বড়ো লোক বাপের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে জাফির ক্লাব থেকে বের হয় বন্ধুদের সাথে হইহুল্লার করতে করতে। বন্ধুরা একে একে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে আর জাফির সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাইকে এসে বসলো। ঘড়ির কাটা প্রায় এগারোটার ঘর ছুঁইছুঁই করছে। শহরের সুনসান রাস্তায় গাড়ির চলাচল কমে এসেছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে বড় বড় হলদে রঙের ট্রাকগুলো দেখা যাচ্ছে, যা কাঁচামাল নিয়ে যাচ্ছে। শহরের ব্যস্ততা এখন ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। রাতটা নিস্তব্ধতায় পরিণত হচ্ছে ধীরে ধীরে।
জাফির সিগারেটটা শেষ করে মাথায় হেলমেটটা পরে বাইক স্টার্ট দিলো। জাফির বাইক স্টার্ট দেওয়ার পরপরেই একটি বিলাসবহুল গাড়ি স্টার্ট হয়ে জাফিরের বাইকের পেছনে ছুটে চলল। গাড়িটি ধীরে ধীরে তার বাইক অনুসরণ করচ্ছে।
জাফির মনের আনন্দে বাইক চালাচ্ছে। হঠাৎ করেই, আকস্মিকভাবে তার বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। বারবার স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করলেও কিছুই হলো না। হলো কী হঠাৎ? জাফির বাইকের অয়েল ট্যাংক খুলে পুরোই হতবাক—অয়েল ট্যাংক পুরোপুরি খালি। গতকাল তো ট্যাংক ফুল করিয়েছিল, তাহলে এখন তেল কোথায় গেল? কী অদ্ভুত ঘটনা! তার মাথা কাজ করছে না। এই হাইওয়ের মাঝখানে এসে এমন বিপদে পড়তে হবে, ভাবতেই পারছে না। রেগেমেগে ফোন বের করে দেখল, ফোনের ব্যাটারি পুরোপুরি ডেড। হতাশায় বাইকটা লাথি মারল, কিন্তু ফলস্বরূপ নিজের পায়ে ব্যথা পেয়ে লাফাতে শুরু করল। কথায় আছে—‘হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে,’ তার এই অবস্থা এখন। সবকিছু একসঙ্গে খারাপ হতে হলো, অসহ্য!
জাফির হাইওয়েতে চলন্ত গাড়ির কাছ থেকে লিফট চাইল, কিন্তু কেউ থামল না। ঠিক তখনই, অপ্রত্যাশিতভাবে একটি কালো রঙের হাইস গাড়ি এসে তার সামনে দাঁড়াল। জাফিরের চোখ-মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ফাইনালি কেউ আসলো তাকে সাহায্য করতে। গাড়ি থেকে নেমে এল একজন সুঠাম দেহের অধিকারীর লোক। কিছুটা ভয় অনুভব করল জাফির, কিন্তু লোকটি বিনয়ের সাথে বলল, "হেই, জেন্টলম্যান! কোনো সাহায্যের প্রয়োজন?"
জাফির একটু হেসে বলল, "জি, আসলে আমার বাইকের তেল ফুরিয়ে গেছে।"
লোকটি দুঃখ প্রকাশ করে বলল, "ওহ, সো স্যাড! আমি কি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?"
জাফির খুশি হয়ে উত্তর দিল, "হ্যাঁ, যদি সাহায্য করেন তাহলে তো খুবই ভালো হয়।"
লোকটি সহানুভূতির সঙ্গে বলল, "ঠিক আছে, তুমি আমার সঙ্গে চলো। পাম্প থেকে এক লিটার তেল নিয়ে এসে ট্যাংকে দিয়ে দাও।"
জাফির আনন্দিত হয়ে বলল, "ধন্যবাদ!"
