মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ২২ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


নোহারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে কোনো জন্তু জানোয়ার নয়, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ভ্যাম্পায়ার, যে দেখতে অবিকল মানুষের মতো, কিন্তু আদতে মানুষ নয়। রূপকথার গল্প যে বাস্তবে এভাবে তার জীবনে এসে হাজির হবে, তা সে কখনো ভাবেনি।

নিজেকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় না দেখে, নোহারা নিঃশ্বাস চেপে নিজের হাত দুটো মুঠ করে নিকের সামনে তুলে ধরল। চোখ বন্ধ করে কাঁপা গলায় বলল,
"স্যরি... আমি জানতাম না এমন কিছু হবে। আপনি চাইলে... আমাকে নিজের শিকার মনে করতে পারেন।"

নিক তার দিকে সরু চোখে তাকাল। নোহারার কাঁধ অবধি ছড়ানো সিল্কি চুল সামান্য বাতাসে নড়ছে। মেয়েটার মসৃণ ত্বক ঘামে ভেজা, কপাল থেকে ছোট ছোট ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। টানা টানা চোখ পিটপিট করছে, যা ভয় আর অপেক্ষায় ভরপুর। মেয়েটার এই সরল ভঙ্গি আর অবর্ণনীয় কিউটনেস নিকের চোখ এড়ালো না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিক মাথা ঘুরিয়ে নোহারার হাত সরিয়ে দিল। ঠোঁটের কোণে একধরনের মৃদু বিদ্রুপ হাসি টেনে বলল,
"উফফ! এতো কিউটভাবে কেউ কথা বললে আমি আর কিছু করতে পারি না। গলে যাই একেবারে।"

নোহারা দ্রুত চোখ খুলল। তার মুখে ফুটে উঠল এক ঝলক খুশি, দমবন্ধ করা ভয়ের অন্ধকার থেকে আলো খুঁজে পেয়েছে মনে হলো। যাক, বড় বাঁচা বেঁচে গেলো। এখনো তো অনেক কিছু দেখার বাকি। জীবনের এত সুন্দর মুহূর্তগুলো এভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে না। আকাশের তারা, দিগন্তে সূর্যাস্ত, মিষ্টি শীতের ভোর, আর নিজের স্বপ্নগুলো সবই তো সামনে পড়ে আছে। একটা ভ্যাম্পায়ারের হাতে জীবনের এই গল্প থামানোর ইচ্ছা নোহারার একদমই নেই।

নিক গম্ভীর মুখে আরো যোগ করলো,
"কিন্তু… আমার রক্ত পিপাসা বেড়েছে। নতুন শিকার কে খুঁজে দেবে? কে? এখানে তুমি ছাড়া তো আর কেউ নেই। সুতরাং, লিটল গার্ল, লেটস গো উইথ মি।"

নোহারা হতভম্ব হয়ে গেল। মুখে অসহায় ভাব এনে বলল,
"আমি… আমি কীভাবে খুঁজব?"

নিক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
"আমি শিখিয়ে দেব। খুব সহজ। তুমি শুধু তরুণী মেয়েদের ডেকে বলবে, আমি কিছু কথা বলতে চাই। তাদের আমার কাছে নিয়ে আসবে। এরপর যা করার আমি করব।"

নোহারার চোখ কুঁচকে গেল। সে নিকের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস করে বলল,
"শুধু মেয়েদেরই কেন? পুরুষদের কী দোষ?"

নিক হঠাৎ থেমে গেল। একদম কাছে এসে নোহারার কপালে টোকা মারল। নোহারার চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল, সে এক কদম পেছনে সরে গেল। নিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
"পুরুষরা আমার কাছে আসতে চাইবে কেন? তাদের দিয়ে কাজ হবে না, মেয়ে লাগবে মেয়ে।"

নোহারা হালকা গলায় বলল,
"বুঝতে পেরেছি।"

নোহারার কাজ শুরু হলো। সে একের পর এক চেষ্টা করল। কিন্তু তরুণী মেয়েরা তার কথায় কানই দিচ্ছে না। কেউ বিরক্ত মুখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, কেউ চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না।

