ভার্সিটিতে আজকে উৎসবের আমেজ,প্রতি বছর যে ক্লাব ফেয়ার হয়,সেটা অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মত,কখনো বা এর চেয়েও জাঁকজমকভাবে উদযাপিত হয় এখানে।ফ্রেশার,কারেন্ট স্টুডেন্ট,এলুমনি সবার জন্যই এটা যেন এক প্রাণের মিলনমেলা।পরিচয় পর্ব,হাসিঠাট্টা,গান বাজনা নিয়ে এখনকার জেনারেশনের একদম মনের মতো অনুষ্ঠান হয় ক্লাব ফেয়ারে।
রুশান একদম শুরু থেকেই বিভিন্ন ক্লাবে থাকলেও,ভিনা সেকেন্ড সেমিস্টারের পর,অনেকটা রুশানের কথাতেই তিনটা ক্লাবে যুক্ত হয়।লিটারেচার,ড্রামা এবং ডিবেট ক্লাবে। লিটারেচার ক্লাবে সদস্যা সংখ্যা খুব একটা বেশি না হওয়ায়,ভিনা ফ্রেশার হলেও সেক্রেটারি হয়ে আবার হেড ভলান্টিয়ার ও হয়েছে।ক্লাব ফেয়ারে প্রতিবারই জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যাক্তিত্বদের ইনভাইট করা হয়,অনুষ্ঠান শুরুর আগে যে বক্তব্য রাখতে হয়,সেটা সবসময় লিটারেচার ক্লাবের সদস্যদের মধ্যেই একজন দেয়,সেহিসাবে এবার ইন্ট্রোডাক্টরি স্পিচের জন্য ভিনাকে সিলেক্ট করা হয়েছে।ভিনা প্রথমে রাজি না হলেও পরে মিস রুদমিলার উৎসাহে রাজি হয়েছে।লিটারেচার ক্লাবের সিনিয়র সেক্রেটারি জিনিয়া তাসনিম খুবই লিবারেল এবং ভালো একজন মানুষ। আর প্রেসিডেন্ট ফাওয়াদ আহমেদ ও অনেক কো-অপারেটিভ,সিনিয়র হিসেবে আচরণে কোনো দাম্ভিকতা নেই।গত অনুষ্ঠানগুলোতে তারা বক্তব্য রেখেছিলো,এবার ফ্রেশারদের সুযোগ দিচ্ছে।এই ক্লাব ফেয়ার নিয়েই গত এক সপ্তাহ ধরে মাতামাতি চলছে ভার্সিটিতে,ইন্ট্রোভার্ট ধরনের মানুষ হলেও,ভিনা ভালোই উপভোগ করছে ব্যাপারটা।
ফারজানাও পিছিয়ে নেই,গান বাজনা পছন্দ না করা সত্ত্বেও কালচারাল ক্লাবে জয়েন করেছে,এছাড়াও রুশান যেসব ক্লাবে আছে,তার সবকয়টাতেই এক্টিভ রয়েছিলো কয়দিন।রুশানের সাথে সম্পর্ক ঠিক করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও,লাভ হয়নি,রুশান খুব সাবধানে এড়িয়ে গেছে ফারজানাকে।পুরো ব্যাপারটা ফারজানা এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যেন প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে মনোমালিন্য চলছে,রুশানের এ নিয়ে ঘোর আপত্তি থাকলেও উৎসবমূখর এই আনন্দের পরিবেশ নষ্ট করেনি,তাছাড়া ব্যাপারটা সিনিয়রদের নজরে আসুক,রুশান সেটা মোটেও চায়নি,নিজের নাম গুড বুকেই রাখতে চেয়েছে।
••••••••••••••
অফহোয়াইট বালুচরি সিল্কের ট্রেডিশনাল শাড়ি,যার পাড়ে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পটচিত্র,হাই নেকের থ্রি কোয়ার্টার ব্লাউজ,খোলা চুল,চোখে এপ্রিকট রঙের হালকা ফুল রিমের চশমা,কানে মাঝারি আকারের বাহারি ঝুমকা,চোখে কাজল,ঠোঁটে ক্যারামেল ন্যুড কালারের লিপ্সটিক আর খুবই মৃদু ঘাণের পারফিউম,এই ছিলো ক্লাব ফেয়ারে ভিনার পুরো আউটলুক।রুশানের চোখ ভিনার উপর পরতেই যেন হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো।কমবয়সী কোনো মেয়েকে অফহাইট রঙ্গের শাড়িতেও যে এত চমৎকার লাগতে পারে,রুশান কখনো কল্পনাও করেনি।ভিনাকে ঠিক অপ্সরী না,রুচিশীল এক অনন্য মানবী মনে হচ্ছে।পোষাক খুব রুচিশীল হলেও সেটা ভিনার ব্যক্তিত্ব ছাপিয়ে যায়নি,বরং আরো ফুটিয়ে তুলেছে।
রুশান নিজে পড়েছে জনপ্রিয় এক বাংলাদেশি বুটিকের গাড় বেগুনি রঙের পাঞ্জাবি,চুল হালকা জেল দিয়ে সেট করা।একদম সাধারণ আয়োজন সাজসজ্জায়,কিন্তু এতেই আশেপাশের অনেকেরই নজর কেড়েছে ভালোমতো।
-ভার্সিটির ছেলেগুলো আজকে মনে হয় নিজেদের কোমল হৃদয়খানি এখানে রেখেই বাসায় ফিরবে ভিনা।
ভিনা ভ্রু নাচিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো,এরপর একটা কাগজে লেখা ইন্ট্রোডাকটরি স্পিচে মনোযোগ দিলো,জীবনে এই প্রথমবার স্টেজে উঠে কথা বলবে কত মানুষের সামনে,ভাবতেই পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে,নার্ভাস ও লাগছে ভীষণ।কিন্তু প্রফেসর রুদমিলা খুব আশা নিয়ে আছেন,জিনিয়াও এসে সাহস দিয়ে গেছে।বেশ বড় এই স্পিচে সব ক্লাব,ক্লাবের কার্যক্রম,ক্লাবে কে কোন পদে আছে সব বিবরণ রয়েছে।এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো আমন্ত্রিত অতিথিদের ব্যাপারে সব বলা আছে,যাদের অনেককেই ভিনা চিনে না।তাই স্টেজে ঠিকঠাক সব বলার জন্য এই কাগজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিনা আশেপাশের এ্যরেঞ্জমেন্ট দেখছে,আবার সেই কাগজে চোখ ও বুলাচ্ছে,হাতছাড়া করছে না একটুও।
ফারজানা অনেক্ষণ ধরে ঘুরঘুর করছে আশেপাশে,আজকেই সেই ক্লাব ফেয়ার,আজকেই কিছু করার কথা ছিলো,কিন্তু করতে পারছে না।গত কয়দিন ধরে ভীষণ চাপে আছে,কাকনের ব্যাগে কোনো টাকা পাচ্ছে না,আলমারিও লক থাকে।আগে চুরি করে রাখা টাকা দিয়ে চলছে,সেমিস্টার ফি এর অধিকাংশ রুশানের থেকে ধার করা,বাকী টাকা কান্নাকাটি করে বাসা থেকে নিয়েছে,আগামী কয়মাস হাত খরচ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।দুইদিন আগে আলমারি চাবি দিয়ে খুলতে যাওয়ার সময় তিথি দেখে ফেলেছে।এটা ওটা বলে সামলানো লেগেছে,কিন্তু মনে একটা ভয় তখন থেকেই কাজ করছে,এটা নিয়ে কোনো বড় ইস্যু না হলেই হয়।অন্যমনস্ক হয়ে এদিক ওদিক হাঁটার সময় ফারজানা খেয়াল করলো ভিনা এক হাতে কাগজ,মোবাইল অন্যহাতে ডেকোরেশনের জিনিসপত্র সহ বাস্কেট নিয়ে যাচ্ছে।আজকে ভিনাকে চোখে পরার মতো ভালো লাগছে,কেন সবার এত গুণ,এত রূপ,এত প্রাচূর্য্য!নিজের দিকে তাকিয়ে ফারজানার চোখে পানি এসে পরলো,ঝকমকা সালোয়ার-কামিজের সাথে ম্যাচিং করে সবকিছু পরেছে,দেখতে অনেক গর্জিয়াস লাগলেও,ভিনার সামনে ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে সব।বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে ফারজানা ভিনার কাছাকাছিই থাকলো সুযোগের অপেক্ষায়।
অনুষ্ঠান শুরুর দুই ঘন্টা আগে রিদওয়ান আসলো।কোনো ক্লাবে এক্টিভ নেই যদিও,কিন্তু তবুও সবার এই আয়োজনে অংশ হতে এসেছে।সবার সাথে হাসিমুখে কথা বললেও চোখ খুঁজছে ভিনাকে।কোথায় গেলো মেয়েটা?গত এক সপ্তাহে ঠিকমতো কথাও হয়নি,এত ব্যস্ত ছিলো সে।বেশিরভাগ মেয়ে শাড়ি পরে এসেছে,আর ভিনা তো আজকের উপস্থাপিকা,অবশ্যই শাড়ি পরার কথা।শাড়িতে নিজের ভালোবাসার মানুষকে দেখার জন্য হাহাকার করছে মন।কেমন হয় যদি আজকেই মনের কথা ভিনাকে জানানো যায়?পরিবেশ সব ক্ষেত্রেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ,আজকে ভিনার মন ভালো থাকার কথা,সুযোগ তো কাজে লাগানোই উচিৎ।বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে রিদওয়ান সাজিয়ে নিলো কীভাবে কী করবে,এরপর ভার্সিটি থেকে বের হয়ে ফুলের দোকানে চলে গেলো।ভিনার প্রিয় ফুল কী সেটা জানা না থাকায় সেফ অপশন হিসেবে লাল গোলাপই নিলো বেছে।সুন্দর ফ্রেশ আর বেশ বড় দেখে লাল গোলাপ নিলো।খুব সাবধানে একটা প্যাকেটে রেখে ভার্সিটির কাছের একটা গিফট শপ থেকে কার্ড কিনে নিলো,সাথে কিনলো লাল কালির জেল পেন।সুন্দর গোটা অক্ষরে খুব সাধারণভাবেই লিখলো,I love you Veena,will you be mine?Please?
••••••••••••••
-অল ওকে?
-নার্ভাস লাগছে আপু।তুমিই যাও?তোমার এক্সপেরিয়েন্স আছে,অথবা ফাওয়াদ ভাই?
-কেন সুইটহার্ট?আমাদের ও তো প্রথমবার ছিলো এই জায়গায়,আমরাও নার্ভাস ছিলাম।শুরু না করলে কীভাবে হবে?বছরশেষে তোমরাই তো ক্লাব সামলাবে।
-কিছু যদি উল্টাপাল্টা হয়ে যায়?
-উহু!একদম হওয়া যাবে না,নেগেটিভ ভাবার দরকারই নেই,স্টেজে যাওয়ার আগে আমার কাছে রিহার্সেল দিয়ে যেও।
-থ্যাংক্স আপু।
-মেনশন নট!
ভিনা ঢোক গিললো,মন থেকে ভয় ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছে।পাশ থেকে ফারজানা এক বোতল পানি এগিয়ে দিলো।ভিনা কিছুটা অবাক হয়েই পানির বোতল নিলো-
-কী অবস্থা ফারজানা?
-যেমন থাকার তেমনই,তোমার তো খুবই ভালো দিন যাচ্ছে আজকাল।
ভিনা অনেক কষ্টে হালকা হেসে বললো-
-কোথায় আর,স্টেজে যেতে হবে,আগে যাইনি কখনো।
-মুখস্ত তো বলতে হবে না,কাগজ তো আছেই।
-তবুও।
ফারজানা কিছু বললো না,ভিনার হাত থেকে বোতল নিয়ে নিজে পানি খেলো।রুশান কে দেখা যাচ্ছে না কোথাও,অথচ আজকে রুশানের ভিনার কাছেই ঘুরঘুর করার কথা।পাশ থেকে ফারজানাকে একজন ভলান্টিয়ার বললো-
-তুমি কি কোনো ক্লাবের ভলান্টিয়ার?
-না,কেন?কোনো সমস্যা?
ফারজানার কাঠখোট্টা জবাবে সেই মেয়ে ভীষণ বিরক্ত হলো।
-ক্যাফেটেরিয়া অথবা দোতলার কোনো ক্লাসে যেয়ে বসো,তিনতালায় ক্লাসরুম বন্ধ ফাংশনের জন্য।অডিটোরিয়ামে শুধু ভলান্টিয়ারদের থাকতে বলেছে।
-কে বলেছে শুনি?
-ক্লাবের সিনিয়ার রা,অডিটোরিয়ামে এখন শুধু ভলান্টিয়ারদের কাজ আছে,অযথা ভীড় করবা না।
-একটা মানুষে ভীড় হয়ে যায়?
-আজব মেয়ে তো তুমি!
-আমি আজব মেয়ে?নিজে যে গায়ে পরে ঝগড়া করছো?
-রাবিশ!জোকার একটা।
ভলান্টিয়ার মেয়েটা চলে গেলো।ফারজানা রাগে ফেটে পরছে।ভিনার দিকে তাকিয়ে বললো-
-এদের সাথে কাজ করো তুমি ভিনা?
-ভুল কিছু বলেনি,ফারজানা।আমি স্পিচের জন্য খেয়াল করিনি,নাহলে আগেই বলতাম।
দাঁতে দাঁত চেপে ফারজানা অন্য চেয়ারে যেয়ে বসলো।হাজার অপমানিত হোক আজকে এই হলরুম ছেড়ে যেতে পারবে না।চুপচাপ বসে থাকার সময় দেখলো রিদওয়ান কার্ড আর একটা প্যাকেট হাতে অডিটোরিয়ামে কাকে যেন খুঁজছে।প্যাকেটের খোলা অংশে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখলো গোলাপ ফুলের পাপড়ি বের হয়ে আছে।ফারজানা চেয়ার থেকে উঠে সোজা রিদওয়ানের কাছে গেলো,অনুষ্ঠানের তখনও সোয়া ঘন্টা বাকী।
-কাউকে খুঁজছো?
রিদওয়ান থতমত খেলো,ফারজানাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে,কিন্তু কাউকে ঠিক সরাসরি এড়িয়ে যাওয়া পারতপক্ষে সম্ভব না।
-হ্যাঁ
-কাকে?
-এমনি,আচ্ছা ভিনা কি ভেতরে আছে?
-হ্যাঁ আছে।
-ওকে
রিদওয়ান ভেতরে ঢুকতে নিলে ফারজানা আটকে দিলো,
-অনুষ্ঠান শুরুর আধা ঘন্টা আগে অডিটোরিয়াম খুলবে,এখন ভলান্টিয়ার ছাড়া বাকী কেউ এলাউড না।
-তুমি ভলান্টিয়ার?
ফারজানা বুকে সাহস নিয়ে বললো-
-না তো কী?এমনিই এখানে থাকবো?
-ও!ভিনার ফোন মেবি সাইলেন্ট,অনেক্ষণ ধরে ট্রাই করছি,পাচ্ছিনা।ওকে বলো আমাকে যেন ফোন দেয়।
-আর?
-থাক,তুমি ভিনাকে সরাসরি এখানেই আসতে বলো।
-কেন?কী প্রয়োজন?
-এত কোয়েশ্চেন কেন?আমার কোনো পার্সোনাল কাজ থাকতে পারে না?
-দাঁড়াও এখানে।
ফারজানা বুঝে গেছে কী হবে সামনে।হাতের গিফটের প্যাকেট আর ফুল দেখে নিশ্চিত রিদওয়ান ভিনাকে প্রপোজ করতে চাচ্ছে।এতক্ষণ পর সুযোগ তাহলে এসেছে একটা,শুধু সুযোগ না,খুবই ভালো সুযোগ আসলে।ফারজানা অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে মিহিকা,সেজান আর ক্লাসের যারা পরিচিত আছে,সবাইকে ডেকে জড়ো করলো।এরপর পরিচিত ছাড়াও র্যান্ডম সবাইকে একসাথে ডেকে তিন তালায় যেতে বললো।
অনুষ্ঠান শুরুর ত্রিশ মিনিট আগে ফারজানা প্রথমে রিদওয়ানকে উপরে পাঠালো এরপর ভিনাকে ডাক দিলো।ভিনা প্রথমে একদম যেতে চাইলো না,ফারজানা প্রায় জোর করেই নিয়ে গেলো ইমার্জেন্সির কথা বলে,ভিনা কোনোমতে ফোন নিতে পারলেও স্পিচের কাগজ নিতে পারলো না,আর সেই সুযোগে ফারজানা সেটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললো।সবশেষে ডাক দিলো রুশানকে,এই পুরো নাটকের প্রধান দর্শক তো রুশানই।
•••••••••••••••
তিনতালায় ডান পাশে ক্লাসরুমের করিডোরে রিদওয়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিনার মনে প্রশ্ন জাগছে। ভিনাকে রিদওয়ানের কাছে রেখে ফারজানা চলে গেছে।সবার এমন অদ্ভুত আচরণে খুব অবাক হচ্ছে ভিনা।
-রিদওয়ান....এখানে কী করছো?
-ফারজানা আরকি আসতে বললো...
-কেন?
রিদওয়ান ভাবলো ফারজানা হয়ত বুঝে গেছে প্যাকেট দেখে,তাই সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে এসেছে।এই প্রথম হয়ত সদ্বুদ্ধি এসেছে এই মেয়ের।
-কিছু বলার ছিলো তোমাকে।
-একটু জলদি বলো,আমার যেতে হবে।
রিদওয়ান হাঁটু গেড়ে বসলো,প্যাকেট থেকে গোলাপ ফুল বার করে।
-ভিনা...আই...
পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই বাম সাইডের করিডোর থেকে হুরমুরিয়ে অনেকজন এসে পরলো।মিহিকা আর সেজান বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে ভিনার দিকে।রিদওয়ান তখনো হাঁটু গেড়ে বসা।রুশান ভিড় ছাপিয়ে সামনে এসে ধাক্কা খেলো রীতিমতো। ভিনা ঘটনার আকস্মিকতায় কথা বলাও ভুলে গেলো।পেছন থেকে কয়জন চেঁচিয়ে বলছে,সে ইয়েস,সে ইয়েস।
-রিয়েলি!এর জন্যই ভিনা প্রতিদিন রিদওয়ানের পাশে বসতো?(মিহিকা)
-এর জন্যই কাউকে পাত্তা দিতো না ভিনা(সেজান)
-মিলেছে ভালোই দুইজনের।ক্লাসের দুই সি আর কাপল(ফারজানা)
ভিনা নিজেকে সামলে ইশারায় রিদওয়ানকে উঠে দাঁড়াতে বললো।রিদওয়ান সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালো।পেছন থেকে রুশান এসে দাঁড়ালো ভিনার পাশে।
ভিড়ের মাঝে কথা বলার ফিসফিস আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।ফারজানা একটু জোড়েই ক্রুড় হাসি দিয়ে বললো-
-মনে হয় ডাবল টাইমিং করছিলো,ধরা খেয়ে গেছে।
-ভিনা?ডাবল টাইমিং?ও মাই গড (সেজান)
ভিনা মাথা নিচু করে সব শুনে গেলো।এরপর ধীর গলায় সবাইকে অনুরোধ করলো নিচে অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান এটেন্ডের জন্য চলে যেতে।এদিকে জিনিয়া ভিনাকে খুঁজতে খুঁজতে তিন তালায় এসে এ কান্ড দেখে রেগে গিয়েছে অনেক।
-হচ্ছেটা কী এখানে!হোয়াট ননসেন্স!
কেউ কোনো কথা বললো না,জিনিয়া সবাইকে হাত দিয়ে সড়িয়ে ভিনার কাছে গেলো।
-তুমি না বললে অনেক নার্ভাস,আমার সামনে রিহার্স করবে?এখানে কী করছো?
-স্যরি আপু,আসলে এখানে অনেক বড় মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে।
-অনুষ্ঠান শুরু হতে বেশি বাকী নেই,স্টেজে এখনি ওঠা লাগবে,ফুল দিয়ে গেস্টদের ওয়েলকাম করতে হবে,এক্ষনি চলো।
ফারজানা পিছে পুরো নাটক দেখছে,আরো বড় নাটক স্টেজে অপেক্ষা করছে,আত্মতৃপ্তিতে মন ভরে যাচ্ছে।
জিনিয়া হাত ধরে ভিনাকে নিয়ে গেলো নিচে।ভিনা লজ্জায় প্রায় কেঁদে দিয়েছে,অনেক কষ্টে কান্না চেপে রাখলেও পানি পরেছে চোখ দিয়ে,কাজল লেপ্টে গেছে।তাই জিনিয়াকে রিকোয়েস্ট করে ওয়াশরুমে গেলো।সেখানে গিয়েই ভেঙে পরলো কান্নায়,মুখের সাজ পুরো নষ্ট হয়ে গেছে।ভালোমতো একবারে মুখ ধুয়ে মুছে কোনোমতে আবার কাজল আর লিপ্সটিক লাগিয়ে চুল ঠিক করে ভিনা শেষবার আয়নায় তাকালো,নিজের চাহনির মাঝেই খুঁজে নিলো সাহস,এরচেয়েও অনেক বাজে পরিস্থিতি পার করে এসেছে,এটা কোনো ব্যাপারই না।
••••••••••••••
স্টেজে গেস্টদের আমন্ত্রণ জানানোর পর ভিনার খেয়াল হলো,স্পিচের কাগজ হাতে নেই,এখনি স্পিচ দিতে হবে।হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ই পাশ থেকে রুশান নিজের মোবাইল বাড়িয়ে দিলো,সেখানে স্পিচের ছবি তোলা।পোডিয়ামের সামনে এসে ভিনা খুব সাবধানে মোবাইলের গ্যালারি ওপেন করলো।পোডিয়ামের উপর মোবাইল রেখে সাবলীলভাবে স্পিচ দিচ্ছে ভিনা।অনেকবার পড়ার কারণে বেশিরভাগই নিজ থেকে বলে দিলো,খুব কমই মোবাইল স্ক্রিনে তাকালো।স্পিচ শেষে করতালিমুখর অডিয়েন্সের সামনে মিষ্টি এক হাসি দিয়ে স্টেজ থেকে নেমেই বড় করে নিঃশ্বাস ফেললো।এরপর সোজা চলে গেলো অডিটোরিয়ামের বাইরে।ফারজানা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই,এমন হওয়ার কথা ছিলোনা।রুশান ও ভিনার সাথে বেড়িয়ে আসলো,শুরুতেই কিছু বললো না। ধীরে ধীরে বললো-
-ফারজানা তোমার স্পিচের কাগজ নিয়ে নিয়েছিলো।ওর ব্যাগের ভেতরেই ছিলো এই কাগজ,আমি দেখেছি নিজেই।
ভিনা ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখলো,এরপর পরম কৃতজ্ঞতায় তাকালো রুশানের দিকে।সত্যিই আজকে রুশান সময়মতো না আসলে,আরো শত শত মানুষের সামনে অপমানিত হওয়া লাগতো।
••••••••••••••
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর মোটামুটি পুরো ভার্সিটিতে চাউর হয়ে গেলো,তিন তালার বন্ধ ক্লাসরুমে দুইজন ছেলে মেয়েকে পাওয়া গিয়েছে।মূল ঘটনা পরিবর্তন হতে হতে এমন হলো যে,অবৈধ কাজ করতে গিয়ে ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্ট এর দুইজন স্টুডেন্ট ধরা খেয়েছে,তাদের হাতেনাতে ধরতে আরো স্টুডেন্ট গিয়েছে উপরে,অনেকে আরো যুক্ত করলো ছেড়া কনডমের প্যাকেট পাওয়ার ঘটনা।ভিনার কানে সবই আসলো,কিন্তু কোনো রিয়েক্ট করলো না।অপেক্ষা করলো ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপের।
•••••••••••••••
প্রফেসর রুদমিলার সামনে একুশজন স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে আছে।এরাই ক্লাব ফেয়ারের দিন তিন তালার নাটকের অংশ ছিলো।প্রফেসর রুদমিলার সাথে আরো রয়েছে ভার্সিটির প্রক্টর ও রেজিস্টার অফিসার।মূলত ভিনা আর রিদওয়ান মিলে একসাথে প্রক্টরের কাছে মেইল করেছিলো,পরিকল্পিতভাবে সম্মানহানির বিষয় নিয়ে।ফারজানা কখনো ভাবতেও পারেনি এরকম কিছু হতে পারে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভিনা যে সত্যিই এমন সিরিয়াস ডিসিশান নিবে,জানা থাকলেও ভুলেও এই পদক্ষেপ নিতোনা।
প্রক্টর নোমান উদ্দিন ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন
-সিসিটিভি দেখে তোমাদের আনা হয়েছে এখানে,বুঝতেই পারছো মিথ্যা বলার সুযোগ নেই,তিন তালায় কেন গিয়েছিলে তোমরা?
কেউ কোনো সদ্বুত্তর দিতে পারলো না,বোকার মতো একজন আরেকজনের দিকে তাকালো।এভাবে তাকানো দেখে প্রফেসর রুদমিলা বললেন-
-কেন বাদ দাও,কার কথায় গিয়েছিলে সেখানে?
প্রথমে চুপ থাকলেও ভীড় থেকে দুই একজন বলা শুরু করলো।কেউ নিজের বন্ধুর নাম বললো,কেউ ঠিক মনে করতে পারলো না,কেউ চুপই থাকলো।সেই মুহূর্তেই রুশান প্রায় জোর গলায় বললো-
-ফারজানা,ম্যাম।ও আমাকে প্রায় জোর করে নিয়ে গিয়েছে উপরে,বলেছে অনেক বড় কিছু হয়েছে।
ফারজানা পা অবশ হয়ে গেলো,মনে হচ্ছে এক্ষনি পরে যাবে।
রুশানের কথা শুনে এক এক করে সেজান,মিহিকা আর বাকী সবাই ও বললো,ফারজানাই ওকে উপরে পাঠিয়েছে।
প্রক্টর ফারজানার দিকে তাকিয়ে বললেন-
-কেন নিয়ে গিয়েছিলে সবাইকে উপরে?
-রিদওয়ান ভিনাকে প্রপোজ করতে চাচ্ছিলো তাই।সিসিটিভি তে দেখুন,ও বেন্ড হয়ে বসেছিলো রোজ হাতে।
তখনি ভিনা অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে নীরবতা ভাঙলো।প্রফেসর রুদমিলাকে বললো-
-ম্যাম,কাইন্ডলি আপনি সিকোয়েন্স চেক করুন।আগে আমি আর রিদওয়ান এসেছি,নাকি আগে বাকী সবাই উপরে গেছে।
সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গেছে ফারজানা সবাইকে ডেকে উপরে নিয়েছে।এরপর অনেকটা জোর করেই প্রথমে রিদওয়ান,পরে ভিনাকে ডেকেছে।
পুরো ঘটনা পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো সবার সামনে।ভিনা এতটুকেই থামলোনা,ফারজানা যখন রিদওয়ানের উপর দোষ চাপালো,ফুটেজ দেখিয়ে যে,রিদওয়ান প্রপোজের উদ্দেশ্যেই সেখানে গিয়েছে,তখন ভিনা বললো-
-রিদওয়ান যায়নি,তুমি নিয়েছো ওকে।সবচেয়ে বড় কথা ও এমন ছেলে না যে বন্ধ ক্লাসরুমে আমাকে ডেকে নিবে।আর তুমি ইচ্ছা করেই এমন করেছো ফারজানা।এর কারণ দুইটা,হয় তুমি আমাকে নিচু করতে চাইছিলে,অথবা চেয়েছিলে মানুষের চাপে পরে আমি রিদওয়ানকে যেন হ্যাঁ বলে দেই।যেই কারণেই চাও,আমার উত্তর হচ্ছে এই অন্যায় আমি মানবো না,আর রিদওয়ান আমার অনেক ভালো বন্ধু,ওকে আমি শুধুই বন্ধু হিসেবে দেখি এবং আমি বিশ্বাস করি,আমার মতামত কে ও রেস্পেক্ট করে।দুইজন ভালো বন্ধুর মাঝে সম্পর্ক নষ্ট করা ছাড়াও তুমি অনেক বাজে কাজ করেছো,এর জন্য আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না।
এক কথাতেই ভিনা ভালোমতো বুঝিয়ে দিলো পুরো ঘটনা,সেই সাথে রিদওয়ানের উত্তর ও দিয়ে দিয়েছে।হতভম্ব ফারজানা পরে অসুস্থ হয়ে সবাইকে ডিস্ট্র্যাক্ট করতে চাইলেও লাভ হলো না।প্রক্টর এসে জানিয়ে দিলো ফারজানাকে এই ভার্সিটি থেকে স্থায়ীভাবে বের করে দেয়া হয়েছে,ফারজানা দাপিয়ে কান্না করলেও,কেউ ভ্রুক্ষেপ করলো না।
প্রক্টরের রুম থেকে বের হওয়ার পর ভিনা রুদমিলার হাত ধরে কেঁদে দিলো,শিক্ষকের বেশে মমতাময়ী অভিভাবক পেয়েছে ভিনা,যিনি সব ঝড় ঝাপ্টা থেকে বাঁচিয়ে রাখেন।প্রফেসর রুদমিলা নিজেই ভিনাকে বুকে টেনে নিলেন-
-অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে তুমি,এত কান্না কেন?বোকা মেয়ে!
ভিনা কিছু বললো না।ফারজানার এমন ব্যবহারে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে,কিন্তু পানি মাথার উপরে চলে যেতে থাকলে,শক্ত হতেই হয়।উপায় নেই।
রিদওয়ান ভিনার কাছে লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চেয়েছে,ধন্যবাদ ও দিয়েছে।কারণ ভিনা স্টেটমেন্ট না দিলে সাস্পেন্ড ও হতে পারতো।আর শেষে এ কথাই বলেছে-
-তোমার কাছে আমার এই সম্মানের জায়গা,আমি কখনোই নষ্ট করবো না।তোমার মত একজন বিশ্বস্ত বন্ধু আমি সবসময় আমার পাশে চাবো।চাইলেই আমার উপর দোষ চাপিয়ে অনায়াসে তুমি চলে যেতে পারতে,যাওনি,এখানেই তোমার পার্থক্য ভিনা।তুমি আত্মকেন্দ্রিক না।
ঝড়ের বেগে পুরো খবর ভার্সিটিতে ছড়ালো,অনেকে বাহবাও দিলো ভিনাকে শক্ত পদক্ষেপের জন্য।জিনিয়া আর ফাওয়াদ রীতিমতো সোশ্যাল সাইটে ভিনার পক্ষ নিয়ে বক্তব্যও দিয়ে দিয়েছে।
ভিনা যখন সব ঝড়ঝাপটা কাটিয়ে উঠছে,তখন রুশানের ভাগ্য প্রহর গুনছিলো শনির দশার।
.
.
.
চলবে........................................................................