কামিনী - পর্ব ১৬ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


          উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ায় সকলের টান টান উত্তেজনা আর বিস্ময় যেন প্রকৃতিতে ঘনঘটা ঝ ড় তুলল। রাজকুমারী লিলির দিকে তাকিয়ে রানি বললেন, 
 "কী রাজকুমারী লিলি, তোমার ভ্রাতার চরণের জুতো নিয়ে আমাকে রাজ্যে ফিরে যেতে হবে বলে গৌরব করেছিলে না? আজ তোমার ভ্রাতাই যে আমার চরণে লুটিয়েছে! তোমার প্রাণ আজ আমার হাতে। আমি চাইলেই আজ তোমার শেষদিন। এবার বলো নারীর গর্ব ক্ষুণ্ণ করতে না পেরে তোমার কেমন লাগছে?"

রাজকুমারী লিলি মাথা নত করে ফেলল। এক পা দু'পা করে এগিয়ে এসে নিজের ভ্রাতার পাশে বসে পড়ল। ঠিক রানির পায়ের কাছটায়। চোখে-মুখে তখনও তার অহংকার চূর্ণ হওয়ার বিধ্বস্ততা লক্ষণীয়। রানি সগৌরবে হেসে উঠলেন। ভরা ময়দানে সেই হাসি প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। 

 ২২.....

গোধূলির আবাহনী গানে ছেয়ে গিয়েছে অম্বরের নরম কোণ কমলা রঙে। পাখিরা উড়ে ঘুরে ফিরে যাচ্ছে নীড়ে। নিজের সুবিশাল বারান্দার আরামকেদারায় বসে ঢুলছে রাজা হ্যাভেন। চোখে তার তন্দ্রাঘোর খানিক। সেই ঘোরে ভেসে ভেসে উঠছে রানি কামিনীর দৃশ্য গুলো। 
 সে যখন রানিকে অন্ধকার জঙ্গলে একা রেখেই এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন জঙ্গল পেরুতেই একটি দস্যুর দল তাকে আক্রমণ করে। একা সেই দলের সাথে অনেকটা যুদ্ধ করে। কিন্তু তার কাছে অস্ত্র বলতে ছিলো কেবল তলো য়ার আর ছুরি একটি। শেষ মুহূর্তে দস্যুর দল তাকে যখন পুরোপুরি ঘিরে ধরল তখনই দেবীর মতন আগমন ঘটে রানি কামিনীর। তার ঘোড়া আগের চেয়েও উজ্জীবিত দেখাচ্ছিল। ভোরোর ম্লান আলো তখন কেবল গগণে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। রানির মুখটি সে আলোয় অসম্ভব মোহনীয় লাগছিলো। এবং রানির আগমন ছিলো দুর্নিবার ভানুর মতন। এবং নিমিষেই তিনি দস্যুর দলকে ঘায়েল করতে সক্ষম হন। 

এই যে বারে বারে, প্রতিবার রাজাকে রানি প্রাণ ভিক্ষে দিচ্ছিলেন, সেখানেই যেন রাজা হ্যাভেনের চরম অপমান হলো। যেই রানির সাথে সে ছলনা করতে চেয়েছিল, সেই রানিই যেন তাকে প্রাণ দিয়ে ছলনার বিদ্রুপ করছে বারে বারে। এবং শেষমেশ! ভরা রাজ্যে তাকে নিজের চরণের কাছে নামাতে বাধ্য করেছেন। রানির রাজনৈতিক এই বুদ্ধিদীপ্ত রণকৌশল এই পৃথিবীর ইতিহাসে অতি আশ্চর্যজনক। কোনো নারী এভাবে পুরুষশাসিত পৃথিবীতে এমন প্রভাব বিস্তার করতে পারছে ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে তার! 
 নিস্তব্ধ কক্ষটিতে সশব্দেই প্রবেশ ঘটল বেশি কিছু মানুষের। এবং সেই প্রবেশটি ছিলো ব্যতিব্যস্ত। 

রাজা হ্যাভেন তখনও আঁখিদুটি বন্ধ করেই রাখলেন। শুনতে পেলেন রাজকুমারী লিলির কণ্ঠস্বর,
 "ভ্রাতাশ্রী, তোমার এই অপমানের জবাব আমার চাই। ঐ রানির এই দুঃসাহসিকতার শাস্তি দিতেই হবে।"

হ্যাভেনের চোখ তখনও বন্ধ। কণ্ঠ গম্ভীর হলো, "ঐ রানি নয়। বলো, রানি কামিনীকাঞ্চন। তিনি শ্রদ্ধা প্রাপ্য।"

 ভ্রাতার এমন অবিবেচক শ্রদ্ধায় লিলির রাগ বিস্ময়ে পরিণত হলো। সে অতি আশ্চার্যিত হয়ে বলল, "শ্রদ্ধা! যে মানুষ ভরা রাজ্যে আমাদের এমন মাথা নত করতে বাধ্য করেছেন তাকে আবার কীসের শ্রদ্ধা করবো?"

"মাথা নত করাতে তিনি বাধ্য করেছিলেন? না-কি তোমার অতি চতুরতা আর অহং বোধ এই কার্মের জন্য দায়ী? অন্যের ঘাড়ে নিজের দোষ চাপিও না।"
 ভ্রাতার এমন কথার বাণে লিলি হলো ক্রোধে উন্মাদ। হুংকার দিয়ে বলল,
"আমি দায়ী? আমি? আমি কীভাবে জানব যে আমার ভ্রাতা পরাজিত হতে জানে! একটি সামান্য নারীর সামনে ভ্রাতা হেরে যাবে!"

হ্যাভেন এই অবজ্ঞার বাক্যটুকু সইতে পারল না। উঠে দাঁড়িয়েই তৎক্ষণাৎ চ ড় বসিয়ে দিলো আদরের কনিষ্ঠা বোনটির গালে। ভয়াবহ ভাবে চেঁচিয়ে বলল, 
"এখুনি আমার কক্ষ থেকে বিদেয় হও। তোমার মতন অমানবিক, অবিবেচক এবং অহংকারী মেয়েকে আমি চোখের সামনে দেখতে চাচ্ছি না। তোমরা হিংসুটে নারী। এজন্য একজন নারী এমন সগর্বে বুক উঁচিয়ে চলছে বলেই তোমাদের হিংসানলে তাকে দগ্ধ করতে চেয়েছিলে। যখন দেখলে পারছ না তখন এসব কটুকথা বলে তার অপমান করতে চাচ্ছো। কিন্তু সদা একটি কথা স্মরণে রাখবে— কাউকে দু'টো নিন্দাসূচক বাক্য কিংবা খারাপ দু'টো কথা বললে সেই ব্যক্তি ছোটো হয়ে যায় না। বরং যে বলে ছোটো সে হয়। রাজকুমারীই হয়েছো যা, আচার-আচরণে আভিজাত্য, রুচিশীলতা আনতে পারোনি। ছোটোলোকদের মতন আচরণ। আচারে রয়েছে দীনতা। রাজার কন্যাকেও মার্জিত আচরণ করতে হয় ভুলে যেও না। আর যে রানি তোমাকে প্রাণ ভিক্ষে দিয়ে গেলো তার সম্বন্ধে একটি কথা বলার আগে ভেবে বলো। যার দয়ায় বেঁচে গেলে তার নামে কীভাবে এমন কথা বলো? লজা করে না?"

জন্মের পর প্রথম এই প্রথম লিলির গায়ে বোধহয় কেউ হাত উঠালো। তাও নিজের ভ্রাতা। লিলির কাছে এই ঘটনাটি পৃথিবীর সবচেয়ে অবিশ্বাস্যকর ঘটনা লাগল। সেই এতটাই ক্রোধে ফেটে পড়ল যে ছুটে বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে বলল, রানির ভিক্ষেয় প্রাণ পেয়েছি বলে বলে এতই অবজ্ঞা না? এই প্রাণ আর আমি রাখবো না। কখনোই না।

 ২৩.....

দীর্ঘদিন পর রাজ্যে ফিরে রানির ব্যস্ততম দিন গিয়েছে। রাজ্যের কোষাগারে দেখা দিয়েছে অর্থসংকট। যামিনীর কর মওকুফ করার এই অর্থ সংকটের উদ্ভব হয়েছে। রানি রাজ্যের এই সংকটকে মিটিয়ে দিতে বেপরোয়ার মতন এধার, ওধার ঘুরেছেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রজা পাঠিয়েছেন। প্রজাদের বলেছেন কর মিটিয়ে দিতে। সারাদিনের এই একাধারে ব্যস্ততার ফলে রানির শরীর প্রায় থিতিয়ে এসেছে। অবসন্নতায় মুড়েছে তার দেহ। 

সারাদিন পর মহলে ফিরেই তিনি আদেশ ছুঁড়লেন দাসীদের। দ্রুত একটি শান্তিময় স্নানের ব্যবস্থা করতে বললেন। 
 

রানি তখন স্নানাগারে ব্যস্ত। সেনাপতি হ্যাব্রোকে আসতে দেখা গেলো ছুটে। তারও যে প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছে তা দেখা যাচ্ছে চোখে-মুখে। সে রানির স্নানাগারের দিকেই যাচ্ছিলো। যামিনী নিজের কক্ষ থেকে এটি বুঝতে পেরেই বেরিয়ে এলো। হ্যাব্রোকে পেছন থেকে ডাকল,
 "কোথায় যাচ্ছো? রানি স্নানাগারে।"

হ্যাব্রো এই ডাক শুনে দাঁড়ালো। তার সুঠাম দেহী অবয়ব শক্ত হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, "আমি সেটা অবগত।"

 "তাহলে একজন রানির স্নানাগারে যাওয়ার কী এমন বিশেষ জরুরী, শুনি?" যামিনীর কণ্ঠ কিছুটা কঠিনই শোনালো। সে যে হ্যাব্রোর এই বিষয়টি ভীষণ অপছন্দ করেছে তা কণ্ঠেই প্রকাশ পায়।

"জরুরীটা আপনার সাথে তো নয়, যার সাথে আছে তাকেই বলব।"

 রেগে গেলো যামিনী। রীতিমতো ভেতর থেকে ছিটকে এলো সেই রাগ, "জরুরীটা রানির অর্ধ-উলঙ্গ দেহ দেখার, তাই না?"

কী ভীষণ নোংরা বাক্যটি! হ্যাব্রোর কানে যেন আগুনের মতন গিয়ে ঢুকল। রক্ত যেন তার টগবগ করে ফুটতে আরম্ভ করল। হ্যাব্রো সেকেন্ড ব্যয় না করেই চেপে ধরল যামিনীর গলাটি। চোখের রগ গুলো অব্দি লোকটার ভেসে উঠেছে। এতটায় জোরে চেপে ধরেছে যে যামিনীর মুখ দিয়ে লালা বেরিয়ে গিয়েছে। 
 কিন্তু হ্যাব্রো চরম সুপুরুষ। তাই শেষ মুহূর্তে নিজের রাগটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ছেড়ে দিলো যামিনীকে। রাগে, ঘৃণায় রীতিমতো তার দাঁতের সাথে দাঁত লেগে এসেছে। 
ওদিকে যামিনীর অবস্থা নাজেহাল। কাশতে কাশতে চোখ-মুখ উল্টে গিয়েছে প্রায়। আর একটু হলেই যেন প্রাণ পাখিটা উড়াল দিতো তার।

 "রানি কামিনীর সাথে আপনি কোনো ভাবেই যান না। তার সখী হবেন তো দূরের কথা। এই রাজমহলে এলেও আপনার মনটা নর্দমার কীটের চেয়েও ছোটো। আপনাকে রানির এত বড়ো মর্যাদা দেওয়া মোটেও উচিত হয়নি। রানির সখী হওয়ার মতন কোনো যোগ্যতা আপনার নেই। যদি থাকতো তাহলে এমন একটি কথা কখনো উচ্চারণ করতে পারতেন না। এই বাক্যটি রানিকে কতটা ছোটো করেছে তা যদি একটিবার বুঝতেন তাহলে আপনারও অন্তর কাঁপতো। আমাকে নাহয় ছোটো করার কথা ভেবেছিলেন। রানিকে ছোটো করতে বুক কাঁপল না আপনার? যে মানুষটা আপনাকে তুলে এনেছিলেন কোথা না কোথা থেকে। এনে নিজের সখী বলে সর্ব জগতে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেই অতীত ভুলে গেলেন? রানিকে আজও চিনলেন না? তার অর্ধ-উলঙ্গ দেহ দেখার জন্য তিনি কখনো আমার মতন নগণ্য মানুষকে স্নানাগারে প্রবেশ করাতেন? সারা দুনিয়ায় রানির প্রেমে মজেনি কে? রাজা থেকে শুরু করে প্রজা, কেউ বাদ নেই। চিত্রশিল্পী থেকে শুরু করে কবি, কে রানিকে পেতে চাননি? অথচ আপনি সামান্য আমাকে ছোটো করতে রানির সাথে জড়ালেন! এমন নোংরা মন আপনার? এমন!"
কথা বলেই থামল হ্যাব্রো।
 লোকটা এই প্রথম বোধহয় যামিনীকে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ভাবে বলল। যামিনী তখনও গলায় হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে নিচে। এমন একটি কথা বলার অপরাধে নিজের জিভই টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।

তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো রানির মৃদু কণ্ঠস্বর, "সেনাপতি হ্যাব্রো!"

রানির নরম কণ্ঠেও দু'জন কেঁপে উঠল। যামিনীর তো চক্ষু চড়কগাছ। সখী কিছু শুনে ফেলল না তো!
 হ্যাব্রো নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করল। ঘাড় ঘুরিয়ে মাথা নত অবস্থায় বলল, "বলুন, রানি।"

 "সখীকে কারাগারে নিক্ষেপ করো। কাল সখীর বিচার বসবে। আজ আমি বড্ড ক্লান্ত।"
রানির বাক্যটি যেন তীরের মতন এসে বিঁধলো যামিনীর কানে। সে ভাষা পেলো না কিছু বলার। নিজের হয়ে বলবার মতন শক্তিও পেলো না সে। হ্যাব্রো তপ্ত শ্বাস ফেলল কেবল। আর কেউ না জানলেও, সে তো জানে, রানি সখীর শাস্তির চেয়ে বড়ো শাস্তি দিবেন নিজেকে। সখী গরম বালুর উপর দাঁড়িয়ে ছিলো বলে নিজে দাঁড়িয়ে ছিলেন সারাবেলা। সখীর শাস্তিতে জ্বর উঠেছিলো বলে বৈদ্য ডেকে চিকিৎসা করিয়ে ছিলেন। অথচ তার জ্বর রয়ে গিয়েছিলো অগোচরেই। অথচ সেই সখী কি-না এমন একটি কথা উচ্চারণ করল! একটা বার বুঝলো না কাকে নিয়ে সে বলছে। 

মহলে ততক্ষণে দাসীদের কানাকানি, ফিসফিসানি শুরু হয়ে গিয়েছে। রানি কক্ষে প্রবেশ করতে করতে তার খাস দাসী ফ্রেয়াকে বললেন,
"আজ আমি অনেক ঘুমাব, ফ্রেয়া। মহলে যেন কোনো শোরগোল না হয়। আমার কক্ষে যেন তোমার প্রবেশ না ঘটে। কারো প্রবেশই যেন না ঘটে।"

ফ্রেয়া মাথা পেতে মেনে নিলো সেটা। দাঁড়িয়ে রইল কক্ষের বাহিরে ঠাঁই। এতক্ষণে সে অব্দি খবরটি পৌঁছেও গিয়েছে। এবং এরপরই তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এ-ক'দিনে তো সে দেখেছে রানি কীভাবে সখীর যত্ন করতো! সেই সখীর এমন কথায় না জানি মানুষটা কতটা ভেঙেছে। কতটা টুকরো হয়েছে তার অন্তরের!

 আজ রানির কক্ষে কোনো আলো নেই। কোনো শব্দ নেই। কেবল আছে আফসোসের শ্বাস। নিজের জীবনে প্রতিবার এত ভয়ঙ্কর আঘাতের পর তিনি কীভাবে বেঁচে আছেন সেই হিসেবের আহাজারি! কেন কেউই শেষবেলা তার হয়ে থাকে না! কেন কেউ বুঝল না রানিরও মন ভেঙে শ'খানেক টুকরো হয়?
হিমালায়ের মতন দুর্বার রানিও কাঁদলেন। খুব করে কাঁদলেন। বুকের জমিনে পুরোনো ক্ষত গুলো তখন জ্বলজ্বল করে জেগে উঠল। কত দুঃখের আষাঢ়ী গল্প মনে পড়ল! 
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp