বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। ইট পাথরে ঘেরা দালানকোঠায় থেকে বৃষ্টির আসল সুখ উপভোগ করা যায় না। বৃষ্টির আসল সুখ তো খোলা আকাশের নিচে। রুমে বসেই জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে নিশাত। আর মাত্র দিন তিনেক। তারপরই সে একটা কর্পোরেট জীবনে ঢুকে যাবে। তখনও কি এমন সময় নিয়ে বৃষ্টি দেখা হবে? অসময়ের বৃষ্টি খুব চেনা যে এখন অচেনা, তার কথা মনে করিয়ে দিল। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে তার। চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। কান্না পেলেও কাঁদবে না সে। নিজেকে অন্যমনস্ক করতে হবে ভেবেই পাশে থাকা তানপুরাটা বিছানার উপর নিয়ে বসে। তানপুরার তারে হাত লাগায়। কোনো এক অদ্ভুত শক্তির জোরেই নিশাতের গানের গলা ভীষণ সুন্দর হয়। নিশাত কখনও গান শেখেনি। গ্রামাঞ্চলে গান শেখা মানে বিলাসিতা। নিশাতের মায়ের গানের গলাও ছিল মিষ্টি। গ্রামের দাদী নানীরা বলত, পারুলের মাইয়া পারুলের গানের গলা পাইছে। কী সুন্দর কইরা টাইনা টাইনা গান কয় মাইয়াটা। মেয়েকে গান গাইতে দেখে করিম সাহেব নিজেই মেয়েকে সাথে করে শহরে নিয়ে পছন্দ মতো তানপুরা কিনে দিয়েছিলেন। মাস কয়েক ওস্তাদজী রেখেছিলেন তানপুরা শেখানোর জন্য। নিশাতের যখন মনে হলো তার শেখা হয়েছে তখনই ওস্তাদজী'র একেবারে ছুটি হলো। মায়ের মৃত্যুর পর বাবার প্রতি অভিমান জমে থাকলেও বাবার কিনে দেওয়া সেই তানপুরাটা নিজের সাথেই রেখে দিয়েছে। তানপুরায় সুর উঠেছে। নিশাতের গলায়ও শব্দ হচ্ছে -- আমারও পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো। পাশের রুম থেকে মেয়েরা বের হয়েছে কিন্তু আফসোস নিশাতের রুমে ঢুকতে পারেনি। কারণ রুম ভেতর থেকে লক করা। নিশাত বেশিরভাগ সময় গান গাওয়ার সময় দরজা লক করে রাখে। শিলা নামের মেয়েটা জানে আজ নিশাত আপার মন ভালো নেই। আপার যখন মন ভালো থাকে না তখন আপা এই গানটাই গায়। গানটা আর বেশি দূর গেল না। মুখরাতেই শেষ। গলা ব্যথা করছে নিশাতের। কান্না আটকে রাখলে এই এক সমস্যা হয় তার। সবাই চলে গেলেও শিলা সাহস করে দরজায় কড়া নাড়ে। নিশাত দরজা খুলে শিলাকে দেখতে পেয়ে বুঝে যায় আজও সবাই তার গান শোনার জন্য দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল।অতীতেও এমন হয়েছে কয়েকবার। একদিন স্বয়ং হোস্টেল কতৃপক্ষ এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেদিন নিশাত দরজা খোলার পরে তাকে বলা হয়েছিল, এরপর থেকে যখন গাইবে দরজা খুলে গাইবে। এত মধুর কন্ঠে গান কে না শুনতে চায়। নিশাত সেদিন মুচকি হেসেছিল। কিন্তু সে কথা রাখতে পারেনি। শিলা বিছানায় বসতে বসতে বলল,
‘আপা, বেশ তো গাইছিলে, থামলে কেন?’
‘গলা ব্যথা করছে।’
শিলার আর সাহস হলো না বাড়তি কিছু জিজ্ঞেস করার। বিদায় নিয়ে সেও নিজের রুমে চলে গেল। নিশাত দরজা ফের লক করে শুয়ে পড়ল। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। বৃষ্টি কমলে স্টুডেন্টদের বাসায় যাবে। আগামী মাস থেকে সে আর পড়াতে পারবে না সেটাও বলা প্রয়োজন।
—————
কর্পোরেট অফিসে সবার সাথে সবার খাতির খুব কমই দেখা যায়। এখানে কাজ করতে করতে ফুরসতই মেলে না, খাতির করা তো অনেক পরের কথা। অফিসের প্রথম দিনে সাবরিনাকে নিজের পাশে পেয়ে অনেকটা নিশিন্ত হয়েছে নিশাত। তিন ঘন্টা নিজের কাজ বন্ধ রেখে নিশাতকে সময় দিয়েছে সাবরিনা। অনেক কিছু শিখে নিয়েছে নিশাত। আরও কিছু বাকি। যেগুলো বাকি আছে সেগুলো করতে করতে শিখে যাবে। ইতোমধ্যে সাবরিনা পিওনকে বলে দুই কাপ কফি আনিয়েছে। সাবরিনা কফি সমেত কাপটা নিশাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ট্রাই ইট। ইটস অসাম।’
নিশাত কফি পছন্দ করে না। দুধ চা তার ভীষণ প্রিয়। নিশাতের আমতা আমতা করা দেখে সাবরিনা ফের বলল,
‘কফি পছন্দ না?’
‘নাহ। তেতো লাগে।’
‘কর্পোরেট অফিসে ঢুকেছেন ম্যাম। একটা সময় এই কফিই অমৃত মনে হবে। এখানে এত কাজের চাপ। কোনো কোনো দিন দশ কাপ টপকে দিবেন খবর থাকবে না।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। আমার তো কখনও কখনও দশ কাপের বেশিও হয়ে যায়।’
‘রাতে ঘুম হয়?’
‘অভ্যাস হয়ে গেছে। খেয়ে দেখ। ভালো লাগবে।’
‘আচ্ছা৷ সাবরিনা, থ্যাংক ইউ। আমাকে এত সময় ধরে শেখানোর জন্য।’
‘ইটস ওকে৷ যত তাড়াতাড়ি কাজ শিখে নেবে, ততই তোমার জন্য মঙ্গল। নয়তো আফরাজ স্যারের চোখে পড়লে অফিস থেকে বের করেই ছাড়বে।’
কফির স্বাদটা ঠিকঠাক লাগলেও এখন তেতো লাগছে। আফরাজের নামটা শোনা মাত্রই মিষ্টি জিনিস তেতো হয়ে গেল নিশাতের কাছে। আফরাজ নামক লোকটার সাথে তার যত কম দেখা হবে ততই ভালো। সে চায় না আফরাজের সাথে তার দেখা হোক। ঠিক এই সময়ে পিওন এসে বলে,
‘নিশাত ম্যাডাম, আপনাকে স্যার ডাকে।’
সাবরিনা তখন বলে,
‘বড় স্যার তো এখনও আসেনি। আফরাজ স্যার ডাকছে?’
‘জি।’
নিশাতের আত্মা কাঁপছে। একটু আগেই তো সে মনে মনে চাইল যাতে তার আফরাজের সাথে দেখা না হয়। আর একটু পরেই চাওয়া জিনিসটা ঘুরে গেল। নিশাতকে বসে থাকতে দেখে পিওন আবারও বলল,
‘ম্যাডাম, স্যার আপনাকে ডাকছে।’
‘যাচ্ছি।’
সাবরিনা নিজের ডেস্কে গিয়ে বসল। নিশাত ধীর পায়ে আফরাজের কেবিনের দিকে অগ্রসর হয়।
দরজায় কড়া নাড়ার আগেই আফরাজ বলে,
‘কাম ইন। অ্যান্ড নোট দিস কেয়ারফুললি।’
কথাটা বলেই ইংরেজিতে ফট ফট করে কতগুলো লাইন বলে ফেলল। নিশাত শুধু বোকার মতো দাঁড়িয়েই রইল। সে বুঝে উঠার আগেই আফরাজের বলা শেষ হলো। মাথা তুলে নিশাতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আফরাজ বলল,
‘নোট করেছেন?’
