মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৪৬ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে চারপাশে একটা নরম, নীলচে আবরণ নেমে এসেছে। আকাশের কোণে মিশে থাকা শেষ বিকেলের সূর্যরশ্মি ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে, জায়গা করে দিচ্ছে রাস্তায় জ্বলে ওঠা হলুদাভ ল্যাম্পপোস্টের আলোকে। হালকা বাতাস বইছে, দিনের ক্লান্তি মুছে দিয়ে রাতের শান্ত পরিবেশকে স্বাগত জানাচ্ছে।

বেশ কিছু সময় পার হয়ে যাওয়ার পর অনন্যা জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, চক্ষু মেলে বাইরে তাকিয়ে আছে। নিচের রাস্তায় দু একটা গাড়ি সরে যাচ্ছে ধীর গতিতে, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানগুলোর আলো দপদপ করছে। এক সময় এই বাড়িতে অনেক মানুষের আনাগোনা ছিল, এখন কেবল নিরবতা ঘিরে থাকে চারপাশ। মামীরা নিচতলার সম্পুর্ণ অংশ জুড়ে থাকে।অনন্যা ছোটবেলা থেকেই এই বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করেছে। এক তলা থেকে চার তলা, চার তলা থেকে এক তলা করতে করতেই শৈশবের সময়টা কেটে গেছে। খেলার জন্য ঈরার কাছে ছুটে যেতো, কখনো আবার ঈরাও চলে আসতো ওর কাছে। ঈরা এই নিয়ে অনেক বকা খেয়েছে মামীর কাছে। মামী সবসময়ই বারণ করতো উপরে না যেতে, কিন্তু ঈরা কখনো সে কথায় কান দিতো না। আজও দুপুরের খাবার নিয়ে ঝামেলা বাধাতে চেয়েছিল মামী। অনন্যা এসে একবেলা খাবে, তাতেই তার শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। আর আজ তো অতিরিক্ত ঝামেলা, অনন্যার সঙ্গে নোহারাও এসেছে!

কিন্তু ঈরা এসে পুরো পরিস্থিতি সামলে নিলো। সে জানিয়ে দিল - ওদের খাবার না দিলে আমিও কিছু খাবো না! এটাই একরোখা মেয়েটার প্রতিজ্ঞা! 

অনন্যা চেয়েছিল নোহারাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাবে, কিন্তু ঈরা তাতে বাধা দিলো। শেষে যা হওয়ার তাই হলো। সকল বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে খেয়ে নিলো।

ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে, কিন্তু অনন্যার খেয়াল নেই সেদিকে। সে একদৃষ্টিতে রাস্তার ধারে তাকিয়ে আছে, সময়ের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে মন। এই রাস্তায় একসময় আরণ্যককে দেখা যেত, ছুটির দিনগুলোতে অযুহাতে হাঁটতে আসতো, কিংবা শুধু নিরবে দাঁড়িয়ে থাকতো। প্রথম প্রেমের দিনগুলো খুব সুন্দর ছিল। হালকা শিহরণ জাগানো সময়, নিষ্পাপ উচ্ছ্বাস, ছোট্ট ছোট্ট মুহূর্তে বুকভরা আনন্দ। কিন্তু সেই দিনগুলো এখন কেবল স্মৃতির পাতায় বন্দী।

আর এখন? এখন সে কৌশিক স্যারের স্ত্রী। কৌশিক স্যারের কেয়ারিং স্বভাবটা ইদানিং খুব ভালো লাগছে। অদ্ভুত এক মানুষ, যার রাগ আগুনের লাভার মতো উষ্ণ হয়ে জ্বলে ছাড়খাড় করে দেয় সব, কিন্তু যত্নগুলো তুলোর মতো অতি নরম। অনন্যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেভাবেই হোক, তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবে। তবে জোর করে নয়। ভালোবাসা হবে স্বতঃস্ফূর্ত, আবেগের মতোই নির্মল। জোর করে সত্যিই ভালোবাসা হয় না, ভালো রাখাও হয় না। একদম অন্তরের গভীরতা থেকে আসে বিষয়টা। 

