রাত চারটা বাজতে চলেছে। একসময় যখন শহরের প্রায় সবকিছু ঘুমিয়ে থাকে, তখনও হসপিটালের ভিতরে কিছু মানুষ ক্লান্ত চোখে জেগে থাকে। তাদের চোখ তো চিন্তায় ভরপুর থাকে, ঘুম ভর করবে কী করে? কিছুদূরের রোগীদের এক কক্ষে ঘোলাটে আলো জ্বলছে। এই রাতের বেলায় ও নার্সরা ধীর পায়ে চলাফেরা করছে, টুয়েন্টিফোর আওয়ারস চাকরিতে কোনো অবসর নেই তাদের। ওষুধের গন্ধ হাওয়ায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ইমারজেন্সির দরজাটা মাঝেমাঝে খটখট শব্দ করে খুলে যায়, সেখানে হয়তো কারও অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে প্রবেশ ঘটছে, কিংবা কোনো ক্লান্ত ডাক্তার সামান্য বিরতি নিতে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে।
করিডোরের এক কোণে চেয়ারে বসে থাকা এক বৃদ্ধ ধীরে ধীরে মাথা নুইয়ে ফেলেছেন, ক্লান্ত চোখে ফেলে রাখা রিপোর্টগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। ঘুমঘুম চোখে একটা নার্স পাশ দিয়ে চলে যায়, হাতে ট্রে ভর্তি ইনজেকশন আর কাগজপত্র। দূরে কোথাও মনিটরের একটানা বিপ-বিপ শব্দ শোনা যাচ্ছে, ইসিজির গ্রাফে জীবনের ওঠানামা ধরা পড়ছে।
হাসপাতালের নিস্তব্ধ পরিবেশে আচমকা ভেসে এলো নোহারার ঘুমঘুম কণ্ঠ,
"অনন্যা! আর কতক্ষণ? উমম! বাসায় কখন যাবো?"
নোহারার কণ্ঠে ক্লান্তিভাব ঝরে পড়ছিলো। সে কথাগুলো অস্পষ্টভাবে বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো, কিন্তু নিচের স্থানটা ঠিক স্বস্তিদায়ক লাগছে না। কেমন শক্ত শক্ত লাগছে। সামনের দিকে মাথা বাড়াতেই কিছুতে ঠুকে গেলো! শরীরের ওপর অদৃশ্য এক ভার অনুভব করছে, মনে হচ্ছে কোনো শক্ত পাথর তার পেটের ওপর চেপে বসেছে। পাথরের ভারে শরীর নাড়ানো কঠিন হয়ে পড়েছে। নোহারা সেই মনে হওয়া পাথরের উপর হাত রেখে সরানোর চিন্তা করতে গিয়ে বুঝতে পারলো সেটা পাথর নয়, কারো শক্তপোক্ত হাত যেটা তার পেটের দিকটায় পড়ে আছে।
ভয় জেঁকে ধরলো নোহারার মনের অন্দরে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে সম্মুখে তাকালো নোহারা। সামনে শুধুই কালো ছায়ার মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। রাতের ফিকে আলোয়, ঘুমন্ত চোখে ঝাপসা দেখাচ্ছে চারপাশ। ধোঁয়াটে চোখে তাকিয়ে একটু ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করলো সে।
তারপর মাথা সোজা করে উপরে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো!
"আআআহহহ!" বলে একটা প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠলো নোহারা, আতঙ্কে হাত চালিয়ে দিলো উপরের দিকে, আর পরক্ষণেই জোরে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো! ধপ করে উঠে বসলো আর দাঁড়িয়ে পরে পা উঠিয়ে জোর দিয়ে লাত্থি বসালো সামনে বসে থাকা ব্যক্তির কোমড়ে।
লোকটা প্রথমে কিছু উচ্চারণ করতে পারলো না। সেকেন্ডের মধ্যে তার মুখ ব্যথায় কুঁচকে গেলো, তারপর ধাক্কা সামলেই চেঁচিয়ে উঠলো,
"হোয়াট ইজ ইউর প্রবলেম, ম্যান? সবসময় এতো হাত কেন চলে তোমার?"
নিক ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে নিজের কোমড়ে হাত রাখলো। ধাক্কার তীব্রতায় সিটের কোণায় ঠেস দিয়ে বসল। নোহারা নিজের চুল এলোমেলো করে মাথায় হাত রাখলো,
"আমি তো ভেবেছিলাম অন্য কেউ!"
নিক কটমট করে তাকালো,
"হ্যাঁ, হ্যাঁ! যতসব মিথ্যা কথা! সবসময় আমাকে মারার বাহানা খুঁজতে থাকো!"
নোহারা একটুও প্রতিবাদ করলো না, মাথা নিচু করে নরম স্বরে বললো,
"আপনি তো চলে গিয়েছিলেন না?"
"হ্যাঁ, চলে তো যাচ্ছিলাম। কিন্তু দেখলাম একটা লিটিল গার্ল এখানে এই রাতের বেলা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। তারপর কাত হয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছিলো। তাই বসলাম। আর এখন এর ফলাফল ও জুটে গেলো। অনেক ধন্যবাদ, রাণীসাহেবা। বারবার এভাবে উপহার দিবেন। "
নোহারা চোখ গোল করে তাকালো,
"সন্ধ্যা ব্রো, তার মানে আপনি আমার জন্য এতক্ষণ বসেছিলেন?"
নিক ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো,
"না, আমি তো অ্যানার জন্য...!"
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই নোহারা চোখ কুঁচকে ফেললো।
"অ্যানা? হুম! আপনার নতুন গার্লফ্রেন্ড বুঝি?"
নিক কিছু চিন্তা করে তারপর মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হু! ঠিক ধরেছো। অ্যানা আমার নতুন গার্লফ্রেন্ড!"
নোহারা মৃদু হেসে বলল,
"কনগ্র্যাটস! চালিয়ে যান।"
নোহারা ঠোঁটের কোণে একটা কৃত্রিম হাসি টেনে দ্রুত উল্টো ঘুরে ফোনটা বের করলো। স্ক্রিন অন করে সময় দেখে তার মাথায় হাত। জানালার বাইরে একবার তাকিয়ে নিলো। আকাশের কালচে আভা ফিকে হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।
ফোনের স্ক্রিনে অনন্যার মেসেজের নোটিফিকেশন ঝলসে উঠলো। সেখানে দ্রুত ট্যাপ করতেই বার্তাটা খুলতেই তা চোখের সামনে ভেসে উঠলো,
"চলে গেছিস? তোকে খুঁজে পাচ্ছি না কেন? যাই হোক, বাসায় গেলাম আমি।"
নোহারার বুকের ভেতর ধপ করে কিছু একটা নামলো। ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে ধরে শ্বাস নিলো গভীরভাবে। তারপর ধীর গলায় ফোঁস করে উঠলো,
"এতোক্ষণ ধরে শুধু শুধুই কি বসে ছিলাম! সবে চারটা বাজে। দারোয়ান তো আরো দুই ঘণ্টা পরে গেইট খুলে। এখন কী করবো!"
একটা বিরক্তিকর শব্দ করে মাথার চুল এলোমেলো করলো সে। সামনেই বসে থাকা নিক এতক্ষণ নীরবে তার প্রতিটা প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছিলো। ফ্লোরের দিকে চোখ নামিয়ে ধীর স্বরে বলে উঠলো,
"এনি প্রবলেম?"
নোহারা পা ঠেলতে ঠেলতে নিকের পাশে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। এক হাত লেডিস শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফোনটা গুঁজে রেখে গলায় একরকম বিরক্তি ঝরিয়ে উচ্চারণ করলো,
"হ্যাঁ! অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন বাসায় ফিরে গেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তাই আপসেট!"
নিক ভ্রু কুঁচকে এক দৃষ্টিতে নোহারার দিকে তাকালো। একটু ঝুঁকে এসে সন্দেহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
"হসপিটালে কেনো? কোনো ইঞ্জুরি হয়েছে নাকি?"
