অনন্যা দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। আজ দেরি হয়ে গেছে, আর এখান থেকে ভার্সিটিতে পৌঁছাতে কমপক্ষে বিশ মিনিট তো লাগবেই। যদি জ্যামে পড়ে, তাহলে তো কথাই নেই! ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল, তারপর পেছন ফিরে জোরে বলে উঠলো,
"ও লারার স্বামী! গাড়ি বের করো, ভাই!"
দুই-তিনবার ডাকল, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। তাই ভাবলো, হয়তো তামং বাইরে আছে। তাই আর অপেক্ষা না করে দরজার নব ঘুরিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়াতেই পেছন থেকে কেউ তার ব্যাগ ধরে টান দিল। অনন্যা মুহূর্তেই থমকে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ঘুরিয়ে দরজার সাথে চেপে ধরল কৌশিক। চোখ-মুখ কঠোরতা আর কণ্ঠে গম্ভীর ভাব ফুটে উঠেছে।
"কালকে কি বলেছিলাম মনে আছে?"
অনন্যা হতভম্ব! বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল স্যারের দিকে।
"কাল তো অনেক কিছুই বলেছিলেন। এখন কোনটা মনে রাখার কথা বলছেন?"
কৌশিক ঠোঁট চেপে রাগ সামলানোর চেষ্টা করল। কোনো উত্তর দিল না। শুধু তার চোখের দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হলো, চোয়াল শক্ত হলো, আর পরের মুহূর্তেই সে ঝুঁকে এলো অনন্যার দিকে। অনন্যা বিস্ময়ে চোখ দুটো বড় করে ফেললো। কি হচ্ছে, কিছু বোঝার আগেই কৌশিক অনন্যার গলার ভাঁজে নিচের দিকে দুই দন্ত বসিয়ে কামড়ে ধরলো।
"আহ!"
ব্যথার তীব্রতায় অনন্যার শরীর কেঁপে উঠল, ঠোঁট ফাঁটিয়ে বেরিয়ে এলো দমচাপা চিৎকার। হাত দিয়ে কৌশিককে সরানোর চেষ্টা করল, কিন্তু উল্টো ব্যথায় আরও কুঁকড়ে গেল। অনন্যার মুখ থেকে রাগে-ব্যথায় শব্দ বেরোনোর আগেই করিডোরে পরিচিত এক কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
"মা গো মা! আমি কি দেখে ফেললাম এটা!"
লারা সামনে এসেই দৃশ্যটা দেখে চোখ গোল গোল করে ফেলল। মুহূর্তেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দ্রুত উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।
"আমি কিছু দেখি নাই, সাব! আপনারা চালিয়ে যান। আর ম্যাডাম! আমার স্বামী বাইরেই আছে!"
কথা শেষ করেই পেছন ফিরে লারা বিদ্যুৎগতিতে দৌড় দিল।
অনন্যা ততক্ষণে কৌশিককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। এক হাত গলার ওপর বুলিয়ে দেখল, ব্যথার তীব্রতা এখনো কমেনি। কৌশিক পিছু হটে চোয়াল শক্ত করে কটমট দৃষ্টিতে লারার দিকে তাকাল। কিন্তু লারা ততক্ষণে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে।
রাগে-অপ্রস্তুত হয়ে অনন্যা এবার কৌশিকের বাহুতে সজোরে ধাক্কা দিল।
"ইঁদুরের বংশধর! ফাজিল লোক!"
কৌশিকের চোখের কোণে তীক্ষ্ণ হাসি দেখা গেলো। কিন্তু সে চুপ না থেকে অনন্যার গাল চেপে ধরে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
"স্যারকে ফাজিল বলতে আসছো? তোমাকে তো আমি দেখে নেবো।"
অনন্যা হাত ছাড়িয়ে নাক ফুলিয়ে বলল,
"তো কামড়াকামড়ি করছিলেন কেন?"
"যাতে মনে থাকে আমি তোমার হাসবেন্ড! কেউ ছুঁতে চাইলে দেখিয়ে দেবে এটা!"
"হাট!"
ধমক দিয়ে কৌশিককে আরেকটা ধাক্কা মেরে দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে গেল অনন্যা।
কৌশিক দাঁড়িয়ে থেকে জোরে বলে উঠল,
"ধরলে তোমার কিন্তু খবর করে ছাড়বো!"
পিছন থেকে অনন্যার ঠান্ডা গলা ভেসে এলো,
"এত খবর না করে, ক্লাসে আসুন! আপনার জন্য ছাত্রছাত্রীরা অপেক্ষায় আছে। বিশেষ করে ছাত্রীরাআ!"
কৌশিক মুখ ভেচকালো, দরজা ঠেলে বন্ধ করে দিল।
গাড়ির ভেতরে বসে অনন্যা বারবার গলায় হাত বুলাচ্ছে। ব্যথা কিছুটা সয়ে এসেছে, কিন্তু কামড়ের দাগ থেকে গেছে। এই লোকটার আচরণ একেবারেই অননুমেয়। কখন কী করে, কেন করে বোঝাই যায় না! একটু আগে স্যারের কামড় খেয়ে ভেবেছিল, আজই তার জীবন শেষ! মানুষ তো আর না, আচরণে যেন কোনও ভিনগ্রহের প্রাণী!
কিন্তু পরে... পরে শুনতে পেলো আরেক কাহিনী। অনন্যাকে নাকি কেউ ছুঁতেই পারবে না।
কৌশিক স্যারের ব্যবহার বোঝে না অনন্যা। লোকটা কখনো ঠান্ডা বরফের মতো, কখনো দাবানলের মতো তীব্র। আর স্পর্শ করার ব্যাপারটা নিয়ে তিনি এত সিরিয়াস কেন! অনন্যাকে অন্য কেউ স্পর্শ করলে কি এমন হয়ে যাবে তার?
তামং গাড়ি স্টার্ট দিলো। অনন্যা দ্রুত ব্যাগ খুলে স্কার্ফ বের করল, চুলগুলো খুলে গলার ওপর ফেলে দিলো। স্কার্ফ দিয়ে গলাটা ঢেকে ফেললো, তারপর মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল।
••••••••••••
"বরফ দিয়ে মুখের ব্যথা সারানোর জন্য হলেও একজন চাই!"
নিক চোখ বন্ধ করে গালের ক্ষতস্থানে বরফ চেপে ধরেছে, তবু আরাম পাচ্ছে না।
কৌশিক পাশেই বসে ছিল। লারাকে দিয়ে জঙ্গলের ভেতর থেকে কিছু নক্সফেরন পাতা আনিয়েছে। পাতার নির্যাস নিয়ে নিকের ছিলে যাওয়া পায়ে লাগাচ্ছিল।
নিকের কথা শুনে কৌশিক বিরক্ত হয়ে মুখ বাঁকালো, তারপর ঠান্ডা গলায় বললো,
"ওই মেয়েটাকে ডেকে আনো! বরফ তো দেবে, সাথে শরীরে ভালো মতো মলমও ঘষে দেবে!"
নিক মুখ থেকে বরফ সরিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
"হ্যাঁ, তারপর আমার পুরো শরীর জ্বালা করুক!"
কৌশিক পাতার নির্যাস নিকের পায়ে মাখতে মাখতে ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললো,
"ভাবতেও পারছি না, তোমাকে একটা মেয়ে এভাবে মেরেছে!"
নিক বিরক্ত মুখে বললো,
"ভাববে কি করে? তোমার বউ তো আর এভাবে মা/রে না, মুখে বুলি ফোটায় শুধু!"
নিক এক মুহূর্ত থামলো, তারপর ঠান্ডা স্বরে বললো,
"আর ওই মেয়েটা? কি বলবো! প্রথম প্রথম ঠিক ছিল, কিন্তু ইদানিং কথায় কথায় রেগে যায়। আর কাল যা করলো!"
কৌশিক গ্লাভস হাতে নক্সফেরন পাতার শেষ রসটুকু ভালোভাবে নিকের পায়ে লাগিয়ে বললো,
"এভাবেই বসে থাকো, নড়বে না। সেরে যাবে হয়তো। যদিও এই পাতার সাথে আরও অনেক কিছু মেশাতে হয়, সেইগুলো আমি জানি না। তবে যা জানি, তাই ট্রাই করলাম।"
নিক একপাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
"তুমি কি ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছো?"
কৌশিক নির্লিপ্ত গলায় বললো,
"হুম! যেতে তো হবেই।"
নিক ব্যথায় মুখ বিকৃত করে তাকিয়ে থাকলো কৌশিকের চলে যাওয়ার পথের দিকে। সূর্যের আলো তার পায়ে পড়ে চামড়াটা ক্ষতবিক্ষত করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাকানোও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যন্ত্রণাটা একমাত্র সে-ই জানে, কীভাবে কষ্ট সয়ে আজ এখানে বাড়ি ফিরেছে! হাঁটতে পারছিল না, অথচ ফিরতে হয়েছে একরকম টেনেহিঁচড়ে।
ওদিকে কৌশিক ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে গেলো। আজ ক্লাস শুরু দেরিতে, তাই তাড়াহুড়ো নেই। যদিও অন্যান্য প্রফেসরদের সকাল দশটার মধ্যে নাম এন্ট্রি করতে হয়, কিন্তু কৌশিকের ক্ষেত্রে এই নিয়ম আলগা। সে বিদেশি, তাই কিছুটা সুবিধা পায় বেশি। যখন ক্লাস শুরু হয়, তখন গেলেও কেউ কিছু বলে না। কেউ মুখে স্বীকার না করলেও সবাই বোঝে, তার জন্য নিয়মগুলো একটু আলাদা।
আজ ও তাই হলো। কয়েকটা ক্লাস করিয়ে দুপুরের দিকে অনন্যাদের ক্লাস করানোর কথা কৌশিকের।
আরণ্যক ক্লাসরুমের দরজার সামনে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। ভিতরে প্রবেশ করার আগে একটু দম নিলো। আজ বিশেষ করে ইতিহাস ক্লাসের জন্য ভার্সিটিতে এসেছে সে। কারণ আজ ইতিহাস ক্লাসে অনন্যার সঙ্গে দেখা হবে। একটু সুযোগ হবে কথা বলার!
কয়েকদিন ধরে আরণ্যক একপ্রকার নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল। শরীর-মন ভালো লাগছিল না, তাই বাসাতেই ছিল। সবাই খোঁজ নিয়েছে, বন্ধুরা বাসায় গিয়েও দেখে এসেছে। অথচ যাকে সবচেয়ে বেশি চাইছিল, সে একবারও আসেনি, এমনকি ফোন করেও জিজ্ঞেস করেনি কেমন আছে! এই উপেক্ষা বুকের ভেতর শূন্যতা তৈরি করেছে। খাওয়াদাওয়ার ঠিক নেই, রাতে ঘুমও হয় না। চোখের নিচে কালি জমেছে, মুখটা মলিন হয়ে গেছে। বন্ধুরা বলছে, আগের সেই প্রাণবন্ত আরণ্যক আর নেই। ঠিক ই তো নেই সে আগের মতো! থাকবে কি করে? মনের সুখ যেখানে থাকে সেই সুখটুকুই যদি হারিয়ে যায় তাহলে? তাহলে ভালো থাকা কি যায়? থাকা যায় কী প্রাণবন্ত হয়ে?
কিন্তু আজ সে এসেছে, শুধু একটা কারণেই, অনন্যাকে একবার দেখবে বলে। বুকের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন জমে আছে, কিন্তু প্রথম দেখাতেই কিছু বলতে পারবে কি না, তা সে নিজেও জানে না। ক্লাস শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। সে ধীর পায়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল।
অনন্যা প্রতিদিনের মতো নোহারার সঙ্গে বসে আছে। নোহারা উত্তেজিত ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করছে কিভাবে সে ভ্যাম্পায়ারটাকে শাস্তি দিয়েছে। অনন্যা অবাক হয়ে শুনছে। কথার মাঝেই বলে উঠল,
"ভ্যাম্পায়ারটা তোকে পছন্দ করে বলে মনে হয়। নাহলে মার খাওয়ার পরও বললো, 'ডোন্ট লিভ মি'?"
নোহারা বিরক্তি নিয়ে দুদিকে মাথা ঝাঁকালো,
"ধুর! এদের পছন্দ আর মানুষের পছন্দের মধ্যে বিশাল তফাৎ আছে। এরা পছন্দ করে রক্ত পান করার জন্য। আর মানুষ পছন্দ করে মনের আয়েশ মেটানোর জন্য। ভ্যাম্পায়াররা প্রথমে মানুষ বাছাই করে। মানুষদের দিকে ভালোমতো তাকায়। তারপর যাকে পছন্দ হয়ে থাকে তাকে বিশেষ করে টার্গেট করে। কিছু দিন মেলামেশা করে, তারপর সুযোগ বুঝে অ্যাটাক!"
অনন্যা বিস্মিত হয়ে বললো,
"তার মানে তোকেও একদিন...!"
নোহারা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, চোখে একরকম আত্মতৃপ্তির ঝিলিক।
"হ্যাঁ! তাই তো ভাবছি। তাই শায়েস্তা করা দরকার ছিল। আর সেটা আমি কাল আমার এই দু'হাত দিয়েই করে এসেছি। বাসায় ফিরে কী যে শান্তি লাগছিল, বলে বোঝাতে পারবো না!"
অনন্যার গলা কেঁপে উঠল, অজানা আশঙ্কায় শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো। সে নোহারার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
"সাবধানে থাকিস! আমার কী যে ভয় করছে, বলে বোঝাতে পারবো না।"
আরণ্যক অনন্যার পাশের সিটে জায়গা পেয়ে নিজের ব্যাগটা বেঞ্চে রেখে বসলো। অনন্যার শেষ কথা কানে আসতেই সে জিজ্ঞেস করলো,
"কেনো ভয় করছে?"
অনন্যা চমকে পাশ ফিরে তাকালো। নোহারা তার পাশে বসে ভ্রু কুঁচকেছে। আরণ্যক আবারও বললো,
"আমাকে বলতে পারো। যদি কিছু সাহায্য করতে পারি, আর কী..."
নোহারা কিছু বলার আগেই অনন্যা তার পায়ে আঘাত করে চুপ থাকতে বললো। নোহারা চুপ হয়ে গেল।
অনন্যা তখন উত্তর দিলো,
"না, তেমন কিছু না। আর এতো জায়গা থাকতে এখানেই কেনো বসতে হলো?"
"আমার ইচ্ছে!"
"ওহ, হুম!"
অনন্যা সোজা হয়ে বসলো, আর কিছু বলে অতিরিক্ত কথা বাড়াতে চাইলো না সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কৌশিক স্যার এসেছে। সবাই খুশি হয়ে উঠে তাকে দেখে, আর বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চললো তাকে নিয়েই। সবাই জানালো, তারা কৌশিক স্যারের খুব অভাব অনুভব করেছে। কৌশিক বললো, গুরুতর অসুস্থ ছিল বলেই আসা হয়নি, আর এখন শারীরিকভাবে ঠিক আছেন।
সে হাত নাড়িয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে চোখ চলে গেলো অনন্যার দিকে। অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে স্যারের কথাই শুনছিলো। কিন্তু বিভ্রান্ত করলো পাশে বসে থাকা আরণ্যক! আরণ্যক নিজের সব ধ্যান অনন্যার দিকে দিয়ে রেখেছে। যা দেখে এক মিনিটের জন্য কৌশিকের কথা বন্ধ হয়ে গেলো।
কৌশিক দৃষ্টি ফিরিয়ে পড়ানো শুরু করলো। অনন্যা শুনছিলো আর খাতায় চুপচাপ নোট করছিল। কিছু সময় পর, স্যারের মুখে হঠাৎ নিজের ডাক শুনে ভ্রু কুঁচকালো সে। কৌশিক তাকে দাঁড়াতে বললো।
অনন্যা অবাক হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লো। কৌশিক বললো,
"তোমাকে দেখলাম পাশের জনের সাথে কথা বলছো! ডিস্টার্বেন্স পছন্দ হয় না আমার! জানো না?"
অনন্যা হতবাক হয়ে দ্রুত মুখ খুলে বললো,
"আমি কখন কার সাথে কথা বললাম?"
"এই মাত্র! আমার ডিস্টার্ব হলো।"
কৌশিক কথাটা শেষ করে আরো দুজনকে দাঁড় করিয়ে বললো,
"তোমরা ক্লাসের পরিবেশ নষ্ট করছো। তাই দাঁড়িয়ে থাকো। আর কোনো কথা নয়, এটেনশন প্লিজ!"
অনন্যা তো বুঝতেই পারছে না কেন তাকে দাঁড় করানো হলো, যেদিকে সে কোনো কথাই বলেনি। তার অন্তরে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়লো, কিন্তু মুখে শব্দ উচ্চারণ করার আগেই কৌশিক পড়ানো শুরু করে দিয়েছে।
এদিকে, আরণ্যক আর অনন্যার দিকে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছে না। তার মধ্যে বিরক্তি জমে উঠলো। প্রতিবার কৌশিক স্যারের জন্য অনন্যার সাথে কথায় বাধা পড়ছে। আরণ্যক ভাবতে লাগলো, এই কৌশিক স্যারের এত কিছু অনন্যার সাথেই কেনো করতে হবে? কেন বারবার অনন্যাকে এরকম ট্রিট করতে হবে? কথার মাঝে ডাক দেয়, ক্লাসের মাঝে দাঁড় করিয়ে রাখে, হঠাৎ হঠাৎ বকা দেয়। অথচ অনন্যা তো কিছু বলেনি। সে সোজা দেখেছে অনন্যা কোনো কথা বলেনি, তাও কেন তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো?
অনন্যা রাগী চোখ নিয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে, লোকটার কথাবার্তা কিছু মাথায় ঢুকছে না। তো এই ক্লাসে থেকে লাভ কী? অনন্যা নিজের ব্যাগ গুছিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে বললো,
"কিছু দরকারি কাজ এসে পড়ায় ক্লাসটি করতে পারছি না। স্যরি!"
অনন্যা দরজার দিকে হাঁটা ধরলো। স্যারের কথা কয়েক সেকেন্ড বন্ধ হয়ে গেলেও আবারো সে পড়ানো শুরু করলো। মনে হলো, অনন্যার চলে যাওয়াতে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বিষয়টা আরো বিরক্তিকর লাগলো অনন্যার কাছে। অনন্যা নোহারাকে মেসেজ করে টিউশনিতে চলে গেলো। আরণ্যক ও কথা বলার সুযোগ না পেয়ে আহত হলো। কিন্তু ক্লাস শেষে, নোহারার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো আরণ্যকের।
আরণ্যক, একটু দ্বিধায়, নোহারাকে কয়েকবার রিকোয়েস্ট করলো, অনন্যাকে বোঝাতে, যেন সে একবার সুযোগ দেয়।
নোহারা আরণ্যককে আশ্বস্ত করলো আর দুজনে বসে একটা পরিকল্পনা ও করলো অনন্যাকে মানানোর জন্য।
••••••••••••••
কৌশিক রাতে বাসায় ফিরেছে, রিডোকে বেশ খুশি খুশি লাগছে আজ। সে সুন্দরভাবে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রিডোর এরূপ আচরণে সন্দেহ হলো কৌশিকের। রিডোকে শান্ত করার পর, কৌশিক জানতে চাইলো কেন সে এত খুশি। রিডো বললো, অনন্যা নাকি তার সাথে বসে কথা বলার চেষ্টা করেছে। এই কথা জেনে কৌশিক মুচকি হেসে ফেললো। রিডোর শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করলো।
অনন্যা আগেই খাওয়া দাওয়া শেষ করে বসে আছে। প্রতিদিন স্যার আসলে সবাই মিলে আটটার দিকে খাওয়া হয়। দুই দিন ছিলো না স্যার। অনন্যা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দেরিতে খেয়েছে। রাত জেগে রিডোর সাথে টেলিভিশন ও দেখেছে। বিরক্ত করার কেউ ছিল না এই দুই দিন। আর আজ আটটার জায়গায় সাতটায় রাতের খাবার খেয়ে বসে আছে সে যাতে কৌশিক স্যারকে আর দেখার প্রয়োজন না পড়ে। দুপুরের ব্যবহারের পর রাগ হয়েছিল অনন্যার।
রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে অনন্যা। স্যারের কারণে মাথাটা জ্যাম হয়ে থাকে সবসময়। সন্ধ্যার ঘুম বাদ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু পারে না, স্যারের কথাবার্তা শুধু মাথায় ঘোরে। সকালে যে স্যারের উজ্জ্বল হলুদ পিঠ চোখে পড়েছিল সেখানে আজ কোনো ক্ষত ছিল না। কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে সেখানে গভীর ক্ষত দেখেছে অনন্যা। তাহলে স্যার কি নিজের ক্ষত ও মুছতে পারেন? তো সেদিন কেনো মুছলেন না? কেনো সহ্য করে বসেছিলেন? উল্টো অনন্যাই সেই ক্ষতে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিল। উফফ! কতো প্রশ্ন! অনন্যার মন শুধু এসব প্রশ্নে জর্জরিত হতে থাকে। অনন্যা অনুভব করলো, এসব জিজ্ঞাসার উত্তর কখনোই সে পাবে না যদি কৌশিক স্যার নিজে ব্যক্ত না করেন। যতই চিন্তা ঘুরিয়ে, যতই গভীরে প্রবাহিত হোক না কেন, স্যারের রহস্য যেন শেষ হতেই চায় না। একদিন এই প্রশ্নগুলোই অনন্যাকে পাগল করে ফেলবে।
অনন্যা মুখ ফিরিয়ে লাল গোলাপের দিকে তাকালো। এখনো কি সুন্দর লাগছে গোলাপ তিনটে। আসলেই কি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের থিউরি এই তিনটা গোলাপে? অনন্যা ফোন হাতে নিয়ে গুগলে সার্চ দিতে নিয়েছিল তিন গোলাপের থিউরি! কিন্তু তার আগেই দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেলো। কৌশিক স্যার দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো। অনন্যা ফোন রেখে দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দরজা ভালোমতোই লক করা ছিল, এই লোকটা তাও কীভাবে ভেতরে ঢুকে যায়! অনন্যা সত্যিই বুঝতে পারে না।
কৌশিক রুমে ঢুকতেই গম্ভীর স্বরে বললো,
"ইতিহাসের নোটবুক বের করো।"
অনন্যা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। রুমে ঢুকেই এমন আদেশ? কোনো অভিবাদন নেই, কোনো ভণিতা নেই, সরাসরি নোটবুক বের করতে বলছে!
সে কোনো সাড়া না দেওয়ায় কৌশিক এবার গলার স্বর খানিক উঁচু করলো,
"শুনতে পাচ্ছো না? বললাম, নোটবুক বের করো!"
অনন্যা বিরক্তির সঙ্গে মুখ বাঁকিয়ে ব্যাগ হাতড়ে খাতা বের করলো। কৌশিক নিজের রুম থেকে আরেকটি চেয়ার টেনে এনে পাশে বসলো।
অনন্যা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটা হুট করেই এমন আচরণ করে কেনো?
কৌশিক খাতায় লাইন টেনে একের পর এক ঘটনা বুঝিয়ে যেতে লাগলো। অনন্যার মনে হলো, স্যার শুধু পড়াচ্ছে না, সময়ের পরতে পরতে তাকে অতীতে ডুবিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
অনন্যার মনে হলো, ইতিহাসের পাতাগুলো চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ, বিপ্লব, বিজয় সবকিছু চোখের সামনে ধীরে ধীরে রঙের মিশাইল নিয়ে ফুটে উঠছে। ভেসে উঠছে সিনেমার মতো।
কিন্তু এই সন্ধ্যায় হুট করে স্যারের ইতিহাস পড়ানোর এত আগ্রহ এল কোত্থেকে?
.
.
.
চলবে.......................................................................