‘স্যার, আপনি ডেকে পাঠিয়েছেন।’
‘আমি কি আপনার চেহারা দেখার জন্য ডেকেছি আপনাকে? আর আমি এতক্ষণ যা যা বললাম নোট করতে বলেছিলাম। নোট করেছেন?’
‘আপনি আমাকে ডেকেছেন। আপনি আমাকে আগাম কিছুই বলেননি। আমি কেবিনে আসতে না আসতেই আপনি বলা শুরু করলেন। আমার হাতে না আছে কলম না আছে ডায়েরি।’
‘ম্যাডাম, এটা আপনার স্টুডেন্টদের বাসা না। এটা অফিস। এখানে বলার আগেই সব বুঝে নিতে হয়।’
‘সরি স্যার। আমি এতটাও পরিপক্ক নই।’
‘তাহলে গেট আউট।’
‘এক্সকিউজ মি!’
‘আই সেইড, গেট আউট অফ মাই কেবিন। এটক বোঝা গেছে? এতটুকু নিশ্চয়ই বুঝেছেন।’
নিশাত জানত তাকে অপমানিত হবে। আফরাজ তাকে অপমান করার জন্যই ডেকে পাঠিয়েছে। লোকটার দিকে তাকাতেও নিশাতের ঘেন্না লাগছে এখন। নিশাত চুপচাপ বের হয়ে যায়। নিজের ডেস্কে এসে বসে। সাবরিনা চোখের ইশারায় বোঝায়, অল ওকে? নিশাতও হালকা হেসে মাথা নাড়ায়। মিনিট খানেক পর পিওন আবারও আসে। তবে এবার সে একা আসেনি। হাতে করে প্রায় পঁচিশটা ফাইল নিয়ে এসেছে।
‘স্যার এই সবগুলো ফাইল আপনাকে চেক করতে বলেছে। উপরের ফাইলে সব দেখানো আছে। ওটা দেখেই বাকি ফাইলগুলো চেক করবেন। এবং আজকের মধ্যেই স্যারকে দেখাতে হবে।’
‘এতগুলো ফাইল আজকের মধ্যে কীভাবে শেষ করব?’
‘আপনি সমস্ত ফাইল চেক করে স্যারকে দেখিয়ে তারপর অফিস থেকে বের হবেন। এমনটা স্যার বলেছে।’
পিওন লোকটাকেও এখন নিশাতের বিরক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে যেন আফরাজ একটা তোতাপাখি পালে। তোতাপাখিকে যা শেখানো হয় তোতাপাখি এসে তাই তাই বলে। অলরেডি দুইটা বাজে। এতগুলো ফাইলের কাজ শেষ করতে করতে রাত হয়ে যাবে। নিশাত ভাবছে, তার সেদিন মানা করে দেওয়া উচিত ছিল। এত ঝামেলা মাথায় নিয়ে চাকরি করা তার পক্ষে সম্ভব না।
—————
রাত আটটা ছুঁই ছুঁই। এই ফ্লোরের প্রায় সব স্টাফরাই চলে গেছে। অন্যান্য ফ্লোরে কেউ আছে কি-না সেটা জানে না নিশাত। ফাইলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে নিশাতের। মাইগ্রেনের উপশমটা সেই ছোটবেলা থেকেই রয়েছে। ব্যাগ থেকে ভিক্স বের করে মাথার দুই সাইডে লাগায় সে। সাথে একটা টাফনিল৷ যদি ব্যথা খানিকটা কমে আরকি। আরও এক ঘন্টা পর সবগুলো ফাইল চেক করা হয়ে গেছে। নিশাত পিওনকে দিয়ে ফাইলগুলো আফরাজের কেবিনে পাঠায়। তারপর সে-ও যায়।
আফরাজ এক এক করে সব গুলো ফাইল চেক করে। সে খুব করে চাইছিল যাতে ভুল হয়। কিন্তু নিশাত নির্ভুলভাবে ফাইলগুলোর কাজ শেষ করে তাকে নিরাশ করেছে। আফরাজের নাকে ভিক্সের কড়া ঘ্রাণ লাগে। সে আশেপাশে তাকায়। পরবর্তীতে বুঝতে পারে কেবিনে নিশাত ছাড়া কেউ তো নেই। তার মানে ভিক্স নিশাত লাগিয়েছে। দাঁত মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে নিশাত। সে শুধু আফরাজের তামাশা দেখছে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সে আফরাজকে বলে,
‘আমার মনে হয় আমি আমার কাজটা শেষ করতে পেরেছি। আশা করব আমি এখন অফিস থেকে বের হতে পারব। একদিনেই যদি এত কাজ করিয়ে ফেলেন বাকি সময়গুলো কি আমার চেহারা দেখে কাটাবেন নাকি স্যার? তার চেয়ে বরং কালকের জন্য কিছু কাজ রাখুন।’
আফরাজ মাথা তুলে তাকায়। নিশাতের এখন আর ভয় করছে না। আজকে ফাইলগুলো চেক করতে করতে নিশাত শপথ করেছে সে আর আফরাজকে ভয় পাবে না। এখন থেকে আফরাজকে তার নিজের ভাষা দিয়েই বোঝাবে। নিশাতের চোখে চোখ রেখে আফরাজ বলে,
‘ডোন্ট ইউ ডেয়ার টক মি লাইক দ্যাট, আন্ডারস্ট্যান্ড? নাউ ইউ ক্যান লিভ।’
নিশাত কথা বাড়ায়নি। রাত বাড়ছে। তাকে এখন ফিরতে হবে ভেবে কেবিন থেকে বের হয়ে যায় সে। কোনোকিছুরই চুলটাকে খোঁপায় মুড়িয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়। দশটা বাজতে চলল। কে জানে রাস্তায় চলতি বাসগুলো পাবে কি-না। মেইন গেট থেকে বের হওয়ার সময় দারোয়ান বলল,
‘ম্যাডাম, আপনি এখন বাইর হইতেছেন যে? সব স্টাফরা তো চইলা গেছে।’
নিশাত একটু খোঁচামূলক কথা বলল,
‘বসের অনুমতি ছাড়া অফিস থেকে বের হই কীভাবে বলেন? আজকে তো প্রথম দিন ছিল তাই কাজ বুঝে নিতে নিতে দেরি হয়ে গেছে। আচ্ছা আসি। কাল দেখা হবে।’
‘জি আইচ্ছা।’
নিশাত রাস্তা পার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে তার হোস্টেলে পৌঁছাতে রিকশা ভাড়া সত্তর টাকা। সে রিকশা নিতে চাচ্ছে না। রোজ রোজ রিকশায় যাতায়াত করলে মাস শেষে কিছুই থাকবে না। তেরো নাম্বার বাসটা আসতেই নিশাত চট করে উঠে পরে। সামনে একটা সিটও পেয়ে যায়। হেল্পারকে সিটি হসপিটালের সামনে থামাতে বলে নিশাত বসে পড়ে।
—————
আফরাজ কাজ শেষ করে নিজের কেবিন থেকে বের হয়।
দুই পাশে মোট ২০ টি ডেস্ক। মাঝে চওড়া জায়গা রাখা হয়েছে হাঁটা-হাঁটা-চলা করার জন্য। সেই পথ ধরেই হেঁটে যাচ্ছে আফরাজ। হঠাৎ একটা ডেস্কের দিকে নজর পড়ে তার। ডেস্কে থাকা পি সি'র সামনে একটা বাদামী রঙের খোঁপার কাঠি রাখা। আফরাজের দৃষ্টিশক্তি বেশ প্রখর। এই কাঠিটাই সে সকাল থেকে রাত অবধি নিশাতের খোঁপায় দেখেছে। তাড়াহুড়োয় কাঠিটাও নিতে ভুলে গেছে। আফরাজের যেন কী হলো! সে দুই পা এগিয়ে ডেস্ক থেকে কাঠিটা তুলে নিল। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে হন হন করে হেঁটে চলে গেল।
·
·
·
চলবে......................................................................