পারভীনের অনুরোধে শাড়ি পরল সামার। অর্ণবের মা তার গলায় স্বর্ণের চেইন পরিয়ে দিয়ে বললেন, 'সুখী হও মা। আমার ছেলেকে নিয়ে একটা সুখের জীবন হোক তোমার।'
বাঁকা চোখে সামার অর্ণবের দিকে দৃষ্টিপাত করল। এসব ন্যাকামি তার ভালো লাগছে না। অর্ণবের চাহনিতে অনুরোধ। অপরাধবোধের যন্ত্রণা সেখানে স্পষ্ট।
সামার চুপ করে রইল। অর্ণবের মা গর্ব করে বললেন, 'তুমি তো অনেক সৌভাগ্যবতী। আমার অর্ণব অনেক ভালো ছেলে। আমরা চট্টগ্রামের বাইরে কখনো ছেলের বিয়া দিতাম না। কালচারের সঙ্গে কালচারের একটা পার্থক্য আছে না? আমি হইলাম রাউজানের মেয়ে। পড়াশোনা করছি চট্টগ্রাম কলেজে। অনেক মেধাবী ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইছিলাম বুঝছো, সাবজেক্ট পাইছিলাম ইসলামের ইতিহাস। আমি ইংরেজি নিয়া পড়ার স্বপ্ন দেখতাম। এজন্য সরকারি কলেজে ভর্তি হই। চট্টগ্রামের সব কালচারই আমি জানি। তুমি হইলা ঢাকার মেয়ে। ঢাকার ঐতিহ্য আর চিটাগাংয়ের ঐতিহ্য কী মিলে? শেষে দেখা যাবে তোমার আর আমার মিল হইল না। এইজন্য আমি চিটাগাংয়ের বাইরে থেকে ছেলের বউ আনতে চাইনাই। ছেলেরে বলছিলাম, তোমার যারেই পছন্দ হবে তারেই বউ করবো কিন্তু চিটাগাংয়ের মেয়ে হইতে হবে।'
বিরক্তমুখে সামার কথাগুলো শুনছে। প্রচণ্ড রাগে উঠে যেতে পারছে না পরিবারের কথা ভেবে। রাগ সামলে নিয়ে শুধু এটুকু বলল, 'ঢাকার মেয়েকে চেইন পরিয়ে আবার এসব বলছেন? চেইন পরায়েন না আমাকে।'
অর্ণবের মা থতমত খেয়ে গেলেন। শঙ্কায় শুকিয়ে গেল পারভীনের মুখ। পরক্ষণেই মুখে হাসি ফুটিয়ে অর্ণবের মা বললেন, 'মা দেখি রাগ করছে। রাগ কইরো না মামনি। ছেলে আমার পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি পেয়েছে, স্বাবলম্বী হয়েছে। আল্লাহ চাইলে সে ঢাকা শহরেই থাকবে যতদিন চাকরি জীবন আছে তার। ঢাকাতে বিয়া দিতে আর আপত্তি আসবে কেন? সবচাইতে বড় কথা, তোমার আব্বা খুব ভালো মানুষ। মানুষের সঙ্গে মিশলে মানুষ চেনা যায়। ওনার মেয়েকে ছেলের বউ করতে পারলে আমরা তো সৌভাগ্যবান হই।'
সামার কড়া স্বরে বলল, 'বাবার গুণ দেখে বিয়ে করানোর দরকার আছে? আপনি যাকে বউ করবেন তার কী গুণ, তার চরিত্র দেখে করবেন।'
মহিলা হেসে বললেন, 'এক্কেরে ঠিক কথা বলছো। তোমাকে তো আমাদের অনেক ভালো লাগছে। আমার ছেলে তো সারাক্ষণ তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।'
সামার হাসিমুখে বলল, 'ধন্যবাদ আন্টি। আমি তাহলে উঠি?'
'আচ্ছা মা, যাও।'
সামার নিজের ঘরে চলে এলো। পিছনে চলে এল জাহ্নবী ও ভায়োলেট। ঘরে ঢুকেই গলা থেকে চেইন খুলে বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে সামার বলল, 'কী এক বিপদে পড়লাম।'
ভায়োলেট বলল, 'শান্ত হও আপু। ভাইয়ার সাথে সবকিছু শেয়ার করো।'
সামার বলল, 'ওকে এসব বললে আমিই ছোট হবো ভায়োলেট। ও বলবে, তুমি এ কোন ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা করানোর জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলে, যে নিজেই তোমার কথার অর্থ বুঝে না। বিয়ে করতে চলে আসছে। এসব বলে খুব পঁচাবে আমাকে।'
ভায়োলেট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গিয়ে বসল। তার এসব দেখতে ভালো লাগছে না। সে চায়, সবাই শান্তিতে থাকুক। জগতে নেমে আসুক স্বর্গ।
সামার হেসে বলল, 'তুই এজন্যই সেদিন বলেছিলি? অর্ণব ভাইয়াকে আজকেই বল নয়তো পরে পস্তাতে হবে। আসলেই পস্তাচ্ছি ওকে বলে। ওকে কিছু না বলাটাই উচিৎ ছিল আমার।'
কথাগুলো বলতে বলতে শাড়ি খুলে ফেলে বাথরুমে প্রবেশ করল সে। ভায়োলেট ও জাহ্নবী শান্তভাবে বসে রইল।
খানিকক্ষণ পর পারভীন এসে জানতে চাইলেন, 'কই ওই বেয়াদবটা?'