জাফির সরল মনে গাড়ির পেছনে গিয়ে বসতেই চমকে উঠল। গাড়ির ভেতরে কালো মুখোশ পরা কয়েকজন লোক বসে আছে। তাদের চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জাফিরের দিকে নিবদ্ধ। জাফিরের শরীরটা মুহূর্তে শীতল হয়ে গেল অজানা ভয়ে, ভয়ের চোটে তার লোমকূপগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, একজন মুখোশধারী লোক হঠাৎ করেই তার নাকে একটি ভেজা রুমাল চেপে ধরল। জাফির ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল, কিন্তু তার শক্তি ক্রমশ কমে আসছে। রুমালে থাকা গন্ধ তাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে ঢলে পড়ল এক ঘোর অন্ধকারে। জ্ঞান হারানোর আগে জাফির যা বোঝার বুঝে গেছে—তাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে আর সেই ফাঁদে সে পা দিয়ে ফেলেছে। কী হতে চলেছে তার সঙ্গে আগামীতে?
গাড়ি থেকে আরেক জন লোক নেমে জাফিরের বাইকের দিকে এগিয়ে গেল স্বাভাবিক ভাবে। সে এক লিটার তেল বাইকের ট্যাংকে ঢেলে দিয়ে বাইকে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট করে দ্রুত হাইওয়ে ধরে অজানা গন্তব্যে ছুটে গেল। এদিকে, হাইস গাড়িটাও ধীরে ধীরে তার গতি বাড়াল। গাড়ির ভেতরে জাফির অচেতন হয়ে সিটে পড়ে রইল।
—————
নিস্তব্ধ রাত। চারদিকে গভীর নীরবতা। এ সময়টাই মেহুলের সবচেয়ে পছন্দের। কারণ এই সময়টাই মেহুল পড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বেশি কোলাহলে সে পড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না। মেহুল বইয়ের পাতায় ডুবে আছে। হঠাৎ করেই ফোনে মেসেজ আসার শব্দ হলো। প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো সিম কোম্পানি থেকে কোনো বার্তা এসেছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার মেসেজ আসার শব্দ হলে তার মনে একটু কৌতূহল জাগলো। ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ অপশনে ঢুকল মেহুল।
একটি অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। মেসেজের বচনভঙ্গি বড্ড অদ্ভুত। মেহুল ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে প্রথম মেসেজটা পড়তে শুরু করল—
"তোকে ছোঁয়ার যেই চেষ্টা করবে, তার পরিণতি খুব ভয়ংকর হবে, মেহুল মর্তুজা।"
দ্বিতীয় মেসেজ,
"তোকে ছোঁয়ার অধিকার একমাত্র আমার থাকবে। তোর মন, তোর হৃদয়, তোর পুরো অস্তিত্বে জুড়ে শুধুই আমার নাম লেখা থাকবে শুধুই আমার।"
মেসেজ দুটো পড়ে মেহুলের ভ্রু কুঁচকে গেলো। কে এমন অদ্ভুত ধরণের মেসেজ পাঠিয়েছে তাকে? দুটো মেসেজেই জড়িয়ে আছে হুমকি আর অধিকারবোধ। মেহুল নাম্বারটা ডায়াল করল, কিন্তু নাম্বারটা সুইচ অফ বলছে। মেহুলের মাথায় আচমকা শেরাজের নামটা খেলে গেল কেন জানি। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। শেরাজ তো ফ্রান্সে! এই নাম্বারটা তো বাংলাদেশের।
মেহুল ফোনের স্ক্রিনে নাম্বারটায় চোখ রেখে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। কার হতে পারে এই নাম্বার? কে তাকে এমন মেসেজ দিল? মেহুলের মনে ভয়ের বীজ বপন হলো। কী অপেক্ষায় আছে তার জীবনে? আর কত জটিলতা তৈরি হবে তার এই ছোট্ট জীবনে? মেহুল চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে বড্ড ক্লান্ত সে। কোন পাগল উন্মাদ এই মেসেজ পাঠিয়েছে আল্লাহই ভালো জানেন?
—————
গভীর রাত। চারপাশ নীরবতার চাদরে মোড়া, তবে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে নিশাচর প্রাণীদের ভয়ঙ্কর সব ডাক। জাফির চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করল, মাথাটা ব্যথায় ভারী হয়ে আছে। মাথাটা দু হাত দ্বারা চেপে ধরতে চাইলো, কিন্তু পারল না। হাত দুটো শক্ত করে যেন কিছু একটা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।
জাফির মাথা ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ চোখ মেলে তাকাল। প্রথমেই নজর গেল মাথার ওপর ঝুলে থাকা হলুদ রঙের লাইটের দিকে, যেটা মৃদু ঝুলে আছে আর চারপাশের অন্ধকারকে যেন আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। জাফির নড়ার চেষ্টা করল, কিন্তু শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন লোহার শিকলে বন্দি। তার মস্তিষ্ক দ্রুত কয়েক ঘণ্টা আগের স্মৃতিগুলো ঘেঁটে বের করার চেষ্টা করল—সে ক্লাবে ছিল, বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল, এরপর মাঝ রাস্তায় বাইক খারাপ হয়ে গিয়েছিল? আর একজন সাহায্যের নাম করে তাকে অপহরণ করেছে। সে কোথায় আছে এখন? এটা কোন জায়গা?
জাফির চারপাশটা চোখ ঘুরিয়ে দেখলো। পুরোনো একটা পরিত্যক্ত ঘর। চারদিকে ধুলো জমে থাকা ফার্নিচার, দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। রুমে সে ছাড়া আর কেউ নেই। বাতাসে একটা অদ্ভুত স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। মাঝে মাঝে ইঁদুরের ডাক ভেসে আসছে। জাফির শরীরটা বাঁধন থেকে মুক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। হাত-পা ঝাঁকিয়ে বাঁধন থেকে বেরোনোর চেষ্টা করল, কিন্তু শক্ত করে বাঁধা থাকার দরুণ এক চুলও নড়তে পারলো না। হতাশ হয়ে চিৎকার করে উঠল।
"কেউ আছো? আমাকে এখানে কেন ধরে আনা হয়েছে? কী করেছি আমি? কেন আটকে রেখেছো আমাকে?"
তার কণ্ঠ রুমের নীরবতা ভেঙে প্রতিধ্বনিত হলো, কিন্তু কোনো উত্তর এলো না। আচমকা দরজা খোলার শব্দে জাফির চমকে সামনের দিকে তাকাল। ঘরের হলদে আলোতে দেখতে পেল গাড়িতে দেখা কালো পোশাক পরিহিত তিনজন লোক। মুখ কালো মাস্কে ঢাকা আর মাথায় ক্যাপ, যার জন্য চেহারা দেখা যাচ্ছে না। জাফিরের গলা শুকিয়ে এলো। খানিকটা ভয় পেল। তবুও নিজেকে সামলে মনে সাহস জুগিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, "কারা তোমরা? কেন আমাকে এখানে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে?"
তিনজনের মধ্যে দু'জন কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে অন্য একটা রুমে চলে গেল। ঘরে রয়ে গেল শুধু একজন। সেই ব্যক্তিটি ধীর পায়ে জাফিরের দিকে এগিয়ে আসছে। জাফিরের মনে ভয় আরও বাড়তে লাগল। বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক শব্দ যেন চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই মানুষটি কি তাকে মে রে ফেলবে নাকি? তার মাথায় নানা রকমের ভয়ানক সকল চিন্তা এসে ভিড় জমছে।
জাফির অনুনয়ের স্বরে বলল, "প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি, তাহলে আমি ক্ষমা চাইছি।"
কালো পোশাক পরিহিত লোকটি গম্ভীর গলায় বলল, "ক্ষমা? আমি ক্ষমা করার কেউ নই। আমি তো শুধু একজন গোলাম, হুকুম তামিল করতে এসেছি। ক্ষমা চাইতে হলে যার নির্দেশে তোকে ধরে আনা হয়েছে, তার কাছে চাইবি।"
জাফির আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করল, "তাহলে কোথায় সে? আমাকে তার সামনে নিয়ে যাও। আমি তার পা ধরে ক্ষমা চাইব। কিন্তু আমাকে এটা বলো আগে, আমি কী ভুল করেছি? কেন আমাকে ধরে আনা হলো এখানে?"
"তুই ওনার অতি পছন্দের একটা জিনিস স্পর্শ করে খুব ভুল করে ফেলেছিস। যাকে ছোঁয়ার অধিকার তোর ছিল না আর না অন্য কারোর আছে।"
জাফির আতঙ্কিত চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, "আমি কাকে স্পর্শ করেছি?"
লোকটি ঠান্ডা অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে উত্তর দিল, "মেহুল মর্তুজাকে।"
মেহুল নামটা শুনে জাফির যেন বিস্ময়ে জমে গেল। হতবাক হয়ে বলল, "মেহুল? মেহুলের সাথে ওনার সম্পর্ক কী?"
লোকটি রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠল, "ওই! তোর সাহস তো কম না, শালা। আমাকে উল্টো প্রশ্ন করিস! তুই স্যারের কাছে ক্ষমা চাইবি তাই তো। দাঁড়া, স্যারের সঙ্গে তোকে কথা বলিয়ে দিচ্ছি। উনি তো তোর সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষায় আছেন।"
যেই দু'জন লোক অন্য ঘরে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন ফিরে এলো হাতে একটা ল্যাপটপ নিয়ে। জাফিরের সামনে ল্যাপটপটা রাখা হলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক রহস্যময় মুখ। জাফির ভ্রু কুঁচকে নেয়। মুখটা এতটাই অন্ধকারে ঢাকা যে বোঝার উপায় নেই লোকটা কে? কিন্তু অদূরে পেছনের দেয়ালে ঝোলানো চশমা পরিহিত মেহুলের হাস্যোজ্জ্বল ছবিটা আলোতে ঝলমল করছে। ল্যাপটপ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর এক পুরুষালী কন্ঠ যেই কন্ঠে প্রচণ্ড ক্রোধ মিশে আছে, "তুই তাহলে জাফির আহসান?"
জাফিরের বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। কে এই লোকটা? মেহুলের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
ল্যাপটপ স্ক্রিনে থাকা মানুষটা ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, "নিশ্চয়ই ভাবছিস, আমি কে? মেহুলের কী হই? ভাবাটা স্বাভাবিক। আচ্ছা, তুই অনুমান কর তো আমি মেহুলের কে হতে পারি?"
জাফির কাঁপা গলায় বলল, "আমি জানি না।"
"ও জানিস না। তাহলে আর জানার দরকার নেই। আচ্ছা, তোর মেয়েদের সঙ্গে ফুর্তি করতে খুব মজা লাগে, তাই না? এই পর্যন্ত কতগুলা মেয়ের সঙ্গে ফুর্তি করেছিস বল তো? নিশ্চয়ই অগণিত। বাপের টাকায় ফুর্তি করা মজাই আলাদা।"
জাফির চুপ রইল, কিছু বলার সাহস করল না।
লোকটা এবার আরও গম্ভীর হয়ে বলল, "কিন্তু এই বার যে তুই রং নাম্বারে ডায়াল করে ফেলেছিস। ভার্সিটির অন্য মেয়েদের সঙ্গে যা খুশি কর, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু মেহুলকে স্পর্শ করার সাহস তুই কীভাবে পেলি, হা রা মি র বাচ্চা?"
শেষের কথাটা চেঁচিয়ে বলল। জাফির ভয়ে কেঁপে উঠল। লোকটা একটু থেমে বলল, "মেহুলের দিকে হাত বাড়িয়ে বড্ড ভুল করে ফেলেছিস। এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তোকে তো করতেই হবে।"
জাফির ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, "মানে?"
লোকটি ভেবে বলল, "উমম! ইচ্ছে ছিল, যেই হাত দিয়ে মেহুলকে ছুঁয়েছিস সেই হাতটা শরীর থেকে কে টে নিবো। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করলাম।"
এই কথায় ভয়ে জাফিরের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। তার শরীর কাঁপছে, কপাল দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। ভয়ে তার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। লোকটি জাফিরের অবস্থা দেখে বলল, "আরে আরে, দাঁড়া। এত ভয় পেলে চলবে? হাত কাটব না তো আমি। কিন্তু মেহুলকে ছোঁয়ার শাস্তি তো তোকে পেতেই হবে।"
লোকটা চেঁচিয়ে বলল, "বিকাশ! যে হাত দিয়ে মেহুলকে ছুঁয়েছে ও, সেই হাতে জ্বলন্ত শিকের ছ্যাঁকা দে!"
জাফির চিৎকার করে উঠল, "না না! প্লিজ! দয়া করে এটা করবেন না! আমি আপনাদের পায়ে পড়ি। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করুন!"
কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না। অন্য রুম থেকে একজন একটা জ্বলন্ত শিক নিয়ে এলো। জাফির ছটফট করছে মুক্ত হওয়া জন্য। বিকাশ শিকটা নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো, তার হাতে ধাতব লালচে গরম শিকটা জ্বলজ্বল করছে। জাফির চিৎকার করতে লাগল, কিন্তু সেই চিৎকার কারো কানে পৌঁছালো না। জাফিরের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে অসহনীয় যন্ত্রণায়। কিয়ৎক্ষণ পরে ল্যাপটপ থেকে লোকটির কণ্ঠ ভেসে আসলো, "স্টপ।"
জাফির যেন একটু স্বস্তি পেল। হাতটা অসহ্য যন্ত্রণা করছে যা বলে ব্যক্ত করা যাবে না। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে জাফির। শরীর ভেঙে আসছে তার। চোখ ঝপসা হয়ে আসছে। ল্যাপটপে থাকা ছায়ামানবটি যেন জাফিরের এই অবস্থা দেখে আনন্দ পাচ্ছে।
"তোর শাস্তি কমিয়ে দিলাম। কিন্তু আগামীকাল ভার্সিটি গিয়ে তোর কাজ কি জানিস।"
জাফির ক্লান্ত চোখে ল্যাপটপের দিকে তাকালো। লোকটি বলতে শুরু করলো, "যেভাবে হিরোর মতো বসে মেহুলকে প্রেম নিবেদন করেছিলি ঠিক সেই ভাবে বসে মেহুলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবি প্রেম নিবেদন করার অপরাধে মনে থাকবে কথাটা।"
জাফির মাথা দোলায়। লোকটি পুনরায় বলল, "যেই চৌদ্দটি নারীকে মাহরাম করা হয়েছে একজন পুরুষের জন্য, সেই চৌদ্দটি নারীর দৃষ্টিতে আজ থেকে মেহুলেকে দেখবি। দরকার পড়লে মেহুলকে তুই তোর মায়ের চোখে দেখবি।"
জাফিরকে চুপ থাকতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, "কি হলো, কথা বলিস না কেন? কী চোখে দেখবি মেহুলকে বল?"
জাফির চোখ বন্ধ করে বলল, "মায়ের চোখে।"
লোকটি হেসে বলল, "এই তো, গুড বয়।"
লোকটি বিকাশকে উদ্দেশ্য করে বলল, "ওকে ওর জায়গায় পৌঁছে দে, আর পারলে একটু চিকিৎসা করিস বেচারার।"
বলেই কল কেটে দেয়। জাফির নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে, মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটা তার পায়ের নিচ থেকে সরে যাচ্ছে। যখন তাকে টেনে নিয়ে চলে যাওয়া হলো, জাফির তখন অনুভব করতে পারছে, কোনো শক্তি নেই তার শরীরে। শরীরের প্রতিটি অংশ যেন ব্যথায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। মেহুলকে একটু ছোঁয়ার জন্য এতটা যন্ত্রণা সইতে হবে জানলে কখনই মেহুলের ছায়াও মারাতো না সে। এতটা নিষ্ঠুর একটা মানুষ কী করে হতে পারে? কে এই লোক কি তার পরিচয়?
·
·
·
চলবে...................................................................................