মেঘফুল - পর্ব ০৯ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


রাগ কমেছে পারভীনের। তিনি আনন্দের সঙ্গে রান্নাবান্না করছেন। পোলাওয়ের মিষ্টি সুঘ্রাণ পুরো বাড়ির বাতাসকে সুবাসিত করছে। জাহ্নবী দুয়েক বার রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য বের হলেও ভায়োলেট বাঁধা দিয়ে বলেছে, 'আম্মুকে একা থাকতে দাও।'

অর্ণব জাহ্নবীকে দেখে জানতে চাইলো, 'আপনারা মিষ্টি খেয়েছেন?'
'হ্যাঁ খেয়েছি। আপনার কিছু লাগলে বলবেন আমাকে।'
'অবশ্যই। থ্যাংকস।' 

জাহ্নবী জাভেদ আলীর পাশে বসে রইল। তিনি অর্ণবের সঙ্গে গল্পগুজব করছেন। অর্ণব আজ শান্ত, নিশ্চল। সমুদ্র শান্ত হয়ে গেলে যেমন সবকিছু অন্যরকম লাগে, আজ জাহ্নবীরও তেমন লাগছে। তবে অর্ণবের চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু একটার জন্য ছটফট করছে। ওই চোখ জোড়া বড্ড চঞ্চল, মোটেও শান্ত সমুদ্রের মতো নয়। জাহ্নবী উৎসুক চোখে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে রইল। অর্ণব চোখ ফেরাতেই আরও একবার চোখাচোখি হল তাদের। 

জাভেদ আলী ক্ষণিকের জন্য উঠে যেতেই জাহ্নবী পত্রিকা টেনে নিয়ে বসল। সে জানতে চায় অর্ণব কিছু বলবে কী না!
কিন্তু অর্ণব কিছুই বললো না। কয়েক মিনিট বসে থাকার পর বলল, 'আমি চলে যাবো। আংকেলকে একটু ডেকে দিন না।'
' খাওয়াদাওয়া করে তারপর যাবেন।'
' না, না। আমার দেরী হয়ে যাবে।'
' দেরী হয়ে যাবে মানে?'
' আমাকে বাসা খুঁজতে হবে।'
' রাত হয়ে গেছে। এখন আপনি বাসা কোথায় খুঁজবেন?'

অর্ণব উত্তর খুঁজে পেলো না। হতভম্ব চেহারা নিয়েও হাসার চেষ্টা করলো। জাহ্নবী বলল, 'আপনি একটু দাঁড়ান।'
জাহ্নবী দ্রুত ভেতরে চলে গেল। ফিরে এলো মোবাইল হাতে নিয়ে। অর্ণবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসতে হাসতে বলল, 'আপনি দেখি সত্যি সত্যি দাঁড়িয়ে আছেন। এটা কী জোকস ছিল ভাইয়া?'
কথাটা বলে হাসল জাহ্নবী। অর্ণব বলল, ' হ্যাঁ জোকস বলা যেতে পারে।'
' যে কারণে আপনাকে দাঁড়াতে বলেছিলাম, এখন সেই কারণটা বলব।'
' প্লিজ, তারাতাড়ি বলুন। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।'

জাহ্নবীর হার্ট লাফ দিয়ে উঠল। মনেমনে গর্বিত বোধ করল সে। কারণ এত সুন্দর করে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে কখনো কারও সাথে কথা বলতে পারেনি সে। নিজের মাঝে আসা এই অদ্ভুত পরিবর্তন ওকে আন্দোলিত করলো।
জাহ্নবী সামারকে কল দিয়ে ফোনে পেলো না। নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। বলল, ' ওর ওখানে একেবারেই নেটওয়ার্ক নেই।'
অর্ণব উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। 
জাহ্নবী বলল, 'আমার ছোটবোন সামারকে তো দেখেছেন। ও এসব ব্যাপারে আপনাকে হেল্প করতে পারবে। আমাদের এই বাসাটাও সামার ঠিক করেছে।' 

হাসলো জাহ্নবী। অর্ণব খুশি হয়ে বলল, 'তাই! তাহলে তো ভালোই হয়। আমি ঢাকা শহরে কিছুই চিনি না।'
' টেনশন করবেন না। আমি সামারকে চেষ্টা করছি কিন্তু কল ঢুকছে না। ও বান্দরবানে বেড়াতে গেছে।'
' ওহ আচ্ছা।'

