“আমি তোমাকে কখনো বলেছি তুমি নীল রঙ পড়বে না”
“মানে কি?”
“মানে হলো নীল পড়লে তোমাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। আমি চোখ ফেরাতে পারি না। নীল রঙ তুমি শুধু আমার সামনেই পড়বে এছাড়া নয়”
“আজব, আমি আপনার কথা শুনবো কেন?”
“তাহলে আমি তোমার কথা শুনবো কেন?
জাওয়াদের দৃঢ় কণ্ঠ। তার এমন বেপরোয়া উত্তরে দীপশিখা মুহূর্তের জন্য ভাষাহীন হয়ে গেলো। চোখের ভাষা বদলে গেলো। থমথমে চোখে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে এতোসময়ের বিরক্তিগুলো উবে গিয়ে তীব্র ক্ষোভ দেখতে পেল যেনো জাওয়াদ। এই ক্ষোভের অর্থ সে জানে। সেই ক্ষোভের সাথে মিশে ছিলো অভিমান, বিষাদ আর হৃদয়ের চেপে রাখা ক্ষুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস। ইচ্ছে হলো মেয়েটিকে টেনে জড়িয়ে ধরে রাখতে। বুকের মধ্যিখানে চেপে ধরে বলতে,
“আমার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছো চিংকি? এ কেবল তোমার জন্য। তোমাকে না দেখলে আমার এই স্পন্দন বেসামাল হয়ে যায়। আমি জানি তুমি বুঝতে চাইছো না। আমি জানি তুমি বুঝতে চাইবে না। সেই অধিকার সম্পূর্ণ তোমার আছে। তবে আমাকে অন্তত আমার প্রেমটুকু বুঝাতে দাও”
কিন্তু কথাগুলো বলতে পারলো না জাওয়াদ। তারপূর্বেই দীপশিখা তার শাট ডাউন মুডে চলে গেলো। কথা না বলে নিজের কাজে মনোনিবেশ করা। জাওয়াদকে সে আর পাত্তা দিবে না। তার বলয়ের মাঝে জাওয়াদকে প্রবেশ করতে দিবে না। জাওয়াদ তার জন্য আর পাঁচটা মানুষের মত অপ্রাসঙ্গিক একজন মানুষ। অপ্রাসঙ্গিক মানুষদের জন্য নিজের সময় নষ্ট করার মানে নেই। দীপশিখা তাকে ছেড়ে নীলক্ষেতের বইয়ের গলির ভেতরে ঢুকে গেলো। দীপশিখার পরিচিত কিছু বইয়ের দোকান আছে। নীল পলিথিনের ছাওনি আবৃত দুধারে বইয়ের স্তুপ। মানুষের চলাচলের পথ সরু। তবুও মানুষের কমতি নেই। কে যেন বলেছে এই জেনারেশন বই পড়তে জানে না। ভুল, বইপোকা জেনারেশনকে হয়তো তারা দেখে নি। নীলক্ষেতে বিভিন্ন ধরনের মানুষ আসে। কেউ আসে শৌখিনতায়, কেউ আসে পেসাদারীতায়। দীপশিখা এই দু ধরনের মানুষের মধ্যেই পড়ে। আজ সে শৌখিনতায় আসে নি। সে এসেছে পেসাদারীতায়। নতুন কিছু বই এর রিভিউ করা প্রয়োজন। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ধরনের বইকেই সে তালিকাবদ্ধ করেছে। কিছু থ্রিলার বইও আছে। রোমান্টিক বই এখন বিরক্ত লাগছে। সে একটু নতুনত্ব স্বাদ চায়। পুরানো স্বাদগুলো বিস্বাদ লাগছে। দীপশিখা আর লিস্টগুলো পরিচিত বইবিক্রেতাকে ধরিয়ে বললো,
“এগুলো দিন”
“আচ্ছা আফা”
তার পেছন পেছন জাওয়াদও বইয়ের দোকানে প্রবেশ করেছে। বইয়ের প্রতি জাওয়াদের কখনোই আগ্রহ ছিলো না। এখনো নেই। মানুষ নতুন বই কিনলে তার গন্ধ শুঁকে। কিন্তু এসব কিছুই জাওয়াদের কাছে অহেতুক লাগে। ছোটবেলায় কমিক বই পড়তো। নেশা ছিলো তার। বইয়ের ফাঁকে কমিক বই রেখে পড়াও শুরু করলো সে। কিন্তু বিধিবাম, একদিন আব্বার হাতে ধরা পড়লো। ছাতা দিয়ে যে মারটা খেয়েছিলো এখনো সেই স্মৃতি অম্লান। সেই থেকে গল্পের বইয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলো না জাওয়াদের। গল্পের বই এবং দোকান সম্পর্কেও তাই তার ধারণা ক্ষীন। জাওয়াদ ঠিক দীপশিখার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানে মানুষ গিজগিজ করছে। ছোট একটা দোকান অথচ খদ্দেরের অভাব নেই। জাওয়াদ তার পেছনের সারি করে রাখা বইয় থেকে একটা বই হাতে নিয়ে বললো,
“এই বইটা কি সংক্রান্ত? প্রেম টেম?”
দীপশিখা প্রথমে অন্য দিকে চেয়ে থাকলে জাওয়াদ দোকানীকেই শুধালো,
“এটার কাহিনী কি?”
“এইটা প্রেমের গল্প না ভাইজান। এইটা মার্ডার মিস্ট্রি”
“নাম এমন কেন? হিজ এন্ড হারস”
“দুজনের গল্প তাই”
“কাহিনী কি? এই চিংকি তুমি পড়েছো এটা?”
দীপশিখার একটি বাজে দূর্বলতা আছে। কেউ তার সামনে বই নিয়ে কথা বললে সে এড়াতে পারে না। যতই শত্রুতা থাকুক কেউ বই নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে তার মুখ উশখুশ করে উত্তর দেবার জন্য। এখনও তাই হলো। মুখ ফসকে বলে ফেললো,
“এটা মার্ডার মিস্ট্রি। প্রতি পর্বে এক একটা টুইস্ট। শুনে সেই মজা নেই”
“তুমি পড়েছো?”
“হুম”
“আচ্ছা, তাইলে এইটা নিলাম। আর কিছু ভালো বই বলতো। আমি আবার ইন্টারেস্টিং বই ছাড়া পড়তে ভালো লাগে না। তোমার ইউটিউব চ্যানেল আর পেজ থেকে তো আমাকে ব্যান করে দিয়েছো। নয়তো সেখানেই দেখে নিতাম”
“আমার ইউটিউব চ্যানেল আছে, আপনি জানলেন কি করে?”
“জ্যোতি বলেছে”
দীপশিখা আর কথা বাড়ালো না। সম্পর্কটা আগের মত হলে এখানে আরোও কিছু খোঁচা মেরে মজা নিত হয়তো। কিন্তু এখন ইচ্ছে হচ্ছে। জাওয়াদ একমিনিট শান্ত হলো না। এক এক বই হাতে নেয় আর শুধায়,
“এই বইয়ের কাহিনী কি? ভালো বইটা? তুমি পড়েছো? মার্ডার মিস্ট্রি নাকি এমনেই?”
দীপশিখা বই কেনার সময় বেশি কথা বলতে পছন্দ করে না। একারণে সবসময় বইয়ের দোকানে সে আসে একা। নিরিবিলি এক একটা বই হাতে নিবে, এক-দুই পেজ পড়বে, আগ্রহ হলে কিনে দিবে। এই প্রথম তার মনে হলো একটা জেদী মশা তার কানের কাছে ক্রমাগত ভ্যান ভ্যান করছে। বই কেনার সময় বারবার এমন উপদ্রব তার ভালো লাগছে না। লোকটিকে কড়া করে কিছু বলতে ইচ্ছে হলেও সেটা সম্ভব নয়। মানুষের ভিড়ে অহেতুক একটা সিন ক্রিয়েট হবে। দীপশিখা সেটা চায় না। দীপশিখা তাই ধৈর্য ধরে উত্তর দিচ্ছে। পড়ার মধ্যে কোনো বই হলে বলছে,
“এটা ভালো, পড়ে মজা পেয়েছি”
আর সেটা না হলে বলছে,
“জানা নেই”
একটা সময় দেখা গেলো দীপশিখার বইয়ের থেকে জাওয়াদের বইয়ের সংখ্যা বেশি। দীপশিখা বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“এগুলো আপনি পড়বেন?”
“সন্দেহ আছে?”
“আছে। আপনার মতো মানুষের মধ্যে বইয়ের প্রতি আবেগ হবে এটা কল্পনা করাও ভুল”
“কি বলতে চাইছো? আমি আবেগহীন মানুষ?”
“না আপনি উচ্চতর পর্যায়ের গরু কিসামের মানুষ”
অনেকদিন বাদে দীপশিখার মুখে গালমন্দ শুনছে জাওয়াদ। তার রাগ হওয়ার কথা, তার যে দাম্ভিক সত্তা তাতে তার কথাটায় রাগ করা উচিত। অন্তত একটু চোখ কুঁচকানো তো আবশ্যক। কিন্তু এমন কিছুই হল না। বরং জাওয়াদের ঠোঁট বিস্তৃত হলো। একটা চমৎকার হাসি তার ঠোঁটে হল। ভেতরটা এমন অলীকমায়ায় টুইটুম্বুর হলো। দীপশিখা তার হাসিকে অগ্রাহ্য করলো। সব বই বাদ দিয়ে “গোরা” বইটা রেখে বলল,
“এটা পড়ুন। শেষ হলে অন্য একটা কিনবেন”
জাওয়াদ মাথা নাড়ালো। দীপশিখা পাকা ক্রেতার মতো দামদর করলো। টাকা জাওয়াদ দিতে চেয়েছিলো কিন্তু দীপশিখা অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“আমি আপনার দেওয়া কোনো কিছু নিব না”
কথাটা রুক্ষ্ণভাবে বললো দীপশিখা। জাওয়াদ পকেট থেকে বের করা টাকাটা আবার পকেটেই রেখে দিলো। বের হবার সময় দীপশিখার অমত সত্ত্বেও হাতখানা শক্ত করে ধরলো। খুব সাবধানে সরু গলি থেকে তাকে বের করলো। দীপশিখা হাত ছাড়াতে চাইলে গম্ভীর স্বরে বললো,
“দিনকাল ভালো না চিংকি, জেদ করো না”
দীপশিখা জাওয়াদের সাথে যাবে না এই ব্যাপারটি জাওয়াদের অজানা নয়। ফলে একটি সি.এন.জি ঠিক করে দিলো সে। দীপশিখা তার দিকে কঠিন নজরে তাকালেও সে সহজ গলায় বললো,
“উঠো, আমার সাথে তো যাবে না। এই সন্ধ্যেবেলা আমি তোমাকে একা ছাড়বো না। তুমি সি.এন.জি তে উঠো, আমি পেছনে আছি”
“এগুলো কেন করছেন?”
দীপশিখা থমথমে গলায় শুধালো। তার দৃষ্টি জাওয়াদে আবদ্ধ। দৃষ্টিতে উত্তর শোনার তীব্র আকাঙ্খা। জাওয়াদ মৃদু হাসলো। ধীর স্বরে বললো,
“এই রাতে আমি তোমাকে একা ছাড়বো না”
“কেনো?”
জাওয়াদ কিছুসময় চুপ করে খুব আস্তে বললো,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি চিংকি”
দীপশিখা তীব্র বিদ্রুপ নিয়ে হাসলো, হাসি অক্ষত রেখে বললো,
“এটা আপনার অনুশোচনা”
“না, আমার অনুশোচনা নয়। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি”
দীপশিখার দৃষ্টি বিচলিত হলো। হয়তো শক্ত করে শাসন করে হৃদয়টা আবারো নড়েচড়ে বসলো যেন। চোখের দৃষ্টি নেমে এলো ঘোর আধার। টলমলে করে উঠলো যেন। সে “ভালোবাসি” শব্দটার জন্য কতগুলো বছর অপেক্ষা করেছে। কতগুলো বছর কাঙ্গাল হৃদয় এই এক শব্দের জন্য হাঁসফাঁস করেছে। ভেবেছিলো প্রতীক্ষিত মানুষটির মুখে শব্দটা না জানি কতটা শ্রুতিমধুর লাগবে। হৃদয় মায়ায় ভরে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হল না। বরং চিনচিনে ব্যথায় অস্থির হয়ে গেলো অন্তস্থল। এতোটা বিষাক্তও লাগে বুঝি কোনো শব্দ? দীপশিখা এখনো তাকিয়ে আছে। দুজনের মাঝে কোনো কথা হলো না। শুধু দৃষ্টির বিনিময়। ঘাত-প্রতিঘাত হলো যেন সেই দৃষ্টিতে। একটা সময় দীপশিখার চোখ বেয়ে নেমে গেলো অশ্রুধারা। খুব শান্ত স্বরে বললো,
“মাইকেল ড্রেইটনের এই কবিতাটা পড়েছেন?
"Since there’s no help, come let us kiss and part.
Nay, I have done, you get no more of me;
And I am glad, yea glad with all my heart,
That thus so cleanly I myself can free"
আমাদের অবস্থাটা ঠিক তেমন জাওয়াদ সাহেব। আমাদের মাঝের সমীকরণে এখন শুধু নৈরাশ্য ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। অহেতুক চেষ্টা করা ছেড়ে দিন”
বলেই সি.এন.জিতে উঠে বসলো দীপশিখা। সি.এন.জি চলছে। দীপশিখার চোখ ভিজে যাচ্ছে। শরীরের প্রতিটি অংশ থেকে নিঙড়িয়ে আসছে যেন এই অশ্রু। এতোটা দুঃখ সে আগলে রেখেছিলো। অন্তঃস্থলে আগলে রাখা টুকরো টুকরো আবেগগুলো গলে যাচ্ছে সেই অশ্রুর সাথে। একটা সময় বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলো সে। সি.এন.জিওয়ালা বললো,
“আপনি কি অসুস্থ আফা?”
উত্তর দিলো না দীপশিখা। বাসা অবধি সে কেঁদেছে। মনের যন্ত্রণাগুলো বিষাদসিন্ধুর ঢেউ এ ভাসিয়ে দিয়েছে। সি.এন.জি থেকে নেমে দেখলো ঠিক তার পেছনে জাওয়াদের বাইক। সে সত্যি এসেছে? কি চাইছে সে? চিংকি সব ভুলে তাকে ক্ষমা করে দিবে? এতোই সহজ? আঘাত করে সরি বলে দিলেই সব মাফ? এতোই সহজ ভালোবাসা? ভাঙ্গা কাঁচ যতই লাগানোর চেষ্টা করা হোক চিরের দাগ ঠিক থাকে। চিংকির এই দাগটা গাঢ়। খুব গাঢ়। চিংকিকে একচোখে দেখছে জাওয়াদ। মেয়েটা ভেতরে চলে গেছে। অথচ তার তৃষ্ণা মেটে নি। আরোও দেখতে ইচ্ছে করছে। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। প্রেম জঘন্য জিনিস। সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। প্রেমের মতো ঘুনপোকা জগতে দ্বিতীয়টি নেই। সে শুধু শরীরের খাঁচাটা রাখে, বাকিসব ধ্বংস করে ফেলে।
*****
শুক্রবার বিকেল। ছোট একটি কফি শপে বন্ধুদের সাথে বসে রয়েছে জাওয়াদ এবং পাভেল। আজ তাদের এক কলেজের বন্ধুর বিয়ে ছিলো। বিয়ের পরও আড্ডা শেষ করতে ইচ্ছে হলো না। কলেজের পর এমন একত্রিত হবার সুযোগ হয় না। জাওয়াদের বিয়ে হলে হয়তো তারা আবার একত্রিত হত। জাওয়াদের বিয়ে ভাঙ্গা নিয়েও অনেক কৌতুহল সবার। তাই এই কফিশপে বসা। যদিও গল্পের মাঝে জাওয়াদ খুব অন্যমনস্ক। দশটা প্রশ্নের একটির উত্তরও সে দিচ্ছে না। তার ইচ্ছে ছিলো এখানে আসার। কিন্তু পাভেলের জোরাজুরিতে আসতে হলো। গল্পের মাঝে ফোঁড়ন দিলো সোহেল নামের ছেলেটি। সে কৌতুহলী স্বরে শুধালো,
“এই এটা আমাদের সেন্টিখোর আদিব না?”
সাথে সাথেই সকলের নজর কফিশপের জানালার দিকের টেবিলে গেলো। পাভেল কৌতুক করে বললো,
“আসলেই তো, জাওয়াদের বেস্টু আদিব। ফেয়ারওয়েলের স্মৃতি তাঁজা হয়ে গেলো রে। কি সিনটাই না করেছিলো জাওয়াদের সাথে। যা জাওয়াদ, প্রাক্তন বেস্টুর সাথে অন্তত করমর্দন করে আয়। আফটার অল একমাত্র এই পাবলিকের জন্যই আমরা তোকে মারামারি করতে দেখেছি”
পাভেলের কৌতুক অন্যসময় কাজে দিত। কিন্তু আজ দিলো না। জাওয়াদের চোখ মোটেই আদিবকে দেখছে না। দেখছে আদিবের সম্মুখে নীল শাড়ি পড়া রমনীর দিকে। চিংকি আদিবের সাথে কি করছে?
.
.
.
চলবে......................................................................