শাড়ি পরে জড়সড় হয়ে বসে আছি। জীবনে দ্বিতীয়বার শাড়ি পরেছি। আদনান নিশ্চয়ই পছন্দ করবে! যদিও এ ব্যাপারে কখনো কথা হয়নি। এই মুহূর্তে সামনে আদনান, ওর আপা, সেজভাই ও মামা। আপা ও মামা দুজনেই বয়সে প্রায় আমার বাবা মায়ের সমান। ভাইটার বয়স একটু কম তবুও আমার ছোটচাচ্চুর থেকে অনেক বড়। আমার খুব নার্ভাস লাগছে। এইসব অনুভূতি আমার কমলের পরিবারের সামনে বসে হয়নি। যদিও জানি এখানে আপত্তি করার মত কেউ নেই। আপত্তি থাকলেও কেউ তা বলবে না। এই সিদ্ধান্তটা কেবলই আদনানের। ওর পরিবার সম্পর্কে এতটুকু ধারণা এ কদিনে পেয়েছি। ওর আপা তো ভীষণ খুশি। আমি যখন তৈরি হচ্ছিলাম উনি এসে একাই আমার ঘরে ঢুকে গেলেন। ওনার ভাই যতটা ইন্ট্রোভার্ট, উনি ততটাই এক্সট্রোভার্ট। তবে মনটা ভাইয়ের মতই পরিস্কার। আমার হাতটা ধরে বললেন,
"তুমি খুব ভাগ্যবতী বোন। তোমার উসিলায় আট বছর পর ভাইটার দেখা পেলাম। তা না হলে হয়তো ও কখনোই আর বাংলাদেশে আসতো না।"
আমি ইতস্তত করছিলাম। কী বলব বুঝে পাই না। উনি বললেন,
"আদনান খুব অভিমানী জানো? ওকে আমার কাছে রাখার জন্য কি না করেছি! কিন্তু ওর দুলাভাই পছন্দ করতেন না বলে থাকলোই না। কত কেঁদেছি জানো? ও যখন হলো তখন আমি অনেক বড়। মা অসুস্থ থাকতেন, আমিই কোলেপিঠে করে বড় করেছি। ওর জন্য যত পরান পোড়ে নিজের ছেলেমেয়ের জন্যও এতটা পোড়ে না।"
"আমি তো বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে বাংলাদেশে আসবই আপা। তখন আদনানকে নিয়ে আপনার বাড়িতে উঠবো। কেমন?"
আপা হেসে ফেললেন। আমাকে কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
"তুমি অনেক লক্ষী মেয়ে তিন্নি।"
এই একটা চুমুতেই তিনি আমার মন জিতে নিলেন। খুব আপন মনে হলো। তিনি বললেন, আমার ভাইটা অন্যদের মত না। অনুভূতি প্রকাশ করতে জানে না। তোমাকে বুঝে নিতে হবে বোন। তুমি ওর জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হলে সব রাগ অভিমান ভুলে ও বাকি ভাইবোন আত্মীয়স্বজনের সাথে আবার যোগাযোগ করেছে ভেবে দেখো তো। একা প্রেম করলেও একা বিয়ে তো করা যায় না।"
আমি হেসে বললাম,
"আমি হয়তো ওকে অতটা বুঝতে পারি না আপা। কিন্তু বোঝার চেষ্টা করি।"
"একসাথে থাকতে থাকতে দেখবে এমন হবে যে তুমি ওর মুখ দেখেই মনের কথা বুঝে ফেলবে।"
"ইনশাআল্লাহ। আমার জন্য দোয়া করবেন আপা।"
"অনেক অনেক দোয়া করি। আজীবন দুজনে সুখে থাকো।"
আজ যেহেতু বিয়ের কথা ফাইনাল হবে তাই আমার মেজ চাচা-চাচী, বড় খালামনি, মামা-মামী ও কয়েকজন কাজিন এসেছে। দুই পক্ষই পরিচয় পর্ব সারছিলেন। কথায় কথায় দুই ফ্যামিলি বেশ জমে উঠলো। তখন ভেতর থেকে মা এবং মেজ চাচী দ্বিতীয় দফায় নাস্তা নিয়ে এলো। নাস্তার ট্রে টেবিলে রাখার সাথে সাথেই আদনান চমকে তাকালো আমার দিকে। কারণ ওখানে দুধ পাকন পিঠা ছিল। মা সবাইকে পিঠা নিতে বললেন। সাথে এও বললেন যে এটা আমি বানিয়েছি। আমি আদনানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করছি। আদনান সবকিছু রেখে পিঠা খেল, অনেকটুকু খেল। আদনানের চোখ ছলছল করছে। গতকাল সারারাত জেগে এই পিঠা আমি বানিয়েছি, ভেজেছি। সকালবেলা দুধে ভিজিয়ে তবে ঘুমোতে গেছি। আমার কষ্ট সার্থক।
আমাদের বিয়ের খুঁটিনাটি বিষয়ে আলাপ করছিলেন সবাই। তখন আমার মেজ চাচা আদনানকে জিজ্ঞেস করলেন,
"তুমি তিন্নিকে ওদেশে নিয়ে যাবে? নাকি তুমিই দেশে ফিরে আসবে?"
"আংকেল যদি ফিরে আসতে বলেন তবে ফিরে আসব তা না হলে তিন্নিকে নিয়ে যেতে চাই।"
বাবা হেসে বললেন,
"না না বাবা। ওকথা তোমাকে যাচাই করার জন্য বলেছিলাম। এতবছর ধরে কত কষ্ট করে ওখানে সব গুছিয়ে নিয়েছ, ওখানেই থাকো। সুন্দর নিরাপদ একটা জীবন পাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।"
আদনানের মামা বলল,
"তাহলে তিন্নিকে কবে নেয়ার কথা ভাবছিস?"
আদনান বলল,
"তিন্নি যখন চাইবে। ও যদি চায় ক্রেডিট ট্রান্সফার করে নেয়ার ব্যাবস্থা করব। আবার পড়াশোনা শেষ করেও যেতে পারে।"
আমার মামা বললেন,
"তুই কি চাস মা?"
আমি লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বললাম,
"ক্রেডিট ট্রান্সফার করে যেতে চাই।"
সবাই অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই নিলেন। আদনান বলল,
"আমি তাহলে ফিরে গিয়েই কাগজপত্র রেডি করব।"
আমাদের বিয়ে ঠিক হলো পরের শুক্রবার। অর্থাৎ বিয়ের আগে এক সপ্তাহ আর পরে আর এক সপ্তাহ পাব আদনানকে। এরপরই তার ছুটি শেষ হয়ে যাবে। ফিরে যাবে সে!
আদনান বলল,
"আংকেল আমি কি এখন তিন্নির সাথে একটু একা কথা বলতে পারি?"
আদনানের এ কথায় অনেকেই হেসে উঠলো। কেউ জোরে হাসলেন, কেউ মুখ টিপে হাসলেন। বাবা অবশ্য হাসলেন না। তিনি খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন,
"হ্যাঁ অবশ্যই। যাও।"
আমরা ছাদে গেলাম কথা বলতে। আদনান কথা শুরু করল পিঠা দিয়ে। বলল,
"দুধ পাকন পিঠা কীভাবে বানালে? তুমি তো বলেছিলে পারো না।"
"শিখেছি।"
"কবে শিখলে?"
"যেদিন বলেছিলে এটা তোমার পছন্দ সেদিন থেকেই উদ্যোগ নিয়ে শিখেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি আমার হলে খাওয়াব তা না হলে কখনো জানতেই দেব না যে আমি এটা শিখেছি।"
"কঠিন চ্যালেঞ্জ! এত কষ্ট করে এই কঠিন পিঠা বানানো শিখেছিলে যার জন্য তার কাছ থেকে উধাও হয়ে ৬ টা মাস রইলে কী করে ?"
"পাগল হয়ে গিয়েছিলাম প্রায়। কি ভয়াবহ অবস্থা গেছে বোঝাতে পারব না। আচ্ছা তোমার কীভাবে কেটেছে ওই ৬ টা মাস?"
আদনান মৃদু হেসে বলল,
"কেটে গেছে একভাবে।"
আমার খুব কান্না পাচ্ছে। কান্না আটকানোর চেষ্টা করছি। আদনান বুঝে বা না বুঝে যেভাবেই হোক একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটিয়ে আমার চেষ্টাকে সহজ করে দিল। হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কান্না টান্না কোথায় যে উড়ে গেল! আমি মোমের মত গলে যেতে যেতে টের পেলাম, আদনান আপাদমস্তক কাঁপছে। ওর বুকের ভেতর অস্বাভাবিক ঢিপঢিপ শব্দ!
.
.
.
চলবে.......................................................................