কলোনির পুকুর পাড়ে বসে আছে ভিনা।কিছুক্ষণ আগে পুরোনো বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে এসেছে।এখন ভোর পার করে মাত্র সকাল হয়েছে।সূর্যের প্রথম আলোয় চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।ভিনা একা আসেনি।পাশে মাহভিন দুই পা ঝুলিয়ে বসে আছে।চোখে ঘুম থাকায় চঞ্চলতা নেই।আজকে জীবনে প্রথমবার মাহভিনকে নিয়ে ভিনা একা বের হয়েছে।আগে কখনোই এমন হয়নি।কয়দিন আগেই বিয়ে ভেঙেছে রুশানের সাথে।এরপর পুরো বাড়িতে গুমোট পরিবেশ ছিলো।সোহেল ভিনার সাথে কথা বন্ধ রেখেছেন।
আজকে এভাবে হটাৎ মাহভিনকে নিয়ে বের হওয়ায় মুনার মুখ মলিন হয়ে গিয়েছিলো।চোখে ছিলো অজানা ভয়।মানা ও করতে পারছিলেন না।নিজেকে শান্ত রেখে ভিনাকে জিজ্ঞেস করেছেন কোথায় যাচ্ছে।ভিনা সংক্ষেপে উত্তর দিয়েছে যে হাঁটতে বের হচ্ছে।মুনা এ কথায় সন্তুষ্ট হননি।তার মনে হচ্ছিলো আরো কিছু ব্যাপার আছে।এত সকালে মাহভিনকে নিয়ে হাঁটতে যাওয়া স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো না।হাজারটা ভয় এবং আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও মুনা কিছু বলতে পারলেন না।কারণ....বাচ্চা তার না।
ভিনা কলোনিতে পৌঁছানোর পনেরো মিনিট পরে যাবির আসলো।হাত ভর্তি খেলনা এবং জামা কাপড়ের ব্যাগ।চোখে অন্যরকম আনন্দ।এসেই মাহভিনের হাত ধরলো।মাহভিন যাবিরের দিকে তাকালো প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে।এরপর হাত সড়িয়ে নিলো।ভিনাকে জিজ্ঞেস করলো--
-- আপু এটা কে?
ভিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।চোখে পানি জমে আছে,চারপাশ ঝাপসা লাগছে।আসল পরিচয় দেয়া সম্ভব না।মাহভিন কথা শিখেছে,মানুষ চিনে।আসল পরিচয় দিলে এই ছোট মনে দ্বন্দ্ব লাগবে।ভিনা ধরা গলায় বললো-
-- তোমার আঙ্কেল হয় সোনা।আদর করবে,খেলনা দিবে।কোলে যাও লক্ষী।
মাহভিন যাবিরের হাতের দিকে দেখলো।খেলনা দেখে চোখের ঘুম চলে গিয়ে ঝলমল করছে।মিষ্টি হাসি দিয়ে মাহভিন যাবিরের কোলে গেলো।পানি পরছে যাবিরের চোখ দিয়ে।সেই পানি আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো।অনেক্ষণ মাহভিনকে কোলে নিয়ে খেলা করার পর মাহভিন নেমে গেলো।খেলনার মধ্যে গোলাপি রঙের বল ছিলো। সেই বল দিয়ে খেলতে চাচ্ছে এখন।ভিনা মাহভিনকে বুঝিয়ে দিলো কোন জায়গা পর্যন্ত বল নিয়ে যাওয়া যাবে।এর দূরে গেলে খেলনা হারিয়ে যাবে।মাহভিন বুঝদার মানুষের মতো হাত নেড়ে ভিনাকে অভয় দিয়ে বল খেলায় মেতে উঠলো।
যাবির এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে মাহভিনকে।নিজের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আজকে এই ফুটফুটে মেয়ে পৃথিবীতে থাকতো না,ভেবেই মাথা নিচু করে কান্নায় ভেঙে পরলো।ভিনা যাবিরকে আগে কখনোই এভাবে কাঁদতে দেখেনি।শক্ত মানুষের কান্নায় ভারী এবং তীক্ষ্ণ অনুভূতি লুকিয়ে থাকে।যাবির চোখ মোছার সময়ে ভিনা ওর হাতে বড় দাগ লক্ষ্য করলো।
-- দাগ কীভাবে হয়েছে?
-- ভাঙচুর করেছিলাম বাসায়।রুপিনের উপর রাগ হচ্ছিলো।
-- দাগ দেখে তো মনে হচ্ছে না।তুমি কি এটেম্পট নিয়েছিলে?
যাবির নিরুত্তর বসে থাকলো।
-- তুমিও ভেঙে পরেছিলে?
-- কাপুরুষ ছিলাম ভিনা।কিছুই করতে পারলাম না।না মরতে পারলাম,না বাঁচতে।সাহস ছিলো না দেখে নিজের বাচ্চাকেও....
ভিনা ভেতরে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে।ঠিকি তিনজন এক হলো। তবে কত ভিন্ন পরিণতি নিয়ে।টঙের মামা আজকে আরো বিস্তৃত হাসি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।উনার হাসিই বলে দিচ্ছে সব।হয়তবা এই সাধারণ ভালো মানুষটা ভাবছে ওরা তিনজন মিলে সুখী পরিবার।কয়েক বছর আগে প্রেম করতো,এখন পড়াশোনা করে বিয়ে করে সংসার করছে।তাই যদি হতো!
ভিনা ঘড়ি দেখলো।বেশি সময় হাতে নিয়ে আসেনি।ব্যাগ থেকে ফাইল বের করে কাগজগুলো ভালোমতো চেক করলো।এরপর যাবিরের দিকে কাগজগুলো এগিয়ে দিলো।
-- তোমার জিনিস তোমাকে ফিরিয়ে দিলাম যাবির।
যাবির কাগজগুলোতে চোখ বুলালো।উইলের কাগজ।রুপিনের সম্পত্তি ভিনা যাবিরের নামে লিখে দিয়েছে।কিন্তু সব সম্পত্তি না।জুয়েল চৌধুরী মারা যাওয়ার পর রুপিনের নিজের তৈরি সম্পত্তির কিছুই যাবিরকে দেয়নি।এখানে সব সম্পত্তি যাবিরের নানার।রুপিনের সম্পত্তি ভিনা দান করে দিয়েছে বেসরকারি সামাজিক সংগঠনে।তাদের মূল কাজ গ্রামের অসহায় নারীদের সাহায্য করা।
-- লাগবে না ভিনা।অর্থহীন জীবনে এই অর্থ দিয়ে কী করবো?এখন কী করবো?
-- কোনো দয়া করছিনা।তোমার প্রাপ্য শুধু তোমাকে বুঝিয়ে দিলাম। স্বেচ্ছায় ধাক্কা খাওয়ার কী প্রয়োজন?তুমি এখন ভালো চাকরি পাবে না জেলে থাকার রেকর্ড হওয়ার কারণে। অন্তত টাকা দিয়ে,ভালো লইয়ার দিয়ে নিজের মিথ্যা মামলা নিয়ে যুদ্ধ করো।তুমি ছাড়া পেয়েছো শুধু, মিথ্যা মামলা এখনো প্রমাণিত হয়নি।
যাবির বেশ খানিকটা সময় ভেবে চিন্তা করে কাগজগুলো নিলো।কারণ একটাই,নিজের বিরুদ্ধে হওয়া মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা।
মাহভিন তখনো খেলছে। ভিনা যাবির দুইজনই সেদিকে তাকিয়ে আছে।ভিনার অস্থায়ী সংসার।কত স্বপ্ন ছিলো এই সংসার নিয়ে।কাল্পনিক এই সংসারে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছিলো।নীরবতা ভাঙলো ভিনা।
-- আমাকে ভালোবাসতে যাবির?
-- এখন এসব জানা কি খুব জরুরি?
-- বিয়ে এখন করছিনা।ভেঙে দিয়েছি বলতে পারো।
যাবির কোনো মন্তব্য করলো না।দেখে মনে হলো ধাক্কা খেয়েছে।
-- তুমি জেল থেকে ফিরে এসে কেন আমার হা৯ত ধরতে চাওনি যাবির?আরেকজনের হয়ে যাচ্ছিলাম দেখেও কি খারাপ লাগে নি?
-- সম্পর্কে তৃতীয়জন এসে পরেছিলো ভিনা।জেল থেকে ফিরে এসে আমার কাছে কিছুই ছিলো না।
-- এখন তো সবকিছু আছে।এখন?
দুইজনের মাঝে আর কোনো বাক্য বিনিময় হলো না।কোটি কোটি শব্দের অনুভুতি অব্যক্ত রয়ে গেলো।ভিনা নিজের কৈশোরের স্বপ্নের ক্ষণস্থায়ী সংসারকে স্থায়ী করার জন্য আকুল হয়ে গেলো।সেরাতে বাসা থেকে বের করে না করে দিলে,সেরাতে নিজেকে সামলে রাখলে,কিছু মানুষ প্রতারণা না করলে আজকে এই সংসার ওর হতো।আজকে যাবিরের এই সর্বহারা হওয়ার পেছনেও ভিনা কিছুটা দায়ী।সবই হাতের কাছে ছিলো,সবই সুন্দর ছিলো।আজকেও তিনজন কাছাকাছি আছে।শুধু নাম নেই,পূর্ণতা নেই,অধিকার নেই।
ভিনা মাহভিনকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো।মাত্র একবার কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে গেলো।মুনা দাঁড়িয়ে আছে।কয়েক ঘন্টার চিন্তায় মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।দরজা খোলা মাত্র মাহভিন ভিনার হাত ছাড়িয়ে মুনার দিকে ছুটে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মুনাকে।মুনা মাহভিনকে কোলে নিয়ে গাল কপাল ভরিয়ে তুললো চুমুতে।মাহভিন মুনার বুকে মুখ গুঁজে রইলো।ভিনা অপলকভাবে তাকিয়ে থাকলো এই দৃশ্য দেখে।
রুশানের মন বলছিলো যাবির ফিরে আসায় ভিনা রুশানকে ছেড়ে চলে যাবে।ভিনা বিয়ে ভেঙে দেয়ার পর রুশান বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো।চোখের সামনে বিয়ে থেকে বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিলো।ভিনা যাওয়ার আগে যাবির এবং রুশানকে একসাথে ক্যাফেতে ডাকে।সেদিন রুশান সেদিন সব জানতে পারে যাবিরের ব্যাপারে।রুশানের কোনো বক্তব্য ছিলো না।পরিবর্তনের মধ্যে যা ছিলো,তা হলো আগে যাবিরকে দেখে রাগ হতো,এখন সহানুভূতি হয়।কিন্তু ভিনাকে হারানোর দুঃখের কাছে এসব কিছুই না।ভিনা রুশানকে নিজের মায়ের সাথে দূরত্ব ঘোচাতে বলে।ভিনা না থাকলেও পরিবার পাশে থাকবে বলে আশ্বাস দেয়।যাবিরকে প্রাপ্ত সম্পত্তি দিয়ে নিজেকে গুছিয়ে ব্যবসা দাঁড় করানোর কথা বলে ভিনা।দুইজনকেই সময় দেয় নিজেদের জীবন গুছিয়ে নেয়ার জন্য।বর্তমানে বিয়ে করা ভিনার পক্ষে সম্ভব না।দেশে ফিরে এসে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিবে।
ভেতরে এক মহাসাগর পরিমাণ সত্য বয়ে বেড়ায় ভিনা।সোহেল ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বিগত কয়দিনে কী হয়েছে।ভিনা কাউকে কিছু বুঝতে দেয় নি।কিছু সত্য সোহেল জানেন না,কিছু সত্য যাবির জানে না।সত্য সবসময় সুন্দর হয় না।সত্যের কুৎসিত রূপ আছে।দরকার কী মানুষগুলো বাকী জীবন এই অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য দিয়ে বোঝাই করা।ভালো থাকুক তারা।
ভিনা ডেনমার্কে ইউনিভার্সিটি অফ আরহাস থেকে পাওয়া স্কলারশিপে পড়ার প্রস্তুতি নেয়।যাওয়ার আগে জেবাকে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে যায়-
'রুশানকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিলাম।ভালো রাখবেন ওকে'
চারমাস পর ভিনা প্রফেসর রুদমিলাকে সাথে করে ডেনমার্কে চলে যায়।সোহেল মেয়ের সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।যাওয়ার দিন ও কথা বলেননি।রুশান এয়ারপোর্টে এসেছিলো ছলছল চোখ নিয়ে।যাবির এয়ার পোর্টের ভেতরে প্রবেশ করেনি।বাইরে প্লেন ফ্লাই করা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলো।
_______________________________
আট বছর পর.......
তিন বছরের দুইজন ছেলে আইল্যান্ড কিচেনের টেবিলের উপর বসে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে।এরা কেউ কাউকে দেখতে পারে না।খেলনা,খাবার,আদর সবকিছু নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকে।এদের মাঝখানে মিল তখনই হয় যখন মায়ের কাছে কোনো একজন বড় রকমের ধমক খায়।তখন দেখা যায় ঘরের কোনো কোণায় বসে একজন আরেকজনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।বিরল দৃশ্য সেটা।
ভিনা কানে এয়ার পড লাগিয়ে কথা বলছে।ছুটিতে ছিলো,কিন্তু ঘরে বসেও এক রত্তি স্বস্তি নেই।অফিসের ফোন আসতেই থাকে।কিচেনে রান্না করার মাঝখানে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে।কথা শেষ হওয়া মাত্র ছেলেদের দিকে চোখ গরম করে তাকালো ভিনা।দুই ভাই মায়ের এই চাহনিকে প্রচন্ড ভয় পায়।খোঁচানো বাদ দিয়ে ভদ্রভাবে খাওয়া শেষ করলো দুইজন।ভিনা ছেলেদের দিকে মনোযোগী হয়ে তাকায়।টুইন আইডেন্টিকাল ছেলে,চেনা বড় দায়।
হ্যাঁ। এরা ভিনার যমজ ছেলে।Veehan এবং Vaseem.
বাসায় আজকে মেহমান আসবে।অনেকদিন পর অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে ভিনা।ছুটির দিনগুলো একা থাকতে পছন্দ করে না।দুপুরের পরই আসবে সবাই।ভিনা ছেলেদের হাত মুখ ধুইয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলো।ছেলেদের বাবা সকালে বাজার সহ ঘরের অনেক কাজ করে এখন ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছে কাছের মানুষের সাথে।
ভিনা ঘর পরিষ্কার করে দুই কাপ কফি নিয়ে ড্রয়িং রুমে গেলো।যাবির এবং রুশান একসাথে বসে টিভিতে খেলা দেখছে আর গল্প করছে।ভিনা ওদের ডিস্টার্ব করলো না।হাসিমুখে নিজের ঘরে চলে আসলো।
যাবির আর রুশানকে একসাথে এভাবে দেখা কল্পনার বাইরে ছিলো।কিন্তু সময়.....সময় সব বদলে দেয়।ধৈর্য্য ধরলে সুদিন আসে ঠিকি।সারাজীবন কেউ কখনো দুঃখে অথবা সুখে কাটায় না।কারো জীবনের প্রথম ভাগ খুব সুখে কাটে,শেষভাগ কষ্টে।কারো জীবনে সুখ দুঃখ ঢেউয়ের মতো।কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী না।কারো জীবনের প্রথম ভাগে প্রচন্ড দুঃখে কেটে দুঃখের সব কোটা পূরণ করে ফেলে।দেখা যায় জীবনের নির্দিষ্ট সময়ের পর এদের সুখ উপচে পরে।ভিনা তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের জীবন পেয়েছে।এখন সুখ উপচে পরছে ওর জীবনে।স্বামী,সন্তান,সাফল্য নিয়ে জীবন ভরপুর।
ভিনা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ার গোছাতে বসলো।সেখানে ধুলোপড়া পুরোনো ডায়রি পরে আছে।সেটার মাঝখানে ডেনমার্কের প্রথম টিকিট,মাহভিন'স এর হিসাব নিকাশের খোলা কাগজ,ভার্সিটির গ্রেড শিট,বিয়ের কার্ড রয়েছে।সময় কত দ্রুত চলে যায়।দেখতে আজকে কত বছর পার হয়ে গেলো জীবনের।ভিনা ডায়রি হাতে স্মৃতির পাতায় নিজেকে হারিয়ে ফেললো।
ডেনমার্কের নতুন পরিবেশে ভিনা পড়াশোনা শুরু করেছিলো গ্র্যাজুয়েশন শেষে।এদিকে রুদমিলা ডেনমার্কের অন্য একটি ইউনিভার্সিটিতে এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে যোগ দিয়েছেন।এই মানুষ অবসর পছন্দ করেন না।কাজকেই নিজের জীবন মনে করেন।নতুন দেশে অপরিচিত মানুষের মাঝে থেকেও ভিনার কোনো সমস্যা হয়নি।যত্নের কোনো কমতি রাখেননি রুদমিলা।দিনশেষে গরম খাবার এবং স্নেহময় আশ্রয়ের কোল সবসময় ছিলো।কিন্তু দিনশেষে কষ্টের জায়গা রয়েই গিয়েছিলো।সোহেল ভিনার সাথে যোগাযোগ রাখেননি।কিন্তু মুনা নিয়মিত যোগাযোগ করতেন,ভিডিওকলে ভিনা মাহভিনকে বড় হতে দেখতো।এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিলো।
ভিনা ঈর্ষণীয় রেজাল্ট করে ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বের হয়।বিদেশে স্থায়ী হওয়ার ইচ্ছা না থাকায় ফিরে আসে দেশে।অনেক চেষ্টা এবং পরিশ্রম করে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে ফিনানশিয়াল এনালিস্ট হিসেবে হাই স্কেল বেতনে যোগ দেয়।ততদিনে মাহভিন্স ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে গেছে।ভিনার উপদেশ এবং মুনার দক্ষতায় নামকরা সব জায়গায় আটটি আউটলেট মাহভিন্স এর।মুনার নিজের ব্যস্ততার শেষ নেই।নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য ও দিতে হয়।
নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার পর আসে বাবা মেয়ের মান-অভিমান ভাঙার পালা।সোহেল তখন অনেক দূর্বল হয়ে গেছেন।মনে রাখতে পারেন না অনেক কিছু।কিন্তু মেয়ের উপর অভিমান কষ্ট সব ধরে রেখেছেন।বিয়ে করে সেটেল হলেই সোহেলের অভিমান ভাঙবে।ভিনা শেষে বিয়ে করে ফেলে।এই বিয়ে সবার জন্য অনেকদিক দিয়েই বিস্ময়ের ছিলো।সবার মন রক্ষা করেই এই পদক্ষেপ নেয় ভিনা,কিন্তু নিজের সাথেও আপোষ করেনি।
বিয়ের পর নিজের অফিসের কাছাকাছি বাসা নেয়া হয়।ব্যবসায়ী স্বামী সব বিষয়েই অগ্রাধিকার দেয় ভিনাকে।বিয়ের দুই বছর পর ঘর আলো করে আসে যমজ দুই ছেলে।অফিস,বাচ্চা,সংসার এবং সামাজিক কাজকর্ম নিয়ে ভিনার ব্যস্ত জীবন। এক মুহূর্ত দম ফেলার সময় নেই।শুধু ভিনা না,এসময়ে অনেকের জীবনেই পরিবর্তন এসেছিলো।
একদিন অফিসে কাজ কম থাকায় পেপারে হালকাভাবে চোখ বুলাচ্ছিলো।হটাৎ এক খবরে চোখ আটকে যায়।ছবি খুব পরিচিত মানুষের।খবরের হেডলাইন- প্রবাসের জেলে বাংলাদেশি নারীর মৃত্যু।খবরের পাশে তোহার ছবি দেয়া।এমেরিকার ফ্লোরিডায় অবৈধভাবে এবং মিথ্যে পরিচয়ে বসবাসের কারণে তোহাকে গ্রেফতার করা হয়।বাংলাদেশ এম্বাসিতে খবর পাঠিয়ে তদন্ত শুরুর আগেই তোহার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় জেলে।ছবিতে তোহার চেহারায় মর্মান্তিক জীবনের ছাপ স্পষ্ট ।কিছু মানুষ ভিনাকে প্রচন্ড কষ্ট দিয়েছিলো জীবনে।ভিনা তাদের অভিশাপ দেয়নি ঠিকি,কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বিচার ঠিকি করে দিয়েছে।খবরের কাগজ পাশে রেখে ভিনা চুপচাপ বসেছিলো অনেক্ষণ। বহুদিনের বুকে বয়ে বেড়ানো পাথর নেমে গিয়েছিলো।
ভিনা কর্মজীবনে প্রবেশ করার পরই পুরোনো সব বন্ধুদের সাথে নতুন করে যোগাযোগ করে। কথা গাইনির ডাক্তার।ওয়াসিম ইঞ্জিনিয়ার,আবির টিচার এবং সাদ নামকরা ব্যবসায়ী।সবাই যে যার মতো সেট হয়ে গেছে।শুধু একজন নিখোঁজ ছিলো।সে হলো আরশি।সবার সাথে যোগাযোগের করার পরে বড় ইনফ্লুয়েনশিয়াল সার্কেল হয়েছিল ভিনার।সবাই মিলে ইনভেস্ট করে একটি অর্গানিক প্রোডাক্টসের ম্যানুফ্রেকচারিং কোম্পানি দাঁড় করায়।এই কোম্পানি নন প্রোফিটেবল বিজনেস হিসেবে সর্বনিম্ন মূল্যে ভালো মানের স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি করে নারী উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য সারাদেশে পরিচিতি লাভ করে।এই উদ্যোগ ভিনা নেয়ায় ব্র্যান্ড ফেস হিসেবে সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ভিনা এসবের মাঝে নওমিকে ভুলে যায়নি।ভিনা ঠিক করে রেখেছিলো নওমির জন্য কিছু একটা করে কাজের ব্যবস্থা করে দিবে।বহুদিন নওমির সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি।যখন করেছে তখন বুঝলো কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই নওমির।নওমি নিজেই বুটিক শপের মালিক।খাদি এবং অন্যান্য দেশীয় প্রোডাক্ট বিক্রি করে ভালো পরিচিতি পেয়েছে।বর্তমানে নিজের অকালে বৃদ্ধ সর্বসান্ত বাবাকে নিয়ে আলাদা থাকে।খুব শীঘ্রই একজন ডাক্তারকে বিয়ে করতে যাচ্ছে।
ভিনার ভাবনায় ছেদ পরলো,পেছন থেকে একজন জড়িয়ে ধরে ভিনার কাঁধে চুমু দিলো।দুই হাত দিয়ে ভিনাকে জড়িয়ে রেখেছে।এই ঘ্রাণ ভিনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে।ভিনার সন্তানের বাবা এই মানুষটা।
-- ছাড়ো,বাচ্চারা দেখে ফেললে সমস্যা হবে।
-- হলে হোক।ওরা দুনিয়ায় এমনি এমনি আসছে নাকি।
-- ধুর,অসভ্যতা করোনা।বাসায় অন্য মানুষ আছে তো।
রুশান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।এরপর কানের সামনে ফিসফিস করে বললো-
-- তাকে দেখানোর জন্যই আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরি না!
ভিনা রুশানকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে হাসতে হাসতে রুম থেকে চলে গেলো।আজকে বাসায় ফ্যামিলিয়াল গেট টুগেদার।অনেক কাজ বাকী আছে।রুশান চলে গেলো নিজের ছেলেদের কাছে।এদেরকে কিছুক্ষণ না দেখলেই কেমন যেন খালি লাগে।
দুপুরের লাঞ্চ শেষে ভিনা ড্রয়িং রুমে বসলো।রুশান ছেলেদের ঘুম পাড়াতে গেছে।যাবির প্রায় উইক এন্ডেই এ বাসায় আসে।খুব ভালো সম্পর্ক ভিনা এবং রুশানের সাথে।যাবিরের ব্যবসায় রুশান অনেক সাহায্য করেছে।রুশান নিজেও পাকা ব্যবসায়ী। বাবার রিয়েল এস্টেটের ব্যবসাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিচ্ছে।যাবিরের সাথে ভিনার সম্পর্ককে কেউই জটিল করেনি।অতীত কে অতীতেই রেখেছে।
-- তারপর,কী খবর বলো।
-- খবর নেই কোনো।এটাই খবর।ছেলেরা দেখি অসম্ভব জ্বালায় তোমাকে।
-- বাপের স্বভাব পেয়েছে আরকি।নিজে কবে বিয়ে করছো?
-- করে ফেলবো।একজনের সাথে পরিচয় হয়েছে।মেয়ে ফার্মাসিস্ট।
-- সেই তো!দেখা করতে চাই।কথা আগালে বাসায় একদিন নিয়ে এসো।
কলিংবেল বেজে ওঠায় ভিনা উঠে চলে গেলো।দরজা খুলতেই প্রিতির দুই ছেলে মেয়ে আর মাহভিন ঝাপিয়ে পরলো ভিনার উপর।এদের পেছনে প্রিতি,রেহান,জেবা,ফারুক সাহেব,সোহেল এবং মুনা দাঁড়ানো।দুই পরিবার সবসময় একসাথেই যেকোনো জায়গায় বেড়াতে যায়। এ বিষয়টা ভিনার এত ভালো লাগে যে বলার মতো না।
সোহেল ঘরে ঢুকেই ভুলভাল নামে নাতিদের ডাকা শুরু করলেন।জেবা এতে ক্ষেপে গেলেন।তার নাতিদের কেউ ভুল নামে ডাকলে তার গায়ে লাগে।দুই বেয়াই বেয়াইনে ছোটখাটো ঝগড়া লেগে গেলো।রুশান ঘর থেকে বের হয়ে সোহেলকে ঠান্ডা করলো।ভিনা ঠান্ডা করলো জেবাকে।
মাহভিন সবার চেয়ে একটু বড় হওয়ায় নেতা নেতা ভাব রাখে নিজের মধ্যে।মাহভিনের পরেই প্রিতির ছেলে রাজিন,এরপর প্রিতির মেয়ে পারসা।সবচেয়ে ছোট ভিনার দুই ছেলে। ঘুরতে আসলে বাচ্চাদের সামলে রাখে মাহভিন।ভিনার এ বিষয়টা খুব ভালো লাগে।সবাই মিলে লিভিং রুমে গল্পে মেতে উঠলো।রুশান এবং ভিনা একসাথে খাবার রান্না করেছে সবার জন্য।গল্পের বিষয়বস্তু জেবা এবং ফারুক সাহেব পরের সপ্তাহে কোন ছেলের বাসায় উঠবেন।দুইজনই পালা করে রুশান এবং রেহানের বাসায় থাকেন।মাঝে মাঝে ঘুরতে যাই বাইরে।জীবনের শেষভাগে এসে জেবা এবং ফারুক সাহেবের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়েছে।ফারুক সাহেবের জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই এখন।
মুনা গভীরভাবে তাকিয়ে আছেন যাবিরের দিকে।যাবিরের সাথে ভিনার বন্ধু হিসেবে এর আগেও অনেকবার দেখা হয়েছে।যখনি দেখা হয় উনি অবাক চোখে তাকান।এই ছেলেকে তার অনেক চেনা চেনা লাগে।মনে হয় বহুবছর আগে কোথায় যেন দেখেছেন।মনে করতে পারেন না।
মাহভিন বাচ্চাদের সাথে খেলার ফাঁকে যাবিরের পাশে বসেও গল্প করে।সন্ধ্যার আগে যাবির চলে যায় কাজ থাকার কারণে।সবাইকে বিদায় জানায় বের হওয়ার আগে।রুশান নেমে একেবারে গাড়ি পর্যন্ত নেমে আসে।
ব্যস্ততার মাঝেও ভিনা কিছুক্ষণ ব্যয় এই সুখগুলো অনুভব করার জন্য।পাঁচ বছর আগে রুশানকে বেছে নিয়েছিলো।ভালোবাসার খাতিরেই বেছে নিয়েছিলো।যাবিরকে ভালোবাসলেও সময়ের পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছিলো।এত কিছু হওয়ার পর যাবিরের মাঝে ভিনার জন্য ভালোবাসা থাকলেও তা প্রকাশের মনমানসিকতা ছিলো।ভালোবাসার চেয়ে দুইজনের জীবনেই বাস্তবতা বড় হয়ে গিয়েছিলো।তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়ে ভিনা নিজেই যাবিরের জীবনে ফিরে নি,প্রচন্ড ভালোবাসার কারণেই ফিরেনি।প্রকৃতি প্রচন্ড ভালোবাসা কাছে থেকে প্রকাশ করতে দেয় না।তীব্রতা বেশি থাকায় দূরে থেকেই এধরনের মানুষকে ভালোবাসতে হয়।ভিনা চেয়েছে যাবির যেন নতুন কাউকে নিয়ে শুধু ভালোবাসা দিয়ে জীবন সাজিয়ে নেক।মাহভিন তখন মুনার সাথে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলো।ভিনার ভালোবাসা এবং দায়িত্ব বড় বোন পরিচয়েই পালন করেছে,করবে।দায়িত্ব পালনের জন্য আলাদা পরিচয়ের প্রয়োজন হয়না।মানুষের জীবনে সব সম্পর্ক পূর্ণতা পায় না।পূর্ণতা অপূর্ণতা নিয়েই সম্পর্ক। আজকে রুশান প্রচন্ড ভালোবাসায় ভিনাকে আগলে রেখেছে।ভিনা বহুদিন এই ভালোবাসার কাঙাল ছিলো।আজকে রুশানের সাথে বিয়ে হওয়ায় সব সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে।এমনকি রুশান নিজেই যাবিরকে আপন করে নিয়েছে।সুস্থ সম্পর্কের চেয়ে ভালোবাসার উত্তম প্রতিদান কিছুই হতে পারেনা।
গভীর রাতে সবাই যাওয়ার পর রুশান ভিনার পাশে বারান্দায় বসলো।বাচ্চাগুলো ঘুম।এখন পূর্ণিমার মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে।অন্ধকার বারান্দায় দুইজন একসাথে বসে বৃষ্টি দেখছে।ভিনা রুশানের কাঁধে মাথা দিয়ে রেখেছে।রুশান ভিনার হাত ধরে খুব ধীর গলায় প্রশ্ন করলো-
-- তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো ভিনা?
ভিনা উত্তর দিলো না। ঠোঁটের কোণে শুধু রহস্যময়ী হাসি ফুটে উঠলো।
.
.
.
সমাপ্ত........................................................................