আদনানের সাথে সেই যে প্রথমবার দেখা করলাম? দেখার মত দেখা ওই একবারই। আমাদের বাসায় যেদিন এলো সেদিন কেবলই দেখা হলো, কথা হলো না। এরপর দেখাটাও দূর থেকে হয়েছে, ও রাস্তায় আমি বারান্দায়। আমার খুব ইচ্ছে করে ওর কাছে, সামনে বসে দুটো কথা বলব। তা আর হয় না। আমি ঘরে বন্দী। আমাদের সম্পর্কটা সেই লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপই রয়ে গেল। জানি না এর নিস্পত্তি কীভাবে হবে!
মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে এসব ভাবছি। ঠিক তখন দরজায় কেউ টোকা দিল। আমি জবাব দিলাম না। হয়তো খেতে ডাকছে। খেতে ইচ্ছা করে না। যে ডাকছে সে আগে কথা বলুক। কে ডাকছে সেটা বোঝার পর কিছু বলার হলে বলব। কারো সাথে কথাও বলতে ইচ্ছে করে না ইদানীং। ঠিক তখনই বাবার গলা পেলাম। আমার নাম ধরে ডাকছেন। লাফিয়ে উঠে দরজা খুললাম। বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়েই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
"তোর উপর রাগ করে আদনানকে আসতে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম তুই যখন চাইছিস ওর সাথেই বিয়ে দিয়ে দিব। জোর করব না আর কিছুতেই।"
আমি জবাব দিলাম না। আমার ভয় করছে। কী হতে চলেছে বুঝতে পারছি না ঠিক। কিন্তু বাবার হাতে মমতা ছিল। মা, দাদাজান আর চাচ্চু পাশেই দাঁড়ানো। বাবা আবার বললেন,
"কিন্তু ভাবতেই পারিনি আদনান এমন খাঁটি সোনা।"
বাবার এই কথায় আমার চোখে জল এসে গেল। বাবা বললেন,
"আদনানের সম্পর্কে খোঁজ-খবর করে আমি রীতি মতো মুগ্ধ। প্রথমদিন তার সততা ভালো লেগেছিল। সেইজন্যই খোঁজ-খবর নিতে লাগলাম। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলাম সে নেগেটিভ সব কথা বললেও পজেটিভ কিছুই বলেনি। আজ-কালকার যুগে এমন ছেলে বিরল। এবার আমি মন খুলে তোদের বিয়ের আয়োজন করব।"
দাদাজান এবার বললেন,
"আদনানের সততাই সেদিন আমাকে মুগ্ধ করেছিল।"
মা বললেন,
"আমার ভয় করে। খোঁজ-খবর তো কমলের ব্যাপারেও নিয়েছিলে! পরে তো আসল রূপ বের হলো। খোঁজ-খবর নিয়েও আজকাল মানুষ বোঝা দায়।"
বাবা মাকে বললেন,
"হ্যাঁ তোমার কথা ঠিক। তবে কমলের ঘটনা থেকেই শিক্ষা নিয়েছি। কমলের যতটা খোঁজ নিয়ে যথেষ্ট মনে করেছিলাম, তা আদৌ যথেষ্ট ছিল না। তাই আদনানের ব্যাপারে খোঁজ নিতে কোনো কিছু বাদ দেইনি। আর এবার রূপকও আমার সাথে ছিল। আজ-কালকার জেনারেশন অনেক এডভান্স। যা যা আমার মাথায় আসেনি তা রূপকের মাথায় এসেছে। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি ওর বড় বোনের সাথে কথা বলে। পরশুদিন ওনাদেরকে দাওয়াত করেছি।"
মা বললেন,
"তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ।"
আমি চাচ্চুর দিকে তাকালাম। সে ভরসার হাসি দিল। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল বাবা কী খোঁজ নিয়েছেন, কোথায় খোঁজ নিয়েছেন। কী জানতে পেরেছেন? কিন্তু সেই সাহস নেই। আমি বাবার কাছে গিয়ে বললাম,
"বাবা তুমি এখন আর আমার উপর রাগ করে নেই তো?"
বাবা আবার আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
"না। আদনান আমার সব রাগ গলিয়ে ফেলেছে।"
"আর কষ্ট নেই তো?"
"না মা।"
কতদিন পর বাবা আমাকে মা ডাকলেন! আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। কেউ কোনো কথা বললাম না আর। বাবার সাথে আমার জীবনের সবচেয়ে মিষ্টি ও আবেগ প্রবণ এক মুহূর্ত!
রাতের বেলা অনেকদিন পর সবার সাথে একসাথে খাবার খেলাম। এরপর ঘরে ঢুকে দেখি আদনান অনেকবার কল করেছেন। ফোনটা ঘরেই রেখে গিয়েছিলাম। আদনানকে কল ব্যাক করে বললাম,
"সরি ঘরে ছিলাম না।"
"সমস্যা নেই। তোমার বাবা ফোন করেছিলেন। খবর দেয়ার জন্য ফোন করছিলাম। খবর পেয়েছ নিশ্চয়ই এতক্ষণে?"
"অনেক খবর পেয়েছি। তুমি কোন খবরের কথা বলছো?"
"পরশু সন্ধ্যায় আপা, মামা সবাইকে দাওয়াত করেছেন আংকেল। আমাকেও ফোন করে বলেছেন।"
"কী জাদু করেছ আমার বাবাকে?"
আদনান হেসে বলল,
"জাদু করব কেন?"
"বাবা তোমার খোঁজ নিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেছেন বলল। বাবার সব রাগ নিমিষেই উধাও! এমনি এমনি তো হয়নি।"
"স্পেসিফিক কারণ আমি জানি না। তবে আংকেল প্রচুর খোঁজ-খবর নিয়েছেন কিছু কিছু টের পেয়েছি। আর আজ আপার সাথে দেখা করেছেন।"
আমি আচমকা দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করলাম,
"কেমন লাগছে আদনান?"
আদনান নিস্পৃহ গলায় বলল,
"টেনশন লাগছে।"
"এখন আবার কীসের টেনশন?"
"এতদিন টেনশন ছিল তোমার বাবা আমাকে পছন্দ করবেন কি না। এখনকার টেনশন হচ্ছে সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে হবে কি না।"
আদনানের এই এক কথাতেই ওর টেনশন আমার ভেতর ট্রান্সফার হয়ে গেল!
.
.
.
চলবে.....................................................................