ভায়োলেট বলল, 'মা, বাদ দাও না।'
'কী বাদ দিবো? পড়াশোনা জানা শিক্ষিত মেয়ে, সে বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলে। আমার মান সম্মান তোরা সব শেষ করার জন্য জন্মাইছিস।'
সামার বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল, 'মা, বড়রা ভুল কথা বললে তাদের ভুলটাকে শুধরে দিতে এরকম উত্তর দিতেই হয়। সে আমাকে দেখতে এসে বলছে, চিটাগাংয়ের বাইরের মেয়ে আনতাম না। তাহলে এসেছে কেন? এটা কী আমাকে অপমান করা নয়?'
পারভীন ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, 'একেকটা মেয়ে যেন রাজ সম্মান নিয়ে জন্মাইছে আমার।'
ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। সামারের কান্না এসে গেল। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই চোখের নোনা জল চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল তার।
জাহ্নবী ভায়োলেটকে বলল, 'থাক রে বোন, আমি আসি। তুই ফোন দিস আমাকে।'
পারভীনের কাছে বিদায় নিতে গেলে তিনি কোনো কথা বললেন না জাহ্নবী'র সঙ্গে। জাহ্নবী বিমর্ষ মনে বাসা থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিলো। সে ভেবেছিল আজকের দিনটা অনেক ভাল কাটবে। শুরুটা ছিল যতটা সুন্দর, দিনের শেষটা ততটাই যন্ত্রণা'র।
দুদিন ধরে অফিসের কর্মব্যস্ততায় সময় কাটছে জাহ্নবী'র। পরিবার, মন মানসিকতা সবকিছুকে এক পাশে সরিয়ে সে কাজে মন দিয়েছে। দুপুর পেরোতেই এমডি স্যারের চেম্বারে ডাক পড়ল তার।
তিনি জাহ্নবী'র প্রশংসা করে বললেন, 'ইউ আর এ জিনিয়াস। এত দ্রুত সময়ে এত নির্ভুল কাজ করেছেন, আমি ইমপ্রেসড।'
ধন্যবাদ জানিয়ে মিষ্টি হাসল জাহ্নবী। আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হল তার।
এমডি স্যার বললেন, 'নাদির সাহেব ছুটিতে আছেন। আপনিও যেহেতু এই প্রজেক্টটার সঙ্গে ছিলেন, আপনি বরং এটার সেকেণ্ড প্রজেক্ট টাও দেখুন। যেকোনো প্রয়োজনে নাদিরের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। অফিসের গাড়ি নিয়ে যাবেন প্রয়োজনে।'
জাহ্নবীর চিবুকে উজ্জ্বল আলো খেলা করে গেল। মধুর ভঙ্গীতে হেসে এমডি স্যারকে ধন্যবাদ জানাল জাহ্নবী। নতুন আরেকটা কাজ পেতে চলেছে সে। স্যারদের প্রিয় হতে পারার আনন্দ যে কতখানি, তা স্কুল কলেজেই বুঝতে পেরেছে জাহ্নবী। কর্ম জীবনেও স্যারদের নজরে আসার মত সুপাত্র হতে পারাটা গৌরবের।
আজ অফিসের গাড়ি নিয়ে রওনা দিয়েছে জাহ্নবী। নাদিরের বাসায় যেতে হবে। গতকাল অনলাইনে মিটিং হয়েছিল। তিনি আজকে বাসায় ডেকেছেন। পুরোটা পথ জাহ্নবী'র মনে উষ্ণ আনন্দ টগবগ করে ফুটছে। আজকেও দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকতেই পারে পান্নাবাহারের সঙ্গে। তবে দেখা হলেই বা কী! তার আত্মবিশ্বাস তখন চুপসে মিয়ানো মুড়ি হয়ে যাবে। ওই মানুষটাকে দেখলেই তার বুকের ভেতর কেমন একটা হয়!
জাহ্নবী পান্নাবাহারের ভাবনাকে মন থেকে তাড়িয়ে কাজের ব্যাপারে মন দিলো।
নাদিরকে আজ অনেকটাই সুস্থ দেখাচ্ছে। যদিও এখনো হাঁটতে পারে না সে। সাহিদা আজকেও কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছিল জাহ্নবীর দিকে। জাহ্নবী হাসিমুখে জানতে চাইলো, 'ভাল আছেন?'
উত্তর দিলো না সাহিদা। ঘাড় ঘুরিয়ে 'ভাল আছি' জানান দিলো। জাহ্নবী কাজের ফাঁকে বারবার মাথা তুলে ড্রয়িংরুমে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল সেখানে কেউ বসে আছে কী না! ওখানে একটা পরিচিত ছায়া দেখতে পেলে ভীষণ ভালো লাগত তার।
তিন ঘন্টা পর নাদিরের বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও জাহ্নবী অবচেতন মনে চাইছিল, মানুষটার সঙ্গে তার দেখা হোক। কিন্তু হায়, আজ প্রকৃতি তা চাইল না!
জাহ্নবী খুব করে চেয়েছিল বারবার যাওয়ার প্রয়োজন আসুক নাদিরের বাসায়। কিন্তু এরপর আর যাওয়া হয়নি তার। হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেইল কিংবা কখনো ফোনে কথা বলেই কাজ করতে হল। দ্বিতীয় প্রজেক্টটাও প্রায় শেষ হতে চলল। পান্নাবাহারের সঙ্গে আরও একবার দেখা হওয়ার আশা ছেড়ে দিলো জাহ্নবী। মনকে বোঝালো, 'আর কখনো এই লোকটার কথা ভাবা যাবে না। যদি ভুল করে আর একবার দেখা হয়ে যায়, তবে ধরে নেবো সে শুধুই আমার।' আত্মবিশ্বাসী মনে কথাগুলো নিজেকে বলে দিলো জাহ্নবী।
একদিন হঠাৎ ফোন করল নাদির। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, 'জাহ্নবী, আমাকে ওয়েলকাম করুন। I am now completely healed. আগামীকাল তন্বীর বাড্ডে। দুইয়ে মিলে আমরা একটা অসাধারণ পার্টির আয়োজন করতে যাচ্ছি। আপনি অবশ্যই আসবেন। আগামীকাল সন্ধ্যায়, আর যেন বলতে না হয়।'
জাহ্নবী অসম্ভব আনন্দিত গলায় জানতে চাইলো, 'সত্যি বলছেন স্যার! আপনি হাঁটতে পারছেন?'
'ইয়ো ইয়ো। হেঁটে হেঁটে কাল রেস্টুরেন্টে যাবো। ধানমণ্ডি আড্ডা রেস্টুরেন্ট চেনা আছে আপনার?'
'না স্যার।'
'ধানমণ্ডি ল্যাব এইডের ঠিক উল্টো দিকে। আপনি সাত টার দিকেই চলে আসবেন। ওকে?'
জাহ্নবী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ফোন রেখে দিলো৷ উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে তার। পার্টিতে সে নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যাবে! সে চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে, সেখানে পান্নাবাহার থাকবেই। কিন্তু পার্টিতে কী পরে যাবে সে? তার তো সেরকম কোনো জামাকাপড় নেই।
জাহ্নবী ফোন করল ভায়োলেটকে। এত খুশি খুশি গলা শুনে ভায়োলেট বলল, 'কী গো আপু? আজ এত আনন্দ?'
'একটা পার্টির ইনভাইটেশন পেয়েছি। আমি কী পরবো বল তো? আমার জামাগুলো কী একটাও পার্টিতে পরে যাওয়া যাবে?'
'শাড়ি পরে যাও।'
'আমার তো শাড়িও নেই।'
'আমার কালো শাড়িটা দিয়ে আসবো তোমায়?'
'আচ্ছা শোন, একদিন বাসায় পার্টি দিয়েছিলাম না? আমাকে তোরা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিলি মনে আছে?'
'মনে থাকবে না কেন?'
'কাল আমাকে এভাবে সাজিয়ে দিতে হবে।'
'ওসব মেজোপু পারে। আমি পারি না।'
'তুই মেজোকে ম্যানেজ কর। কাল তোরা সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসবি। আমি অফিস থেকে তারাতাড়ি ফিরব। তারপর তোরা আমাকে সাজুগুজু করিয়ে দিবি। ঠিক পরীর মতো করে। '
ভায়োলেট ভীষণ অবাক হল। জাহ্নবীকে কখনো সাজতে দেখেনি সে। তার সাজসজ্জা করার মতো একটা উপকরণও নেই। কোনোদিনও কাজলও লাগায়নি মেয়েটা। আজ কী কারণে তার এত সাজতে ইচ্ছে করছে তা বুঝে আসছে না ভায়োলেটের। তবে জাহ্নবী'র এই আনন্দঝরা কণ্ঠ শুনতে দারুণ আনন্দ হচ্ছে তার।
জাহ্নবী বলল, 'আর শাড়িটাও নিয়ে আসবি। সামারের একটা মখমলি ব্লাউজ আছে না? ওটাও আনবি।'
'কী ব্যাপার আপু? হঠাৎ মখমলি ব্লাউজ? হুম'
'উফফ স্পেশাল একটা পার্টিতে যাচ্ছি। একটা ব্যাপার আছে না?'
কথাটা বলেই উচ্চ শব্দে হেসে উঠল জাহ্নবী। তার হাসির শব্দে মুখরিত হল চারপাশ। বারান্দা থেকে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল অতিথি শালিক পাখিটি। ফোনের অপর প্রান্তে মুগ্ধ হয়ে হাসির শব্দ শুনছে ভায়োলেট। এ যেন ভুবনজয়ী হাসি!
.
.
.
চলবে..........................................................................