নিক গলির এক প্রান্তে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে অস্বস্তি আর রাগ ফুটে উঠেছে। তার ধৈর্য কমছে, ভ্রু কুঁচকে গেছে। নোহারার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে, কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটাবে।

নোহারার কপালে ঘাম জমে গেল। চুল ভেজা ভেজা হয়ে উঠল। যখনই নিকের দিকে তাকাচ্ছে লোকটা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে আর নোহারা তাতেই অসাড় হয়ে পড়ছে। নোহারা মনে মনে ভাবল, এ লোকটা কীভাবে মেয়েদের ফাঁদে ফেলে? এটা তো কোনো সহজ ব্যাপার নয়। আমি যে এখন কী করব!

নিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নোহারার দিকে এগিয়ে আসলো, ক্ষুব্ধ স্বরে বললো,
"হ্যাঁ, অনেক উপকার হলো আমার। আর করা লাগবে না।"

নোহারা ঠোঁট উল্টে বললো,
"সন্ধ্যা ব্রো! স্যরি।"

নিক থমকে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
"হেই লিটিল গার্ল, ডোন্ট আই লুক স্কেয়ারি? তুমি ভয় পাচ্ছো না কেন?"

নোহারা ঠোঁট চেপে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে কিছুটা মৃদু হাসি মুখে এনে বলল,
"নো, আপনি দেখতে হ্যান্ডসাম। একটুও ভয়ংকর নন। তাছাড়া বয়সই বা কতো হবে আপনার? ২৫/২৬? আমার থেকে বেশি বড় না আপনি। তাই এতক্ষণ ভয় পেলেও এখন ভয় পাওয়ার কারণ দেখছি না।"

নিক দ্রুত এগিয়ে এসে নোহারার সামনে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে সে নোহারাকে তার উপস্থিতির অদৃশ্য শক্তি দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। নিক গুরুতর কণ্ঠে বললো,
"আমার বয়স ৫০ এর কাছাকাছি।"

নোহারা শ্বাস রোধ করে দাঁড়িয়ে গেল, তার হেঁচকি এসে গেল। একের পর এক হেঁচকি দিতে দিতে সে নিকের দিকে চোখ বড় করে তাকালো, যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না। নিকের মুখে কোনো অনুভূতি ছিল না, চোখ দুটোয় কেবল নিষ্ঠুর বাস্তবতা ছিল যা নোহারা একটু আগেও অনুভব করতে পারেনি।

নিক ইশারা করে বললো,
"বাসায় যাও। রাত হচ্ছে।"

নোহারা নিষ্পলক তাকিয়ে রইল নিকের যাওয়ার পানে। ডাকতে ইচ্ছে হলো কিন্তু ডাকলো না। মনে হলো লোকটা কতো কতো প্রশ্ন রেখে গেলো, যেগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে নোহারার হৃদয়।

••••••••••••

"স্যার!"

কৌশিক কম্পিউটারের স্ক্রীনে চোখ রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল। অনন্যা উনার রুমের দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়েছে। বেশিরভাগ সময় স্যারের রুমের দরজা বন্ধই থাকে। কিন্তু আজ সৌভাগ্যক্রমে খোলাই পায় অনন্যা। তাই রুম প্রবেশ করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। যদিও তার গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল স্যারের সাথে।

কৌশিক কোনো উত্তর দিলো না। অনন্যা বাধ্য হয়ে টেবিলে হাত দিয়ে বারি মেরে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবারো বললো,
"স্যার, শুনছেন?"

কৌশিক স্ক্রীনেই চোখ রেখে, নিজের কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে একটু ক্ষীণ হাসি দিয়ে বললো, "আমার কান তোমার মতো নয়, যে একেক সময় একেক জায়গায় রেখে দিই। বলো, শুনছি!"

" রাবার ব্যান্ড আর ক্লিপ গুলো আমার জন্যই রেখেছিলেন তাই না?"

কৌশিক চোখ তুলে অনন্যার দিকে তাকালো। মেয়েটা যে সেগুলো পেয়ে খুশি তা অনন্যার চোখ ই বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, চকচক করছিল চোখ দুটো। কৌশিক আবারো কম্পিউটারে মনোনিবেশ করে উত্তর দিলো,
"না। তোমাকে তো দুই নাম্বার ড্রয়ার খুলতে না বলেছিলাম। কিন্তু জিনিসগুলো যেহেতু পেয়েই গেছো ব্যবহার করতে পারো।"

অনন্যা মন খারাপ করে ফেললো। মুখ গোমড়া করে বললো,
"থাক! আমার জন্য যেহেতু কিনেননি। ঠিক আছে আমি নিয়ে আসছি।"

"দরকার নেই। রেখে দাও। তোমার এমনিতেও লাগবে। আর কী কী লাগবে তামং কে জানিয়ে দিও। ও সব নিয়ে আসবে।"

"হ্যাঁ! সব তামংকেই বলবো। বিয়েটা তামংয়ের সাথে হলেই ভালো ছিল। অন্তত আপনার মতো ঘাড়ত্যাড়ামি তো করতো না। চুপচাপ আমি যা বলতো মেনে নিতো।"
রাগান্বিত স্বরে বললো অনন্যা।

"তামং অলরেডি ম্যারিড। ওকে বিয়ে করতে চাইলে প্রথমে লারার সাথে কথা বলতে হবে।"

অনন্যা রাগে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কৌশিক বুঝতে পেরে বললো,
"যাও লারার সাথে কথা বলো গিয়ে।"

অনন্যা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুতেই মনোযোগ একটানে রাখতে পারছিল না। একটু অবসন্ন মনে পাশ থেকে আরেকটা চেয়ার টেনে কৌশিকের পাশে বসলো। কৌশিক তখন স্টুডেন্টদের পড়াশোনার জন্য ডকুমেন্ট তৈরি করছিল, তার মনোযোগ ছিল সম্পূর্ণ কাজে। অনন্যা একটু বিরতি নিয়ে বড় করে শ্বাস টেনে বলতে শুরু করলো,

"আরণ্যক সম্পর্কে আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।"

কৌশিকের হাত টাইপিং করতে করতে হঠাৎ থেমে গেলো। চোখ ঘুরিয়ে অনন্যার দিকে তাকালো। অনন্যা তার ইচ্ছেটা সোজা বলে ফেললো,

"আমি আরণ্যককে নিয়ে আজ অনেক ভেবেছি। আসলে ওর সাথে সাথে ভুলটা আমারও ছিল। আমি সেদিন একটা মেয়ের সাথে ওকে রেস্টুরেন্টে দেখেছিলাম, তারপর বিষয়টা কনফার্ম করার জন্য ওর সাথে কথা বলা উচিত ছিল, কিন্তু আমি বলিনি। এত পরিমাণ রাগ উঠেছিল যে আরণ্যকের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আজ আরণ্যক দাবি করছে মেয়েটা ওর গার্লফ্রেন্ড না কাজিন ছিল। তখন আমি নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। কিন্তু সমস্যা সেটা না, সমস্যা হচ্ছে আরণ্যক যখন সেসব বলছিল, তখন আমার কষ্ট হচ্ছিল কারণ আমি ওকে ভুল বুঝেছি। এখন জানি না ওর কথাটা কতটা সত্যি, কিন্তু ভুল বোঝা ছাড়াও আরণ্যকের কথায় আমি ফিল পাচ্ছিলাম না। মানে, আগে যেরকম হতো, আরণ্যকের সাথে কথা বলে ভালো লাগতো, রাত হলে ফোনকল করা একটা অন্য ধরনের অনুভূতি হতো। কিন্তু আজ নেই। মনে হচ্ছিল, আরণ্যক না থাকলে আমার জীবন থেমে থাকবে না, বা ও ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না এমন মনে হচ্ছিল না।"

কৌশিকের মুখাবয়বে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো না।
অনন্যা আরো বললো,
"আমি বুঝতে পারছি না কি করা উচিত। আরণ্যকের ছলছল চোখ দেখে মনে হচ্ছিল খুব কষ্ট পাচ্ছে সে। আমি আমাদের বিয়ের কথা বলে দিতে চাই কিন্তু আপনি না করেছেন তাই বলতে পারছি না। আমি আরো ভাবছি বিয়ের দিন যদি আমি আরণ্যককে ফোন করে জানাতাম তাহলে কী বিয়েটা তখন আরণ্যকের সাথে হতো?"

কৌশিক মৃদু হেসে বললো,
"আরণ্যকের জন্য যদি খারাপ লেগে থাকে, তুমি ওর কাছে ফিরে যেতে পারো।"

কথাটা হেসে বললেও কৌশিক শান্ত হতে পারছিলো না।

অনন্যা কৌশিকের কথায় পাত্তা দিলো না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
"স্যার জানেন? 

মানুষ প্রথমে ভালোবাসায় হারায় না। মানুষ হারায় মায়ায়। কথার মায়ায়, শব্দের মায়ায়, চোখের মায়ায়, অন্তরের মায়ায়। ভালোবাসা হয় ধীরে ধীরে, খুব আস্তে। কখনো মনে হয় কিছুই ঘটছে না, কিন্তু একদিন হঠাৎ অনুভব করা যায়, কিছু তো হচ্ছে, কিছু বদলে যাচ্ছে। আমরা বুঝি না কখন ভালোবাসা আসে, কখনো মনে হয় ভালোবাসা কি শুধু এক মুহূর্তের ঘটনা? আসলে ভালোবাসা কখনোই ধরা যায় না। যতই আমরা চাই, যতই তাকে আঁকড়ে ধরতে চাই, সে অদৃশ্য হয়ে যায়, আরো রহস্যময় হয়ে ওঠে।

অনেকে বলে ভালোবাসা বলে কিছু নেই। তারা বলে, এটি শুধু একটা আবেগ, এক ধরনের প্রশংসা যা কিছুদিন পরে ম্লান হয়ে যায়। আমি যদি সত্যি বলি, আমি নিজেও জানি না, ভালোবাসা আছে কিনা। আপনি যখন ভালোবাসায় পড়বেন বুঝবেন না তখন। আপনার মন কোটি কোটি মানুষের মধ্যে শুধু একজনকে খুঁজে পেতে চাইবে, তার মায়াভরা চাহনি দেখার জন্য আপনি পাগল হয়ে উঠবেন। সেদিন হয়তো বুঝবেন এটাই ভালোবাসা। তখনই আপনি বুঝবেন, ভালোবাসা আসলে কি! 

কিন্তু আমি না এখন আর খুঁজি না আরণ্যককে। আগে খুঁজতাম। প্রথম প্রথম! যখন মন নতুন করে প্রেমে পড়েছিল তখন খুঁজতাম কিন্তু এখন আর এমন হয় না কেনো বলুন তো? আমার পক্ষ থেকে কি এটা ভালোবাসা ছিল না? কি ছিল তাহলে?"

কৌশিক নিশ্চুপ হয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে ছিল, মেয়েটার কথায় এক প্রকার হারিয়ে যাচ্ছিলো। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল দুজনের প্রথম দেখা হওয়া! তারপর দ্বিতীয় দেখায় বিয়ে! তৃতীয় দেখায় অনন্যার নদীতে পড়ে যাওয়া। কৌশিকের মনে পড়ে, সেদিন নদীতে অনন্যাকে বাঁচানোর জন্য নিজের শরীরের অনেকটুকু শক্তি ব্যবহার করে ফেলেছিল। এর ফলস্বরূপ তার শরীর পুড়ে গিয়েছিল। নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করা আসলেই সহজ ছিল না। কিন্তু সেদিন নদীতে ঘটে যাওয়া আরেকটা ঘটনা কৌশিককে চিন্তায় ফেলে দেয়, যার কারণে সে অনন্যাকে দূরে সরিয়ে দিতে চায় না। কাছে রাখতে চায়। তার জানতে হবে সেটা কি ছিল! অনন্যা হয়তো কৌশিকের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় খুলে দেওয়ার জন্য এসেছে। আর সেটা কী! এর উত্তর শুধু একজনই দিতে পারবে। কৌশিকের বান্ধবী ভেনোরা!
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp