রাত তখন গভীর। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে। তার আলো সারা পৃথিবীকে মায়ায় ঢেকে রেখেছে। ভরা পূর্ণিমার নিটোল চাঁদ তার ঝলমলে আলোর পসরায় পৃথিবীর আকাশ ভরিয়ে দিয়েছে। ঝিকিমিকি তাঁরার মাঝে বিশাল চাঁদ। মাটির উপর থেকে ধীরে ধীরে চোখ তুলে চাঁদের দিকে তাকাল রোদেলা। ওর বুকের ভেতরটা কেমন ছটফট করছে, অজানা এক উত্তেজনা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। রোদেলা লম্বা শ্বাস টেনে ফেলল। সময় খুব দ্রুত চলে যায়। এক মাস চোখের পলকে কেটে গেছে যেনো। প্রায় শ্বশুর বাড়ি ও মামারবাড়ি লোকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ওখানে সব ঠিক আছে। সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষের মন ও বসে গেছে। ফারিয়া বেগমের আচরণ এখন সাধারণ হয়ে গেছে। তবে আগের থেকে এখন একটু কম কথা বলেন। সংসারের সকল দায়িত্ব মাইমুনার উপর দিয়ে তিনি সারাক্ষণ রুমে শুয়ে বসে থাকেন। শ্বশুর মশাইকে এখন আগের চেয়ে দূর্বল লাগে। বুড়ো লোকটা বোধহয় খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করছেন না। বয়সের একটা ছাপ স্পষ্ট ফেলছে চামড়ায়। রোদেলা ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। সেহরিশ শেষ মূহুর্তে ওকে জোজোর কবরস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট দূরে একটা গোলাপ বাগান। বাগানটার মালিক শফিকুল চৌধুরী। ওনার আদেশে বাগানের একপাশে খালি স্থানে কবর দেওয়া হয় জোজোকে। কবরটা দেখে বিস্মিত হয়ে ছিল রোদেলা। মাটির উপর কয়েকটা গোলাপের ফুল সহ ডাল রাখা আছে। বাগানের একজন মালি বললেন, মারিয়া তার ছোট্ট ছোট্ট হাতে রোজ কবর টাকে পরিস্কার করে। তারপর বাগানের সবচেয়ে বড় ও সুন্দর দেখে ফুলগুলো জোজোর কবরের উপর রাখে। নিয়ম করে রোজ মারিয়া জোজোর সঙ্গে দেখা করতে আসে। অনেকক্ষণ বসে থাকে। তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে হিচকি থামিয়ে বলে, ওর ভুল ঔষধ খেয়ে নাকি জোজো অসুস্থ হয় তার কিছুদিন পর মারা যায়। রোদেলা চোখ বন্ধ করে ভারী নিঃশ্বাস ফেললো। জুবিয়ার থেকে শুনেছিল জোজো অসুস্থ। আর জোজোকে ও পশু হাসপাতালেও নিয়ে যায়। তখন জোজোর অবস্থা করুণ ছিল। ডাক্তার হাল ছেড়ে দেয়। রোদেলা মালির থেকে কথা শুনে জোজোর কবরের মাটিটা ছুঁয়ে দিলো। চোখের জল উপচে পড়ছে। ফিরে যাওয়ার সময় এই বিষয়ে মারিয়াকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি সে। ছোটো মেয়ে। এই বিষয় নিয়ে যত ঘাঁটবে সে তত ভয় পাবে। এমনিতে মেয়েটা অনেক অনুতপ্ত বোধ করছে। রোদেলার মনো একটু ভালো লাগলো, এতো কিছুর মাঝেও সেহরিশ তার বিষয়টা মনে রেখেছিল। ভুলেনি।
নিশ্চলভাবে হেঁটে রোদেলার ঠিক পেছনে দাঁড়াল সেহরিশ। পৃথিবী থেকে অনেক দূরে, চাঁদের দিকে চকিত তাকাল। আলগোছে রোদেলাকে পেছনদিক থেকে আলিঙ্গন করে ওর কাঁধে থুতনি রাখল। সেহরিশ বলল, 'মাঝেমধ্যে চাঁদটা কে দেখে অনেক হিংসে হয়।'
সেহরিশের কণ্ঠে হিংসে শব্দটা শুনে চমকাল রোদেলা। একটা হালকা হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো, 'কেনো?'
সেহরিশ আরেকটু শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল, 'কখনো কখনো মনে হয় তুমি আমার থেকেও বেশি চাঁদ কে ভালোবাসো।'
রোদেলার চোখে পানি টলমল করছে। চারপাশে শুধুই নিস্তব্ধতা। কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজে গুনগুন করছে তার প্রিয় পুরুষ। এই মানুষটার স্পর্শে যেনো সে তার সমস্ত অস্তিত্ব টের পায়। হঠাৎ এক ফোঁটা অশ্রু তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো। সেহরিশের অগোচরে জলটুকু মুছে নিলো ও। রোদেলা ধীরে ধীরে পেছনে তাকিয়ে একপলক দু'পলক সেহরিশ কে দেখল, তারপর মৃদুস্বরে বলল,
'এই পৃথিবীতে আপনার চেয়ে প্রিয় আর কিছুই নেই।'
••••••••••••
প্রেগন্যান্সির পর থেকে জুবিয়ার জীবন চার দেয়ালে বন্দী। বাড়িই তার জীবন। মাঝে মাঝে হাসপাতালে যায়, বাইরে কোথাও যায় না। রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে পারে না। বমি হয়। জুবিয়ার ওর বন্ধুদের সাথে একসাথে লাঞ্চ করার ইচ্ছা অনেকদিনের। তূর্ণ তার ইচ্ছা পূরণ করতে বাড়িতে একটা ছোট গেট টুগেদার করে। সময়মতো তূর্ণর বাড়িতে অতিথিরা এসে হাজির। রোদেলা আর উমাইয়াকে নিয়ে জুবিয়া ড্রয়িং রুমে চলে গেল। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেহরিশ আর সাদাফ। ওরা ভেতরে ঢুকতে পারছে না। তূর্ণ সামনে দাঁড়ানো। সেহরিশ ভ্রুকুটি করলো।
তূর্ণ এসে অকপটে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'অনেকদিন পর তোকে দেখলাম।'
সাদাফ রুক্ষ গলায় বলল, 'গতকাল দেখেছিস।'
তূর্ণ রাগান্বিত গলায় বলল, 'তোকে নাক ফুঁকতে কে বলছে?'
সাদাফ বলল, 'তুই দাওয়াত করে আনিয়ে এখন দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখছিস। আমাদেরকে ঢুকতে দিবি নাকি না?'
তূর্ণ শাহাদাত আঙুল নাড়তে নাড়তে বলল,
'তুই আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়ে গেছিস।'
সাদাফ এক কদম দু কদম এগোল। শার্টের হাতা ভাজ করে কনুই পর্যন্ত গোটাতে গোটাতে বলল, 'কি বললি? আবার বল।'
তূর্ণ এক দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেল। সেহরিশ সাদাফের কাঁধে এক হাত রেখে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, 'ওর শয়তানির ফাঁদে পা দিস না। মাথায় চড়ে বসবে।'
তূর্ণর সঙ্গে সাদের বন্ডিং খুব ভালো। সোফার উপর বসে আছে সাদ। তার হাতে দুটো খেলনা। তূর্ণ তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কথা বলার সঙ্গে খেলা করছে। সাদ দাঁত দুটো বের করে শব্দ করে খিলখিল করে হাসছে।
উমাইয়া ডানে-বামে মাথা নেড়ে বলল,
'ওকে সামলানো অনেক কঠিন। বুঝিনা তূর্ণ কিভাবে সামলে নেয়।'
কথার পিঠে জুবিয়া হেসে উঠল।
সাদাফ বিড়বিড় করে বলল,
'একজন বৃটিশ কে আরেকজন বিশ্ব বৃটিশ ই সামলাতে পারে।'
সেহরিশ সাদাফের দিকে তাকাল। সাদাফ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, 'ভুল কী বললাম? তুই বল। একটা জ্বালায় ঘরের বাহিরে আরেকটায় জ্বালায় ঘরের ভেতরে।'
সেহরিশ মৃদু হাসল। তারপর বলল,
'কিছুদিন পর ও নিজেও বাবা হবে। এখনো যদি ওর বাচ্চামো না যায়। কিছু করার নাই।'
সাদাফ বলল,
'খবর পেয়েছিস?'
সেহরিশ তাকাল না। জিজ্ঞেস করলো,
'কী? কোন ব্যাপারে?'
সাদাফ বলল,
'এ বছর ইতালিতে সবচেয়ে বড় শো অনুষ্ঠিত হবে। গত রাতে আমাদের আমন্ত্রণ এসেছে। আমার মনে হয় সেখানে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু নাচের গান দেখে সময় নষ্ট করতে চাই না।'
তূর্ণ সাদকে কোলে নিয়ে সবে এসে দাঁড়াল। সাদাফের কথা শেষ হতেই সে বলল, 'কেউ না গেলেও আমি অবশ্যই যাবো।'
সাদাফ বলল,
'তোর কাজ সেখানে গিয়ে মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করা।'
তূর্ণ রেগে বলল,
'মোটেই না। আমি একজন স্ত্রী পাগল স্বামী।'
'ভাই সাবধানে থাকিস, জুবিয়া জানতে পারলে তোর চোখ উপচে ফেলবে।'
এই বলে সাদাফ অন্য দিকে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল তূর্ণ। তারা তাকে কি মনে করে? একটা আলাভোলা ছেলেটাকে ভয় দেখাচ্ছে। ভাবতে রাগ লাগছে।
চারজন স্টাফ সুন্দর করে খাবার টেবিল সেট করেছে। জুবিয়া সবাইকে নিয়ে খাবার টেবিলে এলো। দুপুর হয়েছে অনেকক্ষণ। গল্প আর আড্ডায় সময় দৌঁড়ে চলে গেল যেন। জুবিয়াকে চেয়ারে বসিয়ে রোদেলা ও উমাইয়া খাবার বাড়তে থাকে। কর্মীরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। এখন একটা পরিপূর্ণ পরিবারের মত মনে হচ্ছে। তূর্ণ সাদাফের মুখোমুখি ও সেহরিশের ডানদিকে বসল। রোদেলা সবার প্লেটে খাবার দিল। তারপর একটা চেয়ার টেনে বসল। তূর্ণ তার কাঁটাচামচে খাবারটি গেঁথে সেহরিশের দিকে ধরল।
সেহরিশ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে হাত নাড়লো,
'তুই জানিস না, আমি কারো হাতে খাবার খাই না।'
তূর্ণ নাছোড়বান্দা। জোর গলায় বলল,
'তুই না খেলে আমিও খাবো না। আর এখানে কাউকে খেতেও দেবো না। তোকে আমার থেকে একটু হলেও খেতে হবে।'
এখন তূর্ণর কথা না মানার উপায় নেই। সবাই ক্ষুধার্ত। সেহরিশ কিছুক্ষণ ভাবল। অনুরোধটি রাখবে।
সেহরিশ জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। চেয়ার থেকে একটু সামনে এলো। তূর্ণর চামচ থেকে সেহরিশ খাবার খাবে এমন সময় চামচটি সরিয়ে ফেলল ও। তারপর নিজেই চামচ থেকে খাবার খেয়ে নিল। সেহরিশ হতভম্ব। হা হয়ে গেছে। তূর্ণ আর সাদাফ সশব্দে হাসতে লাগলো। সাদাফ খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে সেহরিশকে উদ্দেশ্য করে বলল,
'তুই আবার ওর ফাঁদে পা দিয়েছিস। তোকে আবার বোকা বানালো।'
সেহরিশ কোন উত্তর দিল না। চেয়ারে মেরুদণ্ড শক্ত করে বসে আছে। সেহরিশ তার ডান হাত চেপে ধরে তূর্ণকে ঘুষি মারতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল।
রোদেলা বলল,
'আপনি খেতে শুরু করুন। তূর্ণ ভাই তো শুধু দুষ্টামি করেছে। রাগ করবেন না যেন।'
তূর্ণ ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল।
.
.
.
চলবে......................................................................