নিকের দৃষ্টি ইতিমধ্যেই নোহারাকে ওপর থেকে নিচে স্ক্যান করা শুরু করে দিয়েছে। নোহারা ঢোক গিলে সোজা হয়ে বসলো। গলা খাঁকারি দিয়ে খকখক করে কেশে নিলো, তারপর দ্রুত বললো,
"নাহ! আমি ঠিক আছি। এভাবে তাকানো বন্ধ করুন। আসলে আমি অনন্যার জন্য এসেছিলাম।"
অনন্যা শব্দটা শুনে নিক ভ্রু কুঁচকে ফেললো। দ্রুত প্রশ্ন করে বসলো,
"অনন্যা কে?"
"আমার বান্ধবী। ওর বয়ফ্রেন্ড মানে এক্স অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, সেজন্যই দেখতে এসেছিলাম আমরা।"
"অনন্যা শিকদার?"
নোহারা সচকিত হয়ে তাকালো, তারপর দ্রুত প্রশ্ন করলো,
"জ্বি! ওয়েট! আপনি কী চেনেন ওকে?"
নিক সব বুঝতে পেরে হাসলো। নিজের চোখের পাতাটা নেড়ে মিথ্যা ছুঁড়ে দিলো,
"না!"
"তাহলে ওর নাম কীভাবে বললেন?"
"আমার কান খুব পাতলা। খুব সহজেই সব কথা প্রবেশ যায়। এভাবেই জেনে গেলাম।"
নোহারা সন্দেহভাজন মন নিয়ে বললো,
"কিন্তু ওর নাম কোথায় শুনলেন?"
নিক আবার হেসে উত্তর দিলো,
"নার্সের মুখে।"
নোহারা অবাক হয়ে বললো,
"নার্স কেনো ওর নাম নিবে?
"আই ডোন্ট নো, লিটিল গার্ল।"
নোহারা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। নিক হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো এবং কিছু না বলেই ডান দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো। নোহারা তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো, ভাবতে লাগলো, ভোর হয়ে যাচ্ছে, তাই হয়তো চলে যাচ্ছে উনি।
সে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেললো, চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। অনেকটা সময় চুপটি মেরে বসে রইল নোহারা। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো। চোখের সামনে একটি জুসের ক্যান দেখতে পেলো সে। নোহারা বিস্মিত হয়ে মুখ উপরে তুলতেই নিকের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখতে পেলো। কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে থাকলো তারপর মুচকি হেসে ক্যানটা হাতে নিলো। নিক তার পাশে এসে বসলো।
নোহারা ধীরে ধীরে বললো,
"আপনার চলে যাওয়া উচিত।"
"যাবো তো অবশ্যই।"
"সকাল হয়ে যাবে।"
"সময় আছে এখনো।"
নোহারা তার কথায় অভিভূত হলো। লোকটা কি সত্যিই তার জন্য বসে থাকবে?
সে ধীরে সুস্থে প্রশ্ন করলো,
"কতক্ষণ থাকবেন?"
নোহারা আশা করেছিল, নিক বলবে, "যতক্ষণ তুমি থাকবে।" কিন্তু নিক তার মুখে একদমই সেই উত্তরটি না বলে, তার হাতে থাকা জুসের ক্যান থেকে এক চুমুক খেয়ে তৃপ্তির আওয়াজ করলো। নোহারা পুরোটা সময় লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে।
বেশ অনেকক্ষণ পরে নিক হেসে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললো,
"লিটিল গার্ল, ওই রিসেপশনের মেয়েটা কিউট না? ভাবছি মেয়েটাকে পটিয়ে, তারপর আলাদা কোনো রুমে নিয়ে কাজ সারবো। তারপর বাসায় যাবো।"
নিকের কথায় নোহারা এক ঝটকা খেলো। মেজাজ একদম বিগড়ে গেলো। ক্যানটা হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো, পা দিয়ে মেঝেতে জোরে আওয়াজ করলো। পায়ের কিছু অংশ নিকের পায়ের উপর এসে আঘাত করলো। নিক নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে আবার নোহারার দিকে চোখ তুললো, মুখে কঠোর অভিব্যক্তি নিয়ে বললো,
"সমস্যা কি তোমার? বেশি করলে এক্ষুনি! ঠিক এই জায়গায় তোমাকে আস্ত খেয়ে ফেলবো!"
নোহারা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো। তারপর জুসের ক্যান পাশে রেখে নিকের সাদা-নীল জ্যাকেট টেনে ধরে কাছে টানলো। উচ্চস্বরে বললো,
"খেয়ে ফেলবেন? আমিও দেখি কি করতে পারেন আপনি!"
"নোহারা! জ্যাকেট ছাড়ো।"
"নাহ! আপনি একটা বদ লোক!"
"কি করেছি?"
"প্লেয়ার!"
"তো? তোমার কোনো ক্ষতি করেছি?"
"আমাকে যন্ত্রণা দিয়েছেন!"
"কবে দিলাম?"
"প্রতিদিন দিচ্ছেন।"
"ঠিক আছে। ছেঁড়ে দাও। আর কখনো যন্ত্রণা দিবো না।"
"কেনো দিবেন না? আমি ভিন্ন কেনো?"
"অতিরিক্ত করলে সবার মতোই তোমাকে...!"
"করে দিন।"
নিক তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো, তার চোখে ঝলসে উঠলো একরকম তীক্ষ্ণ আগুন। শক্ত হাতে নোহারার হাত ছাড়িয়ে নিলো। উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ করেই নোহারার হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। নোহারা প্রচন্ড অবাক হলো। মুখে কোনো প্রশ্ন করলো না। শুধু নিশ্চুপ হয়ে পিছু পিছু যেতে লাগলো। নিক একটার পর একটা করিডোর পেরিয়ে একসময় থামলো একটা অন্ধকার রুমের সামনে। দরজাটা ধীরে ধীরে ঠেলে খুলে ফেললো, তারপর কোনো দ্বিধা ছাড়াই ভেতরে ঢুকে গেলো, নোহারাকেও টেনে নিলো সঙ্গে।
রুমের ভেতর একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা। হালকা বাতাসের ঝাপটা জানালার পর্দা নাড়িয়ে দিচ্ছে। নিক দরজা বন্ধ করলো। তারপর এক ঝটকায় নোহারাকে দেয়ালের দিকে ঠেলে ধরলো।
ফিসফিসিয়ে বললো,
"বি প্রিপায়েরড, লিটিল গার্ল!"
নোহারা চোখ বড় বড় করে তাকালো। হালকা ঢোক গিললো সে। নিক ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছে। নোহারার ঘাড়ের কাছে এসে পৌঁছেছে সে। তার নিঃশ্বাস নোহারার ঘাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে। আচমকা নিকের চোখের মণি গাঢ় লাল হয়ে উঠলো, মনে হলো গভীর রক্তের আভা সেখানে জ্বলছে ধুপধাপ করে। নিকের চোয়ালের দু'পাশ থেকে চারটা তীক্ষ্ণ দাঁত বেরিয়ে এলো, ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো। ধারালো ছুরির মতো চকচক করছে দাঁতগুলো। যখনই নোহারার ঘাড়ে দাঁত স্পর্শ করতে যাবে ঠিক তখনই নোহারা তার আত্মস্থিরতা ফিরে পেলো। কোনো কিছু না ভেবে এক ঝটকায় হাঁটু উঁচু করে নিকের দুই পায়ের মধ্যাংশে আঘাত করলো!
নিকের মুখ থেকে একটা শ্বাসরুদ্ধ গোঙানি বেরিয়ে এলো। যন্ত্রণায় সে নিচে বসে পড়লো। নোহারা নিজের মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ব্যাপারটা বুঝতেই নিচুতে বসে নিককে ধরতে চাইলো।
বলে উঠলো,
"স্যরি! স্যরি! সুরসুরি লাগছিল। সামলাতে না পেরে।"
"ধ্যাত! গেট আউট! এই মুখ একদম দেখাবে না আমাকে। তোমার চেহারাও দেখতে চাই না আমি। স্টুপিড!"
নোহারা নিকের বাহু ধরে বললো,
"বেশি জোরে লেগেছে? ডাক্তার দেখাবেন?"
নিক এক ঝটকায় হাত সরাতে গিয়ে তার হাত নোহারার গালে আছড়ে পড়লো। শব্দটা ঘরের নীরবতা ছেদ করে ছড়িয়ে গেলো। তীব্র ঝাঁকুনিতে নোহারা ভারসাম্য হারিয়ে দূরে গিয়ে পড়লো।
নোহারা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো, হাত দিয়ে আলতো করে গালে স্পর্শ করলো। জ্বালাপোড়া করা ব্যথা ছড়িয়ে পড়েছে ত্বকের নিচে। সেখানে মাথা নত করে কতক্ষণ হাত বোলাতে লাগলো।
তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলো নোহারা। কিন্তু নিক দ্রুত এগিয়ে তার কব্জি শক্ত করে চেপে ধরলো। তার হাতের চাপ এতটাই জোরালো ছিল যে পালানোর কোনো পথ পেলো না নোহারা।
নোহারা মৃদু হেসে বললো,
"আমি বড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম। বুঝতে পেরেছি।"
নিক তার কথায় পাত্তা না দিয়ে হাত টান দিয়ে নোহারাকে নিচুতে বসিয়ে দিলো। তারপর ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এলো। নিকের চোখের মণি সাধারণ বর্ণ ধারণ করলো। সে মেয়েটার দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরলো,
"আমাকে পছন্দ করো, লিটিল গার্ল?"
নোহারার বিস্মিত হলো হঠাৎ, মুখ উঁচিয়ে ঠোঁট শক্ত করে চেপে বসে রইলো। একটাও শব্দ করলো না।
নিকের ধৈর্য ভাঙতে লাগলো। নোহারার কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকিয়ে উঠলো,
"এন্সার মি!"
নোহারা তার চোখে চোখ রাখলো।
"হুম!"
"আমার আসল পরিচয় জানো তারপরও কি করে?"
"আপনিই প্রতিদিন দেখা করতে এসে আমার মনে ফিলিংস তৈরি করে দিয়ে গেছেন।"
"এটা আমার কাজ!"
"আমার সাথে প্রতিদিন দেখা করা আপনার কাজ ছিল? যদি শেষে ধোঁকা ই দিতে হতো, প্রথম দিনেই শেষ করে দিতেন। কেনো এতো দিনে টানলেন?"
নিক ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো,
"আমার ইচ্ছে! আমি যখন ইচ্ছে যা মন চায় করতেই পারি।"
"মিথ্যে! মিথ্যে বলবেন না একদম!"
নিক নোহারার হাত ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলো,
"হুম। ঠিক আছে। মানলাম মিথ্যে বলছি। তোমার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগতো আমার। জাস্ট এতো টুকুই। ইয়েস, নাথিং এলস।"
"নিজেকে বোঝাচ্ছেন নাকি আমাকে?"
"কি বলতে চাও?"
"আমি এতো বয়স্ক মানুষকে কখনোই পছন্দ করতে চাইনি। আমার ভাবতেই কেমন লাগছে। ইয়াক! তারপরও করেছি। কিন্তু আপনি সামান্য এক ভ্যাম্পায়ার হয়ে আমাকে পছন্দ করতে পারবেন না?"
"হেই! হেই! কি বললে? আমি সামান্য ভ্যাম্পায়ার?"
নিক তেড়ে আসলো।
"অফকোর্স, সন্ধ্যা ভাইইই! আমার হাতের কাছে আপনি সামান্যই! একটুখানি আপনিই।
নিক রেগে গেলো। কাছে এসে নোহারাকে ধরতে গেলেই নোহারা লোকটার গালে টুপ করে চুমু বসিয়ে দিলো। নিক গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর হঠাৎই বললো,
"এই লিটিল গার্ল! আই ওয়ান্ট মোর।"
নোহারা মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
"একটাই দিয়েছি। এটাই অনেক।"
"না না! আই ওয়ান্ট রিয়েল কিস!"
"আপনি বলেছিলেন...!"
নিক আর অপেক্ষা করলো না। ঘায়েল করে বসলো নোহারার উপর। ঝট করে কাছে এসে নোহারার হালকা সিক্ত ওষ্ঠ চেপে ধরলো।
*********
কৌশিক চেঞ্জিং রুমের বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। তার পরিহিত গাঢ় নীল রঙের ফিটেড শার্ট, শার্টের কাপড় হালকা চকচক করছে। শার্টের কলার একটু উঁচু, হাতা গুটিয়ে রাখা, আর বুকের একপাশে সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারি করা ছোট্ট একজোড়া তীরের নকশা। শার্টের সাথে ম্যাচ করে কৌশিক পরেছে কালো রঙের স্লিম-ফিট প্যান্ট, যা তার উচ্চতাকে আরও শার্প করে তুলেছে। কোমরে চামড়ার ব্রাউন বেল্ট, বেল্টের মাথায় একটা ছোট্ট ধাতব তীরের ডিজাইন। পায়ে হালকা লেদারের ব্রাউন বুট। হাতে একটা স্পোর্টি ঘড়ি, সবসময়ের মতো বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে প্লাটিনামের রিং।
অনন্যা হাত ভাঁজ করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কৌশিক আয়নার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। প্রতিফলনে অনন্যাকে দেখতে পেয়ে ঠোঁটের কোণে অজান্তেই এক টুকরো প্রশস্ত হাসি চলে এলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে হাসিটা চেপে নিলো কৌশিক। ঠোঁট আঁটসাঁট করে নিলো, নিজের দুর্বলতা লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
কঠোর, নির্লিপ্ত কৌশিক যে কখনো অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেয়নি, সে ইদানিং অকারণেই হাসছে! কতো সুন্দরীরা ঘুরে বেড়িয়েছে তার আশেপাশে। কৌশিক এ দীর্ঘ যাত্রায় বহু নারীর সঙ্গে মিশেছে, তাদের রূপ, তাদের আভিজাত্য সবই তার পরিচিত। কিন্তু এই শ্যাম মেয়েটি চমক দেখায়নি কোনো বাহ্যিক চাকচিক্যে। অনন্যা তার সরলতায়, তার শ্যামলতায়, তার নিঃশব্দ অস্তিত্বে কৌশিকের অন্তরকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। কৌশিক দুই হাত দিয়ে নিজের গালে কয়েকবার আলতো চাপড় দিলো। নিজেকে মনে করিয়ে দিলো না সে বদলায়নি, সে এখনো আগের মতোই কঠিন আছে। কিন্তু ভেতরের সেই অদৃশ্য দেয়াল কীভাবে যেন ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু কৌশিক উপলব্ধি করেও করতে পারছে নাকি চাইছে না। কোনটা?
অতি আশ্চর্যের ব্যাপার, অনন্যার আশেপাশে থাকলে সে অন্ধকারে ডুবে যেতে পারে, অথচ সেই অন্ধকার কখনোই ভয়ংকর মনে হয় না। বরং এক আলোকময় প্রশান্তি জড়িয়ে ধরে তাকে। সুন্দর সেই অন্ধকার! অনন্যা তার চারপাশের ঠান্ডা হাওয়ায় একরাশ উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। কৌশিক এখন বুঝতে পারে, উষ্ণতা আসলেই স্বস্তিদায়ক!
আবার কখনো কখনো কৌশিকের মনে হয়, অনন্যা কাছে থাকলে সে একটা স্বপ্নের ভেতর চলে যায়। দুজনের চারপাশে রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়, নরম বাতাসে কল্পনার পাখিরা গান গায়। এক অপরিচিত প্রশান্তি তার রক্তে মিশে মাখামাখি হয়ে যায়। আচ্ছা, এই অনুভূতির নাম কী?
.
.
.
চলবে..........................................................................