অর্ণব অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। জাহ্নবীর হঠাৎ মনে হল, চঞ্চল চোখ জোড়া হঠাৎ করেই হারিকেনের আলোর মতো নিভে গেল। তবে কী চোখ দুটো এতক্ষণ ধরে সামারকেই খুঁজছিল! ভাবনায় পড়ে গেল জাহ্নবী। 
অর্ণব বলল, ' সমস্যা নেই। আমার হাতে আরও কিছুদিন সময় আছে। উনি কবে ফিরবেন?'
' পরশুদিন সকালে।'
' ওনাকে বিষয়টা বলে দেখবেন প্লিজ? আমি আজকে চট্টগ্রাম চলে যাবো। আমিও আমার মতো করে খোঁজার চেষ্টা করবো। আংকেল নিজেও বিষয়টা দেখবেন বলেছেন।'

জাহ্নবী মনেমনে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ' ঠিক আছে।'
ভায়োলেটের ঘরে চলে এলো জাহ্নবী। মুখের ওপর বই রেখে ভায়োলেট ঘুমিয়ে পড়েছে। জাহ্নবী খানিক্ষন ঘরে পায়চারি করলো। অর্ণবের জন্য তার ভেতর কোনো অনুভূতির জন্ম হয়েছে কী না, সেটা বুঝতে চেষ্টা করছে জাহ্নবী।

খাবার টেবিলে পারভীন নিজেই খাবার সাজিয়েছেন। হাতমুখ ধুয়ে মেয়েদেরকে ডাকতে এলেন তিনি। ওনাকে আজ নববধূর মতো উৎফুল্ল এবং ব্যস্ত দেখাচ্ছে। 
খাবার খেতে খেতে অর্ণব বলল, ' আমি এখনই রওনা দেবো। আপনাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। ক্ষমা করবেন আন্টি।'

পারভীন সবার মুখের দিকে এক পলক তাকালেন তারপর আরেক চামচ গোশত তুলে দিলেন অর্ণবের পাতে। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, 'রান্না ভালো হয়েছে? খেতে পারছো তো?'
' জি আন্টি। অনেক ভালো হয়েছে।'
' তোমার বাবা মা সবাই ভালো আছেন?'
' হ্যাঁ। আপনারা আমার বাসায় বেড়াতে আসুন না একদিন। আমি তো এক তারিখে ঢাকায় চলে আসতেছি আন্টি। তারপর আর কখন সুযোগ হবে.. আপনারা এই ফাঁকেই আমাদের বাড়িতে আসুন।'

পারভীন হাসিমুখে বললেন, ' তুমি ভালভাবে চাকরিতে জয়েন করো। যাওয়ার সময় অনেক পাওয়া যাবে। আমি বহুদিন বাড়ির বাইরে যাই না। সংসার ছেড়ে আসলে যাওয়াই হয় না কোথাও।'
' আপনারা সবাই মিলে যাবেন। তাহলে আর সংসার নিয়ে টেনশন থাকবে না।'
' সেটা দেখা যাবে। যাওয়ার দিন অনেক পড়ে আছে। তুমি মাছ নাও নি কেন? এক পিস দেই?'

জাহ্নবী চোখ বড়বড় করে ভায়োলেটের দিকে তাকালো। ভায়োলেট মুখ টিপে হাসল। জাভেদ আলী মাথা নিচু করে খাচ্ছেন। পুরুষ মানুষ জাগতিক সব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে পছন্দ করেন না। কিন্তু জাহ্নবী ও ভায়োলেট ঠিকই বুঝতে পারছে হঠাৎ পারভীনের এই আধিখ্যেতার কারণ কী!

অর্ণব বলল, ' আন্টি আর খাবো না। রান্না খুবই সুস্বাদু হয়েছে। আমি জার্নির সময় ভরাপেটে থাকলে সমস্যা হয়।'
' তুমি আজকে থেকে যাও। আজকেই তো এসেছ।'

এবার জাভেদ আলী নিজেই অবাক হয়ে এক পলক পারভীনের দিকে তাকালেন। বিষয়টা দৃষ্টি এড়াল না জাহ্নবীর। 
অর্ণব বলল, ' আমি দুদিন পর আবার আসবো। বাসার ব্যাপারে আংকেল খোঁজ নিয়ে দেখবেন। সামার আপুর নাকি এসব ব্যাপারে ভালো জানাশোনা আছে। উনিও দেখবেন। তারপর আমি আসবো।'

পারভীন তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলেন, 'সামারের কথা বাদ দাও। সে হচ্ছে পাখির মতোন। দুনিয়া নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যথা নাই। তুমি এক কাজ করো। কাল সারাদিন বাসা খুঁজে দেখো। চারটা বাসা দেখলে একটা পছন্দ হবেই। বাসা ঠিক করে কাল রাতের বাসে চলে যাইতে পারবা।'

জাহ্নবী ঢোক গিলে ভায়োলেটের দিকে তাকালো। ভায়োলেট নিঃশব্দে খাবার খাচ্ছে। জাহ্নবী ভ্রু নাচালো ভায়োলেটকে লক্ষ করে। ভায়োলেট বলল, ' হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে। আপনার কোন এলাকায় বাসা লাগবে?' 

অর্ণব থতমত খেয়ে বলল, 'আমি তো এখানকার কিছুই জানিনা, চিনিনা।'
' সমস্যা নেই। অফিস কোথায় আপনার?'
' ধানমণ্ডি সাতাশ।' 
' আরে! আপু তো ওখানকার সব এলাকা চেনে। আপু কাল আপনাকে নিয়ে বাসা দেখতে যাবে। টেনশন নেয়ার কিছু নেই। বাসা পেয়ে যাবেন।'

জাহ্নবী খাওয়া বন্ধ করে চোখ বড়বড় করে ভায়োলেটের দিকে তাকিয়ে রইল। ভায়োলেট মুখ টিপে হাসল। সে আসলে কথাটা বলেছে পারভীনের মনে কী আছে সেটা জানার জন্য। মুহুর্তেই তার এই ট্রিকস শতভাগ কার্যকরী হয়ে গেল।

পারভীন বললেন, ' হ্যাঁ জাহ্নবী তো লালমাটিয়ার ওদিকে যাতায়াত করতো। চিনিস না তুই ওদিকটা?' জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন পারভীন।

জাহ্নবী ঢোক গিলে মাথা নাড়লো, 'হুম।' 
মনেমনে হাসল ভায়োলেট। 

খাবার শেষ করে ঘরে এসেই জাহ্নবী রেগে ভায়োলেটকে বলল, 'তুই কেন বললি আমি ওখানকার সব চিনি?'
' আরে আমি একা বলেছি নাকি? আম্মুও তো বলেছে।' 
' কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আম্মু একটা অপরিচিত ছেলের সঙ্গে আমাকে বাসা দেখতে যেতে বলবে, এটা অবিশ্বাস করার মতো। অন্যকেউ বললে বিশ্বাস হতো। কিন্তু আম্মু! কিভাবে?' 
ভায়োলেট হেসে বলল, ' সেটা জানার জন্যই তো আমি কথাটা বলেছি। তারমানে বিষয়টা এখন স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার।'
 ' কোন বিষয়টা?'
 ' অর্ণব সাহেবকে মা তার বড় মেয়ের জামাই বানাতে চাইছেন।' 

জাহ্নবী ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ভায়োলেট বলল, ' আম্মুকে আমি ভালো করে চিনি। নিজের লাভ ছাড়া সে কোনোদিনও কিছু চিন্তাও করে না।' 
' কিন্তু আরেকটা বিষয় ভাব। যে ছেলেকে আম্মু গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত পছন্দ করতো না। হঠাৎ কেন আম্মুর মনোভাব চেঞ্জ হয়ে গেল!'

ভায়োলেট কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ' নিশ্চয়ই এখানে কিছু একটা আছে। সেটা কী হতে পারে?'
' আব্বু কিছু বলেছে?' 
' হতে পারে। আব্বু বাসায় আসার পর আম্মু হঠাৎ চিনিগুড়া চাল খুঁজতে এসেছে। আচ্ছা, আব্বু নিজেই এই ব্যাপারটা আম্মুকে বলেনি তো?' 
জাহ্নবী চোখ বড়বড় করে জানতে চাইলো, 'কোন ব্যাপারটা?'
' এইযে অর্ণবকে তিনি পছন্দ করেছেন।' 

দুই বোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল অনেক্ষণ। বাবা মায়ের মনে কী চলছে সেটা জানার জন্য গবেষণা করাটাও একটা আনন্দদায়ক ব্যাপার। ভায়োলেট আনন্দ পাচ্ছে, ভীষণ আনন্দ। সে মনেপ্রাণে চায় জাহ্নবীর সঙ্গে ভালো কিছু হোক। এই খড়কুটোর মতো জীবন জাহ্নবীর উপযোগী নয়, সে আরও ভালো কিছুর জন্য তৈরি। কিন্তু অর্ণব কী আসলেই জাহ্নবীর জন্য সেই ভালো বয়ে আনবে? মুহুর্তেই চিন্তিত হয়ে উঠলো ভায়োলেট। 

জাহ্নবী বলল, ' অর্ণব সামারের ব্যাপারে আগ্রহী আমার মনে হয়।' 
' তাতে কিছু আসে যায় না। মেজোপুর নিশ্চয়ই এতক্ষণে ওই ছেলেটার সঙ্গে কিছু হয়ে গেছে।' 
'ছি, নিজের বোনের ব্যাপারে এসব বলতে লজ্জা লাগল না?
' লজ্জার কী আছে আপু? ও সারা রাত আমার পাশে শুয়ে ফোনে কথা বলে। ওদের প্রেম হয়ে যাচ্ছে। একসঙ্গে ট্যুরে গেলে প্রেম তো আরও তারাতাড়ি হয়ে যাওয়ার কথা।' 

জাহ্নবী গম্ভীর হয়ে গেল। ভায়োলেট জাহ্নবীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, ' আপু, অর্ণব হয়তো সামার আপুর প্রতি আগ্রহী নয়। তুমি ভুল জেনেছো। সব বাদ দাও, অর্ণব সাহেবকে কী তোমার ভালো লাগে?' 
জাহ্নবী চমকে উঠলো। শিরশির করে উঠলো ওর শরীর। ভায়োলেটের চোখের দিকে তাকালো সে। ভায়োলেট অপেক্ষা করছে জাহ্নবীর উত্তর শোনার জন্য। 

রাতের অন্ধকার ছেয়ে এসেছে পুরো পাহাড় জুড়ে। ঝিঁঝি পোকার ডাক সবকিছুকে ছাড়িয়ে ক্রমশ ভারী করে তুলছে কান। সামার তাঁবুতে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। গা ছমছম করছে ওর। 

হঠাৎ তাঁবুর বাইরে থেকে মৃদুস্বরে আরজুর গলা শোনা গেল। সামার বলল, ' কিছু বলবেন?' 
' বাইরে আসুন না একটু।'

সামার নিঃশব্দে তাঁবু থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। পাশেই কাঠখড়িতে আগুন জ্বলছে। আগুনের কমলা রঙের আলোর ছটা লেগে ঝিকঝিক করছে আরজুর মুখ। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে অপূর্ব দেখাচ্ছে ওকে।

সামার বলল, ' বাইরে অনেক ঠাণ্ডা।' 
' আমার চাদরটা নিন।'

আরজু নিজের গা থেকে চাদর খুলে সামারকে দিলো। সামার চাদরটা গায়ে জড়াতে জড়াতে জানতে চাইলো, ' কী বলবেন? ঘুম আসছে না?' 
আরজু মুচকি হেসে বলল, ' তেমন কিছু না।'
' তাহলে বাইরে আসতে বললেন কেন?' 
' আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল, তাই।'

সামার চমকে উঠল ভীষণ। ওর চোখেমুখে, সর্বাঙ্গে এক ধরণের দীপ্তি খেলা করে গেলো। আরজুর চোখের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল সামার। আরজুর চাদরে জমে থাকা উষ্ণতা ওর শরীরকে স্পর্শ করছে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মুচকি হাসল সে। পৃথিবীতে প্রেমে পড়ার মুহুর্তের চাইতে সুন্দর আর কিচ্ছু নেই!
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp