অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৪৯ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-- ভিনা বিয়ে করছে,অথচ তোমাকে আগে জানালো না!আমার কাছে বিষয়টা অবাক লেগেছে।

রেহান ল্যাপটপে চোখ রেখে কথাগুলো প্রিতিকে বললো।প্রিতি বিছানার এক পাশে হেলান দিয়ে বসে আছে চুপচাপ।ভিনা মাসখানেক ধরে এ বাসায় থাকে না।বাবার অসুস্থতার কথা বলে এক সপ্তাহের জন্য গিয়েছিলো,এরপর কী হলো কে জানে।কথাবার্তা কমিয়ে দিলো,ফোন দিলেও ধরতো না।প্রিতি নিজে যখন বাসায় গেলো তখন পরিবেশ অস্বাভাবিক লেগেছে।ভিনাকে দেখেই মনে হচ্ছিলো কিছু লুকাচ্ছে,মুনাকেও দেখে মনে হয়েছে কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না।পারিবারিক কোনো বিষয়ে সমস্যা হতে পারে ভেবে আর কোনো প্রশ্ন করেনি।এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে।খুঁচিয়ে সব বের করা উচিৎ ছিলো।
রিমোট বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে প্রিতি বাথরুমে চলে গেলো। কান্না পাচ্ছে,একইসাথে রাগ ও উঠছে।রেহান মানুষ হিসেবে অনেক ভালো,কিন্তু কোন কথায় কে হটাৎ কষ্ট পেয়ে যাবে,সে হিসেব করে না।তাই অনেক অপ্রিয় সত্য কথাও নির্লিপ্ততার সাথে বলে দেয়।এখন একে কে বুঝাবে?যখন চোখ মুখ মুছে প্রিতি খাবার দিতে গেলো,রেহান পেছন থেকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো-

-- কান্না করে ভাসিয়েই ফেলেছো দেখছি।এতটুক কথায় কেউ কষ্ট পায়?
-- মাঝে মাঝে তুমি পাশের বাসার ভাবিদের মতো করো রেহান।ইচ্ছা করে খোঁচামারা প্রশ্ন করো।
-- এক্সাম্পল দারুণ দিয়েছো!তোমার ফ্ল্যাট বেড়ানোর স্বভাব নেই,তাই ভাবলাম খোঁচার দায়িত্ব আমিই নেই।
-- ধ্যাৎ 
-- আচ্ছা আচ্ছা,এবার সিরিয়াস।রুশান কি জানে কিছু এ ব্যাপারে?
-- না...
-- জানাবে কীভাবে ঠিক করেছো?
-- উহুউ
-- একসময় রুশান পাগল ছিলো ভিনার জন্য।গত কয়মাসে কী যে হলো!খুলেও বললো না কিছু।তুমি কি জানো এ ব্যাপারে? 

প্রিতি ঢোক গিলে রেহানের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।এরপর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুষ্ক হাসি দিয়ে বললো-
-- না। এখন ওরা বড় হয়ে গেছে,আমরাই ছোট রয়ে গেলাম কি না!কিছুই জানায় না।ইউ নো...'পার্সোনাল ইস্যুস'।

এরপর একরকম পালানোর জন্যই রান্নাঘরে খাবার গরম করতে চলে গেলো।রেহান টেবিলের উপর রাখা ফ্রুট বাস্কেট থেকে আঙ্গুর ছিড়ে মুখে নিলো,এরপর কয়েক মূহুর্ত প্রিতির দিকে তাকিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে চলে এলো ঘরে।

প্রিতির বলকানো তরকারির দিকে তাকিয়ে শুধু একটা প্রশ্নেই ডুবে গেলো,এত বয়সের পার্থক্যে বিয়ে করা কি খুব জরুরি ছিলো?কারণ,বয়সের পার্থক্য বেশি হওয়া একদিকে যেমন ভালো,অন্যদিকে খারাপ ও।নিজের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে প্রিতি জানে,যদি ভাগ্য খারাপ হয়,তাহলে ভিনা ডোমিনেশনের শেকলে আজীবন বাধা পরে যাবে।

------------

মুনা উসখুস করছেন ভিনাকে কিছু বলার জন্য।তিনবার ভিনার ঘরে এসেও কিছু বলতে পারলো না।চতুর্থবার ঘরে ঢুকতেই ভিনা বই বন্ধ করে মুনাকে ডাক দিলো।
-- বসো এখানে।কী বলবে বলে ফেলো।

মুনা তড়িঘড়ি করে দরজা চাপিয়ে দিয়ে ভিনার পাশে বসলেন।এরপর দুই হাত নিজের কাছে নিয়ে বললেন-

-- আমি তোমার বাবাকে বুঝিয়ে নিবো।সত্যি করে বলো,এই বিয়েতে তোর মত আছে?
-- কেন মত থাকবে না?আমি সব ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
-- আরেকবার ভেবে দেখ না।
-- কেন?তোমার পছন্দ হয়নি নাদিমকে? 
-- হয়েছে কিন্তু....

মুনা আর ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না।নাদিম ভালো হলেও নাদিমের বোন নাইদা কে মুনার অস্বাভাবিক মনে হয়।আরেকটা ব্যাপার হলো নাদিমের মা নয়নিকা বুদ্ধিমতী মহিলা হলেও মেয়ের কাছে কোনো কারণে পরাস্ত থাকেন।নাদিমের এই বিয়ে মুনার কাছে নাইদার জোরাজোরি মনে হচ্ছে।একজনের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর পুরো বিয়ে নির্ভর করছে।এই ব্যাপারটাকেই মুনা মানতে পারছেন না।আবার ভিনাকেও বলতে পারছেন না।কারণ নিজে এক সময় ঘর ভাঙানির ভূমিকায় ছিলেন ভিনার জীবনে,এখন চান না ভিনা তাকে আড়চোখে দেখুক।তবুও,অভিজ্ঞতায় মাখা দৃষ্টিতে উনি ঠিকি বুঝে গেছেন নাদিমের সংসারে প্রধান কে এবং কেমন।জেনে বুঝে এমন পরিবেশে ভিনাকে ঠেলে দেয়ার মানেই হয় না।কিন্তু অনুতাপের কারণে না সোহেলকে,না ভিনাকে উনি এটা বুঝাতে পারছেন।

-- কিন্তু কী মা?
-- একটু ভেবে দেখিস রে ভিনা।একটু হিসাব করে আগা।
-- ঠিকাছে

মুনা ঠিকাছে শুনেও আশ্বস্ত হতে পারলেন না।উদ্ভ্রান্তের মতো দরজায় একবার ধাক্কা খেয়ে এরপর নিজেকে সামলে চলে গেলেন।ভিনা তাকে সামলাতে গিয়েও পরে উঠলো না।

বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে ভিনা গত কয়দিনের কথা ভাবতে বসলো।সন্ধ্যা নামবে এখনি,এই সময়টা যাবতীয় বিষন্নতা জেঁকে বসে।নাদিম লোকটাকে এক শব্দে বিশেষায়িত করা যায় না।কখনো তার ভদ্রতা মুগ্ধ করে,কখনোবা অপ্রয়োজনীয় আধিপত্য পুরো ব্যক্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে।ভিনার ও কিঞ্চিৎ সংশয় কাজ করে।তবুও,এ যুগে একদম পার্ফেক্ট লাইফ পার্টনার কেইবা পায়?

হ্যাঁ, নাদিম আর আর ভিনার বিয়ে ঠিক।দুই মাস পরেই বিয়ে।গত পরশু নাদিম পরিবারসহ এসে আংটি পরিয়ে গেছে।দুই পরিবারের বেশি কেউ আসেনি।ভিনার দিক থেকে এক চাচা,দুই ফুপু এসেছিলো।নানাবাড়ি দিক থেকে আত্মীয় স্বজন কাবিনের দিন আসার কথা।কিন্তু নাদিমের দিক থেকে নাইদা,নাইদার হাজবেন্ড রাজ,তাদের দুই ছেলে এবং তার মা নয়নিকা এসেছেন।কম লোকজন আসা প্রসঙ্গে সোহেল তাদের জিজ্ঞেস করলে নাইদা দাম্ভিকভাবে উত্তর দিয়েছে 'আপনাদের যা অবস্থা!বেশি চাপ দিতে চাইনি'।যদিও ভিনা এটা চুমকির কাছ থেকে শুনেছে।সরাসরি শুনে থাকলে অবশ্যই এর যথাযথ উত্তর দিতো।ঘটনার সত্যতা জানতে সোহেলের কাছে গিয়েছিলো,সোহেল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন এমন কিছুই হয়নি।সবই শোনা কথা।বিয়ের ঘরে ভাঙানির জন্য এসব কথা ওঠে,এগুলো কানে দিয়ে লাভ নিয়ে।তবু ভিনা সহজে বিশ্বাস করেনি।কারণ বিয়ের ঘর বলার মতো এত আত্মীয় স্বজন আসেনি তখন।তাই ঘটনা সত্যি হতেই পারে।তারপরো এনগেজমেন্টর অভিজ্ঞতা ভালো যায়নি,ভিনা খুব স্বাভাবিকভাবে আংটি পরালেও নাদিমের সময় বাঁধ সাধে নাইদা।সে ভাইয়ের হাত থেকে আচমকা আংটি নিয়ে নিজেই পরাতে যায়।ভিনাসহ উপস্থিত সবাই চমকে যায়।ভিনা নিজেকে শান্ত রেখে বলে-

-- কী হয়েছে আপু?
-- এরে!নতুন বউ এত কথা বলে নাকি।

ভিনা চুপ হয়ে গেলো।নাদিম নাইদার কাছ থেকে খানিকটা জোর করেই আংটি নিলো।নাইদা মুখ বাঁকিয়ে বললো-

-- ইশশিরে!এই বউয়ের হাত ধরতে তর সইছে না।বিয়ের পর কী করবিরে তুই?

নয়নিকা উঠে এসে হাত ঝাঁকি দিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন কড়া দৃষ্টিতে।এরপর নিজেই আংটি নিয়ে ভিনার হাতে পরিয়ে দিলেন।নাদিম মুখ শক্ত করে রাখলো,এরপর ভিনার দিকে তাকালো ক্ষমাপ্রার্থনা করে।ভিনা মাথা নাড়িয়ে বুঝ দিলো,সমস্যা নেই।
সবাই খেতে বসার সময় ড্রয়িং রুমে নাদিম ও ভিনা একা ছিলো।তখন নাদিম ভিনার হাত ধরে বলেছে-

-- রিয়েলি স্যরি ভিনা।আমার বোন অনেক ইম্যাচিওর। কিছু মনে করো না।
-- আমি মনে করিনি।

এভাবেই শেষ হয়েছিলো এংগেজমেন্ট।তার পরেরদিন,মানে গতকাল বিয়ের গয়না কিনতে যাওয়ার সময়েও নাইদা এসেছিলো।নাইদাই হালকা ধরনের কিন্তু মিডিওকোর গয়না পছন্দ করছিলো।ভিনা চাইলেও কিছু বলতে পারেনি।এমনকি নাদিম ও না।একদম শেষে যেয়ে নাদিম রুবি পাথরের ছোট লকেট দেয়া চেইন কিনেছে ভিনার জন্য,যেটা ছিলো নাইদার অগোচরে।ভিনা ভাইয়ের জীবনে বোনের আধিপত্যের বিষয়টা টের পাচ্ছিলো ভালোমতো।কিন্তু মাথা ঘামায়নি।কারণ শেষে অস্ট্রেলিয়ায়ই চলে যাবে নাদিমের সাথে।তবে....কালকে রাতে নাদিমের একটা কথা পছন্দ হয়নি।ঠিক কথা না,কথার ধরণ।রাতে নাদিমের সাথে কথা বলার সময় অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার বিষয়ে কথা হচ্ছিলো।তখন নাদিম বলেছে-

-- সব প্রসেসিং শেষে নিয়ে যেতে যেতে বছরখানেক লাগতে পারে।ততদিন তুমি মায়ের সাথে থাকবে।যদি মা গ্রামেও যায় থাকার জন্য,সেখানেই যাবে।

একবার জিজ্ঞেস ও করেনি,তুমি কি থাকতে পারবে,তোমার কী মতামত অথবা এরকম কিছু।কারণ চট করে গ্রাম বা অন্য জায়গায় স্বামী ছাড়া থাকা সহজ না।এ যেন শেকড় ছাড়া আগাছার মতো ঘরে পরে থাকা।ভিনা কোনো উত্তর দেয়নি।এক অজুহাতে ফোন রেখে দিয়েছে।

সব বাদ দিয়ে ভিনা ফেসবুকে ঢুকলো।বিয়ে হয়ে যাচ্ছে,সংসার শুরু হবে এরপর চলেই যাবে।তাই অনেক সাহস নিয়ে পুরোনো সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করবে।কথা,সাদ,ওয়সিম,আবির,নওমি,আরশি...।ভিনা নিশ্চিত আরশির খোঁজ পাওয়া যাবে না।এই মেয়ে নিজেকে এত সহজে সবার সামনে আনবে না।ভিনার খুব জানতে ইচ্ছা করে আরশির ব্যাপারে।কী হয়েছিলো ওর সাথে,কীভাবে বেঁচে আছে?
অনেক্ষণ ঘাটাঘাটি করে কথা,সাদ এবং ওয়াসিমের আইডি খুঁজে পেলো ভিনা।রিকোয়েস্ট দেয়ার সাত ঘন্টার ভেতরে সবাই এ্যড হয়ে গেলো,কথা এ্যড হয়েই গ্রুপ খুলে ফেললো সবাইকে নিয়ে।সারারাত ভিনা কথা বললো গ্রুপ কলে।সাদ কলেজের শেষের দিকে বাঙ্ক দিয়ে ঘুরার দিনের সব ছবি দিলো গ্রুপে।বহুদিন পর ভিনার চোখে পানি আসলো ছবিগুলো দেখে।কলেজপড়ুয়া উচ্ছল কিশোরী!স্বপ্নময় দিন,রুটিন মাফিক পড়াশোনা,চমৎকার সব বন্ধু এবং অনেক বেশি অনুভূতি মাখানো প্রেম।কী সুন্দর ছিলো সেই দিনগুলো।ভিনার সব ছুড়ে ফেলে সেখানে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।ইচ্ছে করছে আরশিকে জড়িয়ে ধরতে,ক্যান্টিনে সবার সাথে আড্ডা দিতে।ইচ্ছে করছে পুকুর পাড়ে যাবিরের সাথে সেই কাটানো বিকেল ফিরে পেতে।

সেদিন আবারো ভোর হলো।ভিনা আবারো ভোর দেখলো রাস্তায় নেমে।নতুন কারো সাথে জীবন শুরুর আগে পুরোনো মায়া ফেলে আসতে হবে।হোক সেটা ক্ষত,সেখানেও ভবিষ্যতের প্রলেপে সারিয়ে তুলতে হবে।পিছুটান নিয়ে সংসার করা গেলেও মন লাগানো যায় না।মন না লাগালে সেই সংসার পরিপূর্ণ ও হয় না।ভিনা সিদ্ধান্ত নিলো,গত তিন বছরে যা করেনি,সেটা এখন করবে।যাবিরকে খুঁজে বের করবে।সব প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞেস করবে।এরপর সব মায়া সব স্মৃতি ফেলে এগিয়ে যাবে।আর মাহভিন?মাহভিন শুধু ভিনার মেয়ে,যার ভবিষ্যতের দায়িত্ব সোহেলের।ভিনার এখন একটাই লক্ষ্য,যাবিরকে খুঁজে বের করা,যেটা করা খুব একটা কঠিন হবে না। 
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp