-তোর মাইয়ারে যদি এক সপ্তার মইধ্যে ফেরাইতে না পারোস,এই বাড়িতে থাকতে দিমু না তরে আমি।বইলা দিলাম।
-এই বাড়ি আমার জামাইয়ের,দলিল আসে আমার কাসে।যদি বাড়ি থেইকা বাইর কইরা দেয়ার কথা ভাবেন ও,কেস দিয়া জেইলে ঢুকায়ে দিমু।আজকে আমার পোলার যে অবস্থা করসেন,সেই অবস্থা আপনের করবো আমার মাইয়া।
কথা শোনার পর নাসের তেড়ে এসে খোদেজাকে মারতে গেলে খোদেজা বটি নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সামনে।খোদেজার চোখের চাহনিই বলে দিচ্ছে নাসেরের গলা এক কোপে নামিয়ে দিতে বেশি সমস্যা হবে না। ভাই মরার পর এই প্রথম নিজের ভাবিকে দেখে ভয় পাচ্ছে নাসের।এত সাহস পাচ্ছে কই এরা?
ভেতরে ভয় পেলেও বাইরে সেটা প্রকাশ না করে স্বভাবমতো নাসের বললো,
-কীরে?মাইয়ারে ব্যবসায়ে নামাইসোস নাকি?বড় বড় ব্যাটাগো লগে শুয়াইসোস?এত ত্যাজ কেমনে?
খোদেজা সত্যি দৌড়ে এসে বটি দিয়ে কোপ বসিয়ে দিলেন,নাসের সরে যাওয়ায় কোপ হাতে পরলো,দরদর করে রক্ত পরে ঘরের ফ্লোর লাল হয়ে গেছে।একটু এদিক হলেই এই কোপ ঘাড়ে এসে পরতো।ঘটনার আকস্মিকতায় নাসের চিৎকার ও করতে পারলো না,বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে খোদেজার দিকে তাকিয়ে আছে।
-হারামির বাচ্চা,থানায় যাবি?যা,আমিও কমু তুই কী কী করসোস আমার আর আমার মাইয়ার সাথে।তরে শেষ কইরা ফেলাবো।আর আরশিরে যে ফিরায়ে আনতে কইতাসোস,আরশি যদি ফিরা আসে,কেয়ামত হইবো তোর,মনে রাখিস।
-কাজটা ঠিক করলি না।
-একদম ঠিক কইসোস,গলায় বসাইতে পারলে ঠিক হইত,সেই কাটা গলায় আমি পারা দিয়া মাইরা ফেলাইতাম তরে। আমার জামাইয়ের টাকায় থাইকা,পইড়া বিয়া কইরা সংসার পাতসোস।আগাছার মত ছিলি,আইজকা মানুষটা মইরা গেসে দেইখা আমগোরে জুতার তলায় রাখসোস না?আমার মাইয়াটার জীবন নষ্ট কইরে দিতে চাইসোস।এরপর যদি বেশি করোস আমগো লগে,তোর বউ বাচ্চাসহ এই বাড়ি থেইকা বাইর কইরা দিমু আমি।
এরপর খোদেজা বটি ফেলে রেখে নাসের কে এক হাত দিয়ে টেনে বাথরুমে আটকে ফেললো।
-তর বউরে ফোন দিয়া এক্ষনি বলবি ভাড়ার টাকা আমার হাতে দিতে।নাইলে তোরে আমি এমনে রাইখাই মাইরা ফেলাবো।তুই চিনবি এখন আমারে।
নাসের চিৎকার চেঁচামেচি করলো শুরুতে,এরপর রক্তের পরিমাণ দেখে কান্না শুরু করলো।নাসেরের বউ কলি এসে দাপাদাপি শুরু করে দিলো এসব দেখে।কিন্তু খোদেজা অটল।সত্যিই যখন কলির কাছ ভাড়ার সব টাকা,বিল পত্রের কাগজ সব হাতে বুঝে পেলো,তখন বাথরুমের দরজা খুলে নাসেরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সিড়িতে এনে ফেললো খোদেজা।
খোদেজা ছোটখাটো পাঁচ ফুটের ও কম একজন শুকনা মানুষ।নাসেরের মত লম্বা পুরুষ মানুষকে এভাবে এক হাতে ধরাশায়ী করতে দেখে সবাই চমকে উঠলো।ভাড়াটিয়ারা জড়ো হলেও কেউ খোদেজার বিরুদ্ধে কথা বললো না,কারণ তারা কম বেশি সবাই জানে খোদেজা,আরশি আর ইশমামকে নাসের কত ভুগিয়েছে।
বাসা থেকে সবাই চলে যাওয়ার পর খোদেজা ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পরলেন,ফুপিয়ে কাঁদছেন।আজীবন তিনি শ্বশুর বাড়িতে সব বউদের চেয়ে বেশি লক্ষ্মী ছিলেন,তার উচ্চ গলার স্বর কেউ শোনেনি।বড় ঘোমটায় নিজেকে আবৃত করে রাখতেন সবসময়। স্বামী মারা যাওয়ার পর ও তিনি নিজের 'লক্ষ্মী বউ' এর খোলস থেকে বেরোতে পারেননি,বরং আর শক্ত করে খোলসে ঢুকেছিলেন এই ভেবে যে এতে তার সন্তানদের দিকে কেউ আঙ্গুল তুলতে পারবেনা।কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন,তাকে গৃহকর্ত্রী, মা এবং রক্ষক এই তিন ভূমিকায় যুদ্ধে নামতে হবে।তার এই ভুলের সবচেয়ে বেশি মাশুল আরশির দিতে হয়েছে।ভালো ঘরের মেয়ে হয়েও অন্যের বাসায় কাজ করতে হয়েছে,এত মেধাবী মেয়ে পড়াশোনাও করতে পারেনি ঠিকমতো,কত কষ্টে এইচএসসি দিয়েছিলো।কিন্তু এতসব কষ্ট ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেয়নি নিজের মাকে।খোদেজা স্বামীহারা হয়ে অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে মাতম করে গেছেন,ঢাল হয়ে না দাঁড়িয়ে।ফলাফল,ইন্টারের পরে বিয়েতে রাজি না হওয়ায়,নাসের মধ্যবয়স্ক যে লোকের সাথে আরশির বিয়ে ঠিক করেছিলো,তাকে দিয়েই ধর্ষণ করানোর চেষ্টা করেছে এবং নিজেও সেই চরম ঘৃণ্য কাজে অংশগ্রহণ করেছে।আরশি নিজেকে অতি কষ্টে বাঁচায়,এক পর্যায়ে হাত ও ভেঙে যায়।সেসময় ইশমাম এসে দুইজনকে কোনোমতে আটকায়। ভাঙা হাত নিয়েই পালাতে বাধ্য হয় আরশি।খোদেজা এসবের কিছুই জানতেন না।কারণ ঘটনা ঘটেছে নাসেরের নিজের ঘরে যখন তার বউ বাপের বাড়ি গেছে।আরশি পালানোর পর নাসের নিজেই সব জায়গায় চাউর করেছেন ঘরের মেয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়েছে।খোদেজাও প্রথমে তাই বিশ্বাস করেছেন,কারণ এ বিয়েতে আরশির মত ছিলো না কখনোই।কিন্তু পরে ইশমাম যখন অস্পষ্টভাবে সব বলে,খোদেজার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে।দুইদিন পর অচেনা নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে আরশি কান্নাভেজা কন্ঠে শুধু এতটুকুই বলে-
-আব্বা মারা যাওয়ার পর তুমিই তো ছিলা মা,আজকে যদি তুমি শক্ত হইয়া আমাদের পাশে থাকতা,এইদিন দেখা লাগতো না।তুমি বউ মানুষ দেইখাই যে সহ্য করবা এটা ভুল,যত সহ্য করবা,মানুষ তত চাপায়ে দেবে তোমার উপর।তোমার দায়িত্ব ছিলো আমারে আগলায়ে রাখার,তুমি পারো নাই।আমি চইলা গেলাম দূরে,কিন্তু তোমাদের ছাইড়া না।আমি দূর থেইকাই খেয়াল রাখবো তোমাদের,আর যেদিন ফিরবো,নাসের সেদিন আমার হাতে মরবে।
সেদিন মেয়ের অভিযোগে হুশ ফেরে খোদেজার। স্বামী মারা গেলে নারী অসহায় হয়ে পরলেই সবাই খুবলে নিবে,তাকে হতে হবে আগুন,আগ্নেয়গিরির উত্তাপ দিয়ে সংসারকে আগলে রাখতে হবে।
নাসের হাসপাতালে যাওয়ার পর,সেখানে থাকা অবস্থায়ই থানায় ফোন দিলো,কিন্তু তখন আরো বড় ধাক্কা খেলো,থানায় আরশি নারী নির্যাতনের মামলা করে রেখেছে।নাসেরের সুস্থ হলেই তাকে পুলিশি হেফাযতে নেয়া হবে।নাসেরের মনে হলো,কর্মফল ভোগের সময় হয়ে যাচ্ছে।
••••••••••••••
-কী কথা বলবো?আমি তো ঐ মেয়েকে চিনিও না জানিও না।
-তাতে কী হবে ভাইয়া?একটু কথাই তো।প্লিজ ভাইয়া?
-জিদ করলেই তো সব হয় না রুশান,বুঝার চেষ্টা কর।এমন তো সে আনএডুকেটেড।
-ব্যাপারটা শুধু হেল্পের না।আমার বিশ্বাস,প্রিতি আপু ভিনার ব্যাপারে সব জানে।
-সো?
-তুমিই বলেছিলে,ভিনার পাস্ট আমার জানা জরুরি।
-এটার সাথে আমার কী সম্পর্ক?
-তুমি আর প্রিতি আপু প্রায় সমবয়সী,যত সহজে তুমি কথা বলতে পারবা,বা জানতে পারবা,তত সহজে কি আমি পারবো?কিন্তু আমার জানা জরুরি,কারণ আমি ভিনাকে অনেক ভালোবাসি।
-প্রিতি নামের ঐ মেয়েটা কেনইবা আমাকে ভিনার ব্যাপারে বলবে?আর আমিই বা কোন কারণ দেখিয়ে জানতে চাবো?
-আমার জন্য কি এতটুকুও পারবে না?তুমিও তো নাবিহা আপুকে ভালোবাসতে,জানোই তো কীরকম অনুভূতি হয়।
-এটা কিন্তু ব্ল্যাকমেইল।
-ভিনাই হেল্পের জন্য এসেছিলো।আমি শুধু এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাচ্ছি।কীইবা এমন হবে কথা বললে।
-ঠিকাছে,ভিনা যে পারপাসে এসেছে,ঐ পারপাসে নাহয় কথা বললাম,কিন্তু এতটুকু কনভারসেশনে কি প্রিতি আমাকে ভিনার ব্যাপারে সব বলে দিবে?কমনসেন্স কাজে লাগা।
রুশান কিছু বললো না,খুব ডিস্ট্র্যাক্টেড লাগছে নিজেকে।একসাথে অনেকগুলো আনএক্সপেক্টেড ঘটনায় মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।প্রথমত ফারজানার ভিনাকে মিথ্যা বলা,কাদের ভাইয়ের চলে আসা যার মানে ভিনার পরিবারের সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হওয়া আর রেহানের উদাসীনতা।ভিনার সাথে সম্পর্ক শুরুই হয়নি,তবুও কত বাঁধা আসছে এখনি।
রাতে কিছু না খেয়েই সায়বার বাসা থেকে চলে আসলো রুশান,হুট করেই বুক ভারী হয়ে গেছে।ফারজানাকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না,কিন্তু পর পর তিনদিন ভিনাকে রিদওয়ানের সাথে ক্যাফেটেরিয়া আর ক্লাসের বাইরে দেখেছে।অবশ্যই এর মানে না এই না যে রিদওয়ানের সাথে ভিনার কিছু চলছে,একি ডিপার্টমেন্টের হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কথা একটু বেশিই হবে।কিন্তু রুশানের নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে,রিদওয়ানের সাথে ভিনার পরিচয় বেশিদিনের না,তবুও রুশানের থেকে বেশি কথা বলা হয়। বিশেষ করে ফারজানার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই ভিনা নিজেকে আরো দূরে সড়িয়ে নিয়েছে।কেন দরকার এমন করার?আর ভিনার অতীতে এমন কী কষ্ট ছিলো,যে ভালোবাসা থেকে নিজেকে এভাবে দূরে সড়িয়ে রাখতে হবে?কত মানুষ কত প্রতারণার শিকার হয়,শুধু একবার না,বহুবার হয়।তাও নতুন প্রেমের জন্য,ভালোবাসার জন্য স্বপ্নভরা চোখে অপেক্ষা করে।
রুশান রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরে সোজা নিজের ঘরে চলে আসলো।গেট খুলতে নিয়ে দেখলো চাবি কাজ করছে না,তার মানে লক চেঞ্জ হয়েছে।সত্যিই এবার বাড়িছাড়া করা হয়েছে ভেবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে নেমে আসলো।ফ্রেশ হয়ে আবার বের হয়ে যাবে।সরাসরি সায়বার বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই।কী করবে তাও জানে না।
নিচে নেমে ফারুক রুশানকে ডাক দিলেন।তিনি অনেক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছিলেন রুশানের জন্য।আজকে জলদি বাসায় ফিরেছেন শুধুমাত্র রুশানের হাতে নতুন লকের চাবি দেয়ার জন্য,যেন অপেক্ষা করতে না হয় রুশানের।
-কোথায় যাচ্ছিস?
-সায়বা খালার বাসায়,মা বোধহয় রুমের লক চেঞ্জ করেছে।
-জেবা না,আমি চেঞ্জ করেছি।
কথাটা শেষ করেই ফারুক রুশানের হাতে নতুন লকের চাবি দিলেন।রুশান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
-তোমার ঘরে চল।একসাথে বসি।
রুশান ঘরে ঢোকার পর ফারুক দরজা চাপিয়ে দিলেন।এরপর টেবিলের উপর রাখা বক্সের দিকে তাকিয়ে বললেন-
-এয়ারিং কি এখানেই ছিলো?
রুশান অবাক হয়ে গেলো।এয়ারিং এর বক্সের দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো এটা কোথায় ছিলো।
-না...টেবিলের ডান পাশের কোণায় রাখা ছিলো।সকালে ক্লাস ছিলো,তাই তাড়াহুড়ায় আলমারিতে রাখিনি।
-জেবা তোমার ঘর সার্চ করে যখন তুমি থাকো না।
-কী!মানে কী!রুম সার্চ করবে কেন?
-কেন করবে সেটা ভালোমতোই জানো।তোমার চলাফেরা আর আগেরমতো নেই,সন্দেহ করবে,স্বাভাবিক।
-আমি কখনো মিথ্যা বলিনা,তবুও এভাবে সার্চ করা প্রয়োজন?
-অবশ্যই না,এর জন্যই লক চেঞ্জ করেছি।এটার চাবি আর কারো কাছে নেই।
-বাবা...তুমি?
-হ্যাঁ, আমি।তোর মার অনেক অভিযোগ,আমি নাকি ছেলেদের মানুষ করতে কোনো দায়িত্ব পালন করিনি, তাই এখন থেকে দায়িত্ব পালন করবো।অফিসে যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছি।অনেক টাকা কামানো হয়েছে।এখন কয়দিন বেঁচে থাকি।
-এই অভিযোগ তো এখানে শেষ হবে না,আরো বাড়বে।কারণ মার প্রটোকলে এভাবে ছেলেদের মানুষ করা যাবে না,এটা গুরুতর অপরাধ।
ফারুক সশব্দে হেসে উঠলেন।বাবাকে কখনো এভাবে হাসতে দেখেনি রুশান।আগে সম্পর্ক অনেক ফর্মাল ছিলো,তুই করে কখনো কোনো ছেলেকে ডাকেননি ফারুক,আর একি রুমে বসে কথা বলা যেন,কল্পনার মতো।এই বিধ্বস্ত অবস্থায় বাবার হাসিমুখ রুশানের মনে প্রশান্তি এনে দিয়েছে।
-তুই ঘুমা তাহলে,আর প্রয়োজনীয় দামি জিনিসগুলো আলমারিতে বা সেফ কোনো জায়গায় তুলে রাখিস।
ফারুক চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে রুশান ডাক দিলো।চুপ থেকে ধীর গলায় বললো-
-বাবা,আমি একটা মেয়েকে অনেক ভালোবাসি।
-আমি জানি।
-তুমি জানলে কীভাবে?
-কারণ আমি এই বয়স পার করে এসেছি।আর সত্যি বলতে,তোর কাছে এই দামি এয়ারিং দেখে বুঝেছি।এটা নিশ্চয়ই রেহান এনেছে?
-হ্যাঁ।
-তোদের দুই ভাইকে একসাথে দেখে আমার যে কি শান্তি লাগে,বোঝাতে পারবো না।জেবার কান্ডকারখানার পর ভাবিনি তোদের এভাবে দেখবো।
-ভাইয়া অনেক ভালো,কিন্তু...
-কিছু হয়েছে?
-এক ব্যাপারে ভাইয়ার হেল্প অনেক দরকার ছিলো,কেন যেন রাজি হচ্ছে না।
-হবে,চিন্তা করিস না তুই।এখন বিশ্রাম নে।
ফারুক সাহেব গেট লাগিয়ে চলে গেলেন।রুশানের আগের মত এত খারাপ লাগছে না,বাবা যখন বলেছে,নিশ্চয়ই কোনো সমাধান হবে।
ক্লান্ত চোখে ফোনের স্ক্রিনে ভিনার ছবি দেখছে রুশান।কোনো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছে না এই মেয়েক ভালোবাসার।তাই নানা প্রশ্ন মাথায় নিয়েই ঘুমিয়ে পরলো।
পরেরদিন সকালে রেহানের ফোনে ঘুম ভাঙলো।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে সাতটা বাজে,প্রতিদিন সাতটায় ওঠার অভ্যাস,কিন্তু আজকে কেন যেন দেরি হয়ে গেছে।রুশান ফোন রিসিভ করলো।
-থ্যাংক্স ভাইয়া,আরেকটু লেট হলে ক্লাস মিস করতাম।
-স্ট্রেঞ্জ!আমি ভেবেছি তুই উঠে গেছিস।
-না,তোমার ফোনেই উঠলাম।এত সকালে ফোন দিলে যে?কিছু হয়েছে?
-হয়েছে,কিন্তু আমার না,তোর বাসায় হয়েছে।
-বুঝলাম না,কী হলো আবার?
-মা বাসা ছেড়ে চলে গেছে।
-হোয়াট!কখন?
-কালকে রাতে।
-আজব তো,হুট করে কেন যাবে?
-কারণ তার নিজ বাসায় কোথাও নাকি এক্সেস নাই।
-বুঝছি,বাবা কালকে নতুন লক লাগিয়েছে ঘরে,এর জন্যই মনে হয়।
-জানি,বাবা ফোন দিয়েছিলো রাতে।জানিয়েছে সব।
-জানো,বাবাকে কালকে বলে দিয়েছি,আমি একজনকে ভালোবাসি।
-আগে থেকেই জানতো।
-কীভাবে?
-আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,তোর ব্যাপারে,আমি লুকাই নাই।এমন কিছুই করিস নি যে গার্জিয়ান জানলে সমস্যা হবে।
-কোথায় কাজ করি,সেটা জানে?
-হ্যাঁ জানে।আমি সবই বলেছি।মজার কথা হলো,বাবা ভিনার বাবা সোহেল আঙ্কেলকে চিনে।সেভাবে পরিচিত না,ব্যবসায়িক সূত্রে আরকি।আচ্ছা,তুই কি রাগ করেছিস বলেছি দেখে?বাবা অনেক টেনশনে ছিলো তাই ভাবলাম,বলে দেই।আমাকে বাবা জোর করেনি কিন্তু।
-ভালো করেছো বলে,আমি নিজেই বলতাম।জেনেশুনেই যে ছাড় দিচ্ছে,এটা দেখে ভালো লাগলো।
-আর শোন,আজকে আমি বাসায় আসবো।ভার্সিটি থেকে জলদি আসবি,আর ভিনাকে জানিয়ে বল দুইদিন যেতে পারবিনা।বাপ বেটা পার্টি করবো।
-না মানে....কাজে যাই,জলদিই আসবো,ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড...
-আহারে,আচ্ছা যা।
-এখন কথা হলো মা কোথায় গেছে?আমার চিন্তা লাগছে।সায়বা খালার বাসায় যায়নি শিওর,কারণ তুমি আছো।
-কার কাছে আর,ছোট মামার কাছে গেছে।সায়বা খালার পর আছেই তো তার ঐ জানের টুকরা ভাই।বছরে দুই একবার বোন বোন বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে,আর কাজের সময় একদম নাই হয়ে যাবে।
-মেজবা মামা?উনি তো একটা পিস!
দুই ভাই একসঙ্গে হেসে উঠলো।এরপর রেহান বললো-
-আচ্ছা,আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা।আমি প্রিতির সাথে কথা বলবো আজকে বিকেলে,কিন্তু আমি শিওর সে ভিনার ব্যাপারে বলবে না।তাই অনেক এক্সপেকটেশানস নিয়ে থাকার দরকার নেই।আমি চাইনা ফিউচারে তুই বল যে আমার কারণে তোর প্রেম সফল হয় নাই।
-তুমি খুব ভালোমতো জানো আমি এধরনের কিছুই বলতাম না,শুধু অনেক অভিমান হতো আরকি,কষ্ট পেতাম।
-আর আমি চাইনা,তুই মনে কোনো কষ্ট রাখ।
-স্যরি ভাইয়া....
-স্যরি কেন?
-কারণ অনেক আগে আমি ভুল বুঝেছিলাম তোমাকে।
-পুরোনো কথা বাদ দে।আজকে রাতে পার্টি হবে!
-আই এম এক্সাইটেড!
ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে রুশান ফারুককে ডেকে নিয়ে একসাথে বসে নাস্তা করলো।ক্লাসে দেরি হবে জেনেও অনেক্ষণ গল্প করলো ফারুকের সাথে।কারণ রুশানের মনে হয়েছে,এই মানুষটা আগে যেমন সময় দিতে পারেনি,তেমনি তার সন্তানরাও কখনো তাকে সেভাবে আপন করে নেয়নি।এতদিন পর যখন বাবা হয়ে নিজের ভুলগুলো শুধরানোর চেষ্টা করছেন,তখন রুশান আর রেহানের ও সমান দায়িত্ব তাকে সময় দেয়া।
ভার্সিটিতে ক্লাস করে রুশান আগের মতো ভিনার ক্লাসের সামনে অপেক্ষা করছিলো।বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর খেয়াল করে দেখলো ভেতরে কেউ নেই।পরে দরজায় লাগানো নোটিসে দেখলো,আজকে ক্লাস অফ ছিলো।
আশেপাশে খুঁজতে গিয়ে দেখলো ক্লাসের বাইরে যে বসার জায়গা আছে,সেখানে ভিনা রিদওয়ানের সাথে বসে কী যেন আলোচনা করছে।রুশান খেয়াল করলো দুইজনের মাঝখানে ভিনা ব্যাগ রেখে এক অদৃশ্য দূরত্ব টেনে দিয়েছে।রিদওয়ান ভিনার দিকে অপলক তাকিয়ে কথা বলে গেলেও,ভিনা আই কন্ট্যাক্ট মেইনটেইন করছে না,বরং বই খুলে রেখে সেখানে তাকিয়েই সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছে।অন্য যেকোনো মানুষ হলে বুঝে যেত ভিনা এখন কথা বলতে আগ্রহী না,কিন্তু রিদওয়ানের মুখের অভিব্যাক্তিই বলে দিচ্ছে,সে ভিনার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে।রুশান ভালোমতো বুঝে গেলো রিদওয়ান ভিনাকে শুধু বন্ধু হিসেবে দেখে না।
রুশান সামনে যেতেই ভিনা সুন্দর হাসি উপহার দিলো।রিদওয়ান সেই হাসি দেখে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন ই হয়েছে।
-তোর কাছেই আসতাম,কথা ছিলো।
-সেইম।কিন্তু তুমি বোধহয় ব্যস্ত এখন,আমি ফোর্থ ফ্লোরে যাচ্ছি,কাজ শেষ করে এসে পরো।
ভিনা আর রুশানের ভিন্ন সম্ভাষণ দেখে রিদওয়ান কনফিউজ হয়ে গেলো।সরু চোখে রুশানকে দেখতে থাকলো।
-আসলে কাজ নেই তেমন।
এরপর ভিনা রিদওয়ানের দিকে ঘুরে বললো-
-আমি পরে কথা বলবো এই ব্যাপারে।স্যরি,তোমাকে সময় দিলাম না।
-ইটস এবসোলুটলি ওকে। সি ইউ সুন।
ভিনা ফিল্টার থেকে বোতলে পানি ভরে স্টাডি রুমে চলে এলো।এখানে কয়েকজন পড়ছে,কয়েকজন গল্প করছে।মাঝখানের একটা টেবিলে বসলো ভিনা রুশান।
-তারপর,তোর খবর কী?
-আমার খবর নাই তেমন,কিন্তু ফারজানাকে সেদিন ভালোই ধমকাধমকি করেছি।অসহ্য লাগে আমার ঐ মেয়েকে।
-ধমক না দিয়ে বুঝালে ভালো হতো। অপমানের চেয়ে বুঝালে বেশি কাজে দেয়।
-ও বুঝবে না।আই নো হার।
ভিনা কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেছে।এক টেবিল পরেই ফারজানা বসা।হাতের মধ্যে ব্লেড দিয়ে কাটা দাগ স্পষ্ট।প্রাণহীন ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
-নেভার,সিম্প্যাথি দেখাবা না ভিনা।এসব এটেনশন পাওয়ার জন্য করছে।
ভিনা উত্তর দিলো না।ফারজানার জন্য সিম্প্যাথি হচ্ছে না একটুও,কারণ ফারজানার চাহনিতে অন্যরকম ভয়বহতা আছে,এই চাহনি মানুষের জীবনকে মুহূর্তেই ছাই বানিয়ে দিতে পারে।এত কঠোর,এত নির্মম সে চাহনি!এটা যেন ভবিতব্য কোনো অশনির সংকেত।
ফারজানা নিজেই উঠে চলে গেলো।ভিনা চিন্তিত হয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে।
-ভিনা?আর ইউ ওকে?
-হুম,আমি ঠিকাছি।যেটা বলার জন্য এসেছি আরকি,কাদের ভাই আসবে পরশু।তুমি দুইদিন এসে তাকে কাজ বুঝিয়ে দিলে,এরপর আর আসা লাগবে না।রাত হয়ে যায় যেতে যেতে।
-এটা নিয়ে পরে কথা বলবো।
-ঠিকাছে,আরেকটা কথা,চারদিন পর মাহভিনের জন্মদিন।বাবা তোমাকে জানিয়ে দিতে বলেছে।নিজেই জানাতো,কিন্তু তুমি তো জানোই সে ঢাকার বাইরে আছে এখন।
-বাহ্!কতবড় হয়ে গেলো দেখতে দেখতে।
ভিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে করে বললো-
-আসলেই।
ভিনার দিকে তাকিয়ে রুশানের মনে ভয় হলো।
'ডোন্ট সে মাহভিন ভিনার মেয়ে'
রেহানের বলা এই কথাটা মাথায় বাজছে।
.
.
.
চলবে.........................................................................