কৌশিক স্যার অন্যরকম। তার চোখ এড়িয়ে কিছু যায় না। কেমন করে যেন সব অনুভব করে ফেলে, বুঝে ফেলে না বলা কথাগুলোও। এই বিষয়টা অনন্যার খুব ভালো লাগে। কোনো কিছু না বলেও যখন কেউ বুঝে ফেলে, সেটা অন্যরকম প্রশান্তি এনে দেয় মানুষকে।

ঈরা আর নোহারা কথা বলতে বলতে রুমে এসেছে। বিছানায় ফোন বাজতে দেখে তারা এগিয়ে গেলো। নোহারা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অনন্যার ফোন বাজছে। অতঃপর অনন্যার দিকে এগিয়ে গেলো। অনন্যার কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে নোহারা দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,
"শুন না! তোর স্যার ফোন করেছে। আমি ধরবো তোর হয়ে? প্লিজ! আমার না অনেক দিনের ইচ্ছা স্যারের সাথে একটু ইটিশপিটিশ কথা বলা।"

অনন্যা চমকে বাস্তবে ফিরলো। দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে নোহারার দিকে চোখ কুঁচকে তাকালো। অনন্যা র অবস্থা দেখে ঈরা আর নোহারা খিলখিল করে হেসে উঠলো।

ঈরা মুচকি হেসে বললো,
"জামাই ফোন করেছে! আমাদের তো আর এ ঘরে জায়গা নেই।"

নোহারা সঙ্গে সঙ্গে যোগ করলো,
"হ্যাঁ ঈরা! তুমি তো জানো না স্যার কী পরিমাণে হট! উফফফ, দেখলেই ইচ্ছে করে...!"

ঠোঁট কামড়ে ধরলো নোহারা। কথা শেষ করার আগেই অনন্যা নোহারার মুখ চেপে ধরলো। চোখ বড় বড় করে ফিসফিসিয়ে বললো,
"চুপ! একদম চুপ!"

ঈরা বললো,
"জানি, নোহা ভাবী! আমাদের অনন্যার বিয়ের দিন ই তো দেখলাম উনাকে। তাছাড়া ভার্সিটিতে ও দেখা যায় উনাকে।"

অনন্যা কাউকে আর কিছু বলতে না দিয়ে দুইজনকে ঠেলে রুমের বাইরে নিয়ে গেলো। নোহারা আর ঈরা বাইরে গিয়ে জোরে হেসে উঠলো।

অনন্যা দেখলো কল কেটে যাওয়ার সাথে সাথেই আবার ফোন দিয়েছে কৌশিক স্যার। অনন্যা দ্রুত ফোনটা ধরলো। কৌশিক বলে উঠলো,
"কী, ম্যাডাম? তোমার বিয়ে হয়েছে! বাসায় গিয়ে এই কথাটা ভুলতে বসেছিলে ? এতো সময় লাগলো কেনো ফোন ধরতে?"

"খেয়াল করিনি।"

"খেয়াল করনি?"
কৌশিকের কণ্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়ছে।

অনন্যা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চার্জারের তার ঘুরাচ্ছিল, চোখ রাস্তার দিকে। ধরা গলায় বললো,
"হ্যাঁ, খেয়াল করিনি।"

ওপাশ থেকে কৌশিক ঠান্ডা গলায় বললো,
"মানে আমি ফোন না করলে তুমি ভুলেই যেতে?"

অনন্যা নরম স্বরে হাসলো, 
"এতো অভিমান কিসের, স্যার?"

"স্যার? এখনো স্যার বলছো?"

"প্রায় সময়ই তো বলি।"

"আমি তোমার স্যার শুধু ভার্সিটিতে।"

"তাহলে বাসায়?"

"হাসবেন্ড!"

"নাহ! আপনি তো বড় ইঁদুর। হা হা!"

"ইরিটেটিং। কতবার বলতে হবে আমি ইঁদুরের ধার ও ধারি না? যাই হোক, তুমি বাসায় আসবে নাকি আমি আসবো কোনটা?"

অনন্যা মুচকি হেসে বললো,
"কোনোটাই না।"

"হোয়াট!"

"হুম! আজ আমি মামার বাসায় থাকবো। অনেক দিন হয়েছে আসি না। আচ্ছা জানেন, আপনি কতো ফেমাস? আমি আসার কিছু সময় পর পুরো মহল্লা জড়ো হয়ে গেছে আপনার সম্পর্কে জানার জন্য। আমাকে বিয়ে করে আপনি তো ফেমাস হয়ে গেলেন,স্যার।"

"আগে থেকেই ছিলাম।"

"এহ! অনন্যা শিকদারের বর বলে আজ আপনার কথা সবাই শুনতে এলো, বুঝছেন?" 
অনন্যা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো।

ওপাশ থেকে কৌশিক খানিকক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
"কী বললে ওদের?"

"বললাম আপনি আমাদের ভার্সিটির প্রফেসর। সবাই তো শুনেই হাঁ!"
অনন্যার কণ্ঠে দুষ্টুমি ঝরে পড়ছে।

কৌশিক বললো,
"হুম! বাসায় আসো, শিকদার। নাহলে তুলে নিয়ে আসবো।"

"কাল সকালেই এসে পড়বো। আজকের দিনটা ওদের সাথে কাটাতে চাই।"

"এটা একদম ঠিক হচ্ছে না, শিকদার। আমি কিন্তু চলে আসবো।" 
কৌশিকের ধীর কণ্ঠে অবাধ্য দাবি ঝরে পড়লো।

অনন্যা চোখ উল্টে বললো, 
"পাগল হলেন নাকি? ভার্সিটির প্রফেসর আপনি! পড়াশোনা করে সময় কাটান, অথবা ভালো কোনো বই পড়ুন। আমার কথা মনে পড়বে না।"

ওপাশ থেকে কৌশিক হালকা হাসলো, তারপর গভীর স্বরে বললো,
"আই হ্যাভ ডান এনাফ স্টাডি! নাউ আই ওয়ান্ট টু স্টাডি ইউ। মে আই?"

অনন্যার শ্বাস এক লহমায় আটকে গেলো। মনে হতে লাগলো ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটার কণ্ঠ সরাসরি তার কাছে এসে কানে ফিসফিস করে বলছে। কৌশিক স্যার জানে কীভাবে অনন্যার মনের বাঁধন ছিন্ন করতে হয়।

অনন্যা চুপ। ঠোঁট একবার কামড়ে ধরলো, চোখের পাতা একটু কাঁপলো তার, তারপর ও গলা স্বাভাবিক রেখে বললো,
"স্যার, আপনি খুব ডেঞ্জারাস!"

"উঁহু, ডেঞ্জারাস না প্রিন্সেস। অ্যাবসোলিউটলি লিথাল!" কৌশিকের নেশাময় কণ্ঠে দাবানল জ্বলে উঠেছে, ধীরে ধীরে পুড়িয়ে দিচ্ছে অনন্যার হৃদয়, কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে ধকধক করে।

অনন্যা জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখলো। ফোনটা কানে ধরে রাখলেও মনে হচ্ছিল, কৌশিক স্যার একদম পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, তার দিকেই তাকিয়ে আছে সেই নীল জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে।

"কাল দেখা হবে।"
অনন্যা আস্তে করে বললো।

"কাল কেন? আজই নিয়ে যাবো তোকে!"

"স্যার, প্লিজ না।"

কৌশিক কল কেটে দিলো।

অনন্যা ফোনের স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, তারপর বিরক্ত মুখে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, 
"উফ! এই লোকটা এরকম আচরণ কেন করছে হঠাৎ??"

*******

রাতে মামা বাসায় এসেছে। অনন্যা কথা বলতে গিয়েছিল, কিন্তু মামা একটা টু শব্দটিও উচ্চারণ করলেন না।‌ নিশ্চুপ থেকে বুঝিয়ে দিলেন, অনন্যার সাথে তার সব সম্পর্ক শেষ।

অনন্যার খুব মন খারাপ হলো। কিন্তু একদিক থেকে ভাবলে, মামারও দোষ নেই। এই এলাকায় তার একটা নাম আছে, সবাই তাকে ভালোভাবেই চেনে। কিন্তু অনন্যার জন্য সেই নামটায় কলঙ্ক লেগে গেছে। তিনি ছোট হয়ে গেছেন অনেকের কাছে। অনেকেই নিশ্চয়ই রাস্তায় ডাক দিয়ে বলে, তোমার ভাগ্নিকে ঠিকমতো পালতে পারো নি। ঠিক ই তো মামা হয়েছো, বাবার স্থান তো নিতে পারবে না।

হয়তো এজন্যই তিনি অখুশি।

রাতের খাওয়া দাওয়া বেশ নিশ্চুপ হয়ে সারলো সবাই। নোহারা আর অনন্যা মিলে কাজের মেয়েটাকে গোছগাছ করতে সাহায্য করলো। পরে ঈরাও এসে যোগ দিলো।

অনন্যার মামী রান্নাঘরে তিনজনকে একসাথে দেখে মেজাজ গরম করে তাকালো। কঠোর গলায় বললো,
"ছিঃ! কি নির্লজ্জ মেয়ে! ঘরে স্বামী আছে তা নাহয় বুঝলাম তাই বলে এসব করে বেরাবে?"

নোহারা বাসন রেখে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
"অনন্যা আবার কি করলো, মামী?"

"কেন ছেমড়ি! দেখিস না... গলায় লাল লাল দাগ! প্রেম করে আরেকজনের সাথে, বিয়ে হয় আরেকজন এর সাথে। আর বিয়ে হতে না হতেই এসব কান্ড কারখানা দেখতে হচ্ছে। আজকালকার পোলা পাইনরা এতো চালাক। আমার ভাবতেও গা ঘিন ঘিন করতেছে। ধরছিস ও বড়লোক এর পোলারে। এখন পিছনে ঘুরা! এটাই তো পারবি। জীবনে তোর দ্বারা আর কি হইবো?"

অনন্যা চুপচাপ মাথা নিচু করে বাসন ধুয়ে যাচ্ছে। মামীর বলার দরকার বলে যাচ্ছে, অনন্যার দরকার কান থেকে বের করে দেওয়া সে ও তাই করছে। নোহারার খুব রাগ হলো। সে অনন্যার দিকে চাইলো একবার, তারপর হাত ধুয়ে মামীর সামনে এসে দাঁড়ালো। হাত ভাঁজ করে বললো,
"কেনো মামী? তোমার স্বামী কী তোমাকে আদর করে না? অন্যেরটা দেখে এতো জ্বলে কেন হু? আর তুমিও তো বড়লোকের পোলাকে বিয়ে করছো যার এতো বড় বাড়ি আছে, মাসে মাসে ভাড়ার টাকা খাচ্ছো। এটা কী কম?"

অনন্যা ঝটপট ঘুরে দাঁড়িয়ে তীব্র গলায় বললো, "নোহারা! এগুলো কেমন কথা? চুপ থাক!"

অনন্যার মামী রাগে গজগজ করতে লাগলেন। হাত তুলে থাপ্পড় দিতে যাবেন তখন ই ঈরা সামনে এসে দাঁড়ালো। মারটা ঈরাই খেলো। মামী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলেন।
অনন্যা এবং নোহারা এরপর দ্রুত ব্যস্ত হয়ে পড়লো ঈরার দিকে।

ঈরা কিছুটা হেসে হেসে বললো, "আমার কিছু হয়নি। তোরা চিন্তা করিস না।"

রাতের অন্ধকারে, অনন্যা, নোহারা এবং ঈরা একসাথে বিছানায় শুয়ে আছে। রুমের ভেতরটায় অনেকক্ষণ যাবত তীব্র গল্পের শব্দ আর হাসির খিলখিল শব্দই শুধু ভেসে আসছিলো। ঈরা একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। নোহারা অনন্যার এক বাহু ধরে রেখে কাত হয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে। দুজনের চোখ থেকেই আজ ঘুম পালিয়েছে। 

অনন্যা ভয়ে আছে কৌশিক স্যারকে নিয়ে। রাত হয়ে গেছে নিশ্চয়ই সে আসবে না। না আসাই ভালো নাহলে একটা সিন ক্রিয়েট হবে। ভাবছে অনন্যা।

নোহারা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অনন্যাকে। অনন্যা মেয়েটার অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো।

নোহারা প্রায়ই এ বাড়ি এসে থাকতো, দুজনে মিলে পড়াশোনা করতো, ঘুমাতো। ঈরার সাথেও তার বেশ ভালো বন্ধুত্ব। অনন্যা অনেকবার বলেছে, এই বাড়িতে সারাজীবনের জন্য তার সাথে থাকতে। কিন্তু নোহারা কখনো সায় দেয়নি। কারণ মানুষ যা চায়, তাই পায় না।

নোহারার ফ্যামিলি কিছু দূরের এক এলাকার অট্টালিকায় ভাড়া থাকতো। কিছু কারণে তার বাবার অনেক ঋণ জমে যায়, যার ফলে তিনি বাড়ি ছেড়ে গ্রামে চলে যান। গ্রামে তাদের জমিজমা ছিল, যার অর্ধেক বিক্রি করে ঋণ শোধ করেন এবং বাকি অর্ধেকে শাকসবজি চাষ শুরু করেন। গ্রামে ফিরে তিনি নিজের সুখ খুঁজে পান, তাই ঋণ শোধ হওয়ার পরেও শহরে ফিরতে পারেননি। গ্রামের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তার মনকে আঁকড়ে রেখেছিল, আর সে স্থান ছেড়ে তিনি এখনো আসতে পারেন না।

নোহারাও গ্রামে ছিল এক বছরের মত, কিন্তু এক সময় সে জেদ ধরে আর থাকতে চায় না। তাই অনেক চিন্তাভাবনার পর মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য নোহারাকে তার পরিবার এখানে রেখে যান। প্রথম কয়েক মাস অনন্যার সাথেই ছিল সে। কলেজে উঠলে নোহারার বাবা ওর জন্য ভাড়া ফ্ল্যাটের এক বিছানা আর টেবিল সীমাবদ্ধ করে দেন। এরপর থেকেই নোহারা ফ্ল্যাটে কয়েক জন মেয়ের সাথে শেয়ারে বসবাস করে আসছে।

নোহারা হঠাৎ এক নিঃশ্বাসে বললো,
"অনন্যা! তোর আর আমার কারোরই মা বাপ সাথে নেই।"

অনন্যা মৃদু হাসলো। বললো,
"তোর মা বাবা তো কাছে আছেই। তুই গ্রামে রেখে এসেছিস।"

নোহারা একটু থেমে বললো,
"পরিস্থিতি কিছুটা এক। দেখ তোর মা বাবাও তো তোর কাছে আসে না, আমারও আসে না। আমাকে গ্রামে যেতে হয় তাদের সাথে দেখা করতে। আর তোরটা তো বিদেশ, তুই চাইলেও পারিস না।"

অনন্যা মাথা নাড়লো। নোহারা অনন্যার বাহু চেপে কাঁধে থুতনি রেখে বললো,
"তুই মিস করিস না?"

"করি!"

"ফোন করিস না?"

"তারাই করে মাঝেমধ্যে।"

"এই ! এই! বিয়ের কথা জানে?"

"শেষ যেদিন কথা হয়েছিল তখন আমার বিয়ে হয়নি।"

"কি বলিস? এতো দিন হয়ে গেলো? ফোন দেয় নি?"

"না!"

"তুই কেন করিস না? "

"আমি না অনেক ক্লান্ত। বুঝলি! এসব সম্পর্ক সম্পর্ক খেলা আর ভালো লাগছে না। মনে হয় তারা আমার আর কেউ না। তাই আর করি না।"

"কিরে তুই? কোনো ঝামেলায় পড়েনি তো?"

"জানি না। পড়লেও আমাকে তো আর জানায়নি। জানিস, প্রথম বার যখন ওরা বিদেশ চলে গেলো। আমি ফোন ধরে অনেক কান্না করে ছিলাম। কেমন ছন্নছাড়া লাগছিল নিজেকে। বাবা মা সান্ত্বনা দিয়েছিল, বেক্কলের মতো কাঁদিস না। স্ট্রং মেয়েরা এমনভাবে কাঁদে না। বলেছিল, আমাকেও নিয়ে যাবে। নিয়ে যাওয়াটা জরুরি ছিল না, আমার কাছে। আমার কাছে জরুরি ছিল, একসাথে থাকা যেভাবে একটা ফ্যামিলি থাকে। কিন্তু বছরের পর বছর কেটে যায়। তারা সেই কথা তোলেই না। মনে হয়, আমি তাদের জীবনে একটা এক্সট্রা মানুষ। যার দরকার তাদের নেই।"

অনন্যা বলতে বলতে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
"আমি সত্যিই অনেক মিস করি, নোহারা। আমি খুব মিস করি। কল দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, ফিরে আসো, আমাকে একটু আদর ভালোবাসা দাও। বলতে পারি না, দোস্ত। আমি তো ওদের তথাকথিত স্ট্রং মেয়ে তাই না? কেন বলবো? বললে তো আমি বেকুব! আচ্ছা, তুই বল নিজের মা বাবা, ভাইয়ের কাছে স্ট্রং মেয়ে হওয়া জরুরি? ফ্যামিলি তো এমন একটা সংজ্ঞা যেখানে মন খুলে দেওয়া যায় যেখানে সবাই জানবে তাদের মেয়ের মন খারাপ, থাকতে পারছে না মেয়েটা। বলার দরকার হয় না তো! তাহলে তারা কেন বোঝে না? কেন বোঝে না আমি তাদের ছাড়া কষ্টে আছি?"

নোহারা অনন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো, চুলগুলো ঠিক করে দিতে লাগলো। নরম গলায় বললো,
"মন খুলে কান্না কর। থামিস না।"

অনন্যা মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগলো। সবাই সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলে, কাঁদতে না। কাঁদলে নাকি দুর্বলতা প্রকাশ পায়।

নোহারা তার ব্যথা অনুভব করছিল। তাকে কাঁদতে না করেনি। উল্টো থামতে না বলেছে। 

অনন্যা খুব কষ্টে কান্না থামালো। গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। নোহারা ঠিক তখনই বলে উঠলো,
"তোকে কিছু বলার আছে , মানে ওই ভ্যাম্পায়ারটাকে নিয়ে।"

অনন্যা নাক মুছে ধীর গলায় বললো, 
"হ্যাঁ বল।"

নোহারা একটু মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,
 "ওই লোকটা একটা আস্ত খচ্চর।"

অনন্যা ভ্রু কুঁচকালো,
"হ্যাঁ?"

নোহারা গভীর শ্বাস নিলো, এক সেকেন্ড চুপ থেকে মৃদু গলায় বললো, 
"আমি উনাকে পছন্দ করে ফেলেছি।"

অনন্যা চমকে পাশ ফিরলো,
 "হঠাৎ হঠাৎ কি বলছিস! মাথায় কিছুই ঢুকছে না আমার!"

নোহারা ধীরে ধীরে সব ঘটনা খুলে বললো। অনন্যা বিস্ময়ে হতবাক! চোখ বড় বড় করে ফিসফিসিয়ে বললো,

"শেষের দিন তোকে ডিপলি কিস করেছে?"

নোহারা মুখ শক্ত করে মাথা ঝাঁকালো। 
"জ্বি! কিন্তু কিস করেই দৌড়। এরপর আর খুঁজে পাইনি। আর আসেও না! আমার খুব খারাপ লাগে। দেখ তুই, এদিকে ওই লোকটারই দোষ। লোকটা প্রথমে কাছে এসেছে বলেই তো আমি পছন্দ করেছি! নাহলে আমি কি পছন্দ করতাম?"

অনন্যা অনেকক্ষণ নিশ্চুপ ছিল। হঠাৎ বললো,
"আচ্ছা নাম কী?"

"নিকোলাই ভেস্পার! আস্ত ভাল্লুক একটা!"

অনন্যা চোখ বড় বড় করে পাশ ফিরে তাকালো।
"কি বললি?"

"আস্ত ভাল্লুক!"

"আরে না না নামটা!

"নিকোলাই...ভেস্পার!"

অনন্যা মাথায় হাত চেপে ধরলো। ঠিক তখনই বাড়ির ভেতর থেকে একজনের জোর গলার আওয়াজ কানে ভেসে এলো। নোহারা আর অনন্যা ভ্রু কুঁচকে একে অপরের দিকে তাকালো।

ডাকটা এবার আরও জোরালো হলো,
"অনন্যা! কোথায় আছো? বাইরে আসো।"
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp