অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৩১ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


জেবা লনের একদিক থেকে আরেকদিক অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন।তার বোন সায়বা আস্ত একটা বদ হয়েছে।আগে রুশান রেহানসহ চৌদ্দ গুষ্টির সব খবর সায়বা কোনোকিছু বাদ না রেখে বলতো।এখন মুখই খুলতে চায়না।কিছুদিন যাবৎ স্মার্টফোন হাতে পাওয়ার সুবাদে ইউটিউবে বিভিন্ন ইসলামিক স্কলারের লেকচার শুনে নাকি বোধদয় হয়েছে যে কারো নামে গিবত করা উচিৎ না,কারো গোপন কথা বলা উচিৎ না এবং আরো অনেক কিছু!সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হলো জেবা ফোন দিলেই এসব জ্ঞানের কথা বলতে থাকে সায়বা,নিজের বোনের ও মাথা ঠিক করার বিফল প্রচেষ্টা। অনেক গুতোগুতি আর কিঞ্চিৎ ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে অনেক কষ্টে কিছু কথা আদায় করতে পারেন জেবা।ব্ল্যাকমেইল এর উৎস খুবই হাস্যকর,কিন্তু সায়বার কাছে সেটা জীবন মরণ ব্যাপার।সায়বার এ্যরেঞ্জ ম্যারেজ হলেও কোনো এক সময় গ্রামের এক ভাইকে পছন্দ করতো সায়বা,সেটা পছন্দ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো।কিন্তু সায়বা একদিন একটা চিঠি লিখেছিলো সেই ভাইয়ের জন্য,খুবই নিরীহ ধরনের চিঠি,কিন্তু জেবার চোখে সেটা পরে যায় এবং সারাজীবনের জন্য সায়বাকে নিজের মুঠোতে রাখার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যান জেবা।কোনো অপরাধ না করে,কারো জীবন নষ্ট না করেও ভীষণরকম অপরাধবোধ এবং ভয় নিয়ে সায়বা জেবার কাছে বাঁধা পরে যায়।নিজের সাজানো সুখের সংসার এবং আদর্শ স্বামী এই এক ঘটনার কারণে হারাতে পারেন বলেই তার দৃড় বিশ্বাস।বস্তুত, নিজের স্বামীকে একটু বেশিই ভালোবাসেন সায়বা।

রেহান এসেছে এক মাস হয়ে গেছে।এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় এসে সৌজন্য সাক্ষাতের পর আর দেখা হয়নি ছেলের সাথে। কেনই বা করবেন দেখা?যে ছেলেকে বড় করেছেন,সেই ছেলে অন্য মেয়ের জন্য,যার কিনা বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে গেছে,তার সাথে রাগ করে আছে।কী অকৃতজ্ঞ!আজকে নাবিহাকে এভাবে তাড়িয়ে না দিলে এত ভালো ডাক্তারের সাথে বিয়ে হতো ঐ মেয়ের?আর ভুল করে যে বিয়ে হয়েছে,সেটা তো ভেঙ্গে গেছেই,অনেক তামাশাও করেছে এটা নিয়ে,তাহলে সমস্যা কোথায়?

এসব ভেবে জেবার আরো রাগ হলো।তার উপর জেনেছেন যে রেহানের সাথে নাকি রুশান দরজা আটকে কথা বলে। কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয় না।যখনই জেবা জানতে চান তখনই এই কথা বলে সায়বা।বিষয়টা ভেতরে ভেতরে ভীষণ চাপ দিচ্ছে তাকে।তার যে স্ট্যাটাস এবং প্রতিপত্তি,সে হিসেবে অনায়াসে উনি কোনো হাই স্ট্যাটাস পরিবারের একমাত্র কন্যাদের জাদরেল শাশুড়ী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।সারাজীবন অন্যদের ডোমিনেট করে এসেছেন।ছেলেরা প্রেমের বিয়ে করলে সহজে এই মাতবরি ফলাতে পারবেন না,আবার ছেলেগুলাও হাত ছাড়া হতে পারে।এতবড় সর্বনাশ কীভাবে হতে দেন।

-মেডাম,চা খান।আগের চা ঠান্ডা হয়ে গেসে।তাই গরম কইরা থুইয়া গেলাম।

-তো এত বলার কী হলো?তোকে রাখা হয়েছে কেন?ঠান্ডা চা খাওয়ার জন্য?চুপচাপ কাজ করতে পারিস না?

সালাম চুপসে গিয়ে চলে গেলো।বিয়ের পর কোনোদিন এ বাসায় কোনো কাজের মেয়ে রাখেননি জেবা।সবসময় কাজের ছেলে রেখেছেন।এ যুগে বিশ্বস্ত কাজের ছেলে পাওয়া কঠিন,কিন্তু জেবা যেভাবেই হোক,এই অসাধ্য সাধন করে এসেছেন।খুব আজব হলেও নারীজাতির প্রতি তার বিতৃষ্ণা রয়েছে।কোনো বিচিত্র কারণ ছাড়াই উনি মেয়েমানুষদের দেখতে পারেন না।ছেলের বউ এই প্রজাতির মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট।

ফারুক লনে এসে গরম চা পেয়ে লোভ সামলাতে পারলেন না।তৃপ্তি নিয়ে গরম চায়ের স্বাদ নিচ্ছেন,এমন সময়ে জেবা তার লনে নয় নম্বর রাউন্ড দিয়ে দশ নাম্বার রাউন্ডের মাঝপথে ফারুককে আবিষ্কার করলেন।

-এটা আমার চা ছিলো।

-সালামকে আবার বলো বানিয়ে দিতে। 

-এটা ও সেকেন্ড টাইম বানিয়ে নিয়ে এসেছে।পারমিশন কেন নিলে না তুমি?

-আশ্চর্য!নিজের বাড়িতে নিজের টাকায় কিছু খাওয়ার জন্য যে পারমিশন লাগে জানতাম না তো।

-অযথা তর্ক করবে না।এ বাড়ি শুধু তোমার টাকায় চলে না।আমারো কন্ট্রিবিউশান আছে।

-এরপর থেকে ট্যাগ লাগিয়ে দিবে কোনটা তোমার টাকায় কেনা,কোনটা আমার।অবশ্য বাড়ি কিন্তু....

-আমার গয়না দিয়েছিলাম,ভুলো না ফারুক।

-আচ্ছা হয়েছে থামো,আমি সালাম কে দিয়ে চা পাঠাচ্ছি।

-দাঁড়াও।

জেবা অভিব্যাক্তিহীন রুক্ষ দৃষ্টি নিয়ে ফারুকের সামনে দাঁড়ালেন।

-কী বলবে?

-বসো সোফায়।

ফারুক বিরক্তি নিয়ে সোফায় বসলেন।সামান্য চা খাওয়া নিয়ে যা মানুষ চেচামেচি করতে পারে,তার সাথে বর্তমানে কথা বলতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না।

-বলো কী বলবা।

-এই বিরক্তি নিয়ে আমার কথা বলা উচিৎ,তোমার না।তুমি আমার ছেলেকে আমার থেকে দূরে সড়িয়ে দিচ্ছো।সারাজীবন পার করে এখন কেন আমার পুরো জীবনের কষ্ট এভাবে ওয়েস্ট করে দিচ্ছো?

-কী বললে তুমি?আমি তোমার ছেলেকে দূরে সড়িয়ে দিচ্ছি?ছেলে তোমার একার?

-হ্যাঁ আমার একার।আমি ওদের এত বছর কষ্ট করে বড় করেছি। তুমি কিছুই করোনি,টাকা ঢালা ছাড়া।

-টাকা ছাড়া মানুষ করতে পারতে ছেলেদের?ভালো স্কুলে পড়ানো,মাসে ত্রিশ চল্লিশ হাজার খরচ করে প্রাইভেট টিউটর রাখা,দুই ছেলের জন্য দুই গাড়ি ব্যবহার,এসব করতে পারতে?

জেবার রাগে মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন,গলার স্বর নামিয়ে কথা বলা প্রায় অসম্ভব। চাপা কন্ঠে বললেন-

-অযথা তর্কে যাবো না আমি,যে চোখ থাকতেও অন্ধ,তাকে আর কী বলবো?

-অন্ধ আগে ছিলাম,এখন চোখ খুলেছে আমার,সব হারানোর পর।

-তাই?রুশান কোথায় কী করে জানো তুমি?

-হ্যাঁ জানি।ও কোথায় যায়,কী করে সব আমি জানি।

-সায়বা কে আমি টাকা দিতে মানা করেছি,ও দিচ্ছে না টাকা।মোরওভার,রুশান নিজেও নাকি টাকা চাচ্ছে না।তার মানে ও তোমার থেকে টাকা নিচ্ছে।কেন দিচ্ছো তুমি?

-আমি টাকা দিচ্ছিনা।ও নিজের টাকা নিজেই ম্যানেজ করছে।

-মানে?

-মানে কিছু না।

-দেখো,ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট করো না।কিছুদিন হাতে টাকা না থাকলে এমনিই সোজা হয়ে যাবে।

-আর কতদিন সবাইকে ক্রিমিনাল ভেবে এমন বিহেভ করবে তুমি?আমরা কেউ তোমার শত্রু না জেবা।আমার চোখ খুলে গেলেও,ইউ আর স্টিল ব্লাইন্ড।তোমার ছেলেদের সাথে এইসব করা বন্ধ করো।মমতাময়ী হও।বোর্ড স্কুল না এটা।

-তুমি কি জানো রুশান একটা মেয়েকে পছন্দ করে?

-রিয়েলি?ইন্টারেস্টিং। জেনেছো তার ব্যাপারে? 

-শাট আপ ফারুক।যদি ও সত্যিই কোনো প্রেম করে, কী হবে জানো?

-কী হবে?আর তুমি জানলেই বা কীভাবে রুশান রিলেশনে আছে?

-আমি ওর রুমে এক্সপেন্সিভ এয়ারিং এর পেয়ার দেখেছি।

-তুমি রুশানের রুম সার্চ করো ওর এ্যবসেন্সে?

-হ্যাঁ করি,তো?

জেবা ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলেন।

-ছেলে বড় হয়েছে।এখন সবকিছুতে নাক গলানো ভালো না জেবা।তোমার সন্তান হওয়া বাদেও ও আলাদা একজন মানুষ,ওর আলাদা জীবন থাকবে।সবকিছুতে নিজের মাতৃত্ব ফলানো বুদ্ধিমানের কাজ না। পরবর্তীতে এমন করলে,রেহানের মত রুশান ও সায়বার বাসায় যেয়ে উঠবে।

-উঠুক।সায়বা তো চ্যারিটি ওয়ার্ক শুরু করেছে।কিন্তু আমার বাড়িতে,আমার তত্ত্বাবধানে ও এসব করতে পারবে না ব্যাস!

ফারুক আর কথা বাড়ালেন না।নিজের ঘরে যেয়েই সালামকে ডেকে পাঠালেন।মিস্ত্রী এনে দরজার লক চেঞ্জ করবেন,এবং অবশ্যই সেটার চাবি জেবাকে দিবেন না।কারণ এভাবে চলতে থাকলে রুশান সত্যিই সায়বার বাসায় যেয়ে উঠবে।হয়তো জেবা এটাই চাচ্ছে।কারণ সায়বা তার বোনের বাধ্যগত থেকে রুশান রেহানের খবর দিতে থাকবে,এবং সত্যিই যদি রুশানের জীবনে কেউ এসে থাকে,তার জীবন জাহান্নাম বানিয়ে দিবে জেবা।অন্তত নাবিহার মতো পরিণতি কারো হোক,সেটা চাননা।কিন্তু কতখানি সফল হবেন,এ নিয়ে নিজেও সন্দিহান।

•••••••••••

-আরেক সেট এয়ারিং,সেটা কী করবে?

রেহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুশানের পাশে বসলো।রুশান বুঝলো এর মানে কী।

-নাবিহা আপুর সাথে দেখা করবে?

-না,তোর কি মনে হয় ও দেখা করবে?ওর ঘর সংসার হয়ে গেছে,মেয়ের মা হয়ে গেছে,এখন দেখা করবে না শিওর।

-তাহলে?

-কখনো যদি দেখা হয়?

-তুমি এই সেট নিয়ে ঘুরবে?

রেহান আবারো চুপ হয়ে গেলো।জার্মানের বিখ্যাত জুয়েলারি ব্র‍্যান্ড ওয়েলেনড্রফ থেকে নেয়া দুই জোড়া কানের দুল।এক জোড়া ভিনার জন্য আরেক জোড়া কার জন্য সেটা রেহান নিজেও জানে না।তবুও এনেছে,অনেক শখ করে।

-ভাইয়া,ভিনার জন্য এত কস্টলি গিফট কেন আনলে?

-আমার ভাইয়ের একটা ভাব আছে না?

-ভিনা এসবকে গোণায় ও ধরে না।

-ধরবে।সময় হোক,সব হবে।বলেছিনা আমি,জিরো এক্সপেক্টশানস নিয়ে ভালোবেসে যাবি?

-আসলেই কি কোনো আশা ছাড়া ভালোবাসা যায় ভাইয়া?কখনো কি মনে হবে না ফিরতি ভালোবাসা আমরা পাই?

-ভালোবাসা অনেক ব্রড একটা টপিক।ফিলোসোফি দিয়ে ভালোবাসা বোঝাতে গেলে জনম পার হয়ে যাবে।তবে এতটুকু জেনে রাখ,ফিরতি ভালোবাসার আশা তো দূর,মানুষ প্রতারণার কষ্ট নিয়েও জনম জনম ভালোবেসে যেতে পারে।কারণ ভালোবাসা একমাত্র ইমোশন,যেখানে মনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

-প্রতারণার কষ্ট নিয়েও?

রেহান রুশানের কাঁধে হাত রাখলো।

-হ্যাঁ।ভালোবাসার এই এক মুশকিল,কোনো দোষ দেখিয়েও আটকানো যাবে না।ধর তুই একটা মেয়েকে ভালোবাসলি,এখন সে মেয়ে যেই অন্ধ,কালো,পঙ্গু,দুই বাচ্চার মা ও যদি থাকে,তাও ভালোবাসবি।আর প্রেম হলে কোনো অজুহাত লাগে না।এমনিই কোনো কারণ ছাড়া মোহ কেটে যাবে,সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবে।

-কী করবো ভাইয়া?আমার মাথা কাজ করেনা।

-ভালো থাকবি,তাহলেই হবে।একটা কথা মনে রাখ,তুই ভালো থাকলে,তোর সাথে ভালোই হবে।আর সেই ভালো যদি দেরিতে হয়,তাহলে কয়েকগুণ পুরষ্কার পাবি।

রুশান হালকা হাসি দিলো।কিন্তু অনিশ্চয়তায় ডুবে আছে ধ্যান।

••••••••••••

রিদওয়ান আর মিহিকার সাথে ক্লাস শেষে ভিনা ক্যাফেতে ঢুকলো।এরপর দূরে দাঁড়ানো রুশানের কাছে নিজেই গেলো।ভিনাকে প্রথমবার নিজ থেকে আসতে দেখে রুশানের বিস্ময়ের সীমা থাকলো না।আজকে এমনিই ভয়ে ভয়ে ছিলো,কারণ প্রিতির নাম্বার নিতো আজকে,ভিনার ইমার্জেন্সি কন্ট্যাক্টের অজুহাতে।খুবই দূর্বল অজুহাত,তাই সাহস হচ্ছিলো না বলার,নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে চিন্তাভাবনা করছিলো।

-তোকেই খুঁজছিলাম রুশান,রেহান ভাইয়া কেমন আছে?

-হ্যাঁ? আমার ভাই?রেহান?

-হ্যাঁ,তোর ভাই রেহান,কেমন আছেন উনি?

-ভালো।

-উনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন না?

-হ্যাঁ

-আমার আসলে একটা হেল্প লাগবে।প্রিতি আপুও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে।গ্র‍্যাজুয়েশন কম্পলিট করার পর প্রায় আড়াই বছরের গ্যাপ গেছে,এখন আপু আবার পড়াশোনা শুরু করতে চাচ্ছে।তাই সাজেশন নিতাম।

রুশান অবাক হয়ে গেলো এই কো ইন্সিডেন্টে,সে সত্যিই ভাবেনি এতবড় সুযোগ পেয়ে যাবে প্রিতির সাথে যোগাযোগ করার।

-অবশ্যই!ভাইয়া উড লাভ টু ডু দ্যাট।তবে এখানে একটা ব্যাপার আছে,ভাইয়া আর আপুর পড়াশোনা অনেক আগে শেষ হয়েছে,আমি এ বিষয়ে হয়ত ইলাবরেটলি বলতে পারবো না,ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,আপু সরাসরি যোগাযোগ করুক?বেটার হবে না?

ভিনা কিছুক্ষণ ভাবলো।এরপর প্রিতিকে ফোন দিয়ে পার্মিশন নিলো,কথার ধরণ দেখে বুঝা গেলো প্রিতি প্রথমেই রাজি হয়নি,পরে রাজি হয়েছে।ভিনার কিছু ব্যাপার রুশানের অনেক ভালো লাগে,যেমন ভিনা কখনোই হুট করে কাজ করে না,অনেক ভেবে চিন্তে কাজ করে। চাইলেই সে প্রিতির নাম্বার দিতে পারতো,কারণ নিজের উদ্দেশ্য ভালো।কিন্তু তবুও প্রিতি থেকে অনুমতি নিলো।প্রতিটা মানুষকে সম্মানের এই দিকটা সত্যিই প্রশংসনীয়। 

প্রিতির সাথে কথা বলে ভিনা হাসিমুখে জানালো,নাম্বার দিতে পারবে।এরপর রুশানকে বলে দিলো,রেহান যেন দ্রুতই যোগাযোগ করে।এ বিষয়ে কথা শেষ হওয়ার পর ভিনা এমন প্রশ্ন করলো যে রুশান রীতিমতো আকাশ থেকে পরলো।

-আচ্ছা,তুই যে আমার এরকম হেল্প করছিস,তোর গার্লফ্রেন্ড মাইন্ড করবে না তো?

-ওয়েট,হোয়াট!আমার গার্লফ্রেন্ড?

-ওকে,আই সি, ফারজানা তাহলে ঠিক ছিলো।

-কী বলছো ভিনা,আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।

-ফারজানা কালকে এসে বললো তোরা নাকি ডেট করছিস দুইজন দুইজকে,কিন্তু তুই নাকি ফারজানাকে কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিস না,গার্লফ্রেন্ড হিসেবে 'স্বীকৃতি' দিস না।

ভিনা বহু কষ্টে হাসি চেপে কথা বলার চেষ্টা করছে।কোনোভাবেই চাচ্ছে না হাসির জন্য কথার গুরুত্ব কমুক,কিন্তু পারছে না।

-আমরা ডেট করছি!?আমি গার্লফ্রেন্ড হওয়ার স্বীকৃতি দেইনা?ডাকো ওকে,এক্ষনি ডাকো সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

রুশানের রাগে সবকিছু ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছা করছে।এক মাস হয়েছে পরিচয়ের,রেহানের কথা মাথায় রেখেই ফারজানার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করেছে,কখনো ভাবেওনি এই কথা এইভাবে মোড় নিবে,তাও ভিনার সামনে।

-আহা,থাম তো।মাথা গরম করিস না।আমি চিনি ফারজানাকে,একটু ইমোশনাল,হয়তবা একটু বেশিই সিম্পল থাকে।কিন্তু ডোন্ট মেক হার ফিল আনওয়ান্টেড।

-নিশ্চয়ই ফারজানা বলেছে ওর ক্লাস মিলে না দেখে আমি এমন করি?

-আমাকে বলেনি।আমি নিজেই বললাম।

-অবশ্যই তোমাকে বলেছে।মিথ্যা বলো না ভিনা।

-আমাকে বলেনি,সত্যি।

-তাহলে অন্য কাউকে বলেছে?

-হ্যাঁ 

রুশান বিধ্বস্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো।ফারজানা পুরো ভার্সিটিতে এই মিথ্যা কথা চাউর করছে।আর মিথ্যা কথা বারবার বললে এবং সংখ্যায় বেশি মানুষ কে বললে সেটা 'চিরন্তন সত্য' হয়ে যায়।

-কাকে বলেছে? আমাকে বলো ভিনা,প্লিজ!

-সব জানা লাগবে না রুশান।আর এটা তেমন ফ্যাক্ট ও না।এ্যজ এ ফ্রেন্ড আমি এডভাইস দিলাম আরকি।

-অবশ্যই দিবে,কেন দিবে না?

-আরেকটা কথা,কাদের ভাই কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরবে।আগামী মাসে হয়ত কাজে জয়েন করবে।অনেক কষ্ট করেছো এই কয়দিন,আর করা লাগবে না।আর ফারজানাও এটা পছন্দ করবে না আই গেস।

রুশান এই কথা শুনে কষ্ট পেলো।ভরা গলায় বললো-

-আমাকে যদি সত্যি বলি,তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে?

রুশানের করুণ দৃষ্টিতে ভিনা চমকে গেলো।এত অসহায় কেন মনে হচ্ছে ওকে?ভিনা কিছু না ভেবেই উত্তর দিলো,

-হ্যাঁ,করবো।

-আমার আর ফারজানার মাঝে এমন কিছুই নেই ভিনা।আমি ফারজানাকে আমার ফ্রেন্ড হিসেবেও কাউন্ট করি না।শুধুমাত্র তোমার কথা রাখার জন্য আমি ফারজানার সাথে কথা বলেছি,নরমাল বিহেভ করেছি।কিন্তু কখনো অন্যকিছুর ইন্ডিকেশন আমি দেইনি,বিলিভ মি।অনেক হেল্পলেস লাগছে আমার।আমি ছেলে,কিন্তু এসব ব্যাপার আমাকে অনেক প্রেশার দেয়।একটু বুঝো,আর বুঝাও ঐ মেয়েকে।

ভিনা চুপচাপ সব শুনে গেলো।সরাসরি কোনো কনক্লুশনে গেলো না।এই পরিস্থিতিতে সরাসরি কাউকে ভিক্টিম বা ক্রিমিনাল হিসেবে ধরে নেয়া যায় না।কিন্তু রুশানের কথার মাঝে এমন কিছু ছিলো যার কারণে ভিনা ফারজানার ব্যাপারটা দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।তাছাড়া ফারজানার আগে করা কাজগুলোও ফেলে দেয়ার মত না।

-আমি ভালোর সাথে আছি,ভালোর সাথেই থাকবো রুশান।তুই যদি ঠিক হয়ে থাকিস,নিশ্চিন্ত থাক,আমি তোর পাশেই থাকবো। 

ভিনা চলে গেলো।রুশান দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে পরলো ওয়েটিং এরিয়াতে।এর কিছুক্ষণ পরই ফারজানা আসলো।

-একেক সময় একেক জায়গায় পাওয়া যায় তোমাকে,ছুটির সময় নির্দিষ্ট জায়গায় থাকতে পারোনা।খুঁজতেই কত সময় চলে যায়।

রুশান সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো।রুশানের রাগান্বিত চেহারা দেখে ফারজানা কিছুটা ভয় পেলো।

-কেন দাঁড়াতে হবে?আমরা কি ডেট করছি একজন আরেকজনকে?

-না ম..মানে..

-ফাইযলামি বন্ধ করো ফারজানা।ইংলিশে হেল্প লাগবে,এই লাগবে,সেই লাগবে অজুহাতে তুমিই কথা বলতে চাও,আমি না।আর মাত্র দুইবার ক্যান্টিন থেকে আমি কফি খেয়েছি তোমার সাথে,তাও কথা বলার জন্য না,তোমাকে তোমার সমস্যায় সাজেশন দেয়ার জন্য। তার মানে কি আমি তোমাকে পছন্দ করি?আর ফেসবুকে নিজের থেকে কি আমি কখনো তোমাকে নক দিয়েছি?কোনো ইঙ্গিত দিয়েছি যে আমি তোমাকে পছন্দ করি?তাহলে সবার কাছে রিউমার ছড়িয়ে বেড়াচ্ছো কেন?

-কে বলেছে এসব?ভিনা?

-যেই বলুক।সেটা তোমার ভাবার বিষয় না।নিজে কী করেছো সেটা দেখো।

-তার মানে ভিনা।ভিনা নিজের ক্যারেক্টারের ঠিক নাই,ও আমার ব্যাপারে বলার সাহস পায় কোথায়?

-একদম বাজে কথা বলবা না!আর তুমিই তো ভিনার কাছে গিয়েছো এসব ফালতু কথা বলতে।এখানে ওকে দোষ দিচ্ছো কোন লজিকে?

-তো সমস্যা কার মধ্যে?আমার না ভিনার?যে অন্য মানুষের কথার প্রাইভেসি রাখতে পারেনা,তার জন্য এসব বলার কোনো রাইট নেই তোমার।আজকে আমি..... 

-শাট আপ।তোমার ক্লাসের প্যাচাল এখানে আনবা না।ক্লাস দেখে মানুষকে জাজ করার মেন্টালিটি তোমার থাকতে পারে,আমার না।

-ভিনা নিজে রিদওয়ানের সাথে রিলেশনে যেয়ে ঢলাঢলি করছে।রিদওয়ান ছাড়া কারো পাশে বসে না।এর আগে সেজানের সাথে কী যেন কী করেছে,সেজান শুধু ওর পিছেই ঘুরে।এমন বারোভাতারির জন্য এত দরদ দেখাচ্ছো,পরে তো সাফার করবা।

-খবরদার আমার সামনে আর আসবে না।আজকে শুধুমাত্র মেয়ে দেখে কিছু বললাম না।নাহলে তোমাকে মাটিতে ফেলে লাত্থি দিয়ে মেরে ফেলতাম।নিজে ছেলেদের গায়ে পরে লুইচ্চামি করে অন্যকে গালি দাও না?অসভ্য কোথাকার।এক্ষনি সরে যাও সামনে থেকে।

ফারজানা হতভম্ব হয়ে গেলো।চোখে পানি চলে এসেছে অপমানে।ভিনাকে এসব বলেছিলো শুধুমাত্র রুশানের ব্যাপারে নেগেটিভ ইমেজ তৈরির জন্য। কিন্তু ঐ মেয়ে কী করেছে কে জানে,সব এলোমেলো হয়ে গেলো। ফারজানা বুঝে গেছে,রুশানের দেখা বা কথা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।আগামী মাসে ক্লাব ফেয়ার হবে।একি ক্লাবে থাকার সুবাদে তখন একসাথে কাজ করা যাবে। আর তখনি ভিনার দফারফা হবে।এই ভার্সিটিতে পড়ার মুখ থাকবে না তখন ভিনার।ফারজানা শক্ত করে হাতে থাকা ফোন চেপে ধরলো।
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp