজের জীবনের সাথে মানুষকে জড়াতে আমার ভয় লাগে।
-সবাই এক না,আর সময় ও সবসময় এক থাকে না ভিনা।বয়স কত তোমার?এখনি এত বিষন্ন হয়ে যাচ্ছো কেন?এত আশাহীন হলে জীবন কীভাবে চলবে?
-এভাবেই চলবে বাবা।আশা করেও বা লাভ কী?সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনার কাছে এগুলোর কোনো মূল্য আছে?মানুষ জন্মগত আশাহীন হয় না।সবচেয়ে আশাবাদী মানুষগুলোই দিনশেষে আশাহীন হয়।
-এমন কেন করছিস মা।আমার অনেক ভয় লাগে তোকে নিয়ে।
-ভয়ের কারণ নেই বাবা।এমন পাপের বোঝা ঘাড়ে নিয়েও কীভাবে ভয় পাও?এরচেয়ে খারাপ কীই বা হবে আমার সাথে?
-ভিনা....
-কী বাবা?বিয়ের আগে বাচ্চা হয়ে গেছে।একজন মেয়ের জীবনে এর চেয়ে খারাপ কীই বা হতে পারে?
-মেয়ে ছাড়াও তুই একটা মানুষ।এত ন্যারো চিন্তাভাবনা কেন তোর?জীবন পরে আছে।জীবন মানে কি এতটুকু?জীবন মানে অনেক কিছু!পড়াশোনা করবি,মানুষের সাথে মিশবি,পৃথিবী চিনবি,বিয়ে করবি,নিজের সংসার করবি,নিজের সন্তানকে নিজে বড় করবি।
শেষ বাক্যে ভিনার বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হলো।সব ঠিকঠাক আছে।পড়াশোনা করছে,মাহভিনের নিরাপদ জীবনের ব্যবস্থা হয়ে গেছে,চমৎকার একজন শিক্ষকের সাথে পরিচয় হয়েছে,যে খুব আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা নিয়ে আগাতে সাহায্য করছে।আর প্রিতি তো বড় বোন হয়ে ছায়ার মত আছেই।এত এত ভালোর মাঝেও কিছু মুহূর্তে নিজেকে এত নিঃস্ব,এত অসহায় কেন মনে হয়?
-ভিনা,নিজের সাথে এমন করিস না মা।আমি কয়দিন থাকবো কে জানে।
-বাবা প্লিজ....এসব কেন বলছো আমাকে?
-সত্যি করে বল তো, রুশান কি জানে মাহভিন তোর বোন না?
-না।
-কখনো যেন জানেও না।
-আমি জানাবো না।এই কারণে যে,মা মাহভিনকে নিজের সন্তানের মতো যে অধিকারে বড় করছে,সেটা বিন্দুমাত্র প্রশ্নবিদ্ধ হোক।কিন্তু আমার জীবন আমি অন্যের সাথে সাজাবো,এই কারণেই নিজের অতীতে করা ভুল লুকাবো,এমন মেয়ে আমি না।আর যেহেতু তোমাকে কথা দিয়েই দিয়েছি,আমি নিজ থেকে কখনো এই ব্যাপারে কাউকে জানাবো না,তাই আমি অন্য সম্পর্কেও যাবো না,বিয়ে তো কখনো না।
সোহেল হতভম্ব হয়ে গেলো ভিনার কথা শুনে।সোহেল এ বিষয়ে সরাসরি কিছু না বললেও ভিনা ঠিকি বুঝে ফেলেছে সে কী বলতে চায়।এত বড় কবে হলো তার মেয়ে?আর বয়সের তুলনায় এই অসময়ে আসা উপলব্ধি ভিনার জন্য যে ভালো না,তাও বুঝতে পারছে।
-কেন ভিনা?কেন?
-কারণ,আমি একাই ভালো ছিলাম,ভালো থাকবো।
••••••••••••
-সায়বা তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস।
-আমি না জানলে কী করবো আপা?
-তুই জানিস,কিন্তু বলছিস না।
-এটা তোমার বাড়াবাড়ি আপা।তোমার ছেলেদের জীবন,তোমার দায়িত্ব।আমাকে কেন এসবে জড়াও।
-আমার কারণে তোর সংসার টিকে আছে,ভুলে গেছিস?
-আর কত বছর এমন করবা আপা?আমার এখন বাচ্চা হয়ে গেছে,কত বছর সংসার হয়ে গেছে,তবুও এখন এমন করবা?
-তুই ই বাধ্য করছিস করতে।
-আমি নিজেই উনাকে বলবো।
-হাসালি আমাকে।যা মুরোদ থাকলে বল না।দেখি সায়বার কত দম।
জেবা তাচ্ছিল্য ভরে কথা শেষ করলেন।
সায়বা বোনের এবারের অপমান কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলো না।পুরো দুপুর নিশ্চুপ বসে থেকে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো,তার স্বামী সুমনকে সব বলে দিবে।এতে তার সংসার ভেঙ্গে গেলেও,এই চাপ নিয়ে কোনোভাবেই তার পক্ষে থাকা সম্ভব না।বিকালে ওয়াহিদ,তার স্বামী,ঘরে ফিরলে সায়বা সোজা চলে যায় ঘরে।
-দেখুন কিছু কথা বলবো আমি।এরপর যদি আপনি সংসার নাও করতে চান,আমার কোনো দাবী থাকবে না।শুধু কাইফকে নিজের সাথে নিয়ে যায়েন।
-মানে?সায়বা এসব কী বলছো?
-হ্যাঁ। এতটুকু কথা রাখবেন।
-বলো তো কী হয়েছে?
-আমি সত্যিই আপনাকে শুধু ভালোবাসি।
-আশ্চর্য!খুলে তো বলবে?
-অনেক আগে,যখন আমি এইটে পড়তাম,আমাদের বাড়ির পাশেই মাজেদ ভাই থাকতো।উনাকে আমার ভালো লাগতো।একদিন এই কথা বলে আমি উনাকে চিঠি দিতে গিয়েছিলাম।
-তারপর?
-আপা চিঠি দেখে ফেলেছিলো।এতটুকুই।
-তো?
-আমি অনেক বড় ভুল করেছি।আমাকে ক্ষমা করে দিন।বিশ্বাস করুন,আমি শুধু আপনাকেই ভালোবাসি।তার সাথে কিছুই ছিলো না আমার।
-বুঝলাম,কিন্তু কী হয়েছে এতে?এত বছর পর কেন এসব বলছো?
-আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন?
-ক্ষমা আসবে কেন?তুমি কী এমন করেছো যে ক্ষমা চাইতে হবে?
-আ..আ..পনি..
-বোকাই রয়ে গেলে।মানুষ কত কী করে!আমি ভাবলাম কী না কী!তুমি পারোও সায়বা।
-আপনি অনেক ভালো।অনেক বেশি ভালো!
ওয়াহিদ মুচকি হেসে চলে গেলেন।সায়বার নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করছে।অযথাই এত বছর নিজেকে খাঁচায় আটকে রেখেছিলো।এরপর জেবাকে ফোন দিয়ে সায়বা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো-
-সবাই তোমার মতো না আপা।আমি বলে দিয়েছি ওয়াহিদকে।আর কখনো আমাকে রুশান রেহানের ব্যাপারে চাপ দিবে না,ভুলেও না।
.
.
.
চলবে.......................................................................