অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৪০ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


প্রফেসর রুদমিলার চোখ টলমল করছে,অনেক কষ্টে তিনি পানি আটকে রেখেছেন।সামনে বসে থাকা ভিনাকে দেখে তার মন ভেঙে গেছে।মলিন চেহারা,শুকিয়ে যাওয়া শরীর এবং মাথায় বিশাল এক ক্ষত নিয়ে ভিনা মাথা নিচু করে আছে।

-জানাতে তো পারতে আমাকে।আমার দেবর পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বদমাইশগুলোকে রিমান্ডে নিয়ে পঙ্গু বানিয়ে ফেলতাম।এখানে তো এটেম্পট টু মার্ডার এবং রেপের মতো সিভিয়ার ক্রাইম আছে।কীভাবে এত চুপচাপ আছো,আমি ভেবে পাচ্ছিনা।কেন ভিনা?

-কারণ এখানে আনফর্চুনেটলি আমি ভিক্টিম হয়ে গেছি।আমার বোন প্রিতি,সে সন্দেহ করছে তার চাচা পুরো ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। এই কেস নিয়ে বেশি ঝামেলা করলে আপুর বাবার ক্ষতি হতে পারে,কারণ তার বাবা চাচার তত্ত্বাবধানে আছে।

-সিরিয়াসলি?নিজের মতো আরো মানুষের সাথে আছো দেখছি।প্রিতির নিজের বাবার প্রতি এত টান দেখে অবাক হচ্ছি আমি।

-অবাক হওয়ারই কথা। আপুর মতো মানুষ হয় না।

-কেমন বোন তোমার?

-আপন কেউ না,কিন্তু বোনের মতো বলতে ইচ্ছে করে না।বোনের থেকেও বেশি কিছু। 

-এত আবেগ নিয়ে থাকা যায়?পৃথিবী এত সোজা?ভার্সিটিতে মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে উঠলে,এর মধ্যে বড় বড় কতগুলো ইন্সিডেন্ট হয়ে গেছে তোমার সাথে।ক্যারিয়ার ও তো আছে।মানুষের সমস্যায় জড়িয়ে পরলে নিজেকে দেখবে কখন?

ভিনা কিছু উত্তর দিলো না।মনের মাঝে যদিও অন্যরকম তৃপ্তি কাজ করছে।এই জীবনে যতখানি অবহেলিত হয়েছে মানুষের কাছে,সৃষ্টিকর্তা তা ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিচ্ছেন।মাথা নিচু করে বসে থাকলেও ভিনা খেয়াল করেছে রুদমিলার চোখে পানি।স্নেহ এবং ভালোবাসা না থাকলে এই অনুভূতি কাজ করা সম্ভব না।

-আমাকে দেখার জন্য আপনার মতো কিছু মানুষ আছে আমার জীবনে।আমার আর কোনো চিন্তা নেই।

-ভালো কথা শিখেছো দেখছি।এত কথা ভালো না,বুঝলে মেয়ে?

ভিনা মুচকি হেসে বললো মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।

-প্রিতির বাবা চাচার কাছে কেন?আর প্রিতির মা কোথায়?বাকী ফ্যামিলি মেম্বার কোথায়?

-ব্রোকেন ফ্যামিলি।অবিশ্বাস্য হলেও আপুর মার নিজের এই মেয়ের প্রতি কোনো টান নেই।উনার আলাদা সংসার আছে লন্ডনে।নানির বাড়ি বলুন,আর দাদির বাড়িই বলুন,দুই ক্ষেত্রেই সম্পর্কের শিকড় বাবা মাকে দিয়ে।আপুর মা আলাদা,বাবাও মেন্টালি আনস্ট্যাবল।তাই দুই বাড়ির কেউই যেচে পরে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজন মনে করেনি।বাবা মা দুইজন জীবিত থাকতেও আপু এতিম। তাকে এতিমই মনে করুন।এত হতভাগা এতিম আমি দেখিনি।

মিস রুদমিলা খুব বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন।তার স্বামী গত হয়েছেন আরো কুড়ি বছর আগে,যখন তার মেয়ের বয়স আট বছর।রূপ,গুণে কমতি ছিলো না,না ছিলো পাণিপ্রার্থীর অভাব।তবুও মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবন যৌবন সব বিসর্জন দিয়েছেন।মেয়েকে সমাজে মাথা উঁচু করে চলার জন্য নিজে কঠোর পরিশ্রম করে নামের আগে প্রফেসর যুক্ত করেছেন।ভেতরে স্বচ্ছ পানির মতো মানুষ হলেও বাইরে চলেছেন আগুনের উত্তাপ নিয়ে।।মিষ্টভাষী সবার প্রিয় থেকে রুক্ষভাষী চক্ষুশূল হয়েছেন শুধু মেয়ের জন্য।এতকিছুর পর ও সফল হয়েছেন,মেয়েকে স্বাবলম্বী বানিয়ে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।কিন্তু বিনিময়ে আর ভালোবাসা পাননি।মেয়ে সেখানে ফরেনার একজন ফেলো রিসার্চারকে বিয়ে করে ফেলেছে।বিয়ের খবর পেয়েছেন টেলিফোন মাফিক।মেয়ে কখনো তার এই যোদ্ধা মাকে মনে করেনি,ডাকেনি একবারো নিজের কাছে।আত্মসম্মানে ধারালো মিস রুদমিলা নিজে তাই কখনোই মেয়ের কাছে যাননি।

-ম্যাম,আপনি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?

-নট এ্যট অল।আচ্ছা, এখন প্রিতির কী হবে ভেবেছো কিছু?একবার এ্যটাক হয়েছে,আবার যে হবে না কোনো গ্যারান্টি আছে।

-আছে।তিন সপ্তাহ আগে আপুর বিয়ে হয়েছে আমাদের বাসায়।যেহেতু বিবাহিত ট্যাগ লেগে গেছে,মনে হয় না আর কিছু করবে।তবুও আমার অনুরোধ আছে একটা।

-কী অনুরোধ বলো?

-আপনার দেবরকে বলে,উচিৎ শিক্ষার ব্যবস্থা যদি করতে পারেন,ভালো হবে।আন অফিশিয়ালি,তার ব্যাক আপ থেকে যদি শাস্তি দেয়া যায়,আর কখনো এসব করার সাহস পাবে না।যদিও এটা আনএথিকাল হবে,কিন্তু এথিক্স দিয়ে এদের ঠিক করা অসম্ভব। 

-দেখবো ব্যাপারটা।

-আজকে তাহলে আসি। 

ভিনা বিদায় নিয়ে দরজা খুলে যাওয়ার সময় রুদমিলা পেছন থেকে ডাকলেন।

-ফারজানার বিয়ে হয়ে গেছে।

ভিনা বুকে যেন ধাক্কা লাগলো।অযাচিত অপরাধবোধে মন বিষিয়ে উঠলো মুহূর্তে। 

-ভুল হয়ে গেলো আমার।

-নাহ্,ভুল করোনি।ফারজানার হাজবেন্ডের সাথে কথা হয়েছে।ছেলে ভালো।ফারজানাকে নিয়ে ঢাকায় শিফট হবে জলদিই।আমি কথা বলে রেখেছি অন্য ভার্সিটিতে। এসেই ভর্তি হয়ে যাবে।হাজবেন্ড সাপোর্ট করলে পড়াশোনা ঠিকি আগাতে পারবে।মোরওভার,ওর সাথে কথা হয়েছে আমার।ভালো আছে,খুশি আছে।তুমি গিল্ট ফ্রি থাকো।কিছুসময়ে শক্ত হওয়া জরুরি।

-আমার এসব অন্যায় আবদার রাখার জন্য ধন্যবাদ ম্যাম।আপনাকে অনেক জ্বালাচ্ছি।দুঃখিত,কিন্তু আরো জ্বালাবো।

রুদমিলা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখে মুখে ভীষণ বিরক্তি এনে বললেন-

-জানি তো, এখন যাও,বের হও।আমার অনেক কাজ বাকী।

ভিনা প্রফেসর রুদমিলার রুম থেকে বের হয়ে লাইব্রেরিতে দিকে পা বাড়ালো।অনেক ধকল গেছে এক মাসে।পড়াশোনার অবস্থা নাজেহাল।রিদওয়ান বলেছিলো অপেক্ষা করবে লাইব্রেরিতে।

লাইব্রেরির টোকেন কাউন্টারের সামনেই রিদওয়ানকে পেলো ভিনা।খুব মনোযোগ দিয়ে নোটিস পড়ছে।

-স্যরি,আই এম লেট।

ভিনা মিষ্টি হাসির মাধ্যমে ক্ষমা চাইলো।রিদওয়ান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললো-

-উহু,ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

-তাহলে কী করা যায় বলুন তো।

-থাক,কিছু চাওয়ার আগে বন্ধুত্বের দায়িত্ব আছে।সেটা আগে পালন করা যাক।

টোকেন নিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকে মাঝখানের এক টেবিলে ভিনা আর রিদওয়ান বসলো।রিদওয়ান হাতে করে নিয়া আসা তিনটা ফাইল খুলে ভিনার সামনে রাখলো।

-ওয়ার্কশিট আর নোটস রয়েছে এখানে।আর ঐ সাদা ফাইলে রুদমিলা ম্যাম যে পেপার ওয়ার্ক দিয়েছিলো,সেটার রাফ করা আছে।

-পেপারে রাফ গুলো রেখে দাও,সেগুলো আমি নিজেই করবো।নোটস গুলো একদিনের জন্য নিলাম।ফটোকপি করে কালকে ফেরৎ দিয়ে দিবো।

-উহু ফেরৎ দেয়া লাগবে না।আমি ফটোকপি করেই এনেছি।এগুলো তোমার।

-মানে কী!এতগুলো পেপার তুমি কেন ফটোকপি করলে?

-লজ্জা দিও না।সামান্য এই ফটোকপিতে কিছুই আসে যায় না।তুমি শুধু সময় নিয়ে শেষ করে ফেলো পড়া।

-সেটা নাহয় করা যাবে।কিন্তু আমাকে ঋণী করে ফেললে তুমি।

-তোমাকে ঋণী করতে পারলে তো আমার জীবন সার্থক হয়ে যেত।সেই ক্ষমতা আমার নেই।আমার রিকোয়েস্ট,এই বন্ধুত্বের মাঝে ঋণ,উপকার এসব এধরণের শব্দ ব্যবহার করোনা।কিপ ইট সিম্পল।

-আই উইল...

-ম্যাম এর থেকে শুনলাম তোমার ঘটনা।এতসবের মাঝে জিজ্ঞেস ই করা হয়নি কেমন আছো।

-অবশ্যই ভালো আছি।ভালো আছি দেখেই তোমার সামনে বসা।

-এতবড় ঘটনা কীভাবে ঘটলো?

-ভাগ্যে ছিলো,তাই হয়েছে।বাদ দাও।

-মাথার ডান পাশে এখনো আউন্ড ভিজিবল।আরো কয়দিন বিশ্রাম নিতে।

-যত্ন নেইনি,তাই শুকাতে দেরি হলো।নাহলে আরো আগেই শুকিয়ে একদম ঠিক হয়ে যেত।

-নিজের খেয়াল ও রাখো ভিনা।

ভিনা রিদওয়ানের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালো।শেষ কথার মাঝে ঠিক বন্ধুত্বপূর্ণ আকুতি নেই।বরং সেটা ছাপিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ পাচ্ছে,যার কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই।

ভিনা লাইব্রেরিতে বেশিক্ষণ থাকলো না।অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে রিদওয়ানের সামনে থাকতে।লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে টোকেন দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বাইরে চলে এলো।ক্যাফেতে লাঞ্চ করার কথা থাকলেও কেন যেন ইচ্ছা করছে না।বাইরের টং এ এসে এক কাপ কড়া লিকারের চা নিলো।বছরখানেক পর টং এর চা খাচ্ছে।হটাৎ ই পুরোনো দিনের কথা মনে পরে অন্যমনস্ক হয়ে গেলো ভিনা।মনে পরলো,আগে টং এ যার সাথে আসতো,সে হারিয়ে গেছে চিরস্থায়ী ক্ষত রেখে।কিন্তু জীবনের প্রথম ভালোবাসা ভুলে যাওয়া সহজ নয়।মনে পরলো আগে কোমর পর্যন্ত চুল খোপা করে সুতির কাপড় পরে আসতো তার সামনে।কখনো এ নিয়ে ভাবতে হয়নি।কারণ অপর পাশের মানুষটা চোখের চাহনি দিয়েই অনুভব করাতো অপ্সরীর মতো।কেন হারিয়ে গেলো সেইদিন গুলো?

অন্যমনস্ক হয়ে ঠোঁটে গরম চা ছোঁয়াতেই পুড়ে গেলো মুখ।বিরক্ত হয়ে চা না খেয়ে ভিনা চলে আসলো।কিন্তু পুরোনো দিনের কথা মনে করে চুলে হাত দিলো খোঁপা বাধার জন্য।কিন্তু পরক্ষণেই চোখে একরাশ কষ্ট নেমে আসলো যেন।দূর্ঘটনা,ক্ষত,অযত্ন সব মিলিয়ে চুল গোছাধরে হাতে এসে পরেছে।সাধের চুলের এমন পরিণতিতে মন খারাপ হলেও,খুব বেশিক্ষণ তা স্থায়ী হলো না।ভিনা হাতে ঝরে পরা চুল পেঁচাতে পেঁচাতে ফুটপাত ধরে হাঁটছিলো।

-এই ঝাঁঝাঁ দুপুরে তুমি ফুটপাতে হাঁটছো।সিরিয়াসলি?

-তুই এখানে কী করছিস?

-তোমাকে খুঁজতে গিয়ে এসেছি।হাতে কী?

-চুল।সব চুল পরে যাচ্ছে।টেকো কন্যা হয়ে যাবো কয়দিনেই।

-মাথার সেলাই শুকিয়েছে?

-হ্যাঁ। কিন্তু দাগ হয়ে আছে,ব্যাথা নেই যদিও।

-মন খারাপ চুলের জন্য?

-কিছুটা।

-এক কাজ করো,চুল ছোট করে ফেলো।নতুন কোনো স্টাইল করো।নিউ লাইফ,নিউ স্টাইল,ব্র‍্যান্ড নিউ ভিনা!

-ঠাট্টা করিস আমার সাথে?

-মোটেও না।আম ড্যাম সিরিয়াস।বাসায় যেয়ে সবাইকে সারপ্রাইজ দিও।

ভিনা কিছুক্ষণ ভেবে কি যেন চিন্তা করলো।এরপর কন্ঠে তেজ নিয়েই বললো-

-চল তাহলে।রাখবো না এই চুল।না চুল রাখবো,না স্মৃতি। 

রুশান এই কথার অর্থ ধরতে না পারলেও খুশি হলো প্রচুর। ভিনার ওর কথায় চুল কাটছে।ভাবতেই নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রুশানের।

গুলশানের নামী এক পার্লারে ভিনা খরচ করেই চুল কেটে একদম ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে আসলো।রুশান বাইরে অপেক্ষা করলো ভিনার জন্য।চুল বিসর্জন দিয়ে যখন আয়নায় তাকালো ভিনা,চমকে উঠলো কিছুক্ষণের জন্য।আগে কখনোই এত আয়োজন করে চুল কাটা হয়নি।লম্বা চুল নিজেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আগা ছেটে ফেলতো।এই প্রথম এত ছোট করলো।কত ভালো হতো যদি সত্যিই জীবনের কিছু স্মৃতি এভাবে কেটে ফেলে দেয়া যেত।

ভিনা যখন বের হলো পার্লার থেকে,রুশান সবসময়ের মতো মুগ্ধতায় ডুবে গেলো। বয়স কমে গিয়ে কিশোরী মনে হচ্ছে ভিনাকে।কেন,কেন এত সুন্দর মেয়েটা?

••••••••••••••••

-কী করলি ছেড়ি তুই?এটা কিছু হলো?আমাকে বলতি।

প্রিতি ভিনাকে দেখেই আকাশ থেকে পরেছে।প্রথম কয় সেকেন্ড তো মনে করেছে ভুল দেখছে চোখে।

-আমাকে খারাপ লাগছে?সত্যি করে বলো তো?

-না,তা লাগছে না।কিন্তু তাও,তোকে যেভাবে দেখতাম,সেভাবে দেখছিনা।এটাই সমস্যা।

-তোমাকেও তো দেখছিনা।এইযে নাক ফুটা করে নোজপিন পরছো।তোমাকে আগে মেয়ে মেয়ে লাগতো।এখন বউ বউ লাগে।

-সত্যি?

প্রিতি চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

-হ্যাঁ সত্যি।

ভিনা প্রিতির কোলে বালিশ রেখে সেখানে মাথা দিলো।প্রিতি আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

-জানিস ভিনা,সেদিন তুই আমার হয়ে যা করেছিলি,আমি সেটা কখনোই ভুলবো না।কীভাবে আমার মনের কথা বুঝলি তুই?

-তোমার জায়গায় আমি থাকলে,তুমিও একি কাজ করতে।তাছাড়া এইভাবে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো না।বড় অনুষ্ঠান করে ধুমধাম করে অনেক হাসিখুশিভাবে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো।সেখানে নিশ্চয়ই ছেলের মা থাকতো।

-হ্যাঁ থাকতো।

-তাহলে?তোমার বিয়ে আমি হুট করে দেয়ার কথা তুলেছিলাম কারণ...

ভিনা থেমে গেলো। এত শক্ত কথা বলা উচিৎ হবে নাকি ভাবছে।

-কারণ মম আর আসতো না আমার বিয়েতে।আর তুই চেয়েছিস,একদম এতিম হয়ে যেন আমার বিয়ে না হয়।তাইনা?

-হ্যাঁ আপু।আমি জানি না আমি ঠিক করেছি নাকি।

-ঠিক করেছিস। সবচেয়ে বেশি ঠিক করেছিস আমাকে ওখানে যেতে না দিয়ে।সত্যি বলতে আনওয়ান্টেড হয়ে যেতে চাইনি আমি।রেহানের মা হুট করে এসব সহজে নিতেন না।আর আমি আশ্রিতা হয়ে থাকতেও চাইনি।তুই আমার মান রেখেছিস রে।

প্রিতি চোখ মুছলো।ভিনা বালিশ থেকে মাথা তুলে প্রিতিকে জড়িয়ে ধরলো।

-আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আপু।

-আমি জানি রে পাগল।সেদিন তুই যেভাবে আমার পক্ষ নিয়ে ঢাল হয়ে থাকলি,আমার সম্মান রাখলি,আমি সেটা কখনো ভুলবোনা।

সেদিন সন্ধ্যায় প্রিতির মা,রেহানের বাবা এবং রুশানের উপস্থিতিতে প্রিতি আর রেহানের বিয়ে হয়।বিয়েতে উকিল বাবা হিসেবে ছিলো সোহেল।বিয়ে পড়ানোর পরপরই প্রিতির মা চলে যান।মেয়েকে নিয়ে তার কোনো আবেগ কাজ করেনি। বরং তিনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।নিজের মায়ের এমন ভাবলেশহীন আচরণে কষ্ট না পেলেও রেহান এবং নিজের শ্বশুরের সামনে লজ্জায় পরে গিয়েছিলো প্রিতি।কারণ থাকার জায়গা না থাকায় বিয়ে করেছে,এই ধারণা তাদের মধ্যে জন্মাতে পারে ভেবে। ফারুক নিজেও অনেক চিন্তায় ছিলেন।জেবাকে না জানিয়ে এত বড় ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন শুধুমাত্র ছেলের দিকে তাকিয়ে।এত বছর পর ছেলে নিজের নিঃসঙ্গ জীবন থেকে বেরিয়ে আসছে।তাছাড়া রেহানের বয়স বেড়েছে,জীবনসঙ্গী বেছে নিতে ভুল করার কথা নয়।এখন হুট করে বউ নিয়ে গেলে জেবার প্রতিক্রিয়া কী হবে,সেটা নিয়ে ভাবনায় পরে গিয়েছিলেন।মা ছেলের দ্বন্দ্ব আরো নতুন করে বাড়লে কী হবে,বুঝতে পারছিলেন না।এদিকে আত্মীয় স্বজনহীন,মা বাবার ছায়াতল না থাকলেও প্রিতি চাচ্ছিলো নিজের শ্বশুরবাড়িতে পুত্রবধূর মর্যাদায় পরিপূর্ণ সম্মান নিয়ে যেতে।অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি হয়ে যাওয়াটা বিবেকে লাগছিলো।এটা সত্যি নিজের স্থায়ী ঠিকানা এবং নিরাপত্তার ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করেই এই সিদ্ধান্ত, কিন্তু নিজের বাকী জীবন যেই বাড়িতে কাটাবে,সেখানে এমন অসম্মানের সাথে যাওয়া বুকে লাগছিলো।

খাবার টেবিলে যখন সবাই একসাথে বসা ছিলো,তখন নীরবতা ভেঙে ভিনা বললো-

-আমার কিছু কথা ছিলো রেহান ভাইয়া।

-বলো ভিনা।

-আপনার স্ত্রীকে আমি রেখে দিবো নিজের কাছে।ও কয়দিন পর আপনার কাছে যাবে।

ফারুক সাহেবের মলিন মুখে মুহূর্তেই হাসি ফুটে উঠলো।এমন কিছুই উনি চাচ্ছিলেন।

-কেন ভিনা?কোনো আপত্তি আছে?

-হ্যাঁ ভাইয়া।ধরে নিতে পারেন।আপুকে এত জলদি বিয়ে দিতো না আমার বাবা মা,কিন্তু প্রিতি আপুর আম্মু বিদেশ গেলে,উনার দেশে আসা একটু কষ্টকর হয়ে যায়।উনি যেহেতু এসেছেন,তাই তার উপস্থিতিতেই এই বিয়ে পড়ানো।এছাড়া কোনো সমস্যা নেই।এই বাসা প্রিতি আপুর,এইখানে থাকুক,পড়াশোনা করুক।আর আপনারা ধীরে সুস্থে আপনাদের পরিবারের বাকী সদস্যদের জানালেন।পরে একটা ছোট অনুষ্ঠান করে নিয়ে গেলেন আপুকে।এটা আমার মতামত,আঙ্কেল আপনি কী বলেন?

ভিনা ফারুককে প্রশ্ন করলো।ফারুক কথা না পেঁচিয়ে সরাসরি বললেন-

-এটা ভালোই হয়।একদম খালি হাতে বিয়ে দিয়েছি ছেলের।নতুন বউকে সপরিবারে বরণ করে নিতে পারলে আমারো ভালো লাগবে।

-ভাইয়া,আপনার বউ নিয়ে মাতবরি করছি,আপনি কিছু মনে করছেন না তো?

রেহান প্রিতির সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলো।এরপর বললো-

-মোটেও না।প্রিতি নিজেকে গুছিয়ে নেক,পড়াশোনা কন্টিনিউ করুক।এরপর সুন্দর সময় দেখে ওকে ওর বাসায় নিয়ে যাবো।

প্রিতি গোপনে নিজের চোখ মুছলো।'ওর বাসা' কথাটা কানে বাজছে।অবশেষে নিজের বাসা বলে আলাদা ঠিকানা হলো। 

-ঠিকাছে।তাই কথা থাকলো।

ফারুক সাহেব চলে যাওয়ার সমউ প্রিতি তার পা ধরে সালাম করলো।ফারুক প্রিতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

-চিন্তা করোনা মা।জলদিই নিয়ে যাবো তোমাকে।

এরপরের দিনগুলো বেশ দ্রুতই চলে যাচ্ছে।বিয়ের পর প্রিতি এবং রেহানের প্রেম শুরু হয়েছে।দুইজনই রাত জেগে কথা বলে,প্রায়দিনই বিকেলে ঘুরতে যায়।মাহভিন থাকায় এ বাসায় আর বিড়াল আনেনি প্রিতি,সেগুলো রেহানের কাছেই আছে।ভার্সিটি থেকে আসার সময় প্রতিদিনই রেহান কিছু না কিছু নিয়ে ছুটির সময়ে অপেক্ষা করবে।প্রিতি ভালোমতো জানে,রেহান অনুগ্রহ করে বিয়ে করেনি।অনুগ্রহ করে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া কোনো ব্যাপার ছিলো না রেহানের জন্য।কিন্তু রেহান সত্যিই প্রিতির হাত ধরেছে সারাজীবনের জন্য।এত ভালোবাসাহীন জীবনে সৃষ্টিকর্তা ভিনার মাধ্যমে সুখের স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

বাবা মায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান ছিলো প্রিতি।তার মা রাইমা কখনোই নিজের প্রথম স্বামীকে ভালোবাসেননি।ভুল করে প্রিতি পৃথিবীতে এসেছিলো।জীবনের প্রতি মুহূর্তে একথা তার মা বুঝিয়ে দিয়েছেন।প্রিতির বাবা ছিলো সহজ সরল মধ্যবিত্ত সাধারণ চেহারার একজন মানুষ।নিজের অতি রূপবতী স্ত্রীকে ভালোবাসায় কোনো ত্রুটি রাখেননি তিনি।কিন্তু সেই স্ত্রী যখন প্রতারণা করে অন্যের হাত ধরে চলে গেলো,এই আঘাত আর সহ্য করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের মানসিক অবস্থার কাছে হেরে গিয়ে মেয়েকে একাই পৃথিবীর জন্য ছেড়ে দিলেন।প্রিতির অভিভাবকেরা যেখানে তার দায়িত্ব নিতে পারেনি,সেখানে ভিনার মতো কম বয়সী একটা মেয়ে হুট করে এসে সব ঠিক করে দিয়ে গেছে।

প্রিতি খেয়াল করেছে,সোহেল সহজে মাহভিনকে ভিনার কাছে যেতে দেয়না।প্রিতির ভীষণ খারাপ লাগে,ভিনার মতো মেয়ে,যেকিনা মহাসাগর পরিমাণ ভালোবাসা নিজের মাঝে রেখে দিয়েছে,সেই নিজের সন্তানকে সেই ভালোবাসার অংশীদার কর‍তে পারলো না।ছোট্ট সেই মেয়েটা এই নির্মল ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলো।তবুও প্রিতি গভীর রাতে ঘুমন্ত ভিনার দিকে তাকায়,এবং অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে প্রার্থনা করে যেন জীবনে কখনো ভালোবাসার অভাব না হয় ভিনার।এর জন্য অতীত থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। কষ্ট হলেও প্রিতি চায়,যেন মাহভিনের সত্যি কখনো কেউ না জানে,বিশেষ করে রুশান।তবে পৃথিবীতে আমরা যা চাই,তা সবসময় হয়না।
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp